অরিত্রী দে

ঊনবিংশ পর্ব

বাস্তুতন্ত্রের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার বাস্তুতন্ত্র

উত্তরাধুনিক বিশ্বে উপযোগবাদ থেকে যে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, সেখানে মানুষ এবং প্রকৃতি মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতি সেখানে অধস্তন হয়েছে, আর মানুষ হয়েছে ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’। সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তক কার্ল মার্ক্স এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে এমন সমাজব্যবস্থা গড়ার কথা বলেছিলেন যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আর মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সুষম বণ্টন ব্যবস্থা স্থাপিত হয়। এদিক থেকে মার্ক্সের নীতি যেমন বিপ্লববাদী, তেমনি পরিবেশবাদীরও নীতি। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে সহনশীল উৎপাদনের কথা বলেছিলেন। কিছু পশ্চিমী সিনেমা, যেমন- ‘বার্ন’ (Burn), ‘ব্যাটেল অফ আলজিরিয়া’ (Battle of Algeria)তে দেখানো হয়েছে কিভাবে উপনিবেশবাদ কাউকে হাতের মুঠোয় আনতে তার পরিবেশ-প্রকৃতি, তথা তার বেঁচে থাকার উৎসকে ধ্বংস করছে। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই পরিবেশের মধ্যে ‘একত্বে’র বোধ বিপন্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্যগত সংকটও প্রকট। প্রকৃতপক্ষে মানুষ আর পরিবেশ-প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়ানোর অবস্থানে কার জয় কার পরাজয়, বলতে পারা মুশকিল। ১৯৩০-৩৫ সালের মধ্যে একজন আমেরিকান মার্ক্সবাদী মারে বুকচিন (Murray Bookchin) এই প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষ মোটেও ভালো নেই। তিন্নি বুঝেছিলেন যে বিশ শতকীয় সামাজিক বিন্যাস তেমন সুখকর নয়, মানুষ যেমন প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে- সেটাও খুব একটা সুখকর ফসল দান করেনা। এখান থেকে মারে বুকচিন ফিরে যাচ্ছেন কৌম জীবনের স্মৃতির কাছে (সামাজিক বিবর্তনের পথ বেয়ে), যেখানে উৎপাদন ও বণ্টন সুষম ছিল। ছিল সৌহার্দ্য ও সহানুভূতি। সেই সমাজে বণ্টনের সুষমতার মতো ব্যাপারের কারণ খুঁজতে গিয়ে অনুধাবন করেন ‘অর্গ্যানিক সোসাইটি’র (Organic Society) দর্শনকে, যেখানে বর্তমান সাম্যের স্বাধীনতা। এই ধরনের সমাজে এমন ভাবনা ক্রিয়াশীল যে সকলে সকলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র অর্থাৎ প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপরে নির্ভরশীল এবং মানুষ সেখানে প্রকৃতিরই অংশ। ফলে প্রকৃতির প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সঙ্গেও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত হয়। 

IMG_20250313_084153.jpg

‘ইগো’ নয়, চাই ‘ইকো’

মারে বুকচিনের ‘ইকোলজি অফ ফ্রিডম’ (Ecology of freedom, ১৯৮২) বইতে দেখানো হয়েছে যে ‘ইকোলজিকাল নীতি’কে মাথায় রেখে সমাজ পুনর্গঠনের মাধ্যমে পরিবেশগত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এক্ষেত্রে তিনি বরঞ্চ কৌম দুই সম্প্রদায়ের উপরে নৃতাত্ত্বিকের গবেষণা কাজের সমর্থনে জানান, তাদের জীবনাচরণে এমন কোনো শব্দই নেই যা আধিপত্যবাদ, শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যকে ‘বিশেষ’ করে চিহ্নিত করে। সেখানে প্রথা আছে, কোনো নতুন শিশু জন্মালে তার মা’ই কেবল গর্ভধারিণী হননা, ওই সমাজের সকল মায়েরাই হয়। মায়েদের মুখের চেবানো খাদ্য ওই শিশুর মুখে দিয়ে দেওয়া হয়- এমন সংস্কারমূলক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে বিশ্বাস লুকিয়ে আছে যে খাদ্যে মেশানো লালারস শিশুর শরীরে মিশে যাওয়ায় সে একসঙ্গে বহু মায়ের ধারণাকে ধারণ করে। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে পারস্পরিকতার সম্পর্ককে স্বীকার করা হয় (involving interaction between two different organisms living in close physical Association)। এই সম্পর্কে উধাও হয় ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের ভাবনা। বলা বাহুল্য তিনি কখনওই এমনটা বোঝাতে চাননি যে আমাদের, এই আধুনিক পৃথিবীর মানুষদের কৌম জীবনযাপনে ফিরে যেতে হবে, তবে ‘অর্গ্যানিক সোসাইটি’গুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। মানুষ যতই আধুনিক হোক না কেন, পরিবেশেরই অন্তর্গত ও বর্ধিত অঙ্গ। পরিবেশ সংকট আমাদের এমন এক অবস্থানে নিয়ে যায়, যেখানে আমরা আমাদেরকে চেনার উপায় খুঁজি না, মানুষ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক খোঁজেনা। নরওয়ের পরিবেশ দার্শনিক আর্নে নেস (১৯১২-২০০৯) তাঁর ‘ডীপ ইকোলজি’র দর্শনে (Deep ecolog, ১৯৭৩) ‘প্রকৃতি এক’ ও ‘প্রকৃতি দুই’ (Nature one and two)-এর কথা বলেছেন। প্রকৃতি, তার উপাদান প্রথমটির অন্তর্ভুক্ত এবং ‘প্রকৃতি এক’কে ব্যবহার করে মানুষ তার চারপাশে যে নতুন পরিবেশ (environment) গড়ে তোলে, তাকেই বলা হচ্ছে ‘প্রকৃতি দুই’ বা ‘সেকেন্ড নেচার’। মারে বুকচিন এই ‘প্রকৃতি এক’ এবং ‘প্রকৃতি দুই’-এর মধ্যে ব্যবধান হ্রাস করার কথা বলেছেন।   

IMG_20250313_084133.jpg

জীবিত কিংবা নির্জীব সমস্ত বিষয়ই ‘ইকোসেন্ট্রিক’ ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু

‘ইকোলজিকাল ফ্রিডম’ (ecological freedom)-এর প্রসঙ্গে মারে বুকচিন নির্দেশ করতে চেয়েছেন প্রকৃতির প্রতি উপাদান যে অবস্থায় সমান গুরুত্বপূর্ণ, সেই অবস্থাকে। সমাজকে প্রকৃতির বর্ধিত ফর্ম হিসেবে ভাবা গেলে প্রকৃতি সম্পর্কে শিক্ষা সমাজ জীবনের শিক্ষার সঙ্গে যূথবদ্ধতা তৈরি করে। ফলে মানুষ যেমন প্রকৃতিকে বুঝবে, তেমনি তার সামাজিক জীবনকেও বুঝবে- এই বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়েই মুছে দেওয়া যায় ‘সোশ্যাল হায়ারার্কি’কে। তিনি সেই ‘কমিউন’ সমাজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন, যেখানে বর্তমান পারস্পরিকতার সম্পর্ক ও তাকে সম্মান করে সমতাবাদী প্র‍্যাকটিস। ‘যুদ্ধ’, ‘পুঁজি’- এই পরিভাষাগুলোর জন্ম যখন থেকে, আধিপত্যবাদ-শোষণ এবং মানুষের প্রান্তিকতার ধারণার জন্ম তখন থেকেই। সম্পর্কে যারা জানেনা তারা যুদ্ধে ও পুঁজিবাদীদের মাধ্যমে দমিত হল। মারে বুকচিন একে সমাজের অধঃপতনের দিক হিসেবে চিহ্নিত করছেন। সেখানে পৃথিবীর আদি প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাকে মাড়িয়ে যাওয়ার রাস্তাতেই আদর্শ সমাজের পতন। উপায়, সমাজের সেই আদিতম অবস্থানে ফিরে যাওয়া, যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্কগত বিন্যাস মূল্য পায়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *