অরিত্রী দে

পর্ব – ২১

পরিবেশ নামের এক বিকল্প সংস্কৃতির কথাকার

পরিবেশ ভাবনা আধুনিক বিশ্বে ও উত্তরাধুনিক একাডেমিক ভাবনায় একটি তাত্ত্বিক পরিসর। কিন্তু সাহিত্যে তার প্রয়োগ সবসময় সুচিন্তিত ‘থিয়োরি’র রকমে ছিল না। সাহিত্যিকের স্বতঃস্ফূর্ততাতেই পরিবেশ ভাবনা সৃষ্টিলগ্ন থেকে সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাষ্ট্রের নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পরিবেশগত মানের অবনমন ভারতীয় সাহিত্যে একটি সচেতন মাত্রা যোগ করে। ফলে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ থেকেই বাঙালী লেখকদের কাছে আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির বিচারে সুস্থ জীবনযাত্রার উপযোগী পরিবেশ মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। শরদিন্দু সাহা এই সময়ের একজন ভিন্ন ধারার লেখক। তাঁর রচনায় ‘পরিবেশ’ বলতে সমুদ্রের গর্জন, সবুজ গাছের পাতার হলদে হয়ে যাওয়ার মর্মর বেদনা, রাস্তা-মাঠ-ময়দানের ধুলো, যন্ত্রদানব আর প্রচন্ড দাবদাহে তেতো বাতাসের উচাটনে ক্লান্ত বিধ্বস্ত প্রাণের কথা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত ‘স্বাস্থ্য’ বিষয়ক সংজ্ঞা যেমন শরীরকে ছাড়িয়ে মানসিক সুস্থতার লক্ষণকেও ধারণ করে, তেমনই পরিবেশ অর্থে আক্ষরিক সবুজের বাইরেও ব্যাপকতর পরিবেশ ভাবনা লেখক শরদিন্দু সাহার লেখালেখিতে প্রকাশিত। সর্ব অর্থেই সুস্থ পরিবেশের স্পৃহা সেখানে রয়েছে। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য-

দূষণ ছড়ানোর যাবতীয় আয়োজন সাঙ্গ করে এখন বেচারা তৃতীয় বিশ্বের দিকে নজর পড়েছে…মনে রাখা ভাল, আপাত জয়লাভের কৌশলে ফন্দি ফিকিরে, অতিমাত্রায় আগ্রাসী মনোভাব আর উল্লাসে কেউ কেউ আবার নিজেদের ধ্বংসের বীজ রোপন করছেন না তো হে পরিবেশ সুরক্ষার ছদ্ম কারবারী, বিশ্ববাজারের সামন্ত প্রভুরা। ভুলে গেলে চলবে না, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরী করে, রাজনৈতিক সীমানায় কাজিয়ার ইন্দন যুগিয়ে, অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে, বিশ্বায়নের নামে এই পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের খেসারত কোন একদিন অনেক মূল্য দিয়ে শোধ করতে হতে পারে, তখন আবার আজকের এই হতভাগ্য দরিদ্র বিশ্বলোকদের করুণার পাত্র হতে লজ্জা হবে না তো!

লেখকের ‘হাওয়া বদলে যায়’ গল্পগ্রন্থে বদলে যাওয়া সময়, পৃথিবী, আধুনিকতা ও উন্নয়নের নতুন সংজ্ঞার কালে রামাশীষ, আলোময়ী, শম্ভুর মায়ের মতো একগুচ্ছ চরিত্রের দেখা পাই। তারা হঠাৎ বদলে যাওয়া দুনিয়ায় পা রাখতে কলজে ছেঁড়ার কষ্ট পায়, তবু তো চেষ্টা চালাতে হয়। তারা কেউ হয়ে যায় ঐতিহ্যের ধারক ও রক্ষক, কেউ উবে যাওয়া পেশার সংগ্রহশালা, কেউ বা প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের প্রাক্কালীন প্রাকৃতিক ইতিহাসের চরিত্র। শম্ভুর মা শুকনো নদীর এপারে অপেক্ষা করে থাকে গাঙ ভাসানো নদীর স্মৃতি আগলে। ‘আলোময়ীর পাঠশালা’ গল্পে দেখব শহরের পুঁজির গন্ধ, ড্রেনের ময়লার অপ্রীতিকর গন্ধ, খারাপ সময়ের সঙ্কটপূর্ণ গন্ধ আলোময়ীকে আচ্ছন্ন ও আক্রান্ত করতে পারে না। সে খারাপ গন্ধকে ভালো গন্ধ দিয়ে তাড়াতে পারে। তার ভালো গন্ধের আশ্লেষ তৈরি হয় পুরনো বাড়ি, অযাচিত আগাছা, মিষ্টি হাওয়ার গন্ধে। পুরনো ইট-কাঠ-পাথরে সে পুরনো সংস্কৃতিকে খুঁজে পায়, তাকে শ্রদ্ধা জানায়, তাতে বাঁচতে চায়। এই পুরনো গন্ধের উত্তরাধিকারকে সে হারাতে চায় না। পুরনোকে একেবারে উৎখাত করে নতুনকে আশ্রয় নিতে হচ্ছে- এটা আলোময়ী মানতে পারেনি। বরং চেয়েছে যে পুরনোর উত্তরাধিকারে ‘নতুন’ আসুক। বিশ্বায়নের নয়া রূপ, নগরায়নের অস্বস্তিকর দিক এবং পুরনো ঐতিহ্য, পুরনো কলকাতার ঘ্রাণ পাশাপাশি চলা রেললাইনের মতোই উঠে এসেছে। 

‘মরা গাঙে বান ডেকেছে’ গল্পে মুণ্ডেশ্বরী নদীকে কেন্দ্র করে জনপদ, গ্রাম সংস্কৃতি, আধুনিকতার সংকট, ভোগের নতুন নতুন ক্ষেত্র, শিকড়ের সন্ধানের কথা আছে। পঞ্চাননের সময়ে সেই গাঁয়ের লোকজন জাল কাঁধে নদীর পাড় ধরে সারি সারি দাঁড়াত, ঢোল-কাঁসর বাজত, পদ্মা জাল সেলাই করত। কিন্তু যখন নদীতে ধস হয়, বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে যায়, ফসলের চিন্তায় আর উপোসি পরিবারের শুকনো মুখের চিন্তায় ঘুম আসে না। যে নদী তার গর্ভে ফসল, ঘর-বাড়ি ঢুকিয়ে নেয়, সেই নদীই শুকিয়ে গেলে নদীর খাত বরাবর জনপদের পরিবার পার হয়ে যায়। আর গাছগুলো হেসে তাদের আবার ডেকে নেয়। পঞ্চানন মাটি কেটে বাঁধ তেরি করেছিল, তাদের জীবন গাছের হলুদ থেকে সবুজ হওয়া আর সবুজ থেকে হলুদ হওয়ার জীবন। নদীর রুক্ষতায় নদীগর্ভের কাছে আর যখন নদী জলে ভরা থাকে তখন নদীগর্ভের ঊর্ধ্বে ঘর বানাতে হয়। তাপসরা নদীকে নিয়ে যতই দার্শনিক কথা, সুখ খোঁজার কথা, রোমান্টিকতার কথা বলতে চান না কেন, শম্ভুরা জানে এই নদী তাদের কাছে কী। বাঁধ করা আর বাঁধ কাটা, নদী আসে আর নদী যায়- ওর ঘর ছেড়ে নীচে নামে, আবার নীচ থেকে ঘরে চলে যায়; পূর্বপুরুষের গল্পটা শম্ভুর নিজের গল্পই হয়ে যায়। অপূর্ব কেবল তার মনের পরিবর্তন খেয়াল করে। সে ক্রমে বোঝে যে নদী আছে বলেই ব্যবসা, মানুষ, একটি গ্রামের বিশ্বাস-সংস্কৃতি তথা ‘Folk’ গড়ে ওঠে; এমনকি ভেসে যায় ‘মিথ’-এর ভেলাও। আসলে নদী মানে মাটি, জনপদ, গাছ-গাছালি, মেঘ, বৃষ্টি, জল, আলো নিয়ে কোনো স্থানের ভূ-প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য। নদীটা অপূর্ব’র কাছে যৌবনবতী নারী, পরে শম্ভুর কাছে তার নিজের মায়ের মতো হয়ে ওঠে।  

শরদিন্দু সাহা’র ‘চৈতন্য প্রাঙ্গণ’ আরেকটি গল্পগ্রন্থ, যেখানে সঙ্কটের কাল রয়েছে। তবে সেখানে পরিবেশগত বিপন্নতা ছাড়াও মিশে গেছে মানব সমাজের বিবিধ বিপন্নতার দিকগুলি। নিজেকে যেমন চিনতে পারা যাচ্ছে না, হারিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক নির্ণয়ের সূত্রগুলো, পণ্যায়িত হচ্ছে অনুভূতিও। ‘অচিন অপেরা’য় মেঘ-চন্দনা-পুঁইমাচা সহ এমন দুনিয়ায় যেতে চাওয়ার কথা আছে যা আধুনিক দুনিয়ায় কেউ দেখাতে চায় না বা বলা যায় ওই আধুনিক দুনিয়াটাই বিছিন্ন। গল্পের শিশু চরিত্রটি তার মনকে ছোট হতে দিতে চায় না, ভাবনাগুলোকে মরতে দিতে চায় না- বর্তমান একবিংশ শতকীয় অত্যাধুনিকেরা যা হারিয়ে ফেলেছে। বাচ্চাটি সঙ্কট কালেও তার চৈতন্যকে বদলাতে দেয় না, ঘাসের মঞ্জরি, প্রজাপতিতে, তাজা ফুলের গন্ধে বেঁচে উঠতে চায়। যারা জায়গা দখলের লোভে জোরে দৌঁড়ায়, তাদের ত্যাগ করতে চায়। তারা চৈতন্যের রূপ নয়, বরং ‘ফ্যাশন শো’-এর র‍্যাম্প ওয়াক দেখতে চায়। চারপাশে যান্ত্রিক আর অযান্ত্রিক সত্তা, উন্নত জীবনযাত্রার ছায়ার পেছনে ছোটা সমাজের কঙ্কালসার ছবি, মারণ রোগের বিষ- তারই মাঝে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ (‘গুনাহর পটভূমি’)। সে প্রত্যাখ্যান করতে শিখে নেয় সমাজের আর পাঁচজনের বানানো দূষিত পরিবেশকে।  

‘উজানি মঙ্গল’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আক্কাস আলি, তার স্বভাব ও জীবন-যাপন প্রণালী অদ্ভুত। ‘না-মানুষ’ বস্তুর সঙ্গে সহজেই সে ভাষা আদান-প্রদান করতে পারে, সেটি তার অতীন্দ্রিয় ও স্বাভাবিক স্বত:স্ফূর্ত ক্ষমতা। সে বাস্তবতায় বাস করলেও পরাবাস্তবতায় সহজেই বিচরণ করতে পারে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে এক শকুনির দেখা মেলে, যে সামাজিক বিশ্বাসে অমঙ্গলের প্রতীক। লালিত এই অন্ধ বিশ্বাসকে আঘাত করে লেখকের শকুনি চরিত্রের নবনির্মাণ। শকুনি মানব সমাজের আত্ম হানাহানিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়ে মানুষের জন্য নিদান খোঁজে। ষোল বিঘা, ওলাইচণ্ডীকে রক্ষা করতে সে আক্কাসের সহকারীও বটে। যে জংলা ঘাস জলা ছিল সেগুলো বুজে ছোট ছোট জলায় ভাগ হয়ে হয় ষোল বিঘে জমি। নোংরা আবর্জনা বেড়ে যাচ্ছে সেখানে, যন্ত্র দিয়ে জল বের করে ওলাইচণ্ডীর মাঠ জাগিয়ে তোলা হবে। শকুনের অভিমান ছিল মানুষ জাতির প্রতি, প্রচ্ছন্ন দেমাকও ছিল কেননা আসমান জমিন মিলে তার সংসার। তাকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার ক্ষমতা কেবল আক্কাসের আছে, কোনো ভূমি আগ্রাসীদের তথা লোভী মানুষের নেই। শকুনি এরকম লোভীর প্রতিনিধি হিসেবে ভোম্বলকে দেখে, যার শাসনে তটস্থ জীবকুল। ভোম্বলদের বকলমে বাঁকা পথের কারবারিরা এলাকায় খুন-ঝামেলা চালায় ও পারস্পরিকতায় জীবন যাপনের পরিবর্তে অসুস্থ খাদ্য-খাদকের বাস্তুতন্ত্রীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে। আক্কাস আলি ভোম্বলকে যন্ত্রদানবের সমার্থক হিসেবে দেখে, সে প্রকৃতিকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে চলে মাত্র ও মাটি কেটে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র বসতি নির্মাণ করে তার হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়ে উঠতে চায়। অথচ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে আক্কাসের মুখ। ঘৃণার রাজনীতি পুড়িয়ে ফেলতে পারেনি তার সুপ্ত ইচ্ছাকে- প্রকৃতি কেন্দ্রিক বাংলার স্বপ্নকে, প্রকৃতির সঙ্গে পারস্পরিকতায় মানুষের বাঁচার স্বপ্নকে। মানুষের আগুপিছু হওয়ার খাবলা খাবলি তাকে বিব্রত করে। আধুনিক গোছানো সমাজ অগোছালো প্রকৃতিকে দূরে ঠেলেছে- তার বিরুদ্ধে আক্কাস বলতে চায়। 

শকুনি দম্পতিরা দেখে কারা যেন তাদের বসবাসের জন্য বরাদ্দ খোঁদল বুজিয়ে ফেলেছে। এমনকি ভাগাড়েতে পড়া পশুগুলোর চামড়াও তুলে নিচ্ছে ব্যবসায়িক দরকারে। আক্কাস আলি যখন তার বুঁদ হওয়া খেয়ালে ধরে ফেলতে চায় ষোলো বিঘা আর ওলাইয়ের জীবনচরিতের খেয়ালখুশি তখন শকুনি-মানুষের মিতালি হয়। এলাকার নিষ্পাপ একটি মেয়ে খেলার ছলে চোখ বন্ধ করে গাছে গাছে মিতালির স্বপ্ন দেখে। আক্কাস আলিও সেই বাংলা চায় যেখানে ঘরে ঘরে বাতি জ্বলবে, পাখির ডাক শোনা যাবে, শস্য দানার গন্ধ থাকবে। সে হিসাব খোঁজে কবে মাটির সোঁদা গন্ধ পৃথিবীময় ছড়াবে, আবার নরম আলো উঁকি দেবে বাঁশ বাগানে, জোছনা সুন্দরীর নাচ ছড়িয়ে পড়বে কল কল করা টইটুম্বুর জলে। সে মগডালে পাখির ঝাঁক খেয়াল করে, তাদের রঙবেরঙ পালকের ঐশ্বর্যকে লুকিয়ে রাখতে চায় বিপন্নতার কালের স্পর্শ থেকে। উদ্বাস্তু পাড়াতেও খাদ্য খাদকের সুষ্ঠু বাস্তুতন্ত্র তৈরি করতে চায়। যেন ওলাইচণ্ডী আক্কাস-এর কাছে আর্তি জানায়- “ওরা আমার বুকে জমে যাওয়া নীল জল ঘোলাটে করবে, ভ্রষ্ট করে দেবে আমার গর্ভ, আমার ভ্রূণের করবে অপমান।” আলিও শপথ নেয় নীলকন্ঠ হওয়ার, সে বিষাক্ত হতে দেবে না ক্ষীরোদ সাগর রূপী প্রকৃতিকে। তার মনে হয় শত্রুরা কুমারী প্রকৃতিকে ‘প্রসেসিং’ করে তথা ধর্ষণ করে যে রূপ দিয়েছে তা বেশ্যার রূপ। তাকে পুঁজি বানিয়ে ওরা ব্যবসা ফাঁদবে। মায়ের মতো ওলাইচণ্ডিকে জড়িয়ে ধরলে চরিত্রায়িত ওলাইচণ্ডিও কেঁদে ফেলে আলির বুকে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে পকেটবন্দি করে যারা রাজত্ব কায়েম করার সূত্রে ‘সোশ্যাল হায়ারার্কি’তে অবস্থান করে, ব্যক্তিগত মুনাফায় ফুলে ফেঁপে ওঠে, তাদের অত্যাচার ও আধিপত্যের বিপরীতে বিদ্রোহ তৈরি হয়। 

বিপন্নতা ও সংকটকালীন নিরর্থকতায় মানুষও যেন নিজেকে চেনার সূত্রগুলো হারিয়ে ফেলেছে- “সেলাই মেশিনের লোহার চাকতিতে অভ্যস্ত হয়ে নিজেদের দক্ষতা বেচে দেয়।” পৌনপুনিকতার ক্লান্তি, হতাশার ছবিটি বড় সুন্দরভাবে নির্মিত হয়েছে। তারা হয়ে গেছে যেন বন্ধ্যা-নিষ্কর্মা-চুপ। ফলে শকুনিগুলো এতকাল দেখে শুনে বোকা হয়ে থাকলেও এবারে শুরু করেছে চেঁচামেচি। এবার মাঠ কথা বলবে, গাছ কথা বলবে, আজ বাদে কাল তারা আর আলিতে মিলে যেন এক বিকল্প পথের খোঁজ লাগিয়ে দেয়। তিল তিল করে বেঁচে থাকার যে পথ তৈরি আছে বনৌষধির মতো, তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বুঝতে চেয়েছে যে হিংসা ও আধিপত্যের পথ সামনে খোলা রয়েছে তা একমাত্র পথ কিনা। আলিরও ডানা গজায় শকুনির মতো। যখন ষোলো বিঘা আর ওলাইচণ্ডির সবাই যন্ত্রচালিত মৃত তখন আক্কাস আলি দিব্যি বেঁচে থাকে। কারণ তার অবলম্বিত ভাবনায় ও জীবনপথে জাত-বেজাতের বিচার ও বিভাজন আলাদা করে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কবরস্থানের বটগাছ, দূরের কৃষ্ণচূড়া অনেককাল চুপচাপ বসে দেখেছে, এবার কথা বলবে। ওদের সঙ্গে আলির রীতিমতো কথা হয়- সংগ্রাম শুরু হলো বলে; চলতি সমসাময়িক ইতিহাসের এক পাল্টা ইতিহাস তারা রচনা করবে। এখন বিপন্নতার কাল, ভূমি শিথিল, বীজ বুনে ভূমিকে শক্ত আর দৃঢ় করতে গেলেও পেতে হবে সেই বীজের উত্তরাধিকার। অনেক সৃষ্টি, ধ্বংস আর পুনরায় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অগোছালো পদযাত্রায় তৈরি হবে পরবর্তী অনুসন্ধানের পুরোহিত। শিল্পী যেমন ভূমির সাজঘরে আলো ফেলে পরীক্ষা করে বীজ বুনতে চেয়ে, তেমনি বীজও তো খুঁজে ফেরে কোথায় সে তার জন্মের বার্তাকে বয়ে এনে রোপণ করবে! যদিও আনচান মোহ আর গতি পরিবর্তনের খেলায় উন্মত্ত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মনে হয় মাটির কোলে লুটিয়ে পড়বে বীজ, তবু ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে না। শিল্পী হাল ধরে।  শিল্পী হিসেবে মানুষ রূপকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে নিজের জমি মজবুত করতে চেয়েছে, স্বার্থের কথা ভেবেছে, শাবল-খন্তা-কোদাল-কাটারি নিয়ে দলে দলে অভিযান চালিয়েছে।  উন্নয়নের পথে সেই শিল্পীর দল শুধু সৃষ্টির বদলে উৎপাদনের উন্মাদনায় এমনই বুঁদ হয়ে থেকেছে যে পরিমন্ডলকে বশে আনার দক্ষতা রপ্ত করেছে। ফলে বীজ অভুক্ত থাকে দিনমানে, অশ্রুতে চোখ বোজে, ভূমি ওজন করে নেয় অবশিষ্ট যৌবনের কতটুকু ‘ধারণ ক্ষমতা’ নিঃশেষ করলে তার ধারণ ক্ষমতা লোপ পাবে। কিন্তু দেখা যায় বীজ তার সুস্থির প্রদক্ষিণে জেগে থাকে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *