অরিত্রী দে
সপ্তদশ পর্ব
পরিবেশ আন্দোলন : পর্ব দুই
“Many small people, who do many small things in many small places, can change the face of world.” (Berlin wall) তেমনই অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছে, প্রচেষ্টা আর স্বর মিলিত হয়ে পরিবেশ আন্দোলনের জন্ম। আলেকজান্ডার ভন হাম্বল্ট প্রথম পরিবেশবিদ, যিনি ভেনেজুয়েলার জমিতে কেবল একই রকমের শস্য চাষ, শুধুমাত্র অর্থকরী ফসল চাষে ও অনুপযুক্ত সেচ পদ্ধতিতে ভূমির উর্বরতা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। এমনকি অরণ্য ধ্বংসের নমুনা দেখে পরিবেশ বিপর্যয়ে মানুষের কার্যকলাপের প্রত্যক্ষ ভূমিকা দেখিয়েছিলেন উনিশ শতকের শুরুতেই। সেই দিক থেকে সবচাইতে প্রাচীন পরিবেশবাদী আন্দোলন হলো অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্ব থেকে উনিশ শতকের প্রথম পর্বের মধ্যে ঘটে যাওয়া রোমান্টিক আন্দোলন, যা ‘ব্যাক টু নেচার’ নামে পরিচিত। শিল্প বিপ্লব, যুক্তির বাহুল্য এবং প্রকৃতিকে শুষ্ক প্রয়োজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় এই আন্দোলন। বিশ শতকে এসে বায়ুদূষণের সঙ্গে শিল্পজাত রাসায়নিক বর্জ্য, মনুষ্য ব্যবহৃত দ্রব্যের বর্জ্য এসে যুক্ত হয়। ১৮৬৩ সালে ব্রিটেনে প্রথম ‘অ্যালকালি এ্যাক্ট’ নামক পরিবেশবাদী আইন পাশ হয়, অ্যালকালি ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হয় বাতাসে মিউরিয়াটিক অ্যাসিড মিশ্রিত হওয়ার মাত্রা নির্ধারণ করতে। উইলিয়াম ব্লেক রিচমন্ড ‘কোল স্মোক অ্যাবেটমেন্ট সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৮ সালে। ১৮৬৫ সালে ‘কমন্স প্রেজারভেশন সোসাইটি’ (ব্রিটেন) গঠিত হয় গ্রামীণ সংরক্ষণকে শিল্পায়নের দখলের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে। এবং ১৮৯৪ সালে একটি জাতীয় সংস্থা গঠন করা হয় পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে, যার নাম ‘ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর প্লেসেস অফ হিস্টরিক ইন্টারেস্ট অর ন্যাচারাল বিউটি’। উনিশ শতকের শেষ দিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য কিছু সোসাইটি গড়ে উঠেছিল, যেমন ‘প্লুমেজ লিগ’ (১৮৮৯)। এই সোসাইটি পোশাকে পাখিদের চামড়া ও পালক ব্যবহার করার বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। ১৮৬৯ সাল নাগাদ গ্রেট ব্রিটেনে সামুদ্রিক পাখি সংরক্ষণমূলক অ্যাক্ট চালু হয়। এর দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিল ‘প্লুমেজ লিগ’-এর প্রচারাভিযান।
চিত্র ১.১, ১.২
দ্বিতীয় ছবিতে ইংল্যাণ্ডের ‘লেডি’দের কাছে পাখির পালক যুক্ত ‘হ্যাট’ ব্যবহার বন্ধ করার অনুরোধ সংক্রান্ত বার্তাটি খুব স্পষ্ট।
ভারতের প্রথম পরিবেশ আন্দোলন সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের পশ্চিম রাজস্থানের থর মরুভূমির অধিবাসী বিশনয়ীদের আন্দোলন। পরিবেশ সচেতনতা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এদের অবদান ভারতে প্রথম স্থানের দাবীদার। গুরু জাম্বোজি দ্বারা ১৪৮৫ সালে পশ্চিম রাজস্থানের মারোয়ার প্রান্তরে প্রকৃতির উপাসনামূলক অহিংস সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৭০০ সালে অরণ্য ধ্বংসের প্রতিবাদে এই সম্প্রদায় আন্দোলন করে শম্ভুজির নেতৃত্বে। ১৭৩৭ সালে খেজরালি গ্রামে একদল লোক ঢুকে গাছ কাটতে শুরু করলে অমৃতা দেবী ও তাঁর তিন কন্যা এর বিরোধিতা করে। বিশনয়ী ধর্মে সজীব গাছ কাটা ধর্মবিরুদ্ধ। এমনকি মৃতকেও কাঠ দিয়ে না পুড়িয়ে মাটিতে কবর দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে ঠিকাদার কর্তৃক হিমালয়ের গাছ কাটার বিরুদ্ধে সুন্দরলাল বহুগুণা ও চন্ডীপ্রসাদ ভাটের নেতৃত্বে চিপকো আন্দোলন হয়।
চিত্র ১.৩, গুগল
গাড়োয়ালের অধিবাসী চন্ডীপ্রসাদ ভাটের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল চামোলি জেলায় দশোলি গ্রাম স্বরাজ মন্ডল স্থাপন করা। লক্ষ্য ছিল- হিমালয়ের প্রাকৃতিক সম্বল অরণ্যকে কেন্দ্রে রেখে কাঠ দিয়ে সরঞ্জাম বানানো, রেজিন জোগাড় করা, স্থানীয় কুটির শিল্প স্থাপন প্রভৃতি। অর্থাৎ পুঁজিবাদের মুনাফার উল্টোদিকে স্থানীয় পরিবেশ-প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে মানব শ্রম নির্ভর ছোট মাপের কর্মকাণ্ড ও বিকেন্দ্রীভূত স্বনির্ভর জনগোষ্ঠী তৈরি করতে চেয়েছিলেন চণ্ডীপ্রসাদ ভাট। কৃষিকাজ ছাড়া গাড়ওয়ালের যুবকরা জীবিকা নির্বাহ করত সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে, কিংবা দিল্লি-দেরাদুনে গিয়ে মজুর হিসেবে খেটে, রাস্তার পাশে খাবারের ঝুপড়িতে কাজ করে। বলা বাহুল্য চণ্ডীপ্রসাদ ভাটের এই উদ্যোগ যুবক সম্প্রদায়কে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করতেও সক্ষম ছিল। আমাদের মনে পড়বে ই. এফ শুমাখার (E.F Schumacher) রচিত ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ (১৯৭৩) বইটির কথা, যেখানে পুঁজিবাদ-অর্থনীতির জনপ্রিয় ধারণা ও বিশ্বায়নের ধারণাকে সমালোচনা করা হয়েছে। পাহাড়ের অরণ্য সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে ঠিকাদার ও স্বরাজ মণ্ডলের মধ্যে আদর্শগত লড়াই দেখা দেয়।
১৯৭৩ সালের ২৪ শে এপ্রিল চণ্ডীপ্রসাদ ভাটের নেতৃত্বে দশোলি গ্রাম স্বরাজ মন্ডল এলাহাবাদের একটি সংস্থার গাছ কাটা বন্ধ করে গাছকে ‘চিপকে’ অর্থাৎ জড়িয়ে ধরে। ডিসেম্বর মাসে কিছু দূরের গ্রামে প্রায় একই রকম ভাবে প্রতিরোধ হয়। এরপর ১৯৭৪ সালের ২৬ শে মার্চ চামোলি জেলার রেনি গ্রামের নারীরা গৌড়া দেবীর নেতৃত্বে গাছ জড়িয়ে ধরে হৃষিকেশের ঠিকাদারের গাছ কাটা বন্ধ করে। তখনই চিপকোর সঙ্গে নারী এবং পরিবেশের সম্পর্ক একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে দশ বছরের জন্য রেনি গ্রাম সংলগ্ন অলকানন্দা উপত্যকার প্রায় বারো’শ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে কাঠ কাটা বন্ধ হয়। ক্রমে উত্তর কাশি, কুমায়ুন অঞ্চলে বনের গাছ কাটা বন কাটার ইজারা দেবার নিলাম বন্ধ করে দেওয়া হয় এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায়। লিলাম বন্ধ করাকে দাবিতে ছাত্র আন্দোলনও শুরু হয় নৈনিতালে এবং একে কেন্দ্র করে এমনকি ১৯৭৭ সালে পুলিশ গুলিও চালায়। এর পাশাপাশি গান্ধীবাদী সুন্দরলাল বহুগুণা পাহাড়ে থেকেই অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন, মধ্যপান বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন সমবায় সংস্থাও। তিনিই চিপকোর স্থানীয় মানুষের জঙ্গল ব্যবহার ও কর্মসংস্থানের অধিকারকে হিমালয়ের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। তিনি পাহাড়ের সীমানা ছাড়িয়ে আন্দোলনকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার কংগ্রেস দলের জাতীয় নেতৃত্বের সামনে। ফলে সুন্দরলাল বহুগুণা হয়ে উঠলেন চিপকো নামের পরিবেশ আন্দোলনের জাতীয় মুখ। ১৯৭৯ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি গাছ কাটার বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন ও গ্রেপ্তার হন এবং ৩১শে জানুয়ারি মুক্তি পান। তাঁর অনশনের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ১৯৮১ সালে তিনি সমগ্র হিমালয়ের হাজার মিটারের উপরে সম্পূর্ণ গাছ কাটা আইনত বন্ধ করার দাবি তুলেছিলেন। চিপকো আন্দোলন প্রথম পরিবেশ আন্দোলনের রাজনৈতিকভাবে সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত নির্মাণ করতে পেরেছিল।
১৯৭৩ সালেই কেরালার চিরসবুজ বৃক্ষরাজির এলাকায় হাইডেল বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয় এবং ১৯৮৫ সালে সরকার এই এলাকাকে বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। ঝাড়খণ্ডের সিংভূম এলাকার আদিবাসীরা সরকারের ১৯৮২ সালের অরণ্যনীতির বিরুদ্ধে জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলন করেছিল। সরকার বিহারের সিংভূম জেলার (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) প্রাকৃতিক শাল বনকে বাণিজ্যিক সেগুন বাগানে প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব দেয়। এর প্রতিবাদে অরণ্যভূমির আর্থ-সামাজিক অধিকার নিয়ে জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। প্রথমে বিহারে এবং ধীরে ধীরে ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার মতো বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশবাদীরা এই আন্দোলনকে লোভের রাজনৈতিক খেলা হিসেবে দেখেছিলেন। ১৯৮৩ সালে কর্ণাটকের উত্তর কন্নড় এবং শিমোগা জেলায় আপ্পিকো আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে, যার নেতৃত্বে ছিলেন পান্ডুরং হেগদে। অরণ্য ধ্বংসের প্রতিবাদে ও অরণ্য সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের দাবিতে, অরণ্যকেন্দ্রিক প্রাচীন জীবিকা সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। ‘আপ্পিকো’ অর্থে আলিঙ্গন করে গাছের প্রতি নিজের স্নেহ প্রকাশ করা। চিপকো আন্দোলনের প্রভাব এই আন্দোলনে স্পষ্ট প্রতিফলিত।
চিত্র ১.৪- আপ্পিকো আন্দোলন, চিত্র ১.৫- জঙ্গল বাঁচাও আন্দোলন
মেধা পাটকরের নেতৃত্বে ১৯৮৫ সালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নর্মদা নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন হয়। মধ্যপ্রদেশের অমরকণ্টকের মহাকাল পাহাড়ে উৎপন্ন হয়ে নর্মদা নদী পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হয়েছে ও আরব সাগরে মিলিত হয়েছে। নর্মদা উপত্যকার পাহাড়ী অংশগুলিতে গোণ্ড, কোরকু, ভীল ও ভীলালা জনজাতিদের আদি বাসস্থান। নর্মদা উপত্যকায় হাজার হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। নর্মদা উপত্যকার বহুমুখী বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য ভারত সরকার নর্মদা ভ্যালি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট গ্রহণ করে। এই প্রকল্পে ছোট, বড় ও মাঝারি অনেক বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। বাঁধ নির্মাণের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছেন তাদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব ছাড়া আর কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। গ্রামবাসীদের সাথে পরামর্শও করা হয়নি। ফলস্বরূপ গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের আড়াই লক্ষেরও বেশি অধিবাসীর জীবন, জীবিকা বিপর্যস্ত হওয়ার মুখে পড়ে। ১৯৭৯ সালে প্রথম সরকারি অনুমোদন আসে এবং ১৯৮৫ সালে বিশ্বব্যাপ্ত এই প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ মঞ্জুর হয়। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহরাষ্ট্রের বাস্তুহারা মানুষেরা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সমিতি গঠন করে। ক্রমশ আদিবাসীদের গ্রামগুলিতে ছোট ছোট জন-আন্দোলন ও প্রতিবাদ গড়ে ওঠে।
চিত্র ১.৬- নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন ‘লোগো’
১৯৮০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত স্থানীয়রা তেহরি ড্যাম বিরোধী বিদ্রোহ করেছিল তেহরি শহর ও অরণ্যাঞ্চল ডুবে যাওয়ার ঘটনা আটকাতে। তবুও পুলিশ মোতায়েন করে এই প্রজেক্ট চালানো হতে থাকলে সুন্দরলাল বহুগুণা অনশন শুরু করেছিলেন। তেহরি বাঁধ ভারতের উত্তরাখণ্ডের তেহরি গাড়োয়াল জেলার নিউ তেহরিতে ভাগীরথী নদীর উপর নির্মিত। ২৬০.৫ মিটার উচ্চতা সহ ভারতের সবচেয়ে উঁচু এই বাঁধ টিএইচডিসি ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং তেহরি হাইড্রোইলেকট্রিক কমপ্লেক্সের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে। বলা হয়েছিল যে এই প্রকল্প থেকে দিল্লি শহরের প্রয়োজনীয় ৩০০ কিউসেক জলের জোগান দেওয়া হবে। এই বাঁধটির নির্মাণ বাস্তবায়িত হলে যে পরিবেশগত ক্ষতি হওয়ায় সম্ভাবনা ছিল, তা হল- হিমালয়ের ভূমিকম্প প্রবণ নবীন ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে এই প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা যেকোনো সময়ে ধস নামার আশঙ্কাকে বর্ধিত করে। আর বাঁধ বা জলাধার ভেঙে পড়লে প্রচুর বনভূমি ও কৃষিজমি, এমনকি ঐতিহাসিক শহর তেহরির ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং বসবাসকারী প্রাণীর জীবন বিনষ্টির সম্ভাবনা থেকে যায়। বাঁধ নির্মাণের জন্য ভাগীরথী নদী অববাহিকা বরাবর প্রচুর পরিমানে বৃক্ষচ্ছেদনও পরিবেশের ক্ষতি সাধনের কারণ।
উন্নয়নমুখী বাঁধ নির্মাণের বিরূপ প্রভাবগুলি বুঝতে পেরে পরিবেশবিদদের একাংশ, এমনকি চিপকো আন্দোলনের নেতা সুন্দরলাল বহুগুণা অগণিত প্রশ্ন তোলেন তথাকথিত উন্নয়নের প্রতি। ফলস্বরূপ বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরেন্দ্র দত্ত সাকলানির নেতৃত্বে তেহরি বাঁধ বিরোধী সংঘর্ষ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা প্রায় এক দশক ধরে এই বাঁধ নির্মানের বিরোধিতা করে। তেহরি সহ বহু গ্রাম নিমজ্জিত হওয়ার ভয়, ১৯৯১ সালে ঊর্ধ্ব ভাগীরথী উপত্যকায় ভূমিকম্পের পর বাঁধের জীবনকাল ও সুরক্ষা সংক্রান্ত জায়মান প্রশ্ন পরিবেশবিদ ও তেহরি বাঁধ বিরোধী সমিতির চিন্তাভাবনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বাঁধের প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রায় কমিটি গঠিত হয়। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে কমিটির রিপোর্টে বাঁধ নির্মাণের পরিবেশগত দিকটি পর্যালোচনা না করার অসন্তোষ ব্যক্ত হয়। ১৯৯১ সালের ভূমিকম্পের পর কেন্দ্রীয় সরকার আবার বাঁধটির ভূমিকম্প সংক্রান্ত নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য রোরকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ জয় কৃষ্ণ এর নেতৃত্বে পাঁচ জন সদস্যের একটি দল গঠন করে। আলোচিত হয় পরিবেশ উদ্বাস্তুতা এবং পুনর্বাসনের প্রসঙ্গ। পরিবেশবিদদের চিন্তা, চাহিদা ও দাবিগুলির প্রতিনিধিত্ব করে সুন্দরলাল বহুগুণা যথাক্রমে ১৯৯২, ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে অনশনে বসেছিলেন।
বেশ কিছু পরিবেশ আন্দোলনে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে স্থানীয় জনগণের আর্থিক-সামাজিক অধিকার স্বীকৃতিই প্রধান ব্যাপার হলেও শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ের অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। যেমন- ওড়িশার কালাহাণ্ডি ও রায়গড়া জেলায় অবস্থিত নিয়মগিরি শৈলমালা। ওই এলাকার আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছে তাদের দেবতাদের বাসস্থল হল এই নিয়মগিরি শৈলমালা, ঠিক যেভাবে আমাদের কাছে কৈলাস। পাহাড়ের চূড়া তাদের কাছে নিয়ম-রাজা নামে পরিচিত। পাহাড়ে কোন্ধ উপজাতি ঝুম চাষ করে এবং বিভিন্ন রকমের ফলের চাষ করে দিন অতিবাহিত করে। ওই পাহাড়েরই উপরের দিকে আবার অ্যালুমিনিয়াম ধাতুর আকর বক্সাইটের উপস্থিতির সন্ধান পাওয়া যায়। ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম যে কোনো উন্নয়নকামী রাষ্ট্রের আকাঙ্খার বিষয়। কিন্তু ডোঙ্গারিয়া কোন্ধ ও কুটিয়া কান্ধা আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নিয়মগিরি আন্দোলন (২০০৩-২০১৩) করে দাবি জানায় যে বক্সাইট আকর খাননে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর জীবনযাত্রার উপরে কু-প্রভাব পড়বে। ফলে আদিবাসী গোষ্ঠীর আপত্তি, খনি মালিকদের পাল্টা যুক্তি, কেন্দ্রীয় সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে বৈজ্ঞানিক-সামাজিক সমীক্ষা চলতে থাকে। ১৮ই জুলাই ২০১৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এই খনি প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব দেয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গ্রামসভার উপরে। ফরেস্ট এডভাইসারি কমিটি অরণ্য অধিকার আইনের প্রসঙ্গক্রমে আদিবাসীদের উপাসনার অধিকারকে প্রাধান্য দেয় এবং সুপ্রিম কোর্ট এই প্রস্তাব গ্রহণ করে।
একইভাবে সিকিমের রাথং-চু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ধর্মীয় আপত্তির কারণে বন্ধ করা হয় ১৯৯৭ সালে। মনে করা হয় রাথং-চু একটি পবিত্র নদী, যার উৎস ন’টি প্রবিত্র হ্রদ। এই নদীকে ঘিরে ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠানের সময় নদীর জল সাদা হয়ে যাওয়া ও সংগীত শুনতে পাওয়ার জনশ্রুতি এর আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যকে বর্ধিত করে। ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য অধ্যাপক প্রকৃতিবিদ পি.এস.রামকৃষ্ণন এই প্রকল্প তৈরীর বিরোধিতা করে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন, যা এই প্রকল্প বন্ধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধ্যপ্রদেশের সিংগরৌলি জেলার অরণ্য অধ্যুষিত গ্রাম আমেলিয়া গ্রাম। এই অরণ্যের কিছু অংশে বক্সাইট খনির প্রকল্প হিন্ডালকো-এর। গ্রামের জনগোষ্ঠী জঙ্গল নির্ভর হওয়ায় তারা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে, তৈরি হয় মহান সংঘর্ষ সমিতি। কিন্তু অরণ্য অধিকার আইন অনুযায়ী দাবি জানানো হলেও তাতে কাজ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জঙ্গলের রক্ষাকর্তা ডিহ বাবার উপাসনা ক্ষেত্রে ধর্মীয় অধিকারের দাবিতে অরণ্য বাঁচানোর প্রয়াস স্থান পায়৷
এছাড়াও ১৯১৯ সালে ইয়াংসি নদীতে তিনটি গিরিখাত বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে আন্দোলন, রাশিয়ার বৈকাল হ্রদের ইকো-সিস্টেম বিনষ্টকারী পাঁচটি বড় সেলুলোজ ও কাঠের কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৯৪ সালের বীরভূমের খাদান বিরোধী গণ আন্দোলনের স্বাক্ষর তো আছেই। দুন উপত্যকার চুনাপাথর খাদে খনি মালিকদের দায়িত্ব সংযমহীন কাজের জন্য এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার অভিযোগ আনে স্থানীয় অধিবাসীরাই। লক্ষণীয়, এরা সকলেই যে আর্থিক দিক থেকে খুব অবস্থাপন্ন, এমনটা নয়; তবু তারা নিজেদের চরাচরে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সম্বল নষ্ট করতে চায়নি, মাত্রার অতিরিক্ত উন্নয়নও তাদের চাহিদার অন্তর্ভুক্ত ছিল না।