অরিত্রী দে

অষ্টাদশ পর্ব

কার্ল মার্ক্সের পরিবেশ ভাবনা

পরিবেশ ভাবনায় কার্ল মার্ক্স-এর গুরুত্বপূর্ণ কাজ পাওয়া যায় ‘প্যারিস পাণ্ডুলিপি’ (১৮৪৪) আর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে (১৮৪৮)। ‘প্যারিস পান্ডুলিপিতে’ তাঁর বক্তব্য- পরিবর্তন মূলতঃ পরিবর্তনমূলক। এই পরিবর্তন ও সমাজ বিকাশের ধারায় প্রকৃতি থেকে অতিরিক্ত দাবি করতে গিয়েই উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে প্রকৃতি মানবেতিহাসের খাঁজে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। প্রতিটি উৎপাদন মানুষের শরীরকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। ফলে মানবেতিহাসের আবহমান ধারায় প্রকৃতি ও শরীর পরস্পর অবিছিন্ন। এমনকি প্রযুক্তির দ্বারাও প্রকৃতি অনুপ্রবেশ করে মানবেতিহাসে। প্রযুক্তি নিজে উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিণতি, যা প্রকৃতির রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে একটি বিশ্বজনীন চরিত্র দান করলেও তার সংরক্ষণ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করাতে পারে না৷ 

মার্ক্সের মৌলিক প্রস্তাবটি এই যে- ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিবেশের দ্বন্দ্ব অমীমাংসেয়। তাঁর সময়ে অর্থাৎ উনিশ শতকে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উৎক্রমণের প্রক্রিয়াটি গতিশীল ও মানুষের স্মৃতিতে ক্রিয়াশীল ছিল। তাই প্রকৃতি ও সমাজের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিষয়ে মৌলিক সমস্যাগুলি তাঁর কাছেও জীবন্ত ছিল। তিনি পরিবেশের সমস্যাকে শুধু প্রযুক্তির সমস্যা নয়, তাকে ধনতন্ত্রের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি দেখান কীভাবে ধনতন্ত্র মানুষকে ‘বস্তু’ হিসেবে বিবেচনা করে তার শ্রমশক্তির দ্বারা সামাজিকভাবে উৎপাদিত বস্তুকে পণ্য করে তোলে। এমনকি এই পণ্যের উপর জাদুময় ব্যক্তিত্ব আরোপ করে পণ্যমোহ’ও তৈরি করা হয়। ফলে ঘটতে থাকে প্রকৃতি লগ্নতা থেকে বিচ্ছিন্নতা ও প্রকৃতিলগ্ন জীবনচর্যার সার্বজনীন বিস্মৃতি। ধনতন্ত্রে বুর্জোয়া শ্রেণি কখনোই শ্রমশক্তির পুরো মূল্য দেয় না বলেই উদ্বৃত্ত মূল্যে মুনাফা অর্জন করতে পারে। অতি উৎপাদনের সংকট থেকে মুক্তি পায় না ধনতন্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই সমস্যা থেকে অব্যাহতির জন্যই তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, তথা রাষ্ট্রীয় তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ধনতন্ত্র চেষ্টা করছে চাহিদার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে পণ্যমোহ’র তীব্রতাকে ধারাবাহিক ভাবে বিকশিত করে তুলতে। ‘Amazon’, ‘Google’, ‘Apple’-এর বৃহৎ পুঁজির সাথে যুক্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নির্ভর দালাল পুঁজিবাদী গোষ্ঠী (‘Crony capitalist’), যারা একত্রে বিশ্ব-বাণিজ্যে একচেটিয়াকরণকে গতিশীল করেছে। 

বিশ্ববাজরকে কাজে লাগাতে গিয়ে ধনতন্ত্র প্রতিটি দেশের উৎপাদন ও উপভোগের চালচিত্রকে একটি বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছে। নতুন চাহিদা মেটাতে সুদূর দেশ-বিদেশের নানা আবহাওয়ায় উৎপন্ন পণ্য দরকার হয়েছে। ফলে পরিবেশের ধ্বংস সাধনের বিশ্বজনীনতা অনিবার্য হয়েছে। এই ভয়ঙ্কর বিকাশে শ্রম হয়েছে অপাঙক্তেয়, ‘জ্ঞান’ (Knowledge) হয়েছে বাণিজ্যের বিষয় এবং ভোগ্য পণ্যের পাহাড় বর্জ্যকে বাড়িয়ে তুলেছে- যা ক্রমাগত ভেঙে চলেছে প্রকৃতির সমগ্রতাকে, স্বাভাবিকতাকে। প্রকৃতিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির জায়গায় পণ্যকেন্দ্রিক ‘ফেটিস’ (Fetish) সংস্কৃতি প্রশ্রয় পেতে পেতে একবিংশ শতাব্দীতে এই সংস্কৃতির একাধিপত্যে এসে পড়েছি আমরা। ম্যাক ডোনাল্ডস-এর আউটলেটে খাবার খেলে সেখানে বসে ফ্রি ওয়াইফাই’তে কাজ করা যাবে। অর্থাৎ পণ্যের সঙ্গে পরিষেবায় দেওয়া হল ওয়াইফাই এবং ‘রিলাক্সিং’ একটা পরিবেশ যেখানে মন দিয়ে কাজ করা যায়। ঠিক যেমন একটা বড় কফি কাপে খুব ধীরে চুমুক দিতে দিতে অনেকক্ষণ বসে থাকা যায়, ক্রেতা ‘ফ্রি মাইন্ডে’ গল্প জমাতে পারে, ল্যাপটপে কাজ করতে পারে; কেউ তাকে উঠে যেতে বলবে না। পুঁজিবাদী অর্থনীতি বর্তমানে আধিপত্যবাদী শক্তি। আর এই একচেটিয়া পুঁজিবাদের উন্নয়নের মূলে যে অর্থনৈতিক গতিশীলতা, সেটাই পরিণত হয়েছে জলবায়ু সঙ্কটের মূল চালিকাশক্তিতে। বিগত শতকের সাত ও নয়ের দশকের মধ্যে কৃষির কর্পোরে্টাইজেশন এবং নয়ের দশক থেকে জলবায়ু উদ্বাস্তু সমস্যা সচেতনতার প্রধান জায়গা হয়ে ওঠে। 

‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ অনুযায়ী বুর্জোয়া শ্রেণি যে উৎপাদন শক্তি সৃষ্টি করেছে, তা অতীতের সকল যুগের উৎপাদন শক্তির চেয়েও বিশাল, অতিকায়। সামাজিক শ্রমের কোলে যে এতটা উৎপাদন শক্তি সুপ্ত ছিল, পূর্বতন শতকে তা কল্পনাও করা যায়নি। এই উৎপাদন শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের সৃজনশীলতা ও উৎপাদন ক্ষমতা পরিবেশ সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারেনি। সৃজনশীলতাকে নিয়ে ধনতন্ত্র বস্তুত বাণিজ্য করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও তার উপাদানগুলিকে ধনতন্ত্র সর্বদাই মুনাফা অর্জন ও পুঁজি সঞ্চয়ের সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসেবেই দেখেছে। সেজন্য ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ও শক্তিশালী পরিবেশ আন্দোলনের বিকাশ হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ-সঙ্কট ক্রমবর্ধমান। আসলে ধনতন্ত্রের মর্মবস্তুটি এক থেকে যায় বলে পরিবেশের সঙ্গে দ্বন্দ্বটি অমীমাংসেয় থেকে যায়। 

ঊনবিংশ শতকের তিনের দশকে একজন ইংরেজ, স্যার জন বেনেট লয়েস রাসায়নিক সার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। ১৮৪০ সালের মধ্যে জমিতে ফসলের উপর রাসায়নিক সারের প্রভাব পরীক্ষিত হলে সার শিল্পের জন্ম ও সম্প্রসারণ ঘটে। অন্যদিকে এই সময়ে একজন জার্মান রসায়নবিদ ইয়ুস্টস ফন লিবিগ ‘এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি’তে দেখান যে জমির উর্বরতা সহায়ক উপাদানগুলো কিভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সুপার ফসফেট বানানোর কারখানা তৈরি হয়, প্রযুক্তির বিপুল বিস্তার হয়। কিন্তু ১৮৬০ সালের দিকে ফন লিবিগ ধনতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে তার তীব্র ইকোলজিক্যাল সমালোচনা করেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৮৫৬ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে মার্কিন পুঁজিপতিরা গুয়ানো স্যারের জন্য ৯৪ টি দ্বীপ দখল করে। এই ভূমিগত দখল কৃষিগত জনসংখ্যাকে কমায় ও নগরে বাড়তে থাকে শিল্পগত জনসংখ্যা। অপূরণীয় ক্ষতির জন্ম হয়, অপচিত হয় মৃত্তিকার প্রাণ শক্তি। উনিশ শতকে জমির উর্বরতা হ্রাস, শহরে দূষণ বৃদ্ধি ও বনাঞ্চলের ধ্বংস সাধন চিন্তাবিদদের উদ্বেগের বিষয় হয়। মার্ক্সের পরিবেশ ভাবনার কেন্দ্রে ছিল ‘সোশিও ইকোলজিকাল মেটাবলিজম’ (Socio-Ecological metabolism)। প্রকৃতি থেকে সমাজ সম্পদ নিয়ে শিল্প গড়ছে, গ্রাম কিংবা উপনিবেশ থেকে কৃষিজ ও অন্যান্য জৈব সার শহরে, সাম্রাজ্যবাদী দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু ব্যবহারের পর বর্জ্যকে ‘ডি-কম্পোজ’ রূপে প্রকৃতিতে বা মাটিতে ফেরানো হচ্ছে না। ফলে সম্পূর্ণ হচ্ছে না বিপাক চক্রটি। এতে জৈব-অজৈব বস্তু এবং প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে স্বাভাবিক আবর্তন বা বিপাক প্রক্রিয়ায় ভাঙন দেখা দেয়। কার্ল মার্ক্স প্রকৃতি, মানুষ ও সমাজের  মধ্যে বিপাকীয় মিথষ্ক্রিয়ায় বৃহৎ কৃষি খামারের উৎপাদন পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেন। 

প্রসঙ্গত বলা উচিত যে মার্ক্স, পরিবেশ ও সমাজের মধ্যে যে ‘মেটাবলিক রেট’ ও চক্র পূর্ণ করার কথা বলেছিলেন, বিশেষত তৃতীয় দুনিয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছেনা। প্রথমত, প্রযুক্তির উন্নয়নে শহরে শিল্প বৃদ্ধিতে ও ‘অটোমেশন’-এর (Automation) যুগ এসে পড়ায় গ্রামের লোক কাজ হারিয়ে শহরে জনসংখ্যা বাড়াতে থাকে। এত লোকের খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎপাদিত খাদ্য ও তন্তু (fibre) শহরে চলে গেল কিন্তু তা আর প্রকৃতিতে ফিরে এলনা। আবার অন্যদিকে সেগুলো শহরের বর্জ্যকেও বাড়িয়ে চলল। দ্বিতীয়ত, মাটির প্রাকৃতিক সার ও মাটি তথা প্রাকৃতিক খনিজে সমৃদ্ধ মাটি উপনিবেশে, শহরে রপ্তানি হয়ে যায়। তৃতীয়ত, এরকম ধারণা আছে যে কহুজাতিক সংস্থাগুলির তৈরি করা ‘Genetic engineered’ বীজ, ‘High yeilding’ বীজ ব্যবহার না করলে খাদ্য সমস্যা মেটানো যাবে না। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশে দেশীয় ধানবীজ ও সঙ্গে অল্প রাসায়নিক সার ব্যবহার করে চাহিদার সামাল দেওয়া সম্ভব। সমস্যাটা এই যে ওই সার থেকে প্রয়োজনীয় খনিজকে শোষণ করে বেড়ে ওঠা খাদ্যশস্য আঞ্চলিক ভাবে ভোগ্য না হয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। এই পর্যায় থেকেই মার্ক্স পরবর্তী দার্শনিকদের কেউ কেউ প্রকৃতি-মানুষ সম্পর্ক নিয়ে বিকল্প দর্শনের কথা বলবেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *