অভিষেক ঝা

শুধুচো……চাইলেদিনেপাঁচহাজারথাকাখাওয়াআলাদাচো…..য়েরসাথেগাঁ…..মারাতেচাইলেদিনেসাতআরখাওয়াথাকাআলাদাজানিআরখিঁ….তেহবেনা   

   শব্দগুলির ভিতর মধ্যে দাঁড়ি, কমা ,  সেমিকোলন, ডটডট, ইনভার্টেড কমা , কি নিদেনপক্ষে সৌজন্যতামূলক সাদা জায়গাটা প্রাথমিক ভাবে ছিল। রাজমহল পাহাড়ের দিক থেকে আসা ফুলহরের ঘোলাজল মাখা আঁশটে বাতাসে উড়ে আরেক পাশ দিয়ে বওয়া গঙ্গার জলে গিয়ে এখন পড়ল সেইসব । এবং পরিস্থিতি ক্রমশ সহজ  হয়ে উঠছে বলে তার মনে হল। দরাদরি আরেকটু চালাতে হবে সে জানে। পুরো ব্যাপারটা দিন  প্রতি পাঁচ হাজারে না সাল্টালে তার নিজের বাঁশ হতে পারে এ আশঙ্কা থেকেই সে  মেজাজ হারিয়েছিল। “মালা কোনো রে…. না বাবু। মালা দরাদরি করে না”, পাশ থেকে তাকে এখানে নিয়ে আসা মাঝি কান থেকে খইল বের করতে করতে বলে ওঠে। যদ্দূর চোখ যায় সাদা বালু, সেই বালুর ঢিবের পর ঢিব, দু মানুষ সমান ঘাস আর জল ছাড়া খালি আকাশ দেখবার আছে। একটা কালচে রেখা অন্য কোনো  পৃথিবীর সীমানা নির্দেশ করে চলেছে। নৌকা করে সে কালচে রেখা সে পার করে এসেছে ঘন্টা তিনেক আগে। তারও আগে ঘন্টা দুয়েক নৌকাতেই লেগেছিল সে কালচে রেখায় পৌঁছতে। খানিক আগে সে জেনেছে রোজ জানালা দিয়ে যে কালচে রেখাকে সে  তার চেনা পৃথিবীর শেষ ভাবত, তা আদতে লম্বাটে এক ঝাউবন।ভিতর দিয়ে ফুলহরের ঘোলা আর গঙ্গার কালচে নীল জলের ধারা বয়ে গেছে লম্বাটে সুতাদের মতো। দিনের বেলায়ও যে শেয়ালরা থাকে তা ওই ঝাউবনের দিকে তাকিয়ে বুঝেছে সে খানিক আগে। এখান থেকে  সেই  কালচে রেখাকে নিজের  বাড়ি  মনে হচ্ছে  তার। শা…. এতদূরে মারাতে আসার যে শখ কেন জাগে এদের! রাগটা রক্ত বেয়ে রগে পৌঁছতেই নিভে এল।একটিও জেলে নৌকা কেন চোখে পড়ছে না এতক্ষণে মাথায় ঢুকল তার। বিশ হাত দূরে আপন মনে চোখ বুঁজে হাঁ করে দাঁতে রোদ লাগাচ্ছে একটি মাঝারি সাইজের ঘোড়িয়াল।  

  “উপওয়ালা মারাতে চাইছে, মা….কে সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি করে তো বড়বাবুই  বিছানায় পাঠায় বরাবর। ঘোরী, খলজী, মুঘল, ইংরাজ, কংগ্রেস, সিপিএম সব আমলেই তাই হত। এ আমলেও বড়বাবুদের কাজ মা…. রেডি করা”, একশ বিশ বাবা জিভের তলায় রেখে তূরীয় ভাবে বলছিল  পিন্টু সান্যাল।একটি আস্ত রামখচ্চর। বয়সে আমার ছয় বছর আগে রিট্যায়ার করা বাপের চেয়ে কম হবে না,  অথচ চাকরি বাকি এখনও ছয় বছর। স্বচ্ছ ভারতের পায়খানা প্রাপকদের লিস্টটা মেশিনে টাইপ করতে করতেই সান্যালচোতকে বললাম, “ সান্যাল বাবু পরশু কিন্তু আবার নির্মল গঙ্গা। ডি এম নিজে থাকবেন। আপনি দেরি করবেন না প্লিজ”। সান্যালের চোখ আরও বুজে এসেছে, স্বরে খানিক নির্লিপ্তি— “ বুয়লেন বিডিও শা…. নিশ্চিত ঢ্যাম…. ডিএমকে বলেছে এই  অঞ্চলে ডবকা পা….র মা…. অনেক। আমি কিন্তু এবার টর্চ মারব না। শা…. পরদিন হাট করতে গিয়ে মা….দের হাতে জুতা খেতে খেতে বেঁচেছি” । “সঙ্গে পুলিশ থাকবে এবার। টর্চ মারা, হুইসেল বাজানো, দরকার পড়লে বমাল ধরপাকড় ওরাই করবে। আমরা শুধু স্ট্যাট নেব” — মাধাই মণ্ডল,  পিতা জগারু চাঁই এন্ট্রি করি। সান্যালের গলা এখন মেঘ মেঘ, “কয়টা লোক গঙ্গার ধারে হা….তে বসেছে এর চেয়ে জরুরী কিন্তু দেশে কয়টা লোক গরু খায় সেই হিসাবটা করা। শা…. কাটা ছেড়ে হা….র পেছনে পড়ে আছে সব”। আমি এন্ট্রি করে চলি হেনসার মোমিন, পিতা শুশুক মোমিন। বিডিও ডাক পাঠান। সান্যালের চোখ হেসে ওঠে। মারানোর ঠিকা বুঝেশুনে নিতে আমি চেয়ার থেকে উঠে পড়ি। জানালা দিয়ে খানিক দূরে ফুলহর। অনেকটা। একটা হালকা কালচে মত দাগ সীমান্তে। রোজকার মত আমার চোখে অতটুকুই আসে।

 সেদিনও তাই আসছিল।আড়াইটার পরে বিডিও ডাক দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে আমার সাথে কথা বলেছিলেন ঠিক বিশ মিনিট। এই বিশ মিনিট ধরে শা….. বোঝাতে চাই আমি এই জেলার মানুষ হয়েও কিচ্ছুটি জানি না। শা…. গণ্ডস্য গণ্ড ভূতনীর চরের পরেও যে কোনো চর থাকতে পারে তা আমি কী করে জানব? গদাইয়ের চরের শেষ প্রান্তে জেগে ওঠা চর নিয়ে ঝাড়খণ্ড আর আমাদের দড়ি টানাটানি চলছে সেটা প্রথমবারের জন্য শোনা কি আমার অপরাধ?  গদাইয়ের চরে ভূতনীর চর থেকে লাথ খেয়ে আসা চল্লিশ ঘর দ্বারভাঙ্গিয়া মুসলমানকে ও চরে পাট্টা দেওয়া হয়েছে তা না জানা থাকলে  কী এসে যায়? সে লোকগুলা আবার ঠিক করে বাংলা বলতেটলতে পারত না,  তাদের টিপসই দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেওয়া হয়েছে তারা বরাবর বাংলা বলে— এটা না শুনে থাকা নিশ্চয় অস্বাভাবিক নয়? কী করে জানবো দশবছর আগে তাদের ঘরে  ঘরে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, নেতাজী , আর আর… হ্যাঁ নজরুলের ছবি টাঙিয়ে দিয়ে এসেছিল  আমাদের লোকজন? তাদের গাঁজা চাষে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি ।পোস্ত নিয়ে বাড়ি গেছে অফিসের সবাই। সেখানে এবার পঞ্চায়েত ভোটের বুথ করাতে হবে।  এইটা বলতে গিয়ে এত কেত্তন  করার কী দরকার ছিল কে জানে? আসল কথাটা বলল এই সব আগডুম বাগডুমের পর। “ওখানে ভোট করাতে নর্মাল রেশিওর পুলিশ পারবে না। আর অতিরিক্ত পুলিশ ডাকা যাবে না, নইলে ঝাড়খণ্ড বসেই আছে চিল্লাতেঃ ডিসপিউট জোন ডিসপিউট জোন”, ধূমপান নিষেধের গায়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিডিও বলে চলেন,  “ওখানে মারাতে মালা লাগবে”।   

  দুই কাপ চা আর পৌনে তিনটা সিগারেট শেষ হওয়ার সময়টুকুর ভিতর আমি বুঝে নিলাম যা বোঝার। ওখানে সরকার বুথ করিয়ে ভোট করাতে হিসাব বহির্ভূত  পঞ্চাশ হাজার আলাদা টাকা খরচের এক্তিয়ার বিডিওকে দিয়েছে। অফ দ্য রেকর্ড।  বিডিও সোজা মানুষ। জানিয়ে দিলেন তিরিশ খরচা করবেন, বিশ দিয়ে একদিন অফিস ফিস্ট।তাহলে মালার জন্য তিরিশ। এখান থেকে আমার জন্য দশ সরাতে পারলেই, ঝামেলা ছাড়াই মা এর স্মার্ট ফোন হয়ে যায়। অনেকদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছে। “ কিন্তু স্যার এই পঞ্চাশ দিচ্ছে কোন খাত থেকে?”। “তেরো আর আঠাশ নং পায়খানা প্রাপকের  পায়খানা না হলেও চলবে। এতদিন গঙ্গার ধারে হা….ছে, আরও কিছুদিন হা….ক না। এই তেরো নংটা বাদ দিও না, চোখে পড়বে। আচ্ছা একত্রিশ নংকে বাদ দিয়ে দাও”।জানালা দিয়ে খানিক দূরে ফুলহর। অনেকটা। একটা হালকা কালচে মত দাগ সীমান্তে। রোজকার মত আমার চোখে অতটুকুই আসে। 

  তাকে আর তফিজকে বসিয়ে রেখে মাঝি যখন একটা বালুর ঢিব পেরিয়ে গেল জায়গাটা তাকে দেখছিল। এই সস্তার জামাকাপড় যে সে রোজ পরে না এখানকার প্রত্যেকটা বালু এই কথা বোঝে। শঙ্করীটোলা ঘাটে নৌকায় ওঠার আগেই যে তাকে সব শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তা এই  কাদাসোনা রঙা জল জানে। দু ঘন্টা কেটে গেলেও মাঝির দেখা না পাওয়ায় সে ভয় পাচ্ছিল। তফিজ নির্বিকার। মাঝে মাঝে খালি শুখা হাওয়ার বালি নিয়ে ঘুরপাক আর খানিক বাদে বাদে জল থেকে লাফিয়ে আবার জল হয়ে যাওয়া বাদামী শুশুক। আধ ঘন্টা পর সে তফিজকে খানিক ভয় পেতে লাগলো। তফিজ অ্যাড হকে ডেটা এন্ট্রির কাজে ঢুকেছে বছর খানেক। এই ধূ ধূ বিস্তারে সান্যাল বাবুর বাক্য তার মাথায় চৈত্রের ঘূর্ণির মত পাক খেতেই থাকেঃ “শা….. শেরবাদিয়ার জাত।বাপ দাদা ঠিয়া পার্টিতে  ছিলোই ছিলো। ঠিয়া রক্তে বয়”। ভয়টা গাঢ় হওয়ার আগেই ঢিবি টপকে উঠে এল দশ-বারোটা লোক। কাঁধের মুঙ্গেরী বন্দুকগুলো দেখে অত ভয় লাগে না তার, যতটা লাগে বালি শাণ দেওয়া হাঁসুয়াগুলো দেখে। তাফিজের হাত  আঁকড়াল সে। “ডরান নাই।আপ্নে গোবমেন্টের লোক। সব ঠিয়া পার্টি উ ঠিয়া পার্টিরে ডরায়”, তফিজকে ওই অনেক দূরে দেখা  যাওয়া কালচে রেখাটির মত নিজের ঘর  মনে হয় তার।

  মালা মোমিন তাকে দু’মানুষ সমান ঘাস বা হাঁসুয়াগুলোর মত বিস্মিত করে না। মালার মতো  দেখতে প্রচুর রিক্সাওয়ালা, ডে-লেবার দেখেছে সে। ফারাক্কা এক্সপ্রেস মালদা থেকে দিল্লীর দিকে রওয়ানা দেওয়ার সময় এই  চেহারার প্রচুর লোককে ট্রেনের শেষদিকের কামরাগুলায় দেখা যায়। মালারই মতো দেখতে একটা লোককে “আগগে মাগে” চিৎকার করতে করতে মরে যাওয়ার ভিডিও সে দেখেছে। মালদারই মাল ছিল ওটা। জয় শ্রী…..র ভোগে গেছে। কিন্তু এই পরিবেশে সেইরকম দেখতে লোকের সাথে দরদাম করতে হবে ভেবে নিজেকেই খানিক  অচেনা ঠেকছে তার। “ভোটে কোনো ঝামিলা কইরব না—ইয়াকে বলি চো…..। ভোটে অন্য কোনো শা….র ব্যাটা শা….কে ঝামিলা কইরতেও দিব না— ইয়াকে বলি গাঁ…. মারানো” , মালা খুবই ভদ্রভাবে কথা শুরু করে। “ শুধু চো…. চাইলে দিনে পাঁচ হাজার। থাকা, খাওয়া আলাদা। চো…..য়ের সাথে… গাঁ….. মারাতে চাইলে দিনে সাত; আর খাওয়া, থাকা আলাদা”, মালা তার দিকে তাকিয়ে তাকে মাপছে। “ জানি, আর খিঁ…..তে হবে না”, তার গলায় আত্মবিশ্বাস। রাজমহল পাহাড়ের দিক থেকে ফুলহরের ঘোলাজল মাখা  আঁশটে বাতাস আসছে।  

   আমায় ভোট নিয়ে কথা চালাতে ঠিয়া পার্টির চরে পাঠানো হচ্ছে জেনে অফিস  জুড়ে লোকজন বেশ খাতির করতে লাগল। ভোটের পর যে একখান জম্পেশ খাওয়াদাওয়া হবে সকলেই তা জানে। ঠিয়া পার্টির কিসসাতে আমি ছাড়া সকলেই বেশ রোমাঞ্চ পাচ্ছে। শেরশাহের সময় থেকেই যে গল্পগুলোয় গলা কাটা, চরে অর্ধেক পুঁতে রাখা, তিরিশ টুকরো করে বডি পাঠানো রয়েছে সেই গল্পগুলোই ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। ঠিয়া পার্টিকে পুলিশ কিছুই করতে পারে না কেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা চলার সময় মনসুরা বেওয়া আসে, তিনমাস ধরে বিধবা ভাতা পাচ্ছে না। এল ডি সি মহেবুল খুব গম্ভীর মুখে বলে, “ গদাইয়ের চরের পরের চরে ভোট হবার আছে”। আমি ফিক করে হেসে ফেলি। মহেবুল ফিকফিক। মনসুরা চরের মত চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। জানালা দিয়ে খানিক দূরে ফুলহর। অনেকটা। একটা হালকা কালচে মত দাগ সীমান্তে। 

  আজ রোজকার দিন নয়। আমার সাথে তফিজও যাচ্ছে। রোজকার শার্টপ্যান্ট নয়, কাজিডাঙা হাট থেকে দিন পনেরো আগে তফিজের কিনে আনা আকাশ জামা আর ফ্যান্সি প্যান্ট পরে এসেছি।শঙ্করীটোলা ঘাট থেকে দেড় ঘন্টা হল ভুটভুটিতে রওয়ানা দিয়েছি। রোজ যেটাকে হালকা কালচে দাগ দেখি অফিসের জানালা থেকে সেটা একটা লম্বাটে ঝাউবনের আকার নিচ্ছে। “তফিজ, ঠিয়া পার্টি সত্যি সত্যি আছে কদ্দিন?”, টানা ঘোলা জলের ঘোর কাটাতে আমি জিজ্ঞাসা করি। “যকন থেইকি ধইরেন রাজমহলের চুনা পাথর, উদুয়ার বাঁশ, গঙ্গার বালি ইসব কামে লাগাচ্চে লোকজইন। আর গঙ্গা মনমানি মত ইদিকে কেটে উদিকে জমি উঠাইচ্চে তো ফির উদিকে কেটে ইদিকে জমি উঠাইচ্চে। সেই সময় থাইক্যেই”। “সেটা তাও কত বছর?”, সিগারেটটা নদীতে ফেলে দেওয়ার আগে শেষবার টানি।“গঙ্গার বয়স হামি জানি ন্যা”। ঝুপ করে বাদামী দুটো শুশুক নিজেদের পিঠে রোদ পিছলে আবার ডুব দিল। চুপ করে ঝাউবনটার দিকে তাকাই আমি। ঝাউবনটার ভিতর থেকে চারটে শেয়াল তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে বলা  হয়েছে আর খানিক বাদেই ফুলহর গিয়ে গঙ্গায় মিশবে।তার মায়ের ফোনটা ফোকটে পাওয়া যাবে  কিনা তা নির্ভর করছে মালার মর্জির উপর। মালা দেখতে কেমন? পিছু ফিরে তাকায় সে আবার। মালার মেজাজ কেমন? নৌকা বদল হয়েছে ঘন্টাখানেক  আগে। মালা যদি শা…. কেটে দু-ফাল করে গঙ্গার চরে আমায় পুঁতে দেয়? যদি শা…. গঙ্গায় কুমির আছে এমন জায়গায় ফেলে দেয় মালা? লম্বাটে ঝাউবনটা হালকা কালচে দাগ হয়ে আসছে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *