সুতপন চট্টোপাধ্যায়

জাহির 

জাহিরের সঙ্গে আলাপ হল দক্ষিণ গোয়ার পামোলেম সমুদ্র  সৈকতে। বিকেল বেলা, সূর্যের  তেজ  কমে   এসেছে, পশ্চিমাকাশে  ঢলে পড়েছে রোদ। হালকা হাওয়া বইছে। এ সময় পামোলেম বিচে খুব একটা ভিড় নেই। যা পর্যটক তা হাতে গোনা গুন্তি। কাছে পিঠে হোটেলে উঠেছে। অফ্ সিজিন্। আমিও এসেছি এই   বিস্তৃত বিচে সুর্যাস্ত দেখতে। ডান দিকে  চোখে পরে দুটো ঘুমন্ত পাহাড়। একটা বড় আর অন্যটা সমুদ্রের মধ্যে আকারে ছোট। তার মধ্যে বিপুল জলরাশি। বাঁ দিকে তাকালে বিস্তৃত সাদা  বালির সৈকত।  শেষে  বেঁকে গেছে একটা সবুজ  পাহাড়ের  কোল ঘেঁষে দৃষ্টির বাইরে। এই বিচটা  অনেকটাই  অর্ধচন্দ্রাকৃতি। আমার মত জাহিরও এসেছে সৈকতে। সে সৈকতের  ধাপির উপর বসে আমেরিকান কর্ন খাচ্ছিল। আমিও তেমনি একটা ভুট্টা নিয়ে বসেছি। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল জাহির। আমি বললাম, বেড়াতে  এসেছো? 

ঘাড় নাড়ল। 

–বাড়ি কোথায়? 

–কাশ্মীর।  লাজুক উত্তর। 

–কাশ্মীরের কোথায়?    

ও নাম বলল। আবার এক মনে ভুট্টা খেতে লাগল। আমিও তার মত ভুট্টা কিনেছি  কিন্তু একটা মজার  অভিজ্ঞতা হয়েছে । যে লোকটি কাঠ কয়লার আগুনে সেঁকে ভুট্টা বিক্রি করছিল,  তাকে একটা ভুট্টা দিতে বললে সে আমাকে বিরক্ত গলায় বলল, এটা ভুট্টা নয়। এটা আমেরিকান সুইট কর্ণ। ভুট্টার থেকে এ অনেক আলাদা।  

আমি বললাম, ওই হোল। 

লোকটি বলল, না, দুটো এক নয়। সে ভুট্টার গা থেকে ছাল ছাড়িয়ে বড় বড় দানা দেখিয়ে বলল, দেখুন, এখানের ভূট্টা হলে এত বড় দানা দাঁতে কামড়ানো য্যয় না। শক্ত ইটের মত হয়ে যায়। আর এই দেখুন  এর বড় বড় দানা, কি নরম ও রসালো মিস্টি। তাই এটা ভুট্টা বলবেন না। এটা একমাত্র এখানেই হয়।    

আমি মনে মনে হাসলাম । হয়ত নিজের ক্ষেত থেকে কেটে তাজা বিক্রি করছে। ্তাই এতো বড় দাবি! কিন্তু অন্য কোথাও  হয় না, জোর দিয়ে কী বলতে পারে? 

আমি  আমেরিকান সুইট কর্ণ খেতে খেতে প্রশ্ন করলাম, কতদিনের  প্ল্যান? 

জাহির বলল, আমি এখানেই থাকি। আমাদের এখানে দোকান আছে। 

–কোন দোকান? কিসের দোকান? 

বলল, এই  বিচ থেকে যে রাস্তাটা বাজারের দিকে গেছে, ডান দিকে টার্ণ  নিয়েই সাত নম্বর দোকান। আসুন না। আপনি কত দিন?

–চার দিনের প্ল্যান। তোমাদের  কিসের  দোকান? আবার জিজ্ঞাসা করি। 

–নানান ডিজাইনের পোশাক। আপনার, ম্যাডামের সব পাবেন। বলে সে আকাশের দিকে তাকাল। সারা আকাশে এখন লাল আবীর রঙ্। সেই রঙের ঢেউ তীরে এসে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে জাহির। আমিও দেখতে দেখতে খেয়াল করিনি আমদের পাশে অনেক লোক এসে বসেছে ধাপিতে।

–কাশ্মীর থেকে কোন বয়সে এসেছো?

–মাট্রিকের পর। এখান থেকে গ্রাজুয়েট। 

 হঠাৎ এখানে এলে কেন সুদূর কাশ্মীর থেকে?  

জাহির উঠে পড়ল। হাল্কা হেসে বলল, দোকানে আসুন। এখানে বলব না। বলে চলে গেল।

                                                             ২)

বুদ্ধিমান ছেলে। আমার আগ্রহের সুযোগ বুঝে আমাকে ক্রেতা বানাতে সে ভুল করেনি। ঠিক টোপটা দিয়ে সে চলে গেছে। এখানে রাস্তার দু দিকে সারি সারি দোকান। ওদের দোকানে নাও ঢুকতে  পারতাম।  এবার সেই দোকানে যাবার আকর্ষণ ফেলতে পারলাম না। বনানীকে বললাম, যাবে নাকি?

বনানী  বলল, চলো একদিন । দেখেই আসি। দেখতে ক্ষতি কি? পছন্দ হলে কিনবো না হলে কিনবো না। জামা কাপড় তো অনেক আছে।    

আমাদের একটা রোগ আছে। বেড়াতে গেলেই কিছু না কিছু কিনতেই হয়। আজকাল ছোট ছোট   উপহার দেবার রেওযাজ হয়েছে। উপহার বিনিময়ের কালচারে বাঙালী মশগুল। কারোর  জন্য কিছুই না কিনলেও, বন্ধুদের জন্য টোকেন গিফট বা রিটার্ণ গিফট না হলেই নয়। কিনতেই হবে।না হলে মান সম্মান ধুলায় লুন্ঠিত। সে নবীন কিশোরই হোক বা মধ্যবর্তিনী হোক। বনানী এ দোকান সে দোকান ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার এই শখ। কিনবে হয়ত একটা, দেখবে সহস্রটা। দোকানের লোকগুলোকে এমন লোভ ধরায়, খাটায় আর নানান কথা জানতে চায়! তারা অসহায় হয়ে অনেক সময় বুঝতে পারেই  না বনানী  আসলে কি চায়? কী সে কিনবে? কেবল আমি বুঝতে পারি, সে আসলে সময় কাটাতে চায়।  তাঁর হাতে অখন্ড অবসর।  তাতেই তার ভ্রমণ বিনোদন। 

দিনের বেলায় গাড়ি নিয়ে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে জঙ্গল পাহাড় আর ঝর্ণা দেখতে যাই। বিকেলে  ফিরে আসি। তার পর সামনের  রাস্তার ধরে সমুদ্রতটেই  বিশ্রাম । সে দিন প্রবল বৃষ্টি। যে ক’জন আমাদের মত গোয়ায় বেড়াতে এসেছে তারা সমুদ্রের উপর এই আচমকা বৃষ্টি দেখতে এসেছে।  ঝুলন্ত মেঘ থেকে অঝোরে বৃষ্টির  তীর ঝাঁপিয়ে পড়ছে  সমুদ্রের উপর। এ যেন আকাশের সঙ্গে সমুদ্রের যুদ্ধের দৃশ্য। মিনিট দশেক পরেই শরতের নী্ল আকাশ সমুদ্রের জলের উপর তার ছায়া  ফেলেছে। কি মনোরম ! সৈকত থেকে ফেরার পথে বনানী বলল, চল, জাহিরের দোকানে যাই। দেখে আসি।  

                                                      ৩)  

রাস্তার উপর পরপর সাতটা দোকানের মধ্যে একটা দোকান পারিজাত। সাজানো দোকান, ফ্লুরোসেন্ট আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক। আকারে বড়, দোকানের এক দেওয়ালে থাকে থাকে সাজানো প্লাস্টিকের প্যাকেট। একাধিক জামা আছে এক একটা প্যাকটে। দোকানের মেঝেতে একাধিক স্টান্ডে সাজানো ছেলেদের জামা, গেঞ্জি, মেয়েদের ড্রেস, জামা কাপড়। দোকানে ঢুকতেই  এক গাল হেসে দিল জাহির। এলেন তাহলে?

বনানী  বলল, বাহ, আসবো না। তুমি নেমতন্ন করেছো। আমরা বেড়াতে  এসে দেখতে  আসবই তো,  কি কি পাওয়া যায়?  জামা কাপড়ের  আড়াল থেকে এক গম্ভীর গলা কানে এলো, ঠিক বলেছেন।   আসবেনই তো। সেই জন্যই তো আমরা বসে  আছি। না এলে আমাদের চলবে কেন? 

 কীসের ইঙ্গিত? না কিনে যাওয়া যাবে না? মনে হল আমার। 

দেখি, দীর্ঘকায়, পাঠানসদৃশ্য এক মধ্যবয়সী মানুষ। দেখলে বোঝা যায় জাহিরের বড় ভাই বা কাকা। আমাদের দিকে তাকিয়ে জাহির বলল, বড়ে ভাইয়া। ভদ্রলোক নমস্কার করে বলল, যা ইচ্ছে দেখতে পারেন। পছন্দ হলে নেবেন। আমরা কোয়ালিটি জিনিস রাখি। আমাদের আশি পার্সেন্ট  কাস্টোমার  ইউ কে, সুইডেন, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডের। নভেম্বর থেকে এপ্রিল ওরাই দলে দলে প্রতিবছর আসে। প্রান ভরে কিনে নিয়ে যায় ওদের দেশে।  

বনানী  বলল,অন্য দেশের লোক আসে না? 

জাহির বলল, আসে তবে ওই দেশগুলো থেকেই আমাদের কাস্টোমার বেশি। আমাদের উপর বিশ্বাস ।

ভদ্রলোক বলল, তাই আমাদের কোয়ালিটিতে কম্প্রোমাইজ করতে পারি না। মুম্বাইতে আমাদের এক  কাকার কারখানা  আছে। সেখানেই সব তৈরি হয়। এখন অফ সিজিন, তাই কিছুটা ডিসকাউন্টেই  ছেড়ে  দিই।

বনানী  আমার দিকে তাকাল।  কানে ফিস ফিস করে বলল, অসময়ে  এসেছি বলে কেমন দয়া  দাক্ষিন্য করছে , বুঝেছো। আমি ঘাড় নাড়লাম। খুব বেশি ডিসকাউন্ট পাবো বলে মনে হচ্ছে না।  ভাগ্যিস আমাদের ভাষা ওরা বোঝে না!    

“ইম্পালস্ পারচেজ” বলে একটা  কথা আছে ইংরাজিতে। তার সঠিক বাংলা জানি না।  দেখলেই কিনতে হবে, এমনি এই বাংলা প্রবাদের কাছাকাছি। বনানীর  এই রোগটি আছে পুরো মাত্রায়। সে  কোনদিনই  লিস্ট করে  কেনাকাটার ব্যকরণ মানে না। এই নিয়ে আমাকে অনেকদিন বিপদে পড়তে হয়েছে। সেদিন তাই হল। কি যে হল বনানীর । এখানেই কেনবার জন্য সে বলি প্রদত্ত হয়েই যেন এসেছে । এক একটা স্টান্ডে  ঘুরছে, এক একটা  জিনিস এনে বড়োভাই এর সামনে রেখে বলছে, এটা পছন্দ হয়েছে, রাখুন। বলে আবার ফ্লোরে চলে যাচ্ছে। আমার কোমর ধরে গেছে। একটা চেয়ার টেনে এক কোনে বসে পড়েছি। 

বড়ো ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম?   

–আব্বাসউদ্দিন। লোকাল লোক ও আমাদের বিদেশী কাস্টোমার  আমাকে আবি বলে ডাকে।  

— বেশ সুন্দর নাম। দোকানটা কি নিজের? 

— না, না, স্যার, ভাড়া। নিজের হবে কী করে? কয়েক কোটি দাম।  

—বাড়িওয়ালা এখানেই থাকে? 

–না ইংল্যান্ডে। এখানে থাকলেও  তারা সবাই ভাড়া দেয় আর সেই টাকা এঞ্জয় করে।  

–কত ভাড়া দিতে হয় আপনাকে। আপত্তি যদি না থাকে ……।

আব্বাসউদ্দিন বলল, না বলার কি আছে? দশ মাসের জন্য দশ লাখ।  

–ওরে বাবা? এতো ভাড়া? আর দশ মাস কেন?

— দু মাস আমরা দেশের বাড়ি চলে যাই। দোকান বন্ধ থাকে। নো বিজনেস।  

আমি বুঝলাম।

খেয়াল ছিল না। দেখি জাহির চারটে ভুট্টা নিয়ে ফিরছে। আব্বাস বলল, আসুন আপনাদের জন্য জাহির ভুট্টা এনেছে। ওর খুব প্রিয় খাবার। আমরা অপ্রস্তুত । এবং খুশিও। ছেলেটা ঠিক ভুট্টার কথা মনে করে এনেছে আমাদের জন্য। কেনা কাটা থামিয়ে ভুট্টা খেতে লাগলাম, না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে  যে?  

ভুট্টা শেষ হলে জাহির বলল, ম্যাডাম ভুট্টাগুলো দারুণ কিন্তু লোকটাকে আমার ভাল লাগে না।

বনানী অবাক হয়ে  বলল, কেন?  

–রোজ বলে, এটা ভুট্টা নয়। আমেরিকান সুইট কর্ণ। ওই আমেরিকান শুনলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। 

লক্ষ করি, আব্বাস যেন নড়ে চড়ে বসল। বনানী  আবার প্রশ্ন করল, কেন? তাতে কি হয়েছে? 

জাহিরের মুখ চোখ কেমন বদলে গেল হঠাৎ। সে বলল, ওই দেশটাই  তো আমাদের আপনাদের মধ্য মাঝে  মাঝেই যুদ্ধ লাগায়। কতও লোক মরে। ওই দেশটাকে আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না। দেখি  আব্বাস তার দিকে কঠিন চোখে  তাকিয়ে আছে।  

কথাটা আমার আর বনানীর  কানে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিয়েছে। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়েছি। । আব্বাস দেখতে পেয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে সে জাহিরকে বলল, যা তুই জেমস্ এর  দোকানে যা। কাজ আছে। আমি এদিকটা দেখে নেব।

জাহির আমাদের নমস্তে বলে দাদার আদেশ মত ভুট্টা খেতে খেতে  চলে গেল। 

বনানীর কেনাকাটা শেষ হলে আব্বাস আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা কথা বলব ম্যাডাম? কিছু যদি না মনে করেন?

আমি বললাম, বলুন। 

আব্বাস বলল, আমার এই ছোট ভাইটা মাঝে মাঝে খুব সমস্যায় ফেলে দেয়। জানেন, আমাদের আগের পুর্ব-পুরুষের ঘর  ছিল লাহোরে। দেশ ভাগের আগেই আমরা ভারতে চলে এসেছি। আমাদের বাড়ি  সীমান্তের কাছে। সেখানে মাঝেমাঝেই  গোলা গুলি এসে পড়ত। আমরা তাই গাঁও ছেড়ে  এখানে  চলে এসে ব্যবসা শুরু করি। আমরা ভারতের হয়ে গেছি। জাহির  হতে পারে নি।ও লেখা পড়া করেছে। আমরা তো করি নি। তাই ওর কথা বুঝতে পারি না। ও এখনও মনে করে, আমাদের দেশ একটাই । ভারত  পাকিস্তান  বলে আলাদা দেশ নেই। হতেই পারে না।  আমেরিকাই আমাদের মধ্যে  যুদ্ধটা লাগায়, লড়াই লাগায়, বোমা ফেলে, ঘর বাড়ি ধ্বংস করে । আর এই সব মনে হলেই জাহির ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কি করি বলুন তো?  

–এখানে কোথাও চাকরিতে লাগিয়ে দিন। বনানীর দৃঢ় কন্ঠস্বর।  

আব্বাস বলল, আসলে ওর মনটা খুব ভাল। পাঠাই না কেন জানেন?  ওর বিশ্বাসটা নষ্ঠ হতে দিতে চাই না। ওটা তো  আমাদেরও কথা। কিন্তু বলতে পারি কই? চাকরিতে দিলেও ও অসাবধানে কাউকে না কাউকে বলে বসবে। তখন আমাদের খুব সমস্যা হয়ে যাবে। আমদের এই পালোলেমে দশটা ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা আছে। সবই এক পরিবারের। আমরা সবাই এক সঙ্গে থাকি। বলে থামল আব্বাস।

–তাই কি আপনি ওকে অন্য দোকানে পাঠিয়ে দিলেন? প্রশ্ন করি আমি। 

–ঠিক তাই। আব্বাস বলল। তার পর বলল, কি কি  বিল করব বলুন। 

বনানীর  যা পছন্দ তা সবই আব্বাসকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ভালো ডিসকাউন্ট দেবেন। অনেক কিছু নিয়েছি। 

আব্বাস মাথা নিচু করে বিল করতে করতে  বলল, দেব। তবে এই  জাহিরের কথাটা কাউকে বলবেন না দিদি। প্লিজ।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *