অরিত্রী দে
ষোড়শ পর্ব
পরিবেশ আন্দোলন : পর্ব এক
‘পরিবেশ আন্দোলন’ পরিভাষাটি উন্নয়নের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে জীবিকার সমস্যা এবং পরিবেশগত নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় সংগ্রাম-আন্দোলনকে বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই আন্দোলনগুলি প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিক সময় থেকে ভারতীয় রাষ্ট্র এবং এর কর্মকর্তাদের দ্বারা অনুসৃত উন্নয়ন এবং সংরক্ষণমূলক বাস্তুবিদ্যার (Conservation Ecology) ধারণা, নীতির প্রতি সমালোচনা এবং প্রশ্ন তুলেছিল। ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের সূত্রপাত উত্তরাঞ্চলের গাড়ওয়াল এলাকার চিপকো আন্দোলন (১৯৭৩) থেকে। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৭০ থেকে ১৯৮০-এর মধ্যে ভারতে বন ও জলের অধিকার কেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি আন্দোলন হয়েছিল যা বন সম্পদে উপজাতিগুলির অধিকার, বাঁধের মতো বৃহত্তর পরিবেশগত প্রকল্পের স্থায়িত্ব, বাস্তুচ্যুতি এবং পুনর্বাসনের সমস্যার মতো বৃহত্তর পরিবেশগত উদ্বেগের দিক উত্থাপন করেছিল।
ভারতীয় পরিবেশ আন্দোলন উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দ্বারা অনুসৃত উন্নয়নের ঔপনিবেশিক মডেলের সমালোচনা করে। জনগণের চাহিদার উপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্র একটি স্থায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। পরিবর্তে আধুনিক পুঁজিবাদী পরিকাঠামো ও বিষয়সূচি পরিকল্পনার পরিপোষণ পরিবেশ ধ্বংস, দারিদ্র্য এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিকতার দিকে পরিচালিত করে। জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত এলাকা গঠনে ভারতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য বজায় রাখার স্বার্থ নিহিত ছিল। কিন্তু এই নির্দিষ্ট এলাকার পরিসীমা থেকে জনজীবনকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পরিবেশবাদী আন্দোলনগুলি প্রাকৃতিক পরিবেশে জনসাধারণের অধিকার ও পারস্পারিকতার সম্পর্কের সপক্ষে প্রতিনিধিত্ব করে। পরিবেশ আন্দোলনগুলি শুধুমাত্র আধুনিক উন্নয়নবাদের সমালোচনাই করেনা বরং প্রথাগত ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম অর্থনীতি’র পুনরুজ্জীবনের পক্ষেও জোরালোভাবে সমর্থন দেখায়। এতে পরিবেশলগ্ন সম্প্রদায়গুলি ভারতীয় পরিবেশগত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। পরিবেশবিদদের মতে, স্থানীয় (বিভিন্ন উপজাতি) সম্প্রদায়গুলি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সবচেয়ে উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করে, যেহেতু তাদের বেঁচে থাকা এই সহায় সম্বলের সহনশীল ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। একভাবে বলতে গেলে তাদের দৈনন্দিন পারস্পরিক সম্পর্কই স্থানীয় পরিবেশের রক্ষক। পরিবেশ আন্দোলনগুলি প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতা ও ব্যবহারে জনসাধারণের প্রথাগত অধিকার বা ঐতিহ্যগত অধিকারগুলি (যা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল) ফিরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।
পশ্চিমী ধারার বিপরীতে, ভারতে পরিবেশ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যই হল এই যে তারা প্রধানত নারী, দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত সেই সমস্ত জনসাধারণকে একত্রিত করতে পেরেছে যারা পরিবেশগত অবক্ষয়ের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। প্রাথমিকভাবে এই আন্দোলনগুলিকে পরিবেশগত অবক্ষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় সম্প্রদায়ের সংগ্রামের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখা যায়।
পরিবেশবিদ মাধব গডগিল এবং রামচন্দ্র গুহ আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গী এবং কৌশলের ভিত্তিতে ভারতে পরিবেশগত আন্দোলনগুলিকে চারটি সূত্রে গ্রথিত করেছেন। প্রথম সূত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহার রোধ করার এবং দরিদ্র ও প্রান্তিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নৈতিক প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সংগ্রামের মাধ্যমে অনৈতিক ও ঊর্ধ্বতন-অধস্তন, ভোগের সামাজিক ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হয়। তৃতীয় এবং চতুর্থ ক্ষেত্রে, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব বিষয়ে নতুন সমাজ ও জীবনদর্শনের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পুনর্নবীকরণযোগ্য প্রকৃতিজাত বস্তু ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি আসে। যেমন বিজ্ঞানীদের সচেতনতায় পরিবেশ-বান্ধব কৃষি পদ্ধতির উদ্ভাবন, গ্রাম পর্যায়ে প্রকৃতিলগ্ন সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টায় বন রক্ষা ও উক্ত কৃষি পদ্ধতির অনুসরণ।
ভারতে সংঘটিত পরিবেশ আন্দোলনগুলিকে সমস্যা, বিভাগ এবং উদাহরণগুলির ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা যায়-
- অরণ্য ও ভূমি ভিত্তিক পরিবেশ আন্দোলন যে সমস্যা বা ‘ইস্যু’তে কেন্দ্রীভূত-
ক. বনজ সম্পদের প্রাপ্যতা সংক্রান্ত অধিকার,
খ. প্রাকৃতিক সম্পদের অ-বাণিজ্যিক ব্যবহার,
গ. জমির ক্ষয় রোধ
ঘ. সামাজিক ন্যায়বিচার/মানবাধিকার।
যেমন- চিপকো, অ্যাপিকো, সারা দেশের উপজাতি আন্দোলন (উদাহরণস্বরূপ, ঝাড়খণ্ড বা বস্তার ‘বেল্ট’)
- সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ (মৎস্য প্রভৃতি জলজ পালন ও অন্যান্য ‘অ্যাকোয়া কালচার’) কেন্দ্রিক পরিবেশ আন্দোলনের লক্ষ্য
ক. ট্রলিং নিষিদ্ধ করা, চিংড়ি চাষের বাণিজ্যিকীকরণ রোধ করা
খ. সামুদ্রিক সম্পদের সুরক্ষা
গ. উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়ম ও ব্যবস্থাপনার বাস্তবায়ন করা।
যেমন- কেরালা, ওড়িশার ঐতিহ্যবাহী মৎস্যজীবীদের জন্য জাতীয় মৎস্যজীবী ফোরাম কাজ করছে কেরালায়, ওড়িশায় চিল্কা বাঁচাও আন্দোলনে।
- শিল্প দূষণ প্রতিরোধী আন্দোলনে
ক. কঠোর পদক্ষেপে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও দূষণ প্রভাবিত ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা,
খ. এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান, নকশা, স্থানীয় জনগণের জীবিকা সমস্যা বিবেচনা না করেই শিল্পের বেপরোয়া সম্প্রসারণ প্রতিরোধ ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জনের সীমা নির্ধারিত থাকে।
ভোপালে জাহিরো গ্যাস মোর্চা, বিহারে গঙ্গা মুক্তি আন্দোলন, কর্ণাটকের হরিহর পলিফাইবার কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলন, মধ্যপ্রদেশের শাহদোল জেলার বিদুষক কারখানা গ্রুপের নেতৃত্বে গোয়ালিয়র রেয়ন কারখানার বিরুদ্ধে সোন নদীর দূষণকে কেন্দ্র করে আন্দোলন; কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ (KSSP) দ্বারা কেরালায় চেলিয়ার নদীতে বিষক্রিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন- বাঁধ এবং ব্যারাজ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য- গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরণ্যের সুরক্ষা, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, ধস-রোধী পরিকাঠামো তৈরি এবং বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসন ঘটানো।
মনে করব নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, ‘সায়লেন্ট ভ্যালি মুভমেন্ট’, তেহরি বাঁধ বিরোধী সমিতি কর্তৃক আন্দোলন, কোশি গন্ধক বোধঘাট ও বেদথি: পশ্চিমে ভোপালপত্তনম এবং ইছামপল্লী, দক্ষিণে তুঙ্গভদ্রা, মালাপ্রভা এবং ঘাটপ্রভা প্রজেক্টের কথা। এছাড়া বিদ্যুৎ প্রকল্প ও খনি এলাকাকে কেন্দ্র করে যেসমস্ত আন্দোলন হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে কোয়না হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রজেক্ট প্রভাবিত জন আন্দোলন, দ্যুন উপত্যকার খনি বিরোধী আন্দোলন, ওড়িশার ‘অ্যান্টি-বক্সাইট মাইন মুভমেন্ট’।
রেলওয়ে প্রকল্প, বিমানবন্দর প্রকল্প, সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ প্রকল্পে অবৈজ্ঞানিক নির্মাণ ভূ সম্পদের অবনমন ঘটায়। ‘রেইলওয়ে রি-এলাইনমেন্ট অ্যাকশন কমিটি’র প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে। আসাম রেলওয়ে এবং ট্রেডিং কোম্পানির হাত ধরে ১৮৮২ সালে পাটকাই পাহাড় গুঁড়িয়ে কয়লা তোলা শুরু হয়। চলতে থাকে পাহাড় জঙ্গল ধ্বংস করে কয়লা তুলে আনার কালো কারবার। বাড়তে থাকে পরিবেশ দূষণ, কমতে থাকে স্থানীয় আদিবাসীদের জঙ্গলের ওপর অধিকার। ২০০৩ সাল অবধি অনুমোদন ছিল, তারপরেও চলেছে বেআইনিভাবে কয়লা উত্তোলন৷ পশ্চিমবঙ্গের দেউচা-পাচামি, ওড়িশার তালারিয়া জঙ্গলের একাংশে, আসামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল দেহিং-পাটকাই সহ নয়া নয়া কয়লাখনি প্রকল্প সহজেই ছাড়পত্র পাচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ড লাইফ, আসামে হাতিদের জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কয়লা উত্তোলনের ছাড়পত্র দেয় কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডকে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে ‘ট্যুরিজম’ অন্য একটি দিগন্ত খুলেছে। কিন্তু এর কারণে কোনো জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকায় ঘটে থাকে ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। কোন দেশের ক’টি অভয়ারণ্য, ন্যাশনাল পার্ক আছে, তার উপরে সেই দেশের পরিবেশ দরদী ইমেজটি নির্ভর করে থাকে। কিন্তু বিনিময় মূল্য কি? মহারাষ্ট্রের ভীমশংকর এলাকায় ‘একজোট’ আন্দোলন, মুম্বইয়ের সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কে শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, হিমাচল বাঁচাও আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।