সুতপন চট্টোপাধ্যায়
অমিতেশ
ন’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলকাতার দিকে তাকালে পুরো শহরটাকে দেখা যায়। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হয় না। সামনাসামনি মানুষের একদিক দেখা যায়। পুরো মানুষ দেখা যায় না। তাই মানুষ চেনা চিরকালেই কঠিন, বেশিরভাগ সময়েই ভূল হয় । মানুষ ও শহর উপর থেকে দেখাই শ্রেয়, এই সবই ভাবছিল অমিতেশ।
কেন এই কথাটা হঠাৎ মনে এল সে টা ঠিক মাথায় এল না। তবে সকালের ঘটনাটাই তাকে ভিতরে ভিতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে বার বার। নিজেকে অনেকবার বুঝিয়েছে, শান্ত হও, শান্ত হও। বাড়িতে বউ বাচ্ছা আছে, মায়ের ওষুধ আছে, বিন্টের ইস্কুলের মাইনে আছে। নিজের সিগারেট আছে। এই সব একলপ্তে বন্ধ হবে সেটা কী ঠিক? মন মানছে না। কে যেন ভিতর থেকে বলছে , এই সব কিছুই নয়। এই পৃথিবী বিশাল। মাথা নত করাটা পুরুষের কাজ নয়। হাতে তির আর ধনুক থাকলে হিংস্র বন্য জন্তুকে মারতে দুমিনিট সময় লাগে না। সুযোগ বারবার আসে না। আর সুযোগ হাতছাড়া হলে আবার কোন শতাব্দীতে আসবে তাঁর ঠিক নেই। হতেও পারে আর সারা জীবন নাও আসতে পারে। তাঁর চেয়ে এসেছে যখন লুফে নাও। আবার মনে হচ্ছে সে তো বাগচী সাহেবের এক দিকটা দেখেছে।
যখনই দেখেছে, তাঁর মুখ, চোখ আর মুখমণ্ডল দেখেছে। পুরোটা তো দেখেনি। পুরো লোকটা কি তাহলে তেমন নয়? যদি তাই না হয় তাহলে কে সে? মালিকের লাভ লোকসান হোক আর নাই হোক তার এত মাথা ব্যাথা কিসের? সে কেন তার চাকরির উপর মাঝে মাঝে লাল কালি ছিটিয়ে রক্তাক্ত করে চলেছে?
২)
প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল, এভাবে বেশী দিন চলবে না। গত বছরের ফলাফল এমন একটা জাায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোম্পানির অনেক অঙ্গ না কাটলে সে আর শ্বাস নিতে পারবে না। কেন পারবে না তার কোন কারণ নেই। কিন্তু পারবে না। সেই ইঙ্গিত বাগচী সাহেব নাকি মালিকের ইঙ্গিতে দেখেছে। তাই তারি নকল করে অমিতেকে যখন ইশারা করে, তখন না শোনার ভান করে ছিল সে। ছাড়তে হলে আপনি ছাড়ুন, আমি কেন? আপনার তো পকেট আমাদের থেকে অনেক ভারী, সেটা আপনি জানেন না? মুখে বলে নি, সেও ইঙ্গিতে বলেছিল। দুজনেই ইঙ্গিতে খেলছিল বেশ কয়েক মাস। তারপর একদিন সে সময়টি এসে হাজির। বাগচি আর না বলে পারল না। বলল, অমিতেশ, আর তিন মাস।
মানে?
–মানে আর তিন মাসের মধ্যে তোমাকে খুঁজে নিতে হবে। ডাউন সাইজ করবে কোম্পানি। শুধু তুমি নও। প্রায় প্রতিটি ব্রাঞ্চ এর উপর কোপ পড়বে। আমার হাত বাঁধা।
অমিতেশ সে দিন কিছু বলে নি। কিন্তু সে তলে তলে খবর পেয়েছে নতুন ছেলে নেবার তোরজোর চলছে। তার অর্ধেক মাইনেতে।
একদিন দরজা ঠেলেই ঘরে ঢুকে এল অমিতেশ।
বাগচী ফাইল থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করল, কী ব্যাপার। আসার আগে নক করতে হয় সেটাও ভুলে গেছো?
কোন উত্তর নেই। বাগচী এবার তার চোখের উপর চোখ রেখে বলল, যা বলার তাড়াতাড়ি বল। সময় নেই।
এবার অমিতেশ যেন দান দেবার সুযোগ পেয়েছে। আপনাকে একটা প্রশ্ন আছে আমার।
–কী?
–আমার সঙ্গে এই চোর পুলিশ খেলাটা কত দিন খেলবেন?
–মানে?
–মানে খুব সহজ। আমাকে চাকরি থেকে ছাঁটিয়ে আপনার নিজের লোককে অল্প পয়সায় নিয়োগ করবেন বলে বড়সাহেব কে কেন বোঝালেন?
–কী যা তা বলছ?
–ঠিক বলেছি না ভুল?
–ভুল।
–না। আপনি মিথ্যে কথা অনর্গল বলতে পারেন আমি জানি। কিন্তু আমার সঙ্গে সেই চেষ্টা করবেন না। ধরা পরে গেছেন।
–না জেনে কথা বলছ।
প্যান্টের পকেটের ভিতর মুঠোটা শক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছিল। অমিতেশ সামলে নিল। বাগচীর চেম্বার ছেড়ে বেড়িয়ে এসে নিজের জায়গায় যেতে যেতে ভাবল। এত সহজে বেজী মেরে বাহবা সে নেবে না।
৩)
কোলাঘাটের অদূরে জাতীয় সড়কের পাশে প্রায় দশ একরের উপর ন্যাশান্যাল কেমিক্যালের বিশাল কারখানা। গুড় থেকে মদ বা আলকোহল করার বিশাল ডিস্টিলারি আছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। আর মদকে কেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় ভেঙে তার অনু থেকে বারো রকমের ভিন্ন ভিন্ন কেমিক্যাল তৈরি। এই কারখানায় কাজ করে প্রায় একশোর উপর মানুষ। বাগচী সেই কোম্পানির পারচেজ ম্যানেজার। চাকরিটি অনেক দিনের। কানের দুপাশ সাদা, নাক টিকল, নাকের উপর গোল্ডেন ফ্রামের চশমা। গায়ের রঙেই তাঁর বয়স লুকিয়ে সে মধ্য চল্লিশের সুপুরুষ। কিন্তু তাঁর মুখ খুব মিষ্টি ও আন্তরিক। প্রায় সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলে তাঁর একটি কারণ সে সবাইকে বোঝতে চায়, সে সকলের প্রিয় ও আপন। এ এক পাবলিসিটি স্টান্ট। বাগচী কে না দেখলে বোঝ যাবে না। এক এক সময় সে কাঁচের মত সচ্ছ আবার অন্য সময় সে কাঁকরের মত অমসৃণ। তাঁর এই দ্বৈত সত্তাই তাকে অনেক কাছের ও অনেক দুরের মানুষ করে রাখে।
আড়কাঠি হয়েছে অমিতেশ। সে তাঁর ঘুঘুর বাসাটা আবিস্কার করে ফেলেছিল একদিন। সে দিন কী কারণে অফিস থেকে বেরোতে দেরি। সে যে অপিসে আছে খেয়াল ছিল না বাগচীর। সে ডেকে পাঠিয়েছিল শ্যাম বাগারিয়াকে। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় শ্যামকে অফিস ঢুকতেই সে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। এত রাতে তো কেউ আসে না অফিসে? শ্যাম বাগচীর ঘরে ঢুকতেই তার ঘরে লাল আলো জ্বলে উঠেছিল। মানে বাগচী বিজি । ডিস্টার্ব করা যাবে না।
অমিতেশ সেটা দেখেই তৈরি হয়ে বেড়িয়ে গেছিল অফিস থেকে যাতে বাগচী তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে না পায়। ঠিক তাই হলো। বাগচীর বাইরে এসে দেখল অমিতেশ নেই তার সিটে। চলে গেছে। আপদ গেছে। অমিতেশ অফিস থেকে বেরিয়ে পাশের একটা রেঁস্তোরায় বসে রইল কিচুক্ষণ। তারপর দেখল দুজনে অফিস থেকে বেড়িয়েছে। পিছু নিল অমিতেশ।
কিছু দূরে তারা দু জনে একটা রেঁস্তোরার বসল মুখোমুখি। কাচের ভিতর দিয়ে কিছুটা দূর থেকে ফলো করল অমিতেশ। এক সময় সুইটকেসটা বাগচীর হাতে দিয়ে গাড়িতে উঠে পরল শ্যাম। বাগচী যেন কিছু কিনে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছে। বোঝার যো নেই। সে ড্রাইভার কে ডেকে নিলে মিনিট পাঁচেক পরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়াল। বাগচী উঠতে যাবে অমিতেশ সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে একটু লিফট দেবেন স্যার? লেট হয়ে গেছে আজ।
নিরুপায় বাগচী তাকে লিফট দিয়েছিল। কিন্তু অমিতেশ জানে সেদিন বাগচী বুঝে গিয়েছিল যে সে তাকে অনুসরণ করেছে। তার এত রাত অব্দি থাকার কথা না। সামনের সিট বসে ছিল অমিতেশ। পিছনের সিটে বাগচী আর সুটকেস। কাঁচা মালের সাপ্ল্যারের উপহার। মাঝে মাঝে বাগচী সুটকেসের উপর হাত বুলিয়ে নিচ্ছে । আড় চোখে দেখে ছিল অমিতেশ।
সেদিন যে বাগচী সন্ধেহ করেছিল তার লক্ষণ বেশ মনে আছে অমিতেশের। বাগচী তার ঘরে ঘনঘন ডাকা কমিয়ে দিল। কাজ অনেকটাই ভাগ করে দিল বিমলেন্দু নামের বলে এক তরুণ কর্মচারি কে। আর নতুন মালপত্র কেনার জন্য কোটেশান আনার কাজটা প্রায় নিজের হাতে নিয়ে, কাকে দিয়ে করাচ্ছিল সেটা টের পেল না অমিতেশ। সেই থেকে শুরু। এই দুরত্ব ফিতে দিয়ে মাপা যায় না, অনুভবে আর চোখের দৃষ্টিতে মেপে নিতে হয়। অমিতেশ ও তাই করছিল।
৪)
বাড়ি ফেরার পথে হাতি বাগান বাজার থেকে একটা ছোরা কিনল অমিতেশ। ছোরা টা কেনার পর থেকেই তার মাথার মধ্যে সবর্ক্ষণ বাগচীর মুখটা ভেসে উঠতে লাগল। অফিসে, অফিসের বাইরে বাগচী তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। সে একদিন ছোরাটা ড্রয়ারের মধ্যে রেখে বাড়ি এল, কিন্তু তাতেও অবস্থার পরিবর্তন হল না। দিন দিন অমিতেশ বুঝতে পারছিল তাকে সরানোর আপ্রান চেষ্টা করে চলেছে বাগচী। আকারে ইঙ্গিতে সে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
একদিন বাড়িতে বলেই ফেলল অমিতেশ । বউ মহুয়া বলল, সম্মান আগে না চাকরি আগে সেটা ঠিক কর। চাকরির যে অবস্থা চলে গেলে কী করবে? চাকরি কোথায়? তাছাড়া তোমার বয়স একটু বেড়েও গেছে।
সারা দিন অমিতেশের মনের ভিতরে এক তুমুল যুদ্ধ চলছে। আজ সে বারান্দায় বেড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই দেখল বাগচী বেড়িয়ে যাচ্ছে নিজের চেম্বার ছেড়ে। সে যেন ওৎ পেতে ছিল। যেই সে লিফটে ঢুকল, অমিতেশ বারান্দা থেকে সেই হাতি বাগানের ছোরা নিয়ে তৈরি হল । বাগচী গেট দিয়ে বেড়িয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়াবে। তাই দাঁড়াল। আর অমিতেশ উপর থেকে সময় ক্যাল্কুলেট করে ছোরাটা ফেলে দিল নীচে। যাতে তাঁর মাথা ফুটো করে শরীরে ঢুকে যায় ছোরাটা। কোন দিক থেকে মেরেছে বোঝা না যায়।
নীচের দিকে তাকিয়ে রইল অমিতেশ। ছোরাটা মাধ্যাকর্ষনের টানে প্রবল গতিতে নিচে নেমে বাগচীর পাশে আছড়ে পড়ল। সচকিত হয়ে এক লাফে ছিটকে গেলে বাগচী। অমিতেশ ততক্ষণে নিজের সিটে এসে বসেছে। খবরটা আসতে একটু দেরি হল। সে শুনল অল্পের জন্য বেঁচে গেছে বাগচী।
তাই বোধ হয় হয়, এই সব মানুষের এ ভাবে আচমকা মৃত্যু হয় না। তারা অল্পের জন্য বেঁচে যায়। আর অমিতেশের মত মানুষেরা ছোরা কেনে গোপনে, সামনা সামনি ব্যবহার করতে পারে না। লক্ষভ্রষ্ঠ হয় বার বার। প্রতিভাস ম্যাগাজিন