বিকাশকান্তি মিদ্যা
ঠিক সাড়ে আটটা নাগাদ বাগুইহাটি বাজার থেকে বেরিয়ে, সরু রাস্তাটুকু পার হয়ে সাবওয়ে পর্যন্ত যাওয়াটা কী যে ঝকমারি, হাড়ে হাড়ে টের পায় ফেলারাম। দোষ রাস্তার যতটা না, আনুষঙ্গিক এর তার চেয়ে বেশি; আর বাকিটা ফেলার ব্যক্তিগত। কিছুটা পারিবারিকও বটে।
সকাল আটটার পর থেকে ভিআইপি-র শাখা রাস্তাগুলো নদী হয়ে যায়। বেলা বাড়লে সে নদীতে জোয়ার আসে।
পূর্বের হাতিয়াড়া রোডে তো বটে, পশ্চিমের শ্যামনগর, সাতগাছি রোডও এসময় এমন জ্যাম হতে শুরু করে, যে মানুষ দূরের কথা, মাছি গলাও দায়। স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি, বাজারের মানুষ, ডেলি লেবার, সবজি ব্যাপারী, ফল ব্যাপারী, মাছ-মাংস ব্যাপারী, দুধ ব্যাপারী তো আছেই, তার সঙ্গে গাড়ি যে কত বিচিত্র ধরনণের, হিসাব থাকে না। সবাই চায় আগে মেতে।
আগে যাওয়া অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু নিয়মের তোয়াক্কা না করাটাই এদের ধর্ম। বিশেষ করে অটো, টোটো আর বাইক। টোটোর তবু গতির পরিমিতি আছে, অটো, আর বাইক কাউকে তোয়াক্কাই করে না। অটোগুলোর সরকার আশ্রিত ইউনিয়ন বলে না কী, এরা যাত্রী থেকে পথচারী, কাউকে পাত্তা দেয় না। আর ট্রাফিকহীন রাস্তায় বাইক তো রাজা। তবে একা বাইক বা অটোর দোষ দিয়ে লাভ নেই, সাতগাছিরোডে পণ্যবাহীযানেরও খামতি নেই।
যানবাহনের এই জটিলতায় পথ চলতি মানুষ মাত্রেই নাকালের এক শেষ, এর মধ্যে আবার ফেলারামের দুর্দশার অন্ত নেই। কে প্রতিবাদ করবে? কার কথা শুনবে কে? নিজেরটুকু নিয়ে সবাই ব্যস্ত। রাস্তা-ঘাট, ঘর-দুয়ার সর্বত্র; না হলে এমন মানুষকে কেউ বাজারে পাঠায়? এত অসুবিধা সত্ত্বেও?
রাস্তায় তাই ফালাকে পারাপার করতেই হয়, এবং দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার। এ অবস্থায় মন্দির ভালো ভিআইপির সাবওয়েটুকু। সিঁড়ি ভাঙা ফেলারামের পক্ষে পঙ্গুর পর্বত ডিঙানোর মতো কঠিন যদিও, তবু গাড়ির এই পঙ্গপালের ভীড়টা এড়ানো যায়।
গাড়িরই বা দোষ কী, যত বদমায়েশ ওই ড্রাইভারগুলো। এক একজন যেন মিউনিসিপ্যালিটির এক একটা কাউন্সিলার। কাউকে তোয়াক্কা করা নেই। যেমন তাদের গতি, তেমন মর্জিও। ওদের বেপরোয়া চালানো দেখলে ফেলার কেমন হাত পা কাঁপে ভয়ে। এক চোখে দেখা, প্রায় এক পায়ে চলা, একটা হাত সর্বস্ব ফেলার ফাঁকা রাস্তা পার হতেও সাহস হয় না। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তিনটে ব্যাগ নিয়ে রাস্তা পারের জন্যে যখন বার বার সে ঝোঁকে, বা নেমে যাওয়ার পর হঠাৎ গাড়ি এসে পড়ে গায়ের উপর, কেউ কেউ হয়তো আঁৎকে ওঠে ভয়ে, তবে ভদ্রগোছেরা বিরক্তও হয় – কেন যে এরা বের হয়! যত্তসব উজবুক।
একে তার অষ্টবক্র চেহারা, তার উপর ওই টলোমলো অবস্থা। দেখলেই ড্রাইভারগুলোর স্টিয়ারিং ঠিক থাকে না। তাতে আরো ক্ষেপে যায় তারা। ক্ষ্যাপামির সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির গতি বাড়ে, আর বাড়ে ফেলার দিকে মুখ ভ্যাঙানো, আর নোংরা কথার মাত্রা।
কেবল ড্রাইভার – খালাসি না, ফেলাকে নিয়ে ভ্যাঙাতে বাজারের ভিতরও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
বাজারে মাছের আঁশ ছাড়ায় যে ছেলেটা, প্রায়ই মোবাইলে নোংরা ছবি দেখে, সে-ই বেশি পিছনে লাগে ফেলার। নিজের ল্যাংড়া চেহারা সম্পর্কে নিজে ওয়াকিবহাল ফেলা,তবু এই ছেলেটাকে দেখলে বাজারের শুকিয়ে যাওয়া ঝিঙ্গে – চার পাঁচদিন অবিক্রীর পর রাস্তার হোটেল মালিকরা যেগুলো কিনে নিয়ে যায়, তার মত মনে হয় তার। সেই ঝিঙ্গের দেখাদেখি মুদি দোকানের চ্যাংড়াটাও ক্ষ্যাপায় ফেলাকে। চ্যাপ্টা চিড়ের মতো দেখতে ছেলেটা, মালিক বকাবকি করলে শব্দ করে না, হাতের আঙুলের রকমারি মুদ্রায় জ্বালাতন করে। হাঁটুর বয়সী ছেলেটার বাপের বয়সী মানুষটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে বিন্দুমাত্র আটকায় না।
কী আর করবে ফেলা?
ছোটো থেকেই বুদ্ধিতে একটু জড়তা তার, কথাতেও। কথা ফুটতেই কেটে গেছে বছর পাঁচেক। কথা কোনো ভাবে ফুটল, তো সাত দিনের জোরে বাম পা’টা গেল ধরে।
লোকে বলল পোলিও। পোলিওর দৌলোতে বাম পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে রুগ্ন, অকেজো বললে হয়। কোনো ভাবে ডান হাত ডান পায়ের হাঁটুর উপর চাপ দিয়ে বাম পা’টাকে টেনে নিয়ে নিয়ে যখন সে চলে। তখন তাকে ঠিক মানুষ মনে হয় না, যেন পায়ে দোমড়ানো দেশলাইয়ের একটা বাক্স আবার সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা। অমেরুদন্ডী প্রাণীর পিঠের মধ্যে লাঠি দিয়ে তাকে সচল করা চেষ্টা করলে যেমন হয়, তেমন।
এদিকে খোঁড়ায় পা খানায় পড়ে বলে নাকি, রাস্তার গর্তে পড়ে গিয়ে বাম হাতের কনুইটাতে যে চোট লেগেছিল, তা বাতে বসে গেছে। এতো সোনায় সোহাগা কম নেই, দশ বছরের মাথায় পক্স হয়ে দান চোখটা নিষ্ক্রিয়। এক শরীরে এত প্রতিকূলতা গল্প বানানোর জন্যে না। অভিধানের ব্যতিক্রম শব্দটা তাহলে থাকতই না।
নিজের গর্ভের দোষ দিয়ে ভগবানের কাছে কাঁদতো মা। ছোটবেলায় লবণ খাইয়ে না মারার আপশোষ করতো বাবা। আস্তাকুঁড়েতে জায়গা ভেবে ঠাকুমা নাম দিয়েছিল ফেলা। তার সঙ্গে রাম।
রামের রোগটা পারিবারিক। বাবা ধনীরাম বাগুই, কিন্তু ময়দানের ফুটবল খেলায় সেই যে ধনীরাম বল হয়েছিল, সে আর যাই নি। নাই বা গেল, বলের দৌলতে চাকরি জেশপ কোম্পানিতে, তার দৌলতে ভাত ভিক্ষা। ঘরবাড়ি। চারছেলে। ছেলেদের পিছনে বল না থাকলেও, বাবা তার রামটা দিতে ভোলেনি। রাম-ই বল, রাম-ই ভরসা।
হরিরাম, কালীরাম, ফেলারাম আর রামরাম। সবাই দেবতা পেলেও, তার বেলায় ফেলা!
অথচ ধনীরামের ফেলে রেখে যাওয়া রাম-রাজ্যে বিচার বড়ো পক্ষপাতমূলক। স্বার্থনির্ভর।
চাকরির সূত্রে আর জেসপ বন্ধ হয়ে গিয়ে ক্ষতিপূরণ যেটুকু মিলেছিল, তার দৌলতে শোয়া কাঠা জায়গা কিনে ধনীরাম বাগুই দোতলা যে বাড়িটা বানিয়েছিল, তার উপরে তিনটি ঘর, নিচেও তিনটে। সামনে একটু উঠোন।
সাতসকালে উঠে পাঁচ বালতি জলে উঠোনটা ধোয়া দিয়ে শুরু হয় ফেলারামের দিন, তার আগে অবশ্য দু’তলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে রাখা পাপোশটা ঝাড়ে সে। পরিষ্কার করে। প্রথম প্রথম ঘেন্না ভরে বাম হাতে পাপোশটা ধরে থামের গায়ে কয়েকবার আছাঁড় মেরে ফেলে দিত সিঁড়ির সামনে। কিন্তু দিন যেতে মমতা বাড়ে নাকি, বামের জায়গায় ডান হাতে আলতো করে পরিষ্কার করে জায়গায় রাখে। ছুড়ে ফেলে না। এমনকি মাঝে মাঝে ধুয়ে পরিষ্কার করতেও বাদ দেয় না।
বলা যায় এটা দিয়ে সকাল শুরু তার। এ রকম-ই নির্দেশ উপরতলার। কিন্তু সদ্য জাগ্রত মমত্বের সঙ্গে তার কোন যোগ নেই।
নিচের থেকে মানুষ যতবার উপরে ওঠে, পাপোশটায় পা মুছে তারপর যায়। উপরে উঠতে উঠতে কষ্ট হলেও, ওঠার কোন অনুমতি নেই ফেলার।
উপরটা বড়দা, মেজদা, আর ছোটভাইয়ের থাকার ব্যবস্থা। তিনজনেই সংসারী ও আলাদা এবং যেহেতু সংসারী আর অফিস বা কলে-কারখানায় কাজ করে অতএব ওরা থাকে উপরে।
ফেলা বেকার এবং অবিবাহিত, তার ঠাঁই মায়ের দিকে, নিচে। সঙ্গে দু’ঘর ভাড়াটে। আর ভাড়া বাবদ তিন হাজার উপরেই ভাগ হয়, বিনিময়ে দু’বেলা পালা করে ভাত নামে দু’জনের। কিন্তু ফাইফরমাসের সকল দায় ফেলার। ব্যত্যয় হলে মিল বন্ধ। অজুহাত চলে না।
মূলত এমনই প্রেক্ষাপটে ভোর থেকে তাই শুরু হয় ফরমাশের যাত্রা। রেশ চলে মোটামুটি সারাদিন।
পাপোশটা পরিষ্কার করে উঠোনটা ধোয়ার পর, জল শুকানোর আর সময় দেয় না। বড় বৌদি সাত সকালেই পাড়া মাথায় করে, উঠোন ধোয়া তোর হল রে ফেলা, এক প্যাকেট দুধের জন্য দাদার বুঝি অফিসটাই কামাই হয়। দুধ চা না পেলে মানুষটার যে বাথরুম হয় না, তা তো জানিস। যা না ভাই, বাজার থেকে আগে দুধটা এনে দে, অন্য বাজার পরে বলছি।
দুধ আনতে যাওয়ার মুখে মেজদা আজ জুতো, কাল জামা, না হলে প্যান্ট ধরিয়ে দেয়। জুতো সেলাই না হলে পালিশ, না হলে পেরেক মারা; জামাপ্যান্ট আয়রন। মেজদা ছাড়লে ধরে মেজবৌদি।
সে সময় ছোটভাইয়ের বউ বুঝি ওৎ পেতে থাকে, আজ আমাদের বড়ো বেশি কিছু লাগবেনা, তবে বাপ-মেয়ের পেটের গন্ডগোল, জ্যান্ত মাছ একটু লাগবে, সঙ্গে কাঁচকলা, পেপে। কচি পটল হলে ভাল হয়। আর আলু পেঁয়াজের দাম যেভাবে বাড়ছে, কেজিটাক আলু, হাফ কেজি পেঁয়াজ এনে রাখা ভালো। কাঁচা লঙ্কা নেই, গোটা জিরে একটু আনতে পারলে ভালো হয়।
ভাইবৌয়ের এই বেশি কিছু না লাগা’র ফিরিস্তি মোটামুটি রোজ চলে। ছোট ভাইয়ের পেট খারাপের মতো।
তবে এসবে দুঃখ নেই ফেলার, শরীরটা নিয়ে জ্বালা। শরীরটা যদি ঠিক থাকত।
শরীর নিয়ে তাও চলে, মনটা বড্ড পোড়ায়। তাকে সবাইয়ের এই তাচ্ছিল্য বুকের মধ্যে খুব লাগে। মেঘের মতো বাষ্পীভূত হয়।
কিছু বলতে পারেনা সে, মনের মধ্যে গ্লানি জমে। এতটা পরিমার্জিত ভাবে যে সে ভাবতে পারে, তা নয়। তবু সারা দিনের বায়না পূরণে যদি কোন গলদ দেখে বউয়েরা কেউ মেজদার কাছে নালিশ করে, অফিস ফেরত মেজদা এসে তাকে বেদম মারে, মারে না কেবল, ভাত বন্ধের অর্ডার করে। করে পাপোশটায় জোরে জোরে পা মুছে উঠে যায়, তখন কষ্ট হয় খুব, নিজের জন্য তো বটে, পাপোশটার জন্যেও। সকালে পাপোশটা পরিষ্কার করতে গিয়ে কখন যে তার গায়ে হাত বুলিয়ে ফেলে, নিজেই বুঝতে পারে না। মাকে জড়িয়ে মাঝে মাঝে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেলে সে।
মা মায়েদের মত বলে, কী আর করবি বাবা, সবটাই আমার পেটের দোষ ভগবানের উপর ভরসা রাখ।
কত ভরসা আর রাখবে ফেলা?
তবু সেদিনের জন্য মনটা একটু শান্ত হয় হয়তো, কিন্তু একটার পর একটা বায়নায় বিরক্তি জমে। বিরক্ত হলে তো হবে না, দাদার অফিস ফেরতা প্রহার আর খাওয়া বন্ধের কথা ভেবে ছুটতে হয় বাজার। একবার নয়, যার যেমন বায়না। যতবার যায় ফেলা, একই ব্যবস্থার পুনরাবর্তন। মাছবাজারের ন্যাপলা, মুদি দোকানের হাবু, অটোর যত চ্যাঁঙড়া-ব্যাঙড়া। চাপটা বাড়তে থাকে, সবাই তাকে এভাবে ব্যবহার করে, কিছুই পারেনা ফেলা, কেবল হাত পা বাঁধা অসহায়ের মত ছটফট করে। বাজারের অনেকে এসব দেখে বিরক্তই হয়।
কার কাছে যে এর বিহীন চাইবে, বুঝে পায় না ফেলা। মাঝে মাঝে বাজারে না আসার জেদ করে, কিন্তু আয়ু তার কতক্ষণের? উপর থেকে হুংকার উঠলেই কেঁচোর মতো বুক টেনে বেরিয়ে পড়ে।
অলিখিত হলেও এটাই নিয়ম।
ভোরে উঠতে হয় বলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে ফেলা। সেও নিয়ম। বড়দা বক্স টিভিটা পাল্টে এলসিডি আনাতে পুরোনোটা তাদের ঘরে ঠাঁই পেয়েছে বটে, কিন্তু রাত জেগে টিভি দেখার হুকুম নেই। ওতো বিল শোধ করা সম্ভব নয়, তেমন হলে লাইন কেটে দেওয়ার আদেশ আছে মেজদার। তাই যা দেখে দিনের বেলা। সেটুকু ওই ছোটা ভীম। ছোটা ভীমের ওই যেটা মনে ধরে। অনুকরণের চেষ্টা করে। পারেনা। বাকি কিছু দেখলে ঘুম পায়।
কিন্তু শুয়ে পড়লেও যে সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসে, তা নয়। ঘুম আসলেও সে ঘুম যে নির্ভেজাল হয়, বলা যায় না। সব সময় একটা ভয়, কোথায় কী ভুল হলো, মেজদা বুঝিয়ে আবার নেমে এলো। আবার বুঝি ভাত বন্ধের রায় দিল। ভাত বন্ধের সঙ্গে এলোপাতাড়ি যা মারে মেজদা, সহ্য করতে পারে না ফেলা, মনে হয় কবে হয়তো মরে যাবে ওই মার খেতে খেতে। মেজদার মত ভয় লাগে অটোগুলোকে। তারা দিক বিদিক জ্ঞান না করে যেভাবে ধেয়ে আসে বুকে ভয় ধরিয়ে দেয় ফেলার, কবে কখন যে মেরে দেয়, ভাবলে হাত পা কাঁপে। ভাঙ্গা হাতটায় যন্ত্রণা করে ওঠে। ঘুমের মধ্যেও দমটা আটকে আসে তার। প্রায়ই স্বপ্ন দেখে ফেলা, মেজদা মারছে, নাহলে রাস্তা পার হচ্ছে সে, আরেকটা অটো তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার পর একটার পর একটা অটো এসে চাপা দিয়ে যাচ্ছে তাকে।
সেদিন তেমনি স্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠলে মা জেগে গায়ে হাত দিয়ে দেখে ধুম জ্বর ফেলার। শরীর একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। মায়ের চিন্তা, জল ঢালবে মাথায়,না, জলপটি দেবে তা নিয়ে, ছেলের চিন্তা সকালে বাজারে যাবে কী করে এ অবস্থায়?
–তুই থামতো বাপু, একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। একদম যাবি না কাল, যে যার বাজার সেই করবে, না পারলে আমি যাব।
–বারান্দা থেকে উঠোনে নামতে পারো না, তুমি যাবে বাজার! আমারেই যেতে হবে। ওরা শুনবেই না। মেজদা ছেড়ে দেবে ভেবেছো? মারবে তো বটেই খাওয়াও বন্ধ করবে।
ফেলার ভাবনাই ঠিক।
দুধ বিহনে বড়দার, পালিশবিহীন জুতোর কারনে মেজদার, আর কাঁচকলার অভাবে ছোট ভাইয়ের অফিস বন্ধ যাওয়ার দশা। মেজদার এমডি আজ বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে পঞ্চাশ কোটি টাকার চুক্তির মিটিংয়ে বসবে। সব ফাইল তার আলমারিতে। সে না যেতে পারলে, একেবারে মাটি। একেবারে জরুরী ব্যবস্থা।
অতএব ওই অবস্থায় সাত তাড়াতাড়ি বাজার গেল ফেলা। তাড়ার গুঁতোয় উঠোনটা কোনভাবে জল পেল পেলেও পাপোশটা আজ আর ঝাড়া পেল না।
অগত্যা ধুম জ্বর, জুতো, দুধ, কাঁচকলা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরছিল ফেলা, মাথাটা ঘুরছিল বনবন করে। শরীরে আর পারছিল না। পা দুটো তুলে ফেলার মত বোধ কিংবা শক্তি কিছুই কাজ করছিল না। তার টলমল দশা দেখে ছেলেগুলো ক্ষ্যাপাচ্ছিল শুরু থেকে। এ সময় অফিস যাত্রীর ভিড়। যত পারে এ সময় ট্রিপটা বাড়াতে পারলে লাভ। অটোগুলোতে তাই দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য রেষারেষি। কিছু নিতে ভুল হলো কিনা ভেবে মাথার মধ্যে মেজদার উদ্ধত মূর্তি ঘুরছিল, এ অবস্থায় কখন যে সে মাঝ রাস্তায় এসে গেছে খেয়াল নেই, খেয়াল যখন হল চারটে অটো পরস্পর ওভারটেক করতে করতে ঝড়ের গতিতে যে ঘূর্ণি রচনা করছিল রাস্তা জুড়ে, তার মাঝখানে পড়ে গেল ফেলা।
আজ আর বাঁচার কোন উপায় নেই। পথ চলতি মানুষ যখন রুদ্ধশ্বাসে হায় হায় করে উঠলো, ফেলা একবার কেবল আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো প্রাণপনে।
যেন ছোটবেলাকার সেই মেরি গো রাউন্ড খেলা। চলমান ছুটন্ত ছেলের দলকে স্ট্যাচু বলে থামতে বললে ঠিক হয়ে যেত, না হলে দোষী; তেমনি তার সেই জড়ানো গলার চিৎকারের ধাক্কায় কী ছিল কে জানে, সকাল ন’টার ব্যস্ততম বাগুইহাটি দেখল, অটোগুলো তো বটে, বাকি সব গাড়ি, যায় প্রতিটা মানুষ স্থির হয়ে গেল।
আর স্থিরতার সেই তরঙ্গ লাগল প্রায় সারাটা কলকাতায়। তাতে যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল অনড় হয়ে গেল।
রূপকথার পাথরনগরী যেন ভর করল কলকাতায়।
সারাদিনে সে পথের দশা আর ঘুচলোই না দেখে, অফিস না পৌঁছাতে পারা মেজদা, সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে বাড়ি ফিরে নিচে পাপোশে পা মুছে উপরে দো-তলায় উঠতে যাবে কী, দেখে পাপোশটা দো-তলার সিঁড়িতে দিব্যি পা ঝুলিয়ে বসে মিটমিটিয়ে হাসছে।