মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
বিংশ পর্ব
অল্প বয়স থেকেই বাবা জেঠার লেখালেখির অভ্যাস ছিল। সেই সময়কার স্থানীয় পত্র পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লেখালেখি করত। আর একটা ভালো ব্যাপার ছিল, কালনার সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্য করে ক্লাবগুলো স্মরণিকা প্রকাশ করতো। আমি তাই ছোট থেকেই বাড়িতে লেখালেখি ও পত্রিকার আনাগোণা দেখে আসছি। অম্বুকণ্ঠ সীমায়ন হোত্রী পল্লিবাসী সাম্প্রতিক এইসব নানা পত্রিকার কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে।
অসীম (ঘোষ) কাকুর অম্বুকণ্ঠ ছিল চমৎকার একটা পত্রিকা। খবর ও সাহিত্যের সুপরিবেশন করতেন কাকু। নিজের লেখার হাতটা অসাধারণ ছিল। রম্যরচনা আর ছোটগল্পের জাদু কলম ছিল সাথে। আমাদের পাড়াতেই বর্মণ ডাক্তারবাবুর গলিতে ঘোষবাড়ির একদিকে ছিল অম্বুকণ্ঠের প্রেস, অফিস ঘর।
আমি তখন কলেজ। বাবার মনে হয় শুধুই লেখালেখিতে মন ভরছিল না, একটা নিজস্ব পত্রিকার কথা ভাবছিল মনে। অম্বুকণ্ঠের কাজের সাথে কিছুটা জড়িয়ে গেল। আমিও কেন জানি না, জড়িয়ে পড়লাম। বন্ধু পেলাম দীপান্বিতাকে। খবরের খোঁজ করা, ফিচার লেখা এইসব সময় পেলেই করতাম।
এরই মাঝে বাবা ঠিক করে ফেলল, ছোটদের জন্য নতুন পত্রিকা হবে। ছোটদের আঁকা লেখাও থাকবে, আর ছোট্ট করে ফোল্ডার ফর্মে হবে। আমার আর ভাইয়ের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা। নাম নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হল। শেষে বাবা বলল, যেহেতু ফোল্ডার হবে, তাই ‘পরত’ বা ভাঁজ হোক এর নাম। প্রাথমিক ভাবে মূলত ছড়াই ছাপা হবে এই চিন্তা থেকে ‘ছড়াপত্র পরত’ নামকরণ করা হল। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম সংখ্যাটি জন্ম নিল।

পরতের প্রথম পুজো সংখ্যায় সঞ্চিতার সম্পাদক বর্তমানের অন্যতম সুপরিচিত কবি ও গল্পকার তরুণ সরখেল পরতের নামকরণ নিয়ে ভারি সুন্দর লিখেছিলেন।
‘ফোল্ডার’ আর ‘পরতে’
কি তফাৎ জানো?
খুব বেশি নেই তফাৎ
এ কথা কি মান?
‘ফোল্ডার’ ইংরেজি
বাংলায় ‘পরত’,
যেমন ‘অটাম’ হল
বাংলায় শরৎ।
যাই হোক, প্রথম পরত প্রেস থেকে বাড়ি এল বাবার হাত ধরে। একটু মোটা কাগজে ছাপা। হাতে হাতে তাদের মুড়ে ফোল্ডার করে ফেলা হল।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, ঠিক কি উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমিতে বাবার নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানেই পরতের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়েছিল। তারপর কয়েকদিন ধরে চেনা পরিচিতদের মধ্যে ওদের বিলি করা হলো। লেখাও খুব পরিচিতদের ছিল। কিন্তু সৌভাগ্য, দু তিনটে সংখ্যার মধ্যেই পরত ব্যপক পরিচিতি লাভ করল। ছড়াপত্র পরত তখন প্রতিমাসেই প্রকাশিত হতে থাকলো। এবং পরত দপ্তরের ফাইল দূর দূরান্তের কবি লেখকদের লেখায় ভরতে শুরু করল। সেই সময় সোস্যাল মিডিয়া স্মার্ট ফোন দূরে থাক সাধারণ মোবাইল ফোনও সকলের ছিল না। ভাবতে ভালো লাগে, সেই সময়ও দ্রুত পরতের প্রচার ও প্রসার হয়েছিল। ফলে পরত আর তার জন্মের রূপ ধরে রাখতে পারলো না। ফোল্ডার রূপ ছেড়ে বহু পাতার পত্রিকা হওয়ার পথে পা বাড়ালো। আস্তে আস্তে আমরা গ্রাহক আর সদস্য সংগ্রহ করতে লাগলাম। আর ছোটদের বিভাগটা, যার নাম ছিল, ‘ছোট্ট সোনার পাতা, ভরিয়ে তোলার জন্য আমি চেনাশোনা সব বাচ্চাদের কাছে আব্দার করতাম। আমার টিউশন ব্যাচের মধ্যেও পেয়ে যেতাম উৎসাহীদের। এর মধ্যে পরত একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলল। প্রথম বর্ষের পঞ্চম সংখ্যাটি বিক্রির মাধ্যমে অনুদান সংগ্রহ করে কার্গিল তহবিলে বেশ কিছু টাকা দান করা হল। কালনার বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মাননীয় সৌমেন পাল মহাশয় এই সংখ্যাটি সম্পর্কে লিখেছিলেন,
‘সংগৃহীত অর্থ কারগিল যুদ্ধে নিহত ভারতীয় জওয়ানদের উদ্দেশ্যে দান করা হলো মুখ্যমন্ত্রীর সেনাকল্যাণ তহবিলে। নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রাখলেন সম্পাদক কুমার চট্টোপাধ্যায়’।
একটা বছর কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছিল জানি না। বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের জন্য বাবা নেচে উঠলো। সেই কারণে গুণীজন সংবর্ধনা, কবি সম্মেলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন চলতে লাগলো। বাবার কথা মতো নানা কাজে সাহায্য করছি। স্থানীয় পুরশ্রী মঞ্চে অনুষ্ঠান হবে। অনেক কবি লেখক যাঁদের লেখা এতদিন শুধু বইয়ের পাতায় পড়েছি তারা আসবেন বলে বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
দেখতে দেখতেই চলে এল অনুষ্ঠানের আগের দিন। বিকেল থেকে প্রবল ঝড় বৃষ্টি, লোড শেডিং। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের আগের দিন পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁরা সেই সব উপেক্ষা করেই হাজির হলেন।

তিরিশে এপ্রিল সারাদিনব্যাপী ছড়া উৎসব, কবি সম্মেলন, গুণীজন বরণ চলল হইহই করে। তখন স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। কিন্তু এখন মনে হয় বড্ড বোকা ছিলাম। সেই অপূর্ব অকল্পনীয় অনুষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে রাখা দরকার ছিল। তখনকার মানুষজন অনেক সহজ সরল আন্তরিক মনের অধিকারী ছিলেন, না হলে এত গুণী মানুষরা এক ডাকে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, দুর্গাপুর থেকে কালনায় চলে আসতেন না একটা ছোট পত্রিকার এক বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। কাছাকাছির সাহিত্য বন্ধুরা তো ছিলেনই। এই পরিণত বয়সে ভাবি, এমন কিছুই আতিথেয়তা হয়ত আমরা করে উঠতে পারিনি, কিন্তু ধন্য হয়েছিলাম তাঁদের পদধূলিতে। যাঁদের সম্মান জানিয়ে পরত ধন্য হয়েছিল তাঁরা হলেন, শ্রদ্ধেয় ভবানী প্রসাদ মজুমদার, মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, জগদীশচন্দ্র রায়, অমিয় কুমার সেনগুপ্ত, অজিত ভট্টাচার্য, অসিত দত্ত, প্রবীর জানা, অমল ত্রিবেদী, কার্তিক ঘোষ, বিদ্যুৎ পাল, সনাতন চক্রবর্তী, দোলগোবিন্দ মুখোপাধ্যায়, বিজলী প্রভা বিশ্বাস প্রমুখ। এঁদের অনেকেই আজ আর আমাদের মধ্যে সশরীরে নেই কিন্তু আছেন তাঁদের সাহিত্যের জগতে অবদানের মাঝে। যুব সাংবাদিক হিসাবে উৎসাহ প্রদান করা হয় দীপান্বিতা বসু ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বর্তমানে যথাক্রমে প্রতিভাস আর ভাষাপথ পত্রিকার মাধ্যমে এই দুইজন তাদের পরিচয় রেখে চলেছেন। উল্লেখযোগ্য, ওই মঞ্চেই বর্ধমানের কবিতা সন্ধ্যার তরফে সম্মানিত হন শ্রদ্ধেয় স্বপন সেন ও তপন কুমার বৈরাগ্য মহাশয়।
পরতের এই সুন্দর দিনগুলোতে পাড়ার প্রতিটা মানুষের ভালোবাসা ছিল আমাদের পাথেয়, পরতে লেখা বা আঁকা প্রকাশ নিয়ে ছোট ছোট ভাই বোনদের উৎসাহ ছিল আমাদের জেদ। এছাড়া অনুপকাকা, অর্ণবদা, রাহুলদা, সোমনাথদা , ওদের পুরো বন্ধুদের টিম, বিধানদা, ক্রিয়েটিভ কোচিংএর কর্ণধার নিমাই পাত্র সব্বাই ছিল পরতের একান্ত আপন। আর এইভাবেই সকলকে নিয়ে আরও অনেক বছর ছুট লাগিয়েছিল পরত।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)