উমাদাস ভট্টাচার্য
—-খাওয়া হয়েছে কাকী ?
—-হাঁ । খাওয়া তো না —এই গরমে গেলা
অনীক একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে পাতলা টিয়াপাখির মতো মানুষটার দিকে। এই বেলা সাড়ে তিনটার ভাজা ভাজা গরমে ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের দু’তিনটে বাটি খুলে খুলে কিন্ডার গার্টেনের বাচ্চা মেয়ের মতো খাচ্ছিল কাকী। কাকী কাকী বলেই ডাকে অনীকরা। মানে অনীকের মতো যারা আশেপাশের বেসরকারি অফিস ব্যাঙ্কে কাজ করে। হাইরোডের পাশে এখানে প্রচুর হার্ডওয়ারের দোকান সাইবার ক্যাফে শপিংমল উঁচু উঁচু হোটেল ট্র্যাফিক লাইটের লাল চোখ হলুদ আশকারা সবুজ স্ফুর্তি সব পাওয়া যায়। মাঝেমাঝে কম্পিউটারের একঘেয়ে স্বচ্ছতা সরিয়ে অনীকের মতো অনেকেই কাকীর দোকানে এসে দাঁড়ায় সিগারেট পান বা ঠান্ডার সন্ধানে। এই প্রান ওষ্ঠাগত করা গরমে তখন ক্যাটরিনা কাইফ আমের ফোঁটা জিভের ডগায় নিচ্ছিল অনীকের দিকে তাকিয়ে। অনীক যেদিক থেকেই আসুক শীত হোক বর্ষা হোক রৌদ্র হোক বৃষ্টি হোক ক্যাটরিনা অনীকের দিকে তাকিয়ে জিভের ডগায় আমের রসের ফোঁটা নেয়। ক্যাটরিনার থেকে একটু দুরে তাপসী পান্নু গোলাপী ফ্রেমের চশমায় গোলাপী ফ্লোরাল ব্লাউজের ক্লিভেজ গাঢ় করে অনীকের দিকে বিন্দাস হেলে থাকে। হাইরোডের মাথার ওপর ডানা মেলা কিয়স্কে ওপার বাংলার নায়ক অপুর্ব সুখী গয়নায় কিছুটা আকাশ আড়াল করে অনীকের অপদার্থতা মনে করিয়ে দেয়। সেই সময় অনীক কাকীকে বলার আগেই কাকী একটা বড় ফিল্টার এগিয়ে দেয়। অনীক রঙিন কিয়স্কের থেকে আলাদা হয়ে বুকভরে বিষ নেয়। অনেকক্ষন ধরে বুকের ভেতর আটকে রেখে ধোঁয়াটার বেরিয়ে আসার ছটফটানি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।
—-কাল আসলেননা ?
—-কাল বাইরে গেছিলাম।
কাকীকে অনেকবার বলেছে অনীক আপনি করে না বলতে। শোনেনা। পাতলা একটা হাসি দেয়।
—-আপনি যেদিন কিছু কেনেন সেদিন ভালো বিক্রি হয়।
কাকী একদিন বলেছিল অনীককে। হাঁটুর বয়সী অনীক অপ্রস্তুত হয়েছিল। তখনো খুব একটা পরিচয় হয়নি। সবে পাশের ন্যাশনালাইজড ব্যাঙ্কের ব্র্যাঞ্চে বদলি হয়ে এসেছে। আশেপাশের অনেক ছোট অথচ ঝাঁ চকচকে মাল উপচে পড়া দোকান বাদ দিয়ে কাকীর ঘুপচি দোকানটাতেই টিফিন টাইমে সিগারেট নিতে দাঁড়িয়েছিল। বোধহয় ভীড় ছিলনা তাই। কালচে ছোট্ট দোকান। তারও বেশিরভাগ অঞ্চল ফাঁকা। নড়বড়ে টেবিলের ওপর যা সাজানো আছে তার সবকিছু রোজ বিক্রি হয়ে গেলেও একটা মানুষের সারাদিনের খরচ যে চলবেনা এটুকু রোজ অফিসে বসে টাকার হিসাব করা অনীকের অভিজ্ঞ চোখ বুঝেছিল।
—-এই নেন্
অনীক সিগারেটটা নিতে নিতে দেখে কাকীর খাওয়া সারা। বাটিগুলো ধুয়ে পেছনের ছোট টুলের ওপর ওল্টানো। ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে গড়িয়ে টুলের পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে আদর খাচ্ছিল।
—-কি ছিল আজ মেনু ?
কাকী হাসে।
—-আজ আলুপটল ছিল। রুটির সঙ্গে।
কাকী হাসে। কাকী সবসময় হাসে। শব্দ হয়না। কাকীর সঙ্গে কেউ গল্প করে ? অনীক কাকীর গল্প শোনে। শুধু রুটি আলুভাজার গল্প না। কত কিছু। বাড়ি থেকে দূরে থাকলে এমন হয়।
—-জামাইটা ভালো। তাই গানটা প্রাকটিস করতে পারি।
—-রোজ বিকেলে বাড়ি ফিরে গান নিয়ে বসেন ?
—-এখন তত দম পাইনা —চড়াতে একটু কেঁপে যায়।
কাকী অনেকটা বলে লজ্জা পেয়ে যায়।
—-উপরতলায় একা থাকি তো—সময় কেটে যায়।
—-ঘরের কাজ রান্নাবান্না ?
—-মেয়ে বলেছে ঘর সাজানোর দরকার নাই মন সাজিয়ে রাখ। আসলে জামাইটা ভালো।
অনীক অবাক হয়ে দেখে কাকীকে। ছোট্ট খাঁচার ভেতর টিয়াপাখি যেমন এদিক ওদিক করে সেরকম লাগে কাকীকে। আশেপাশে একই মাল নিয়ে আর সব দোকানগুলোয় লোকজনের আসাযাওয়া লেগেই থাকে। এ দোকানে ভিড় নেই। এক আধজন আসে। কিছু নেয়। কাকী পয়সা নেয় জিনিস দেয় তারপর পয়সা ঢুকিয়ে রাখে ভ্যানিটি ব্যাগে। কাকী বলে ভ্যানিটি ব্যাগ। আসলে পার্স। ছোট চারকোনা। ভেতরে লাল রেক্সিন বিবর্ণ হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে ছিঁড়েও গেছে। পয়সা রাখতে গিয়ে বেজায়গায় ঢুকে যায়। তখন হাত ঢুকিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। বাইরটায় নানা রঙের পুঁতি। বেশ কয়েকটা নেই অনীক দেখেছে। চেন অনেকদিন কেটে গেছে। রানারটা বহু ব্যবহারে কালচে হয়ে এসেছে। দু’পাশে আড়াআড়ি গার্টার লাগানো। কাকী প্রায়ই বিপদে পড়ে ব্যাগ থেকে খুচরো বের করে ফেরত দিতে গিয়ে। হয় দু’পাশের কোনো একটা গার্টার ছিঁড়ে গেল নাহয় খুচরো রেক্সিনের বেজায়গা থেকে বের করতে গিয়ে দেরি হতে লাগলো। খদ্দের সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে কিংবা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল নিয়ে উসখুস করতে করতে একসময় দেরি সহ্য করতে না পেরে নড়বড়ে টেবিলটার ওপর নেওয়া জিনিস নামিয়ে রেখে টেবিলের ওপর রাখা গোটা নোট ফেরত নিয়ে পাশের দোকানে চলে যায়। কাকী সব বুঝতে পারে কিন্তু মাথা নিচু করে রেক্সিনের বেজায়গা থেকে খুচরোটা বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে একসময় দু’আঙ্গুলের মাঝে ওটাকে পেয়ে যায় আর অনীকের দিকে অপ্রস্তুত হাসিমুখ তুলে ধরে মৃদুস্বরে বলে
—-এটা সেলাই করতে হবে।
অনীক এই সময়টাতে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নিচু করে কাকীর খোঁজা দেখতে থাকে। অফিসের টেবিলে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে আসতে থাকে কিন্তু ফিরতে পারেনা। ওর হঠাৎ এসময় মায়ের কথা মনে পড়ে। অফিস টাইমে মাও খুব তাড়াতাড়ি করতে থাকে। হাঁড়ি ওল্টানোর সময় হাত মৃদু মৃদু হলেও কাঁপে। অনীক হাজার তাড়াতাড়ি হলেও এসময় রান্নাঘরের আশেপাশেই থাকে। মা বুঝতে দেয়না শুধু ঠিকঠাক হাঁড়িটা মাড় গলানোর জন্য সসপ্যানের ওপর বসলেই অনীককে তাড়া দেয় অফিসের জামাকাপড় পরার জন্য।
—-আপনি কিছু খুচরো পয়সা আর টাকা বাইরে টেবিলের ওপর রেখে দিলে পারেন।
—-রাখতাম। আসলে এটার ক্লিপটা একবার আটকালে খুলতে চায়না।
কাকী টেবিলের নিচে থেকে একটা ছোট তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স তুলে এনে অনীককে দেখায়। বাক্সটার গায়েও সময়ের আঁচড় দেখতে পায় অনীক। এই বাক্সগুলো বড় হলে ইস্কুলের বইখাতার বাক্স হয়। এখন কোনো ছেলেমেয়ে এসব নেয়না। কাকীর হাতের বাক্সটার ক্লিপটা বেঁকে চুড়ে আটকে আছে। খোলা মুশকিল। কাকী টানাটানি করে দেখায়।
—-একটা ছোট বাটি রাখতে পারেন তো
—-আছে তো —আছে তো বলে কাকী তড়বড় করে উঠতে যায় আর তখনই টেবিলটা নড়ে উঠে কি যেন একটা ছিটকে টংটং করে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। কাকী ঘুপচি ঘরটার মাঝখানে একটুখানি দাঁড়িয়ে ঠাহর করতে চেষ্টা করে শব্দটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়। শব্দটার গভীরতা কমতে কমতে একসময় শেষ হলে কাকী অন্ধকার কোনা থেকে নিয়ে আসে একটা স্টিলের গোল বাটি।
—-এইজন্যই তো রাখিনা এতে। টেবিলটা নড়ে গেলেই খুচরোগুলো গড়াতে গড়াতে কোথায় ঢুকে যায়। ও আরো জ্বালা।
অনীক দোকানটা দেখে। কাকীকে দেখে। অফিসের দিকে পা বাড়ায়। সন্ধের অনেক পরে অনীক যখন অফিস থেকে বেরিয়ে হাইরোডের ডিভাইডারগুলো একে একে পেরিয়ে অন্যদিকে এসে দাঁড়ায় তখন কাকীর দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দোকানটাকে ঝলমলে মোড়ের মাথায় অন্য দোকানগুলোর পাশে ইস্কুলের শেষ বেঞ্চে বসা বাড়ি থেকে না খেয়ে আসা অপুষ্ট মেয়ের মতো লাগে অনীকের। কাকীর বন্ধ দোকানের পাশে সেই সময় হাইমাস্ট ল্যাম্পের মায়া আলোয় তাপসী পান্নু ক্যাটরিনা কাইফ কিংবা অপুর্বর সুখের হাতছানির নিচে এগ রোলের দোকান আর ফুচকার দোকান ঘিরে মাছির মতো ভনভন করে হাইওয়েমসৃণ আনন্দজীবন। অনীক বাইকে ওঠার আগে অফিস ব্যাগটা খুলে ছিমছাম ছোট প্যাকেটটা বের করে ডিকিতে রাখার আগে একবার কাকীর দোকানটার দিকে তাকায়। তাকাতেই ফিনফিনে রং চটে যাওয়া দরজাটা অনীকের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে। অনীক স্পষ্ট শুনতে পায়
—-রাগ করলেনা তো বাবা ?
—-না আপনার পার্সটা একেবারে ছিঁড়ে গেছে তাই ভাবলাম
—-আমার জামাইও অনেকবার বলেছিল।
—-তাহলে পাল্টাননি কেন ? এত অসুবিধে হয় আপনার
কাকী অনেকটা সময় হারিয়ে গেছিল নিজের মধ্যে।
—-এটা তোমার কাকুর। এখানে অনেক বড় দোকান ছিল। সরতে সরতে এটুকু নিয়ে আছি। প্রথম প্রথম মেয়েকে বড় করার জন্য বসতাম —
কাকী সিগারেটটা অনীকের হাতে দিয়ে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিচু গলায় বলে
—-এখন লাভের জন্য বসিনা। সঙ্গ করতে বসি।
অনীক কাকীর দিকে তাকায়।
—-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এখন তোমার কাকুর সঙ্গে থাকি দিনমান। এই নড়বড় করা টেবিল এই ক্লিপ আটকে যাওয়া বাক্স গড়িয়ে পড়া পয়সার বাটি সব রেখে দিয়েছি। এই ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়া পুঁতির ব্যাগটা আমিই দিয়েছিলাম একদিন ওকে তাড়াহুড়ার সময় টাকা রাখার জন্য।
কাকী হঠাৎ হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে
—-এমন সিধাসাধা লোক ওই লেডিস ব্যাগটাই সবার সামনে বয়ে বেড়ালো সারাজীবন।
কাকী হঠাৎ করেই থেমে যায়। অনীক অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। কাকী অনীকের আনা পার্সটা আস্তে আস্তে ফিরিয়ে দিয়ে বলে
—-তুমি এসে গল্প কোরো তাহলেই হবে।
অনীক পেছনে হর্নের আওয়াজে সচকিত হয়। পার্সটায় হাত বুলিয়ে রেখে দেয় ডিকিতে। কাকীকে বলতে পারেনি ওর ট্রান্সফার অর্ডার এসে গেছে।