মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
পর্ব – ২৪
বিকেল চারটের ঘণ্টা বাজলে যদি হিন্দু বালিকার কমনরুম থেকে উঠে মেদিনীপুরের বাড়িতে এসে চায়ের জল চাপাতাম তাহলে কেমন হতো! ক্যাপ্টেন আমেরিকার সাহায্য ছাড়া এ জন্মে তা হবার নয় ভেবেই পোর্টালে ঝাঁপ না দিয়ে মনের অতলে ঝাঁপ দি। স্মৃতির মণি মুক্তো যা উঠে আসে তাকেই পালিশ করি। ছোটবেলাটার কথা ভাবলেই মনে পড়ে আমার স্কুলের কথা। উনিশশো এক সালে যার প্রাথমিক বিভাগ সূর্যের মুখ দেখেছিল। ছোটরা অত ছোট বড় বোঝে না। আমার স্কুল তাই প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত টানা একটা ম্যাজিক ব্যালকনি, যেখানে সব প্রথম পাঠের শুরু।
আমাদের প্রাইমারির পঠনপাঠন সকাল সকাল শুরু হতো তার কারণ গরমের কষ্ট নয়, তার কারণ বেলায় হাই স্কুলের জন্য ওই ঘরগুলোও প্রয়োজন হতো। শীতের কষ্ট উপেক্ষা করতে হতো। পরবর্তী কালে শিক্ষিকা হিসেবেও দেখেছি, কোনো পরীক্ষা বা বিশেষ প্রশাসনিক কারণে প্রাইমারি স্কুল বেলাতে করতে হলে হাই স্কুলে ক্লাসরুমের অভাব মেটাতে বিভিন্ন সেকশনের মেয়ে এক করে বসাতে হতো।
আমরা বড়দি হিসাবে পেয়েছিলাম শুক্লা দিদিমণিকে। ছোটোখাটো ফর্সা চেহারার মধ্যে ভীষণ ব্যক্তিত্ব ছিল। আমরা যেমন ভালোবাসতাম তেমনই ভয় পেতাম। তখনও শিক্ষকদের হাতে বেতের জোর ছিল। এবং বেয়ারা ছেলেপুলেদের ওপর তিনি নির্দ্বিধায় সে জোর খাটাতেন। কিন্তু তাতে তাঁর জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র কমেনি।
আমাদের চতুর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার আগে বাড়তি ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই ছুটির পরে ক্লাসগুলোর কথা আজও মনে আছে।

সদ্য খবর পেলাম বড়দি নেই। বড়দি নেই, কল্যাণী দিদিমণি, অনিতা দিদিমণি নেই। তবু আমাদের ছেলেবেলাটা আছে। আজও প্রেয়ারের শান বাঁধানো চত্বরে মিউনিসিপ্যালিটির দিক থেকে আসা পূর্বের নরম রোদে আমি যেন বাড়ি থেকে আনা একতাল মাটি নিয়ে কুমড়ো, বেগুন বানাচ্ছি। পোশাকের দোকান গ্যালাক্সির পেছনের নতুন বিল্ডিং, যেখানে তখনও বেঞ্চ তৈরি হয় নি বলে কার্পেট পাততে হতো, সেখানে অমল ও দইওয়ালার অভিনয় চলছে। বন্ধু পলি বড়দির ঘরের সামনের রঙ্গনফুলের ঝোপ থেকে ফুল তুলে মধু খেতে দিচ্ছে।
কত বন্ধুর সাথে প্রাইমরির পর আর দেখা হয় নি, কত বন্ধুর সাথে হাই স্কুল ছাড়ার পর। দেখলে হয়ত চিনতেও পারব না। এই সব কথা ভাবলে সত্যজিৎ রায়ের ‘ক্লাসমেট’ গল্পটার কথা মনে পড়ে।
আমি যখন এই স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দিলাম তখন বাবার কথায় মিষ্টি নিয়ে সকাল সকাল একদিন ছোটবেলার প্রিয় দিদিমণিদের সাথে দেখা করতে গেলাম। কি খুশি হলেন তাঁরা! পরে আমাকে একটা সুন্দর কলম উপহার দিয়েছিলেন। সেটা আমি এখনও রেখে দিয়েছি।
আসলে পেছনে তাকালে সকলেই হয়ত দেখতে পাবো আমরা আজকে যা, তার পেছনে শুধু বাবা মায়ের নয়, আরও অনেকের ছোট ছোট স্নেহ ভালোবাসার দাগ থেকে গেছে। হয়ত বা কারোর ঈর্ষা, ক্ষোভের দাগও। তবে এটা ঠিক, এখনকার শহুরে ছোটরা আমাদের মতো বিভিন্ন ধরণের মানুষের সংস্পর্শে কমই আসে।

আমাদের সেই পুরোনো পাড়ার কিছু কিছু মানুষ আজও আছেন, সবার জন্য, সবার সাথে। তেমনি একজন হলেন কৃষ্ণা জেঠিমা। সবাই তাকে ঝুমার মা নামে ভালো চেনে। আমাদের পাশের সেই মিষ্টি দোকানের বাড়ির পেছনে তার বাড়ি। মানে বাড়ির দোতলা থেকে দেখলে যেন একটা উঠোন মাত্র দূরত্ব। আমি সেই এতটুকু বয়স থেকে তার কপালে এত্ত বড় টিপটার ভক্ত। বড় টিপ সবাইকে মানায় না। কিন্তু জেঠিমাকে অপূর্ব লাগে। পাড়ার সব পুজো বিবাহ অন্নপ্রাশনে তাকে সবার প্রয়োজন কারণ জেঠিমা সুন্দর ছিরি (শ্রী) গড়েন, সব পুজোর নিয়ম কানুন, দশকর্মা কণ্ঠস্থ। তার থেকেও বড় কথা তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে নিজের সংসার ঠেলার পর তিনি সবার পাশে থাকেন এই সব কাজে সহায়তা করার জন্য। আসলে আমরা বলি, সময় পাই না। আমার দিদা, কৃষ্ণা জেঠিমা বা এই রকম দু একজনকে দেখে আমার বিশ্বাস জন্মেছে, সময় ম্যানেজ করতে হয়। যেটা সবাই পারে না। আমাদের টাউন ক্লাবের সরস্বতী পুজো যেখানে হয় সেখানে দুর্গাপুজো শুরু হবার পরও জেঠিমার দায়িত্বশীল রূপ দেখেছি। সময়ের সাথে সাথে কত কিছু পাল্টে যাবে কিন্তু ও পাড়ার মা কাকিমা জেঠিমাদের সিঁদুর খেলার আনন্দমুখর ছবিগুলো অক্ষয় হয়ে থাকবে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)