মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

পর্ব – ২২ 

আমাদের সেই দোতলার দুটি ঘরের বড় ঘরটিতে বাবা মায়ের সাথে আমরা থাকতাম দাদু অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত। তখন বছর পাঁচেক বয়স হলেও মনে আছে সেই দিনটার কথা যেদিন বাবুনকাকাদের (চিত্রদীপ ভাদুড়ী) বাসাবাড়ি ছেড়ে আমরা পাকাপাকি রাস্তার উল্টোদিকে দাদুর সাথেই থাকতে চলে এলাম। বাবা মা পদ্মপিসি সবাই ঘরটা ধুয়ে মুছে অল্পস্বল্প আসবাবপত্র গুছিয়ে রাখছিল। মনে পড়ে সেই দিনটার কথাও, ভাইয়ের অন্নপ্রাশনের দিন আত্মীয় স্বজনে ঘর ভর্তি। বাবার দিদিমা, জেঠু, আমার দাদু দিদা, মাসিরা আর চেনা মানুষেরা। ছোটো ছাতেই প্যাণ্ডেল করে অন্নপ্রাশনের আচার পালন, হোম যজ্ঞের ব্যবস্হা। সকাল থেকেই ছবি তোলার আয়োজন। 

এই ঘরটাতে কেটেছে আমার আর ভাইয়ের খুনসুটির আর ভালোবাসার অনেক মুহুর্ত। আমার ভোরের স্কুলে রেডি হবার সময় ভাইয়ের নিশ্চিন্ত ঘুম দেখে বড় দুঃখ হতো। কয়েক বছর পরও যখন স্কুল যেতে শুরু করলো তখন ভারি মজা লাগল। কিন্তু ততদিনে আমি তো হাই স্কুল, সকাল সকাল উঠে পড়তেই হতো। স্কুলের জন্য নয়, গলা টলা সেধে পড়তে বসার জন্য। 

এই ঘরটায় আসবাবপত্রগুলো মাঝে মাঝেই জায়গা পরিবর্তন করত, অর্থাৎ আমার বাবার খেয়ালখুশি মতো আজ যদি খাট থাকে উত্তর দক্ষিণে, কয়েক মাসের মধ্যেই চলে যাবে অন্য দিকে। আজ ড্রেসিং টেবিল দরজার পাশে তো কাল অন্য কোথাও। তবে যেখানেই খাট যাক, সেই অনুযায়ী প্ল্যাগ পয়েন্ট তৈরি হয়ে যাবে কারণ রাতে বালিশের কাছে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে প্রসাদ আলোকপাত সানন্দা কি খেলা না পড়লে, দু লাইন না লিখলে বাবার ঘুম আসত না। আবার অনেক অনেক রাত না ঘুমিয়ে বুকের কাছে বালিশ নিয়ে বসে থাকত হাঁপানির টানে। 

ভাই যখন স্কুলে যাবার মতোও বড় হয় নি তখন আমার আর ভাইয়ের খুব মজার একটা খেলা ছিল। এই খেলাটা আমরা বিছানায় খেলতাম। খাটের একপাশে মাথার বালিশ, পাশবালিশ সাজিয়ে সিংহাসন বানাতাম। কখনও আমি রাজা হতাম, কখনও ভাই। কখনও রাজার আসন ফাঁকা থাকত। আমরা অভিযোগ নিয়ে রাজসভায় যেতাম। খেলার সব প্লট আমার বানানো, ভাই আমার কথা মতো খেলতো। ভাবলে আমার এখন কি অদ্ভুত লাগে! 

খেলতে খেলতে মাঝেমাঝে ঝটাপটি লাগতো না তা নয়। তখন পাশের ঘর থেকে দাদুর বা একতলা থেকে মায়ের ধমক ধামক ভেসে আসতো। 

ঝগড়াঝাটি যেমন ছিল তেমন ছিল শয়তানিতে সাথ দেওয়াও। এটা বেশ বড় বয়সেরই একটা ঘটনা। বিছানার ওপর মারামারি চলাকালীন ক্যাঁচ শব্দে মারপিট থেমে গেল। লাফিয়ে খাটের তলায় ঝুঁকে বুঝলাম মাঝের কাঠটায় চিড় ধরেছে। খাটের তলায় দুজনে ঢুকে পড়লাম ঝটপট। দাদুর বাতিল হওয়া বইপত্র ঠাসা একটা অ্যাটাচির ওপর আরও দুটো পুরোনো বই চাপিয়ে ঠেকনা দিলাম আচ্ছা করে। কয়েকদিন ধরা পড়ার ভয়ে দুজনেই কাঁটা। তারপর দিব্যি ভুলেই গেলাম। বেশ কয়েক বছর পর খাট সরানো হলে মনে করা হলো এমনই পুরোনো কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। ভাগ্যিস বাবার এদিক ওদিক আসবাব সরানোর নেশাটা কমে গেছিল ততদিনে!

বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এলে এই ঘরের মেঝেতেই পড়তো সতরঞ্চি, কম্বলের প্রলেপ। অপেক্ষাকৃত পুরোনো মশারির সাথে জোড়া হতো সুতলি বা গেঞ্জির দড়ি আর জানালার শিকে বা দেওয়ালের ক্যালেণ্ডারের পেরেকে লেগে আঁকাবাঁকা ঝুলন্ত মশারির তলায় শুয়ে গল্প করতে করতে মাঝ রাত পার হয়ে যেত। আত্মীয় স্বজনদের সাথে এখনকার মতো ঘন ঘন দেখা বা কথা হতো না কারো, তাই কার ছেলের চাকরি হলো, কার মেয়েটার মোটে ভালো সম্বন্ধ আসছে না, পুজোয় এবার কাকে কাকে তত্ত্ব দেওয়া সম্ভব হল না, কার বড় কঠিন অসুখ সব খোঁজ খবরে রাত পাড় হবার জোগাড় হতো। ছোটরা পছন্দের আত্মীয়ের গা জড়িয়ে এই সব আগডুম বাগডুম শুনতে শুনতে ডুব দিত ঘুমের অতলে। আমার দিদা দাদু মেদিনীপুর থেকে কালনা গেলে আমি সব থেকে বেশি খুশি হতাম। 

এই প্রসঙ্গে আর একটা দিনের কথা মনে পড়ল। আসলে স্মৃতি কোনো ক্যালেণ্ডারের দাগ ধরে ধরে মনে উঁকি দেয় না, যেন ছলকে ওঠে নদীর ঢেউয়ের মতো। 

জগন্নাথ সুর পেশাগত ভাবে মেডিকেল ম্যান হলেও ওনার শখ ছিল নানা শব্দ নকল করায়। আমরা তাঁকে অনায়াসে হরবোলা বলতে পারি। উনি কাজের সূত্রে বাবার ডিসপেনসরিতে আসতেন। পরে ওনার সাথে বাবার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কাকিমাকে নিয়ে একদিন কাকু এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। সেই সুন্দর দুপুর আর বিকেলের কথা আজ হঠাৎই মনে এলো। বাবার অনুরোধে কালনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু সব থেকে বড় পাওয়া হল এই যে, পরে আমার বিয়ের সন্ধ্যায় উনি ভূতের রাজা সেজে অতিথিদের আনন্দ দিয়েছিলেন। মাতিয়েছিলেন বাসরের আসরও। ততদিনে তিনি দূরদর্শন খ্যাত হয়েছেন। দুঃখের কথা আমার বিয়ের ভিডিওটি নষ্ট হয়ে গেছে। আর অনেক দিন ওনার সাথে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *