সুতপন চট্টোপাধ্যায়
সজল মামা
আমাদের বড়িতে মধ্য রাতে কেউ কোনদিন আসে নি। আমরা দেখিনি। তাই আমাদের বাড়ির দরজা ভিতর থেকে হুড়কো দিয়ে আটকান থাকে। বাবা রোজ সকালে খোলে এবং রাতে বন্ধ করে। সে দিন এমনি রাত। দরজা বন্ধ।
মধ্য রাত। ধুপ করে শব্দ হল বাইরে। বাইরে না ভিতরে ঘরের ভিতর থেকে বোঝা দায়। মা’র ঘুম পাতলা, রাতে শব্দ আরো জোরে বাজে। মা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমাকে বলল, দেখ তো নারকোল গাছ থেকে কে যেন লাফিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে। চোর হবে। বাবাকে ডাক। বাবা ততক্ষনে উঠে পড়েছে।
কোনদিন চোর পড়েনি, ডাকাত তো কল্পনার অতীত। ভয়ে গা ছম ছম করছে। বাবা চৌকীর নিচ থেকে বাঁশের লাঠি নিয়ে বারান্দার দরজা খোলার তোরজোর করছে। বাইরে থেকে চাপা গলা, ভয় নেই আমি চোর নই। আমি সজল। বাড়ির দেওয়াল টোপকে বাড়িতে ঢুকেছিল সজল মামা। সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতে এক চাপা উত্তেজনা। সজল মামা আমাদের বাড়িতে মধ্যরাতে? রহস্যের বেড়াজালে মোড়া হয়েছিল আমাদের বাড়ি। কে প্রথম জানবে সজল মামার আসার কারণ টা কী?
সজল মামা বাড়ির ভিতরে একটা টুলের উপর বসল। মা, জল এনে মাথায় একটু ছিটিয়ে দিল। সজল মামা মায়ের ছোট ভাই। তিন বোনের পর দুই ভাই। কমলমামা থেকে বর্ধমানে। সজল মামা বাঁকুড়ায় ডাক্তারি পড়ে। ছোট ভাই সবার আদরের । তার একটা প্রধান কারণ সে মাধ্যমিকে জেলার প্রথম হয়েছিল বলে বোনেরা গর্বে বিভোর । মাকেও মাঝে মাঝে আমাকে বলতে শুনেছি, ছোট মামার মত হতে হবে। এই আপ্ত বাক্যটা মনের মধ্যে ঘড়ির কাঁটার মত টিক টিক করে নড়ত। সেদিন রাতে কেন যেন তার ছিঁড়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম সজল মামা এমন চোরের মত রাতে আমাদের বাড়িতে কেন? কিছু কী অন্যায় করেছে তাই পালিয়ে এসেছে? কী হতে পারে? মারামারি, চুরি, শুনেছিলাম সে হোস্টেলে থাকত। সে কী হোস্টেলে কিছু করেছে?
কে জিজ্ঞেস করবে? দেখি বাবা মাকে বলছে। তুমি জিজ্ঞাসা কর। মা বলছে, আমায় বলবে না,তোমায় শ্রদ্ধা করে, ভয় ও খায়, তোমাকেই বলবে। এর মাঝেই সজল মামা বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে মাকে বলল, কিছু খেতে দে দিদি, দুপুর থেকে খাই নি।
মা সব ছেড়ে রান্না ঘরে চলে গেলে বাবা সজল মামাকে বলল, কী ব্যাপার বলত সজল, এত রাতে তুমি কোথা থেকে? কী করেই বা এলে। বাস তো রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায়?
সজল মামা একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। আমি বাসে আসে নি। একজন আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে বাইকে।
কেন এলে তা তো বললে না। সজল মামা বলল, সেটা পরে বলব। এখানে ক’ দিন থাকব জামাই বাবু।
বাবা বলল, সে তুমি যত দিন থাকতে চাও থাক। তোমারই তো দিদির বাড়ি।
সজল মামা অনেক দিন ছিল আমাদের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে এতোদিন থাকাটা কেউ আপত্তি করে নি। কলেজে পড়তে পড়তে এক বিপ্লবী রাজনৈতিক দলে ভিড়ে গিয়েছিল সজল মামা। তাদের কলেজে একটা খুন হয়েছিল সে কারণে পুলিশ খুঁজছিল তাকে। সে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে থেকে আমাকে অঙ্ক ও ইংরাজী পড়াত । সজলমামা যে খুব মেধাবী ও তুখোড় তা তাঁর পড়ানো দেখলেই বোঝা যেত। অনেক অনেক দিন পর কলেজে ফিরে গিয়েছিল সজল মামা। আর আসে নি।
সেই সজল মামা ডাক্তার হয়ে অনেক কাল ইংল্যান্ডে। আমাদের দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সেই দেশে । কয়েক বছর দেশে আসে নি। ছেলে মেয়ে বড় হতে তবেই আসা আরম্ভ করেছে। বিদেশী বউ, দুই ছেলে নিয়ে এবার কোলকাতায় আসছে সজল মামা। আমাদের বড়িতে থাকবে দু দিন তার পর একদিন হোটেলে থেকে রাজস্থান বেড়াতে যাবে। সেই মত আমি বিমান বন্দরে আনতে গেছি। বাবা নেই, মাও শয্যাশায়ী। তবু বিদেশ থেকে কৃতী ভাই আসছে শুনে বেশ চাঙ্গা। দু দিন থেকে ঘর বার করছে, কুঁজো হয়ে এক হাঁটুতে হাত রেখে। চুল সব সাদা। মাঝে মাঝে বলছে, সজলটা আমাকে দেখে খুব দুঃখ পাবে, এত শরীর খারাপ, চুল সব সাদা। চিনতে পারলে হয়। খুব ইচ্ছে ছিল তালের ফুলুড়ি বানাবো। সজল খুব খেতে ভালোবাসে। কিন্তু তাল মারার লোকই নেই!
ঠিক সময় বি্মানবন্দরে আমি হাজির। সপরিবারে সজল মামা এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে এসেই চিৎকার করে উঠল, বিলটু? আমারা এখানে। বলে এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল আমার। আমি একটা বড় গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই ফিরে এলাম বাড়িতে।
মায়ের কোথায় যেন একা দ্বিধা ছিল। আমাদের মত ছোট্ট বাড়িতে সজল মামার পরিবার থাকতে পারবে তো? বাড়ি পৌছনোর পর অব্দি সেই ধন্দ কমে নি। তাই বাড়িটা দেখিয়ে মা সজলমামাকে বলল, হাঁরে, আমার বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হবে না তো তোদের?
বিদেশিনী মামিমা বলল, না না একবারিই নয়।
আমরা সবাই চমকে গেছি তার বাংলায় কথা বলা দেখে। ভেবেছিলাম মামিমার ও ছেলেদের সঙ্গে আমদের ইংরাজি তেই কথা বলতে হবে। মামিমার কথা শুনে মা অবাক হয়ে বলল, ওমা তুমি তো ভালো বাংলা বলতে পার?
মামিমা বলল, আপনার ভাই শিখিয়েছে। আমি পড়তেও পারি।
আমাদের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
মামিমা আবার বলল, বিয়ের পর হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে বাংলা শেখাত।
শুনে আমাদের কি আনন্দ। মামিমা কে যেন তিন গুন ভালবেসে ফেললাম। মামিমা ও ডাক্তার তবে মামার মত সার্জেন নয়। ডারমাটোলজিস্ট । দুই ছেলে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের বাড়িতে সেদিন উৎসবের আবহাওয়া। মামা বাবার লুঙ্গি পড়ে সোফায় বসে টেলিভিসন দেখছে। মামিমা মায়ের সঙ্গে রান্না ঘরে খাবার তদারকি করার চেষ্ঠা করছে। মা কিছুতেই করতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝেই পছন্দের খাবার করে নিয়ে আসছে। মা আর সজল মামার গল্পের শেষ নেই। তাদের ছোট বেলা, দেশের বাড়ি, দাদার কথা, অন্য বোনেদের কথা নিয়ে মশগুল । এর মধ্যে আমি বাজার করে ফিরেছি। নানা রকম বাজার করে এনেছি । মা লিস্ট করে দিয়েছে। সজলমামা কী কী খেতে ভালো বাসত তার লিস্ট ধরে। চন্দনা সেগুল ধুয়ে, মুছে সব একে একে সাজিয়ে রাখছে ফ্রিজে। মায়ের আদেশ মত সে ব্যবহার করবে।
এমন সময় দুই জমজ ভাই ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মামিমার কোলে। কে বড় কে ছোট বোঝা মুশকিল। মামিমার কোলে মুখ ঘসে এবার আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, চল আমরা বাইরে ঘুড়ে আসি।
দু জনেই এক কথায় রাজি। মা দুজনকে আদর করে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও?
দু জনেই এক স্বরে বলল, ডাক্তার।
মা অবাক হয়ে বলল, ওমা ওরাও বাংলা বলতে পারে! মামিমা বলল, ওই সব শিখিয়েছে।
মা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, সজল, এটা দেখে মা যে কী খুশি হত। খুব খুশি হত। তুই এতো বড় ডাক্তার হয়েছিস, কিন্তু মাতৃভাষা ভুলিস নি।