অরিত্রী দে

পর্ব – ২৩

পরিবেশবাদী বাংলা উপন্যাস

জিম ডোয়ার‍্যে’র বই ‘where the wild books are: A field quide to Eco-fiction’ (২০১০) বইতে বলেন যে ‘ইকোফিকশনে’ না-মানব পরিবেশ কেবল একটি ‘ফ্রেমিং ডিভাইস’ বা পটভূমি হিসেবে উপস্থিত না হয়ে বরং মানব ইতিহাসকে প্রাকৃতিক ইতিহাসের সাথে জড়িত করবে। শুধুমাত্র মানব ইতিহাসকে তথা মানবকেন্দ্রিকতাকে কোনো গুরুত্ব দেওয়ার বদলে ‘ইকো-টেক্সট’গুলির বরং একটি নৈতিক দিক থাকবে- পরিবেশের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার। আর পরিবেশগত বোধটি ক্রিয়াশীল থাকবে প্রক্রিয়া হিসেবে।

মাইক ভ্যাসি যে কোনো ধারায় (রোমান্স, অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য বন ও বন্যদের জীবন্ত করে তোলার উপায় হিসেবে ‘ইকো-ফিকশন’কে ভাবেন।  ডিমে ডোয়ার‍্যের মতে তিনি প্রথম ইকো-ফিকশন শব্দটি শুনেছিলেন ওয়াশিংটন স্কয়ার প্রেস প্রকাশিত ‘ইকো-ফিকশন অ্যানথোলজি’ থেকে (১৯৭১)। এখানে শুরুতেই বলা হয়েছে-

“পৃথিবী একটি ইকো-সিস্টেম। এটি সামূহিক স্মৃতিকে ধারণ করে। ফলে এর মধ্যে যেকোনো ঘটনাকেই যত অ-তাৎপর্যপূর্ণ মনে হোক না কেন, কোনো না কোনো ভাবে কোনো না কোনো সময়ে তা ওই বাস্তুতন্ত্রে অবস্থিত বাকি সবকিছুর অস্তিত্বকে প্রভাবিত করে।”

ইকো-টেক্সটগুলি ইকো-সিস্টেমে অবস্থানকারী মানুষের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে যে সে পরিবেশের সতর্কতামূলক বার্তাকে ক্রমাগত গুরুত্ব না দিয়ে নিজের উৎস ধ্বংসের লীলায় নিজেই মেতে থাকবে কিনা, সভ্যতাকে কসাইখানার দিকে প্রসারিত করবে কিনা।

বাংলার বিজ্ঞানভাবুক মধুসূদন গুপ্ত (কলিকাতা ফিবার হাসপাতালের ডাক্তার), আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর পরিবেশ সচেতনতার নির্দেশও আমরা যখন গ্রহণ করিনি, তখন কলম ধরেছেন প্রোথিত যশা লেখক-লেখিকারা। আমাদের বেঁচেবর্তে থাকা চরাচরের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ সাহিত্যের একটি নতুন প্রকরণ হিসেবে ‘পরিবেশবাদী কথাসাহিত্য’কে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। প্রকৃতি-মানুষ বিরোধ পর্বে এসে পৌঁছতে বাঙালির পরিবেশচর্চাগত অভ্যাসের যে বিপুল বদল ঘটেছে, বাংলা কথাসাহিত্যে পরিবেশভাবনা বিবর্তনের রূপরেখায় তার প্রতিফলন স্পষ্ট। পরিবেশবাদী বাংলা উপন্যাসগুলি গত ত্রিশ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে  আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।

১৯৭২ সালে স্টকহোমে পরিবেশ সমস্যা নিয়ে প্রথম বিশ্ব সম্মেলন হয়। বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনের দু’বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় বাঙালি লেখিকা লীলা মজুমদারের ‘বাতাসবাড়ি’ উপন্যাস। জনবিস্ফোরণপিষ্ট ভবিষ্যতের পৃথিবীতে থাকা-খাওয়ার অভাব, নিঃশেষ হয়ে আসা প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ, জলের অভাব ইত্যাদির অভাবপূরণে বাতাসবাড়ির নকশা তৈরি করেন লেখিকা লীলা মজুমদার। সেখানে সৌরশক্তির যন্ত্র তৈরির কারখানা বানিয়ে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমনি আছে পর্যাপ্ত সবজির চাষ। স্বভাবতই পরিবেশবান্ধব এমন বাতাসবাড়িতে বৃষ্টির অভাবও মিটে যায়। পরবর্তী ১৯৮৯ সালের পরিবেশ সম্মেলনটি হয় নেদারল্যান্ডস-এ। এই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। সেখানে পরিবেশ সমস্যার ঘোষণাপত্রে পেশ করা হয় ছাব্বিশটি নীতির কথা, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা এবং নবায়নযোগ্য উৎস উৎপাদন করার নীতি। লীলা মজুমদারের ‘হাওয়ার দাঁড়ি’ উপন্যাসে (১৯৮৯) বিজ্ঞানসম্মত এই নীতির প্রতিফলন পাই। শীত-বৃষ্টি-গরমহীন এলাকার গাছ মরে যাওয়া, পাহাড় ধসে যাওয়া, ঝরণা লুকোনোর মত সমস্যা সমাধানে পন্ডিত অঙ্ক কষে জানায়- দিনরাত কয়লা তোলা, নলে করে গ্যাস চালান দেওয়া, সব খেয়ে শেষ করে ফেলার কারণে প্রকৃতি আর মানুষের স্বাভাবিক সহাবস্থানের মূলে উপস্থিত নিয়মনিষ্ঠা ফুরিয়ে গেছে। মানুষের অত্যাচার যখন পৃথিবীর অক্ষদন্ডের কৌণিক অবস্থান পাল্টে দিয়েছে তখন উল্টোদিকে বর্জ্যটুকুও নষ্ট না করে তা পুঁতে রেখে জৈব সার তৈরির মাধ্যমে পরিবেশের স্বাস্থ্যবিধান করা ও শস্য ফলানোর শিক্ষাদান আছে। প্রাকৃতিকভাবে দূষণ অপসারিত করতে পরিবেশের সক্ষমতা বাড়ানোর শিক্ষা দেন তিনি। 

আবার হুগলী নদী সন্নিহিত কাঁঠালবেড়ে গ্রামের আটশো বিঘে জমি অধিগ্রহণ করে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পত্তনকে ঘিরে সৃষ্ট দূষণের কথা আছে অমর মিত্রের ‘কৃষ্ণগহ্বর’ উপন্যাসে (১৯৯৮)। লরি লরি ছাই ফেলে জমি উঁচু করে ‘ডেভলপ’ করা হয়, চিমনিতে কাজ করতে থাকা শ্রমিকদের বেওয়ারিশ মৃত্যু হয়, নাম ছড়িয়ে পড়ে- মানুষখেকো চিমনি। ডেভলপমেন্টের কুফল সম্পর্কে সচেতন যারা, তারা দেখেছিল মাটি কেটে নেওয়ার ফলে তৈরি বড় গর্ত, গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে সাপ ব্যাঙ ইঁদুর এমনকি বাস্তুসাপের পলায়ন, ছাই হয়ে যাওয়া নদীর জল, ইলিশের না আসা তথা গোটা গ্রামেরই ধসে যাওয়া বাস্তুতন্ত্র। অমর মিত্র দেখান, বিদ্যুৎ আর ‘ডেভলপমেন্ট’-এর জোয়ারে গ্রামের কেবল অর্থনেতিক কাঠামোই পাল্টে যাচ্ছেনা, তার চেনা জীবনপ্রবাহও বদলে যায়। শিল্পায়ন ও নগরায়ণে গ্রাম আক্রান্ত হচ্ছে। সুকান্তি দত্তের ‘যুধানকথা’য় (২০০১) ইটভাটার দূষণ ও পুকুর বুজিয়ে গুদামঘর বানানোর বিরুদ্ধে লড়াই করে আহত পরিবেশ সচেতন নাগরিক যুধান বারবার পৌঁছে যায় দূষিত কালো জলের বিলে, যেখানে বাদামি ডানা শুকপাখির বলা পুরাণকথায় ফুটে ওঠে লোভ, ক্ষমতা, রাজনীতির আগ্রাসনে পরিবেশ বিপন্নতার আখ্যান। যুধান দেখে তার শৈশবের শুঁটি নদী শুকিয়ে নালার মত হয়েছে, কমলাদিঘির পাড় ও মাঠ বিক্রি হয়ে প্লটে প্লটে ভাগ হয়ে গেছে, ঐতিহ্যবাহী সিংহীবাগান আর নেই, নদী পুড়ে গিয়ে জলপিপি-শালিকের ঝাঁক আর গাছের পাতায়ও আগুন ধরে গেছে। তবু এই ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শেষপর্যন্ত চালিয়ে যায় যুধান, সোনালি শস্যভরা ক্ষেতের ভেতর শরীর ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক মহাবৃক্ষের সামনে পৌঁছে সে সমগ্র আধুনিক মানব প্রজাতির প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমা চাইতে চায়। 

‘মধুবনের বন্ধু’তে (২০০২) চোরাকাঠ পাচারকারীদের হাত থেকে জঙ্গল রক্ষার কাহিনি শুনিয়েছেন লেখক ভগীরথ মিশ্র, বলেছেন পবন কাঠুরিয়ার কাঠ কাটার ফলে পাতলা হয়ে যাওয়া জঙ্গল ঘনত্ব আর পরিবেশে তার প্রভাব সম্পর্কে। স্বকৃত জলবায়ু পরিবর্তনের দৃষ্টান্তে পবন নিজের সংশোধন ঘটায় এবং জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে ব্রতী হয়৷ আকর খনন ও ফসিল জাতীয় জ্বালানির কারণে পাইরাইটের মধ্যে থাকা আর্সেনিক রূপের সঙ্গে অক্সিজেনের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় তৈরি হয় মারণ বিষ। সাধন চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘জলতিমির’ পানীয় জলে সেই আর্সেনিক দূষণের আখ্যান। রবিদাসপাড়ার বাসিন্দা অন্নপূর্ণার মৃত্যুর উৎস খুঁজতে খুঁজতে আমরা জানতে পারি পাড়ার কলের জলে বহুদিন ধরে হাল্কা ফ্যান মত মিশে থাকার সূত্রে গ্রামের মধ্যে পরিছন্নতা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে কিছুটা সচেতন অন্নপূর্ণাই কেবল বুঝতে পেরেছিল পেট ছাড়া, শিলঠোকা কালচে দাগের তাৎপর্য। বিজ্ঞানমঞ্চের প্রতিনিধিত্বে জলদূষণের সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও কালিয়দমনের মিথের আশ্রয়ে আর্সেনিক দমনের প্রসঙ্গ এসেছে। কার্যত সাধন চট্টোপাধ্যায় জনস্বাস্থ্যসচেতনতার প্রথম বাংলা উপন্যাসটি লিখলেন। তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘শেষ রাতের শেয়ালে’ হারিয়ে যাওয়া সোনাই নদী পুনরুদ্ধারকল্পে গঠিত সোনাই রক্ষা কমিটি বুঝতে পারে নদীটাকে সংঘবদ্ধ ভাবে চুরি করা হয়েছে, তার বুক থেকে মাটি তুলে রাস্তাঘাট বানিয়ে ঘিঞ্জি জনবসতির তলায় চাপা দেওয়া হয়েছে। গ্রিনবেঞ্চে সোনাইকে খোঁজার অধিকার জারি রাখার আবেদনে তারা পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা গড়ে তুলতে চায়, সোনাইয়ের সন্তান পুকুরগুলোকে বাঁচানোর দাবি তোলে।

‘সবুজ রঙের শহর’ উপন্যাসে (২০০৯) সিন্থেটিক সবুজের মাঝে নগরায়ণ প্রকল্প স্থান পেয়েছে। কৃত্রিম গাছ, ফুল, জোনাকি, নীলজল ও সমুদ্র গর্জনের ব্যবস্থাপনায় পূর্বে এবং ভবিষ্যতে বহু গ্রাম, চাষের জমি, আমকাঁঠালের বাগান অধিগ্রহণ করে বেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় সবুজ শহর অথরিটি প্রকৃতিলগ্নতায় যাপিত জীবনের সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর। পরিবর্তে সবুজ শহর দিতে চায় প্রযুক্তির কল্যাণে যা খুশি যখন খুশি পাওয়ার গ্যারান্টি। কিন্নর রায়ের ‘প্রকৃতিপাঠ’ উপন্যাস শূন্য দশক থেকে সরাসরি পরিবেশবাদী কথাসাহিত্যের চর্চার পরিসর বিস্তৃত করে দেয়। পরিবেশবাদী পত্রিকা, পরিবেশবাদী লেখকগোষ্ঠী ও আন্দোলনের কথা এসেছে। প্রধান চরিত্র সতীপ্রসন্ন মানুষ আর পরিবেশকে অনেকখানি সংস্কারমুক্ত করার ভূমিকায় পরিবেশদূষণ মূলক কার্যকলাপ, পুকুর বোজানো, বহুতলের প্রাচুর্যে নেমে যাওয়া জলের স্তর, পরিযায়ী পাখিদের কমতি, ধোঁয়াশার আকাশ, ঐতিহাসিক বাড়ি ভেঙে মাল্টি স্টোরড বিল্ডিং ওঠা ইত্যাদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সুস্থ পরিবেশ-বোধ গড়তে চান। সমীরের মত কেউ কেউ যারা যতদিন সম্ভব ‘ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স’ রক্ষার কথা ভাবছিল, সতীপ্রসন্ন তাদের সঙ্গে মিলিতভাবে এলাকার গরীব গৃহস্থদের একমাত্র অবলম্বন পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তৈরির বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলেন; তিনি বুঝতে পারেন যে ‘পরিবেশ’ (পত্রিকা) করা তাঁর বৃথা যায়নি। ‘মেঘপাতাল’ উপন্যাসে বিহারের দলমা থেকে খাদ্যের অভাবে নেমে আসা হাতির দল খেদানোকে কেন্দ্র করে প্রজাতিটির সংখ্যা হ্রাস, হাতির সঙ্গে জড়িত উপযোগবাদ, পশ্চিমবঙ্গে কেবল উত্তরবঙ্গ ও মেদিনীপুরে কোনোক্রমে টিকে থাকা জঙ্গল, শৌখিন বনসৃজন, আত্মরক্ষার্থে বিপন্ন হাতিদের গৃহীত পন্থার কথা আছো তথাকথিত হস্তিবিশারদও যখন হাতি শিকারের দলে থাকে তখন সাবুর মত এক-দু’জন কোনো এক অদৃশ্য যোগাযোগে বুঝতে পারে অবলা পশুদের স্বার্থের কথা। লেখক দেখান যে আধুনিক প্রযুক্তিধন্য সভ্যতা অরণ্য নির্বিচারে ধ্বংস করতে পারলেও হাতিদের অস্তিত্ব নিশেষ করতে পারেনি, তবু অস্তিত্বের বিপদ সংকেত ঝুলতে থাকে হাতিসহ পাইথন, লেপার্ড, পাখি, প্রজাপতিদের সামনে। 

আবুল বাশারের ‘শেষ রূপকথা’ উপন্যাসে লাইসেন্সহীন কেমিক্যাল কারখানা আর তা থেকে ছড়ানো ভয়ানক রাসায়নিক দূষণের কথা আছে। কোনোরকম সেফটি ভালভ, উপযুক্ত ড্রেনেজ সিস্টেমহীন ‘দি মেডিলিঙ্ক ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল’ কারখানা হেভি ওয়েট কেমিক্যালের বর্জ্যে পুকুরের জলে টক্সিক লেভেল ছাড়িয়ে যায়, বিষাক্ত পুকুরের জল আর ঘাস খেয়ে পার্শ্ববর্তী খাটালের গাইগুলোর বাঁট ফেটে রক্তদুধের আমদানি হতে থাকে, শুভেন্দুর চুল অকালে পাকে, মূত্রদ্বারে ঘা হয়, বাড়ির আমগাছটা পর্যন্ত মরে যায়, প্রতিবেশী বাড়ির ছোট মেয়েটি অন্ধ হয়ে যায় (মাইওপিয়াতে), এবং কারখানার দারোয়ানের বুকে যক্ষ্মা বাসা বাঁধে। ক্রমে এলাকার সমস্ত জল আর বায়ু সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। ডাক্তার সীতানাথ দূষণ প্রতিরোধে প্রগতি মঞ্চের ভূমিকা প্রচার করেন, আবার ‘স্কুল অফ এনভায়রনমেণ্টাল স্টাডিজ’-এর সদস্য অমরেন্দ্র বসু পরিবেশ দূষণে দায়ী যে কোনো শিল্প সংগঠন বন্ধ করে দিতে উদ্যত। লেখক ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের অজস্র লাইসেন্সহীন কেমিক্যাল কারখানা থেকে ছড়িয়ে পড়া দূষণের কথা আর সেই দূষণ রোধ করতে গেলে বহু মানুষের বেকারত্বের কাহিনি জ্ঞাপন করেছেন।  

মণীন্দ্র গুপ্তর ‘নুড়ি বাঁদর’ (২০১৬)-এর গল্প স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গল্প, এতে প্রাণীদের নিগূঢ় জটিল অন্তরঙ্গতা খুঁজে দেখা আছে। বরফ, মাটি, পাথরের চাঁই গুমগুম শব্দে বলে ওঠে- “আমাদের প্রাণ নেই, ইন্দ্রিয় নেই, তবু আমরাও কিছু কিছু বুঝি।” তাদের শান্তিতে থাকতে না দিলে তারাও শান্তিতে থাকতে দেবে না মানুষকে। অরণ্যের নুড়িকে লেখক প্রাচীন সঞ্জীবনী জলধারায় বাঁদরে পরিণত করান, যে মানুষের সঙ্গে পারস্পরিকতায় সভ্যতার বাহক হতে চেয়েছিল, কিন্তু অবিলম্বে সে বোঝে মানুষের সঙ্গে অংশীদারী কারবার তাদের মত পশু-পাখিদের চলবেনা।  প্রকৃতির সঙ্গে নিয়মানুবর্তিতায় থাকার পরম্পরাবাহিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আমরা হারিয়েছি কিন্তু তবু আধশুকনো পুকুর, ক্ষেত, কাদরের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলতে যে নেই, তেমন সুরই শোনায় জয়া মিত্রর ‘সূর্যের নিজের গ্রাম’ (২০২১) উপন্যাস। পরিশেষে নাম করা যায় শেখর মুখোপাধ্যায়ের ‘অঝোর মৌসুমি’র (২০২১)। জাতীয় উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে সীমাহীন তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট এলাকার বাস্তুতন্ত্রীয় সাম্যাবস্থাই কেবল বিঘ্নিত হয়না, এমনকি উন্নয়ন এবং পরিবেশের আন্তসম্পর্ক বিষয়ক জিজ্ঞাসাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পর্যালোচিত হয় পরিবেশ ও অর্থব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক ইতিহাস। পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আর তার নির্দেশিত উন্নয়ন ভাবনার একটি বিকল্প হিসেবে ‘Subsistence perspective’ অর্থাৎ বেঁচে থাকতে যতটুকু দরকার, ততটুকুই আয় বা উৎপাদন করার প্রয়োজনীয়তার দিকে লেখক আমাদের নজর টানেন।  

তথাকথিত উন্নয়ন ও ক্রমাগত নগরায়ণ যখন ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’ শব্দটিকে অভিধানের পৃষ্ঠা থেকে দৈনন্দিন জীবনে নিয়ে এল, তখনও মানুষ সচেতনতামূলক কোনো নীতি তেমনভাবে গ্রহণ করেনি। পরিবেশের হঠাৎ বা দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়ের কারণে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে, ঘরবাড়ি হারাতে বাধ্য হলে তাদের বলা হয় পরিবেশ জনিত উদ্বাস্তু বা ‘প্রব্রজণকারী’। ‘এনভায়রনমেন্টাল এমার্জেন্সি মাইগ্রেণ্টস’, ‘এনভায়রনমেন্টাল ফোর্সড মাইগ্রেণ্টস’, ‘এনভায়রনমেন্টাল ইনডিউসড মাইগ্রেণ্টস’  (Environmental emergency migrants, Environmental forced migrants, Environmental induced economic migrants) ভেদে এরা সাময়িক বা চিরস্থায়ী ভাবে নিজ ভূমি থেকে উৎখাত হয়। কারণ- দীর্ঘস্থায়ী খরা, জলসংকট, অতিবৃষ্টি, জমির উর্বরা শক্তি হ্রাসে খাদ্য সংকট বা তীব্র তাপ প্রবাহ। অমিতাভ ঘোষের ‘বন্দুক দ্বীপে’র বিষয়বস্তু বর্তমান সময়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা- জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিযায়ী মানুষ। জানব এদের কথাও।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *