মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
ঊনবিংশ পর্ব
শীতের হাওয়ায় ঠোঁট ফাটার ব্যথার মতো কিছু ব্যথাও ঋতুর সাথেই ঘুরেফিরে আসে। হারিয়ে যাওয়া ঠিকানার সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া অভ্যাস চিনচিনে ব্যথা জাগায় মনে। আচ্ছা, কালনায় এতকাল কাটানো মানুষের শীতকালে রোজ নলেনগুড়ের মাখা সন্দেশ খেতে না পারার দুঃখ কি কিছু কম!
শীতের হাওয়া তাই এক ঝটকায় অনেক কিছু মনে করিয়ে দিল এই মুহূর্তে। পৌষের শেষ মানেই ওপারের একান্ন হাত কালী আর মেলা। পাশে হরিঠাকুরের উৎসবের কথা ছোটবেলার স্মৃতিতে নেই, যেমনটা দেখেছি ইদানিংকালে। দুপুরের খাওয়ার পর তাড়াতাড়ি দল বেধে খেয়াঘাটে ছোটা। হাতে বাওয়া নৌকায় গঙ্গার ওপরের হু হু শীতল বাতাস উপেক্ষা করে পার হওয়া। রোদের মিষ্টতা হাওয়ার তিক্ততার সাথে লড়াই লাগায়। গঙ্গার ওপারে বাদাম, মটরশুঁটির চাষ। শুকনো বালির ওপর হেঁটে এসে প্রতিমার দিকে ঘাড় তুলে চাওয়া। দুদিকে ভয়ঙ্কর ডাকিনী যোগিনী। ছোটবেলায় ভয় আর বিস্ময় মিলেমিশে থাকত। বড় হয়ে খুঁতখুঁতে হয়েছি এত বড় প্রতিমার গঠনের অসামঞ্জস্য দেখে। আবার পরবর্তী কালে অন্যভাবে মজা পেয়েছি আমার পুচকে ছেলেকে একই সাথে আমারই মতো ভীত ও অভিভূত হতে দেখে।
মেলা বসেছে নদীর পাড়ে। বাবার কাছে বায়না করেছি এটা ওটা কেনার। খাবারের স্টল বলতে তখন ফুচকা বাদাম কি পাঁপড়ভাজা। নৃসিংহপুর তখন এক্কেবারে গ্রাম। নদীর ঘাটে জেটি নেই। মেলা দেখার ফাঁকেই আমরা ছুটতাম রাধা কাকিমার বাড়ি। একেবারেই মেলা লাগোয়া। দাদু বাবার ওষুধ খেতেন ওরা। নৃসিংহপুর থেকে অনেকেই সে সময় আমাদের ডিসপেনসারিতে আসতো। ওনারা কালনায় পরে বাড়ি করে চলে আসেন।
কখনও কখনও শীতের বেলা পিকনিক করে কেটেছে গঙ্গার ওপারে। old is gold বলে সকলে। শীতের রোদ তো সেই সোনাই।
ছোলার শাক এই সময়ের আর একটা লোভনীয় খাবার। কোনো কোনো দিন বাড়ির একফালি ছাতে বসে ছোলার নরম পাতাগুলি আঙুলে করে টেনে টেনে আলাদা করে মাঝের শিরা থেকে আলাদা করছি, পাশে চুপটি করে বসে আমার পটকা বিড়াল, এমন স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখে।
দু এক বছর বাবা প্রচুর শীতের গাছ করেছিল ছাতে। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, বোতামফুল। আমার আর ভাইয়ের খুব আনন্দ হয়েছিল সে সব দিনে।
ছাপোষা সংসারে তখন টব বাগানের বিলাসিতা বিশেষ কারো ছিল না। তবুও শীতের ফুলের টান উপেক্ষা করাও অনেকের কঠিন হতো।
আমাদের স্কুল হিন্দুবালিকা ছিল শীতের ফুলের স্বর্গরাজ্য। সরস্বতী পুজোর মুখে বড় গেট দিয়ে ঢুকলেই সারিতে লাগানো গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া হেসে হেসে সম্ভাষণ করত। আর দুপাশে ইতস্তত ভিড় করে থাকত প্যানজ়ি সিলোসিয়া ক্যালেন্ডুলারা। গোলটেবিল পার হয়ে সামনের প্রার্থনার উঠোনে শেষে পুজোর বিল্ডিং বা পেয়ারাতলা বিল্ডিংয়ের লাগোয়া এক ফালি অংশ ছাড়া থাকত শুধু ডালিয়াতে সাজবে বলে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই স্হান তার কৌলিণ্য হারিয়েছে স্হায়ী ফুলগাছ যেমন জবা বা টিকোমা রোপন করার ফলে। বাহাদুরের ঘর সংলগ্ন মাটিতে পুরোনো দুই গোলাপ আজও একই রকম সুন্দরী। মোবাইল যুগে সেলফি কর্ণার বলো আর ফটোশ্যুট স্পট বলো, সেরা কিন্তু এই গোলাপ ঝোপ।
হরেক কিসিমের ফুল চেনা আর চোখ জুরানোর আর এক বাৎসরিক আয়োজন হতো কালনা রিক্রিয়েশন ক্লাবের পুষ্প প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনী শেষে পুরস্কার থাকতো ফুল মালিকদের। মনে আছে, সবুজ গোলাপ দেখে একবার খুব অবাক হয়েছিলাম। আজকাল গুগল সার্চ করলে নানা ফুলের পরিচয় ও পরিচর্চার হাল হকিকত জানা যায়, নানান বাগানপ্রেমীদের দলে সোস্যাল সাইটের মাধ্যমে ভিড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু নতুন একটা গাছ দেখে ছোটবেলার সেই বিস্ময় আর কোনো ভাবেই ফেরত পাওয়া যায় না।
সুভাষ পাঠাগারের একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার কথা কালনার মানুষ ভুলবে না। ডেইলি সোপের রমরমার যুগে ভাবতে অবাক লাগে প্রতিযোগিতার এই তিন চারটে দিনের জন্য সারা বছর আমরা কেমন মুখিয়ে থাকতাম। কেমন একটা দুটো সিজন টিকিট কেটে টাইম স্লট ম্যানেজ করে কয়েকজনে দেখে নেওয়া যেত পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু ভালো থিয়েটার দলের পরিশ্রমের ফসলকে। এই উপলক্ষে প্রকাশিত হতো পাঠাগারের মুখপত্র ‘এবং মহুয়া’।
সাহিত্যের পড়ুয়া হিসাবে এই নাটকগুলি দেখার সাথে সাথে যে বিশ্লেষণ চলতো মনে তা ফলাফল প্রকাশের সময় মিলিয়ে দেখতাম। সমৃদ্ধ হয়েছি, সন্দেহ নেই। এখনও সত্যিই সেই সন্ধ্যের গমগমে পুরশ্রীকে মিস করি। মিস করি শো ভাঙা রাত।
আর অদ্ভুত ভাবে নাটকের কথা লিখতে লিখতে আবার যে ব্যথাটা ঘুরে ফিরে আসছে সেটা শুধু শীতকালের সঙ্গে আঁটা নয়, সেটা সব সময়ের। সেটা ‘ব্যারিকেড’ ভেসে যাওয়ার ব্যথা। যে প্রাণশক্তি ছেলে মেয়ে জোগাড় করে, মহরা দেয়, ফাণ্ড জোটায়, স্টেজ সাজায়, হাততালি বা গালাগালি পাবার পর আবার রং তোলে, প্রপ গোছায়, আবার ঘরে ফেরে, নতুন স্ক্রিপ্ট খোঁজে সেই প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষগুলোর অর্ধেক নেই হয়ে গেছে; হাজার চেষ্টা করলেও আমাদের আর সবাই মিলে স্টেজে ওঠা কোনো দিনও হবে না ভাবলে আরও শীতলতা আমাকে পেয়ে বসে।
ঘন ঘন পাড়ায় কারো বাড়ি পিকনিকের দিন, হুটোপাটি করে এক সাথে মা কাকিমাদের রান্না করা ফুলকপি মটরশুঁটি দেওয়া খিচুড়ি খাওয়ার রাতগুলোও ভেসে গেছে অনেক অনেক দূরে। কিছু বোকামি, কিছু আবেগ, কিছু খুচরো লাভ, কিছু বিতর্ক সব কিছু তাৎক্ষণিকতায় শেষ হবার পরেও যা থাকে তা স্মৃতি। সেই স্মৃতিতে থেকে যায় মা, সুপ্রিয়া কাকিমা, কল্পনা কাকিমাদের রান্নাবান্না, ঠাট্টা হাসির রেশ, থেকে যায় কৃষ্ণা, মিঠু, পকাই, ভাই বা আমার মজার মুহুর্ত, পিঠের গন্ধ, চন্দ্রমল্লিকার শুকনো পাপড়ি আর অনেক অনেক সময় ও রাস্তার দূরত্ব।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)