সুতপন চট্টোপাধ্যায়

আদিত্য

আদিত্য এসেছিল হুগলী জেলার কোন এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে। কোলকাতা শহর তাঁর সম্পুর্ণ অচেনা। কী করে যে  আমাদের বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির পিয়নের চাকরি জুটিয়ে ছিল সে একমাত্র আদিত্যই জানে। কেউ তাকে কোন দিন প্রশ্ন করে নি। লোকে বলে সে আমাদের অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে অসহায়ের  মত কাঁদছিল। আমাদের অফিসের নাগ সাহেবের চোখে পড়ে যায়।হেমন্ত নাগ তখন এই অফিসের বড়কর্তা, রিজিওন্যাল ম্যানেজার। আদিত্য গ্রামের হলে কী হবে সে ফর্সা, মুখমন্ডলে আধা পরিচ্ছনতার ছাপ ছিল, আর মুখের মধ্যে একটা শান্ত ভাব। সেটাই নাগ সাহেবকে আকর্ষণ করেছিল। তিনি আদিত্যকে নিয়ে অফিসে পিয়নের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন । পরিস্কার জামা প্যান্টে আদিত্যকে আধা শহুরে লাগত। গাঁয়ের মুর্খ, অশিক্ষিত মনে হত না। যদিও  আদিত্য একশো ভাগ তাই। কিন্তু তাঁর একটা গুণ ছিল। হুকুম তাঁর কাছে ছিল বেদবাক্য। তাই সে অচিরেই নাগ সাহেবের নিজের লোক হয়ে গেল। মাস ছয়েক পর আদিত্য শহুরে হয়ে গেল। ইয়েস স্যার, নো স্যার, ওকে স্যার, বলতে শুরু করল। আমাদের অফিসের সরকার দেখেছে একদিন সে অফিসের থেকে দূরে গাড়ির পিছনে আপনমনে সিগারেট  টানছে। আর পথচলতি সুন্দরী  মেয়েদের দিকে গুলগুল করে তাকিয়ে দেখছে। সরকারকে দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে আড়ালে লুকিয়ে  ছিল আদিত্য। সেই নিয়ে তাকে অনেকেই খ্যাপাত। তাতে আদিত্যের কোন হেলদোল ছিল না। শুনেই হেসে দিত । লোকের কাছে নিজের পরিচয় দিত অফিস  এ্যসিস্টান্ট । শুনতে খারাপ লাগতো না। সত্যি তো সে অফিসে সকলকে সাহায্য  করে। তাহলে সহায়ক হতে বাধা কোথায়?

দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল। অফিসের সকলের’ই খুব প্রিয় আদিত্য। একদিন সে নাগসাহেবের ঘরে ঢুকে  বলল ,স্যার, আমি আর এই চাকরি করব না। আমি ছেড়ে দিতে চাই। 

শুনে নাগ সাহেব তো অবাক। প্রথমে বিশ্বাস করেন নি। বললেন, কেন ছাড়বি? ঠিক আছে মাইনে কিছুটা বাড়িয়ে দিচ্ছি।

আদিত্য বলল, না, মাইনের জন্য বলছি না। মাইনে যা দেন তাতে ঘরের খরচা মোটামুটি চলেই যায়। মাসের শেষে কিছু হাতে থাকে। তা দিয়ে পোস্ট অফিসে বউয়ের নামে রেকারিং করেছি।

নাগ সাহেবের আবার অবাক হবার পালা। আদিত্যর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন , সেই কি? তুই বিবাহিত? বলিস নি তো আগে?

আদিত্য বলল, এটা কী আর বলার কথা? বয়স হবার আগে বা পরে মানুষ বিয়ে করে। আমি একটু  আগেই করেছিলাম স্যার।

নাগ সাহেব বললেন, মানে? কত দিন আগে বিয়ে করেছিস?

আদিত্য বলল, এখানে চাকরি পাবার আগে। 

নাগ সাহেব বললেন, তাহলে তুই ইন্টারভিউতে মিথ্যে কথা বলেছিলি?

আদিত্য বলল, না বলে উপায় ছিল না। দেশ থেকে তপতীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। মেদিনীপুরের এক উকিল এর কাছে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করি বাড়ির অমতে। বাড়িতে তুমুল ঝগড়া।

বাবা,মা আমাদের বিয়ে মানতে চাইল না। বলল, বেড়িয়ে যা। ওই মেয়েকে আমরা বাড়িতে বউ করে তুলতে পারব না।

নাগ সাহেবের মুখ চোখ কেমন বদলে গেল। বললেন, কেন? মেয়ে তাঁর কী দোষ?

আদিত্য বলল, আমরা বামুন আর ওরা বাগদি। তাঁর উপর বাল-বিধবা। ওদের সমাজে দশ -বার বছরে   বিয়ে দিয়ে দেয়। তাঁর পর মুনিষ খাটে শ্বশুর বাড়িতে। ওর বিয়ে হয়েছিল জেলার শহর থেকে অনেক  দুরের এক গ্রামে। সেখানে  চাষের কাজ করতে গিয়ে  তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। তাঁর পরই সে ফিরে আসে আমাদের গ্রামে। 

নাগ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তোর সঙ্গে আলাপ কী করে? 

–আমরা এক’ই ইস্কুলে পড়তাম। এক ক্লাসে। ছোটবেলা থেকে আমাদের মেলামেশা। 

খানিক থামলেন নাগ সাহেব । তাঁর পর বললেন, তা অন্য কোথাও চাকরি পেয়েছিস তাই ছাড়তে চাইছিস?

আদিত্য বলল, না। আপনি যখন চাকরি দেন তখন আমি হায়ার সেকেন্ডারি তে  তে ফার্স্ট  ডিভিসানে পাশ। আমার চাকরির  খুব দরকার ছিল। তাই সব গোপন করেছিলুম। নিজেকে লুকিয়েছিলুম। বলিনি। বললে চাকরি হতো না। আমি জানতাম। 

নাগ সাহেব এবার বললেন ,আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কেন তুই চাকরি ছাড়তে চাইছিস? তুই কি নিজের কিছু করতে চাস? মানে নিজের বিজনেস?

আদিত্য বলল, না স্যার, বিজনেস করার মত পয়সা কোথায়? 

–তাহলে? 

আদিত্য সঙ্গের ব্যাগ থেকে একটা সার্টিফিকেট বের করে টেবিলে রাখল নাগ সাহেবের। তাঁর পর বলল আমি আর্টিকেলশিপ জয়েন করতে চাই। কথা হয়েছে একটা সি এ ফার্মের সঙ্গে। 

নাগ সাহেব কাগজটার দিকে তাকিয়ে দেখে আদিত্যকে ফেরত দিয়ে বললেন , আই আম ভেরি হ্যাপি। বলে চেয়ার ছেড়ে সবাইকে  বলল, আদিত্য এত দিন আমাদের চরম ধোঁকা দিয়েছে । তাই আমরা তাকে আজ সকলে মিলে খাওয়াবো। 

সুকিয়া স্ট্রীটের একটি বস্তির একটা ঘরে তপতীকে তুলেছিল আদিত্য। সে এক কঠিন সময়। অচেনা কলকাতা শহরে কি করে রোজগার করতে হয় তা এক গোলকধাঁধা। তপতীর কলকাতায় এসে তাঁর সব পরিচয় নতুন করে নির্ধারিত হয়।  সামান্য ইস্কুলের দৌলতে সে পরিচ্ছন্ন, পরিস্কার ও বিনয়ী। দু তিনটে   বাড়ির ঠিকে কাজ হাতে পেয়ে গিয়েছিল । আদিত্য ঘুরে বেড়াতে লাগল বড়বাজারের মুটে, কুরিয়ারের  ডেলিভারিম্যান, কিরণ জ্যোতিষীর চেলা এমনি সব বিচিত্র ভুমিকায়। আমাদের অফিসের পাশে একটি টিভি চ্যানেলের অফিসে সে এসেছিল কিরণ জ্যোতিষীর মাসের কন্ট্রাক্টের টাকা জমা দিতে।  প্রতিদিন রাত দশটায় কিরণ একঘন্টার প্রোগ্রাম করে এই চ্যানেলে। সেদিন তাঁর মাসিক কিস্তির টাকা  দিতে এসেছিল আদিত্য, চার হাজার টাকা পকেটমার হয়ে যায় তাঁর। ভয়ে, দুঃখে অফিসের নিচে অসহায় আদিত্য কাঁদছিল ঠিক তখনই নাগ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার।

আমাদের অফিসে চাকরি করতে করতে বাড়ি ফেরার পথে সে প্রতিদিন রাতের এক সান্ধ্য কলেজে বি কম অনার্স এর ক্লাস করত। সেই পরিশ্রমের ফলকই তাঁর হাতের কাগজটি। ফার্স্ট ক্লাস আদিত্য জানা।

এখানেই আদিত্যর কথা শেষ হতে পারত। এর পর আর আমাদের অফিসের সঙ্গে আদিত্যর কোন যোগাযোগ ছিলনা। বছর দুই পর নাগ সাহেবের অবসর গ্রহণের সময় হয়ে গেল।  তাঁর কিছুদিন পর আমিও এই কোম্পানি ছেড়ে দিল্লী চলে যাই। নতুন চাকরির সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে কোলকাতার সঙ্গে  সম্পর্ক ক্রমাগত ক্ষীণ হতে লাগল। আমার এই নতুন চাকরিতে পৃথিবীর নানা জায়গায় দৌড়তে  হয়, বেশির ভাগই এক অফিসের মিটিং থেকে অন্য অফিসের মিটিং সেরে  হোটেলে ফিরে আসা দিনের  শেষে। তাঁর পর দিল্লীর বাড়িতে ফোন করে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দিনানিপাত। এভাবেই চলছিল, যে ভাবে আবহমান কাল জীবন অতিবাহিত হয়েছে মধ্যবিত্ত মানুষদের । জীবন সংগ্রাম বা জীবনাপাত বলা হয় ঝুলন্ত মাসিক মাইনের ললিপপ সামনে রেখে। এই ইঁন্দূর রেসে আমি আমার অনেক প্রিয়জনের প্রয়োজনে পাশে থাকতে পারিনি। মার মৃত্যুর সময় আমি আমেদাবাদে। ভাই এর ফোনে খবর পেয়ে রাতের বিমান ধরে ভোর রাতে দমদমে নামি।  

 কাতার দেশের দোহা শহরের হিল্টন হোটেলে  সেবার একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যেতে হয়েছিলো। পৃথিবীর মাটির নীচের  সম্পদ তেল ও গ্যাস এর ব্যবহার ক্রমাগত বেড়ে যাবার ফলে  প্রাকৃতিক পরিবেশের যে পরিবর্তন আসন্ন তার উপরই এই সম্মেলন। কী ভাবে, কোন পথে আগামী পৃথিবী এগিয়ে যাবে,তার দিক নির্দেশ ও নির্ণয় করাই ছিল এই সেমিনারের মুল লক্ষ। নিয়ম হিসেবে ঠিক ছিল, কোন দেশ কোন কিছু গোপন  করতে পারবে না। খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। ভারত থেকে আমি ও আর একজন গেছেন এই সম্মেলনে। সম্মেলনের দিন সকাল সারে নটায় সেমিনার হলে সবাই। দুপুরে লাঞ্চের সময় আমি থমকে গেলাম । দেখি আমাকে দেখে এগিয়ে আসছে আদিত্য। দূর থেকে চিনতে পেরেছে আমায়। এগিয়ে এসে বলল, দাদা আপনি? 

আমিও তাঁর হাতে হাত রেখে বিস্ময়ে বিমুঢ। বলল, এই হোটেলে উঠেছেন?

আমি বললাম , হ্যাঁ। 

সেমিনারের পর কফি খাব। চলে যাবেন না যেন, বলে কার সঙ্গে দেখা করতে চলে গেল। 

আমি পিছন থেকে দেখলাম আদিত্যকে। বহু দিন পর । বিদেশে। 

কফির টেবিলে আমাকে ডেকে বসাল আদিত্য। তার পর নিজের পকেট থেকে  বিজনেস কার্ডটা বের করে দিয়ে বলল, এখন আর কিছুই লুকানো যাবে না। দেখি সে  পেশায় চাটার্ড । একটি বিখ্যাত কোম্পানির ফিনান্স ডিরেকটার। দুবাই থেকে এসেছে পরিবেশ পরিবর্তনে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়ে বলতে এই সেমিনারে। তার বক্তৃতার সময় আগামী কাল সকাল দশটা।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *