মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
পর্ব – ২৮
হারিয়ে যাওয়া ফুরিয়ে যাওয়া বুড়িয়ে যাওয়া ছোট ছোট জিনিস, সম্পর্কের সুতো, তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা হঠাৎ হঠাৎ মনকে উদাস করে দেয়। বন্ধুদের গ্রুপে বন্ধুদের সাথে পুজোর সাজের ছবি আদান প্রদান করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার একটা স্টোনের হার আর দুলের সেট ছিল। কুচি কুচি বেগুনী পাথর নাইলনের সুতোয় গাঁথা। আমি সে পাথরের নাম জানি না। আর ওই পাথরের কানের ছোট্ট টপ। ভাই কিনে দিয়েছিল। ছোট থেকেই ওর টিপটপ থাকার ঝোঁক ছিল, সাজা আর সাজানোর ঝোঁক ছিল। সৌখিন কিছু দেখলে আমার জন্য আনত জমানো টাকায়। মেলা থেকে বা কোথাও বেড়াতে গেলে সুতো বা পোড়ামাটির সাজের জিনিস, পার্স এইসব আনতো। অনেক পরে রোজগেরে হয়ে আমাকে অনেক দামি সামগ্রী উপহার দিয়েছে, টিসট্ কোম্পানির ঘড়ি, বুটিকের শাড়ি, আরবের পারফিউম, ফ্যাশন দুরস্ত কাঁধ ব্যাগ; কিন্তু সেই ছেলেবেলার ক্ষ্যাপামিমেশা উপহারগুলোর ধারে কাছে সেগুলো নেই।

তা যা বলছিলাম, পঁচিশ তিরিশ বছর আগেকার সেই সব জিনিসপত্রের কথা মাঝে মাঝেই বড় মনে পড়ে। সেই মালাখানা ছিঁড়ে গেছিল, সেই দুলের একখানা হারাতে আর একখান বাতিল করে ছিলাম। একটা চট-পাটের সুন্দর সেট পরে নিজেই নাটকের সং সেজে এত ঘেমেছিল যে আঠা খুলে পুরো সেট অক্কা।
মনে আছে, সেকালে খবরের কাগজে চুল বাঁধা শেখাতো কেয়োকার্পিন। পার্লার বড় লোকেদের জন্য, আমরা তখন ভাবতাম। খবরের কাগজে আঁকা স্টেপ দেখে দেখে নিজে নিজেই চেষ্টা করি হেয়ারপিন ইত্যাদি দিয়ে। তখন সরু সরু রংচঙে কত তুলে দেবার রিবন, গার্ডার বাজারে আসছে, কত হেয়ার ব্যাণ্ড। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার সেই পাগলী সাজ আমার আয়না ছাড়া বিশেষ কেউ দেখেনি। কোন কোন দিন সন্ধ্যাবেলা পড়াতে এসে প্রীতি পিসি দেখে ফেলাতে বড্ড লজ্জা পেয়েছিলাম। আশেপাশের বড় কাউকে বিনুনি বা হাতখোঁপা ছাড়া অন্য রকম চুলের স্টাইল করতে দেখতাম না। তারই মধ্যে প্রীতিপিসির চুল বাঁধা খুব ভালো লাগতো। পরে জেনেছিলাম, ওই স্টাইলটার নাম টপনট।
আমার ভাইয়ের একটা পুতুল ছিল, তার জন্যও খুব মন কেমন করে। কোনো ব্যাটারি ছিল না। একটা গোল ইঞ্চি তিনেক পেডেস্ট্রালের ওপর স্ক্রুয়ের সাহায্যে লাগানো লং ফ্রকপরা সোনালী চুলের পুতুল টুং টুং শব্দে ঘুরে ঘুরে নাচতো। সম্ভবত সুশীল (মিশ্র) কাকু ওটা উপহার দিয়ে ছিলেন। অনেক অনেক বছর ওটা আমাদের ঘরে ছিল। আমার ছেলেও দেখেছে। তারপর কখনও ভেঙে গেছিল। কিন্তু এখন মনে হয় কেন যে বাতিল করে দিলাম… এত কিছু টুকিটাকি রেখে দিয়েছি, তবুও যেটা নেই সেটার জন্যই কেন এত মন কেমন করে?

কুয়োতলার দুপাশে দুটো চৌবাচ্চা। মাটি ফেলে তার একটাতে স্পাইডার লিলি, আর একটাতে সম্ভবত শতমূলী। সম্ভবত বলছি, কারণ ওটার নাম জানতাম না। কিন্তু ওগুলোর মতোই সুন্দর পাতাগুলো ফুলের বুকেতে থাকতে, বা গোলাপের সাথে জড়িয়ে ফুল দোকানে বিক্রি হতে দেখেছি। স্পাইডার লিলি শুধুমাত্র বৈশাখের শেষ বা জৈষ্ঠ্য মাসে মন ভরিয়ে সারা বছর চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখতো বেড়ালের আনাগোনা, মানুষের চলা বলা। আর লতানো পাতাসুন্দরী কুয়োর ধারে হাওয়ায় দুলতো। মাঝে মাঝে ধনীবাড়ির কাকুরা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যেত ফুলের কাজের অর্ডারে ওই রকম পাতা কম পড়লে। তবে বাড়ির গাছের ফুল পাতা ছিঁড়ে পুজো বা বুকে সাজানো কোনো কালেই আমার পছন্দের নয়। তার জন্য তো চাষের ফুল আছেই।
এই রকমই মন কেমন করে প্যাস্টেল রঙে অপটু হাতে আঁকা এক দেওয়াল চিত্রের জন্য। কারণ সেই কুঁড়েঘর, মাথা হেলানো নারকেল গাছ আমারই কোন শিশু বেলার সৃষ্টি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠার শেষ ধাপে বাঁ পাশে চৌকোমত একটু সিমেন্টের ডেটো করা অংশে আবছা হলেও দাঁড়িয়ে ছিল সেই গাছ, সেই কুঁড়েঘর।
আজ নেই, কোত্থাও নেই। আছে শুধু আমার অন্তরে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
