মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

সপ্তদশ পর্ব 

আমাদের ডাঙাপাড়ার বাড়িটা ছিল ছোটদের রাজত্ব। আমার পুতুল খেলার বয়সটা তাই যেন থামতেই চাইতো না। আমার যত খেলনা, পুতুলের সংসারের সামগ্রী ছিল সেগুলো কিছু ভাইয়ের হাতে বধ হয়েছিল। সিংহভাগটাই যত্নে রাখা ছিল। আমার ছেলের হাতেও তার কিছু অবশিষ্ট আছে। বধ হয়েছিল তা বলার কারণ অবশ্যই আছে। টেলিভিশনে রবিবারের রামায়ণের আবির্ভাবের পর খেলনা জগতে প্লাস্টিকের তির ধনুক, গদা, তরবারি ইত্যাদির এবং ছোটদের বইখাতার মলাট অলংকরণ জগতে রামায়ণ সিরিয়ালাংশের রঙিন স্টিকার, নেমপ্লেট ইত্যাদির আবির্ভাব ঘটে। আমার বড় বড় প্লাস্টিক ডল তখন ভাইয়ের চোখে সূর্পনখা অথবা তাড়কা প্রতিপন্ন হয়। তিরের দ্বারা তাদের নাক কান ফুটো করে তারপর খতম।

যাই হোক, খেলনাপাতি পুতুলটুতুল এই সবের লোভ দেখিয়ে আমি যত পাড়ার ছানাপোনাদের ডেকে আনতাম। খেলার সাথিরা বড় হয়ে গেছে, উঁচু ক্লাসে উঠে গেছি, কিন্তু ছোটদের সাথে না খেললে, বকবক না করলে আমার মন যেন শান্তি পেত না। আসলে আমার বাবাও খুব ভালোবাসতো বাচ্চাদের। বাচ্চাদের আসল নাম বাদ দিয়ে নানা রকম নামকরণ করতো। নানান মজার মজার গল্প বলতো। ছোটদের ভালোবাসার জায়গা থেকেই তো ছড়াপত্র পরত প্রকাশের চিন্তা, যেখানে ছোট্টসোনারা আঁকবে, লিখবে।

পাড়ার শর্মাদের বাড়ির বড় তরফের বড় ছেলে সুরেশদার দুই সন্তান রিশু আর গুড়িয়া। ওরা ঠিক এক বছরের ছোট বড়। দুজনেরই জন্মদিন ছাব্বিশে জানুয়ারি। রিশু আর গুড়িয়া ছিল আমার দুই পুতুল। টুকটুকে রঙ, গোলাপী ঠোঁটের দুটি শিশুকে যেন এখনও মনে মনে কোলে তুলে লোফালুফি করি। গুড়িয়ার সাথে আমার বাবার রসায়ন ছিল আলাদাই। ওদের পরিবার নিরামিষ আহার করত। স্বাভাবিক ভাবেই ওরাও তাতেই অভ্যস্ত হচ্ছিল। আমাদের ঘরেও ওদের নিরামিষ দিতাম। গুড়িয়া মাছ দেখলে ভীষণ রেগে যেত। আর আমাদের খেতে বারণ করত। তাই আমরা ওকে মাছ খাওয়াব বলে রাগাতাম। আমার বাবাকে ও কেঁদে কেঁদে বলত, ‘দাদু মছলি নেহি’, যেন বলতে চাইতো, আর যে যাই করে করুক, তুমি আমার প্রিয় দাদু, তুমিও মাছ খাবে!

খুব দুঃখজনকভাবে একটা দুর্ঘটনায় কোলের শিশুদুটি ওদের বাবাকে হারায়। ফলে সকলেই ওদের খুব ভালোবাসতো।

আমার শেফালি পিসির কথা তো আগেই বলেছি। পিসির বড় নাতি বাবুও (প্রশান্ত) প্রায় আমার কোলে মানুষ। ছুটিছাটার দিন আমি আর ভাই দুপুরে খেয়ে উঠলে আমাদের মাঝে শুয়ে গল্প শুনতে আর হাবিজাবি বকতে বাবু কি ভালোই না বাসতো!

বাবুর দুই কাকার দুই ছেলে, বাবুয়া(আদরের নাম পটকা) আর গোপাল, নিজের বোন সুস্মিতা, এদের সকলকে নিয়ে বড় মজায় কেটেছে অনেক ছুটির বেলা।

একতলায় ওষুধের দোকানের কথা আগেই বলেছি। অনুপ লোধ কাকার মেয়ে আয়ুশি ছিল আমার আরেকটা খেলার পুতুল। দীর্ঘদিন অনুপ কাকারা সত্যময় পাঠগারের কাছাকাছি শান্তা ডেকরেটার্সের মালিকের বাড়িতে ভাড়া থাকতো। দিনের মধ্যে অনেকবার বাড়ি থেকে কারোর না কারোর সাথে সে দোকানে চলে আসতো। ওকে কোলে বসিয়েও টিউশন ব্যাচ পড়িয়েছি কত দিন। 

আর খুব মনে হয় ছোট্ট গুলুমুলু চচ্চড়ির (প্রাপ্তি সান্যাল) কথা। আমরা মজা করে বেপতোদার বড় মেয়েকে ওই নামে ডাকতাম। 

একদল ছোট বড় হয়ে যায় কোলে পিঠে। পাড়ার দাদারা কাকা হয়ে যায় আর কাকারা দাদু। কিন্তু ছোটদের আধো বোল, বড়দের পায়ের পাতায় ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে অল্প অল্প হাঁটা, ফোকলা ফোকলা মুখের অনাবিল হাসি, আগ্রহ ভরা চোখে সব কিছু জেনে নেবার ছবি তবু বার বার ফিরে ফিরে দেখতে চায় মন। তাই তো শুকনো গাছে আবার লাল লাল কিশলয় চোখ মেলে, শীতের শেষে ফিরে আসে কোকিল। শিশুরা আছে তাই পৃথিবীটা একঘেয়ে লাগে না কখনও।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

1 thought on “পুরোনো পাড়ার গল্প

  1. খুব সুন্দর ছেলেবেলার (মেয়ে বেলার) গল্প পড়লাম। লেখিকার পুতুল খেলার দিন গুলো কত সুন্দর আর আনন্দময় ছিল, তা জানা হল। প্রতিভাস পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ও কলমবন্ধুকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
    সুস্থ ও সুন্দর থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *