সুতপন চট্টোপাধ্যায়
কাভেরী
কাবেরীর গায়ের রঙ কুচ কুচে কালো। মাথায় এক মাথা ঘন পিঠ ছাপানো চুল, সবল সাস্থ্য, টানা টানা চোখ । তাকালে বিদ্যুতের ঝলক মনে হয়। শানিত, জিজ্ঞাসু ও আত্মনির্ভর । আমি চেন্নাই-এর অফিসে প্রথন দিন জয়েন করলে সেই আমাকে আমার কেবিনে নিয়ে এল। হাত জোর করে বলল, নমস্কারম, আমি আপনার সেক্রেতারি।
আমি জানতাম আমার আগের জনের একজন সেক্রেটারি আছে। সেই আমার সঙ্গে কাজ করবে। সে যে এমন সুন্দরী হবে জানা ছিল না। মাথায় মোটা বেলফুলের মালা জড়ানো। বিছের মত কালো চুলে সেই মালা তার মাথার চার পাশে ওড়িষি নাচের মেক আপ মনে হয় কোন কোন দিন। তার বসার চেয়ার বাইরে । আমার চেম্বার থেকে একটু দূরে। তার পিছনে আমাদের ডিপার্টমেন্টের দক্ষিন ভারতের সহকর্মিরা। তারা একে একে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করে গেলে কাবেরী আবার ঘরে এল। বলল, যা দরকার হবে আমাকে বলবেন স্যার। আমি একটু পরেই আপনাকে তিনটে ফাইল দিয়ে দিচ্ছি। আমার ড্রয়ারে আছে।
কি কি ফাইল?
একটা ছুটির লিস্ট। একটা কনফিডেন্সিয়াল ফাইল আর একটা স্টাফ পার্ফরম্যান্স ফাইল। এগুলো আপনার ড্রয়ারে রাখবেন। আমার কাছে আর রাখবার দরকার নেই।
তোমার কাছে গেল কি করে?
ভেঙ্কট স্যার যাবার আগে আমার কাছে রেখে গেছেন। কলকাতার হেড অফিসের নির্দেশ ছিল বোধহয়। আমি ঠিক জানি না। বলে সে বাইরে বেড়িয়ে গেলে চেম্বারটা বেল ফুলের সুন্দর গন্ধে ভরে রইল কিছুক্ষণ।
আমার এই বিভাগটা খুব বিরাট নয়। কলকাতার একটি বড় পরামর্শদাতা সংস্থার বিশেষ একটি শাখা । এখান থেকে বেশ কয়েকটি কন্সট্রাক্সন সংক্রান্ত কেমিক্যাল নিয়ে কাজ হয় । ব্যবসা পুরো দাক্ষিণাত্যে ছড়ানো। তারই দায়িত্বে আমি এখানে এসেছি।
প্রথমে এসে মনটা খারাপ হয়ে ছিল। কদাচিৎ, ফর্সা রঙের মানুষ্ দেখা যায় । না পুরুষ না নারী। কিন্তু কালো রঙের কি মাধুর্য না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। মানুষরাও যেমন সহজ, বিশ্বাসী তেমনি তাদের চিন্তা ভাবনা ও জীবন বিন্যাস। তারা সারা শহরটিকে গাছের ছায়া দিয়ে বেধে রেখেছে , এমন সাস্থ্যকর খাবার যে শরীর খারাপের কোন সম্ভবনা নেই, সারা শহরে সাইকেল প্রধান যানবাহন, বাস কদাচিৎ দেখা যায়। গাড়ির সংখা খুব কম। অথচ টি-নগর, এ্যডেয়ার, বেসান্ত নগরে মানুষের ঢল, জিনিস পত্র দোকান উপচে রাস্তায় এসে পড়েছে। বাজার কিন্তু শান্ত, নিঃশব্দ, স্বনিয়ন্ত্রিত চলাফেরা। কলকাতার ঠিক বিপরীত মেরুর শহর।
কাবেরী প্রখর সপ্রতিভ । আমার কাজের সে ধরতাই খুব সহজেই বুঝে ফেলেছে দেখে আমি কিছুটা অবাক হয়েছি। একদিন বললাম, আমি ট্যুরে যাবো, কেরালা।
কেরালা যাবেন? শুনে যেন লাফিয়ে এলো কাবেরী। কবে যাবেন, কোথায় কতদিন থাকবেন ,কি ভাবে যাবেন একটা কাগজে লিখে দিন। আমি আজই বুক করে দিচ্ছি।
আমি বললাম, কেরালা শুনে অমন উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন?
–উঠব না? আমার স্টেট। খুব সুন্দর স্টেট। আগে গেছেন কখনও?
আমি বললাম , না যাই নি। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি তামিল।
কাবেরী বলল, নো ওয়ে। আমি মাল্যায়ালি। দেখে বুঝতে পারবেন না। আমাদের স্টেট ভীষন সুন্দর। গেলে এক্টু এদিক ওদিক বেড়িয়ে নেবেন। আমি বলে দেব। ওই যে অ্যাকাউন্টস দেখে, শঙ্কর, সেও আমাকে তামিল ভেবেছিল। তবে আমি তিনটে ভাষা বলতে পারি। তামিল, তেলেগু ও মালয়ালাম। কন্নড়টা শিখে নেবো ভাবছি।
আমি তো অবাক। তুমি বুঝি ভাষা ভালোবাসো?
কাবেরী বলল, না, ভাষা খুব কাজে লাগে । জানতে হয়। কখন কি কাজে লাগে তা তো বলা যায় না।
তাই শিখে রাখি। আমাদের আপনি পৃথিবীর সব জায়গায় পাবেন। যেখানে থাকি সেখানকার ভাষা শিখতে আমাদের সময় লাগে না।
–বাহ, দারুন গুণ তোমার। প্রশংসা না করে পারি না।
–জানেন স্যার, আমরা যেখানেই থাকি আমাদের রাজ্য, ভাষা ও কালচারের জন্য আমরা খুব ফিল করি। আমরা তামিলদের মত নয়, যেখানে যাবে ইডলি ধোসা না হলেই মন খারাপ। থাকবেই না।
আমি বললাম, সে তোমার কথা শুনেই বুঝতে পারছি। বললাম, বাঙালীরাও তাই। মাছ না পেলে হা হুতাশ করে। হাঁপিয়ে ওঠে। ভ্যাগিস ভাল এখানে মাছ সর্বত্র পাওয়া যায়। কাবেরী হাসল। তারপর বলল, আপনাদের আর একটা অভ্যাসের কথা বলব, কিছু মনে করবেন না?
আমি বললাম, বলো?
কাবেরী বলল, আপনারা ভ কে ব উচ্চারণ করেন। আমার নাম কাভেরী । ব বলতে যেমন মুখের হাওয়াটা আপনারা ভিতরে নেন, সেই হাওয়াটা বাইরে দিকে থ্রো করুন। আমার নামটা ঠিক বলতে পারবেন।
আমি মনে মনে বললাম, আমাদের বর্ণমালায় ব ও ভ দুটোই আছে। সেই থেকে সে আমার কাছে কাভেরী হয়ে গেল।
২)
লাজ্ চার্চ রোডর উপর গনেশ টাওয়ারের তিন তলায় আমার অফিস। পুরো ফ্লোর নিয়ে আমার ডিপার্টমেন্ট। আমার চেম্বারের পিছনে একটি বিকলাঙ্গ শিশুদের হাসপাতাল আছে। সেখানে কোন রোগী নেই। মাঝে মাঝেই সেখানে তামিল সিনেমার সুটিং হয়। যেদিন সুটিং থাকে সেদিন এই অঞ্চলে গাড়ির যাতায়াত বারে নাহলে অঞ্চলটি শান্ত। মেরিনা বিচের কাছেই। মিনিট দশেক লাগে স্কুটারে। অফিসের নিচেই স্কুটার ও স্কুটির পার্কিং। আমি একদিন জানালা দিয়ে দেখি একটি সিনেমার শুটিং হবে। রিহার্সাল হচ্ছে। প্রথম শট নেবে নায়ক। খুব সুন্দরী এক নায়িকার হাত ধরে সে বাড়ির বাইরে চলে যাচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে বাড়ির অমতে চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। লক্ষ করিনি কাভেরী পিছনে দাঁড়িয়ে। বলল, ওই যে শর্টটা কত বার যে নেবে তার ঠিক নেই। আপনি ফিলিম দেখতে ভালোবাসেন?
আমি বললাম, খুব একটা না।
কাভেরী বলল, আমি খুব ভালোবাসি। আমার হাসব্যান্ড শনিবার বাড়ি এলে প্রতি রবিবার আমরা ফিলিম দেখতে যাবোই। মাস্ট।
আমি অবাক হয় বললাম, তোমার হাসব্যান্ড এখানে থাকে না? কোথায় থাকে?
–নেভিলী। নেভিলী লিগনাইট কোম্পানিতে জব করে। শনিবার রাতে আসে। সোমবার ভোরে চলে যায়।
তুমি নেভিলী যাও নি কেন?
–উপায় নেই।
— বাড়িতে আর কে আছে?
–আমার শাশুড়ি। অনেক বয়স। ওনাকে দেখতে হয়। আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে উনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। আমাকে মেয়ের মত ভালোবাসেন।
আমি অবাক হয়ে দেখি কাভেরীকে। সারা দিন সে অফিসের সব দিকে নজর রাখে। আমার সব আদেশ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। কোন অনিচ্ছা দেখিনি কখনও। সে সন্ধ্যে বেলা একটা ক্লাস করে। কিসের ক্লাস করে জানতে চাই নি আমি। সে অফিসের সময়ের আগে চলে আসে শাস্ত্রীনগর থেকে। কোন দিন দেরি হলে মুখে দুঃখ প্রকাশ করে চেয়ারে বসে। আমার কাছে চেন্নাই নতুন জায়গা, কাভেরী আছে বলে অনেক কিছু আমি সহজে সামলে নিতে পারি। আমাকে দক্ষিনের চারটে রাজ্য দেখতে হয়। আমি অফিসে না থাকলে কাভেরী একাই সামলে নেয়। খুব দরকার না হলে আমাকে ফোন করে না।
৩)
সেবার কর্নাটক থেকে ট্যুর করে ফিরেছি। এসে শুনলাম কাভেরী তিন দিন অফিস আসে নি। তাঁর শাশুড়ি মারা গেছেন হঠাৎ। শঙ্কর বলল, সে কাভেরীর বাড়ি গিয়ে দেখা করে এসেছে। তাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে। আমি ফিরলেই সে অফিসে আসবে। মনটা তার খুব খারাপ। খুব স্বাভাবিক। শাশুড়ি মেয়ের মত ভালোবাসত তাকে। এখন তো সে একা হয়ে যাবে কিছুদিন। যতদিন না ওর হাসব্যান্ড এখানে বদলি হয়ে আসে!
কাভেরী কোচির মেয়ে, বিয়ে করে এখানে থাকে চাকরী সুত্রে। যেদিন অফিসে এল, তাকে দেখে কে বলবে সে এমন এক শোক সামলে উঠেছে। গল্প করছে, আমার কাজ করছে। অফিসের অন্য কর্মচারিদের সঙ্গে কখনও তামিলে কখনও তেলেগুতে কথা বলছে। কখন কি ভাষায় কথা বলে বোঝা খুব মুশকিল।
একদিন দুপুরের পর আমাকে এসে বলল, স্যার, আমাকে আজ একটু আগে অফিস ছাড়তে হবে। পাসপোর্ট অফিসে যাব।
–নতূন পাসপোর্ট করতে দিয়েছ? আমি প্রশ্ন করি?
কাভেরী বলল, আমার আছে। বরের নেই। ফর্ম আনতে যাব।
–কোথায় বেড়াতে যাবে?
–জানি না। আগে তো ওর পাসপোর্ট করাই?। বলে এড়িয়ে গেল কাভেরী। বলল, জানেন স্যার, আমাদের অফিসটা খুব ল্যাকি।
আমি বললাম কেন?
বলল, আপনার জানালা দিয়ে দেখুন। আমাদের অফিসের উল্টো ফুটে একটা মুরুগন টেম্পেল আছে। রাস্তা পার হলেই মন্দির। এটা যে কোন অফিসের পক্ষে খুব মঙ্গলময়।
সত্যি। গনেশ টাওয়ারের উল্টো দিকে একটি বড় কার্তিক ঠাকুরের মন্দির আছে। সেখানে সারা দিন মানুষ ফুল মালা দিয়ে পুজো করে, প্রার্থনা করে। জায়গাটা খুব শান্ত। রাস্তার শব্দ ভিতরে পৌঁছ্য় না। এমন ভাবে তৈরি।
প্রথম চেন্নাই এ এসে যে বাড়িটায় উঠেছিলাম সেটা ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। প্রতি রবিবারে দা হিন্দু কাগজে বাড়ি ভাড়ার জন্য আলাদা চার পাতা ছাপা হয়। লোকে সেই বিজ্ঞাপন দেখে বাড়ি খূঁজে নেয়। আমিও তাই করেছিলাম। বিজ্ঞাপনগুলো বাড়ির ঠিকানার সঙ্গে আরও দুটো খবর থাকত । যেমন, অনলি ভেজিটেরিয়ান আর মন্দির থেকে বাড়ির দূরত্ব। প্রথম আমি অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝেছি, মন্দিরের কাছের অর্থ, ভালো বাসযোগ্য এবং পূজার বা প্রার্থনার সুবিধা। তাই মন্দিরের কাছে বাড়ির ভাড়াও বেশি চাহিদাও বেশি। লক্ষ করেছি কাভেরী অফিস ফেরত মন্দিরে ফুল আর মালা চড়িয়ে তবেই স্কুটিতে ওঠে।
৪)
বসন্তের এক সকালে অফিসে এসেই টেবিলের উপর একটি খাম পেলাম। আমার সেদিন অফিসে একটু দেরি হয়েছিল । চেম্বারে ঢুকেই দেখি সারা অফিস প্রতিদিনের মত কর্মচঞ্চল। টেবিলে টেবিলে চা দিচ্ছে মরিয়ম। প্রাতঃকালীন চা। স্টিলের গ্লাস থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে । আমার টেবিলে মরিয়ম চা দিতে দিতে বলল, আজ একটু গরম কম হবে স্যার। দেরি করে ফেলেছেন।
আমি হেসে ঘাড় নারলাম। তার পর সাদা খামটা খুলেই চমকে উঠলাম। কাভেরীর পদত্যাগ পত্র। খুব যত্ন করে লিখেছে। ছত্রে ছত্রে আমার প্রশংসা । শেষে তার এক মাসের নোটিস পিরিয়ড উল্লেখ করে তাকে অব্যাহুতি দেবার জোরাল আবেদন লিখে সই করেছে সে।
প্রথমে মনটা খারাপ হল। ওর মত সেক্রেটারি খুব সহজে পাওয়া যায় না। পরিশ্রমী ও গুছনো। আমি চা শেষ করে ভিতরে ডাকলাম কাভেরীকে।
বললাম, এটা কি? কি ব্যাপার ? কাজ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে তোমার ?
গভীর দু চোখ তুলে কাভেরী বলল, একেবারেই না।
–তাহলে?
–আমি দুবাই থেকে একটা চাকরির অফার পেয়েছি। তাই চলে যাবো।
–দুবাই? যাবে কি করে। তোমার বর ন্যেভিলীতে আর তুমি দুবাই? খুব প্রব্লেম হবে তোমার।
কাভেরী তার সহজাত হাসি হাসল। গোটা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। বলল, কোন অসুবিধা হবে না স্যার। আপনার সঙ্গে কাজ করে আমি দারুণ খুশি। আমি অনেক দিন থেকে আরবী ভাষাটা শিখেছি। আমরা মালয়ালি তো? পৃথিবীর যেকোন জায়গায় ফেলে দিন, ঠিক মানিয়ে নেবো। সব কাজ আমরা করতে পারি। আমরা জন্ম থেকে সেটা শিখেছি। দেখেন নি নার্সিং পেশায় কত মেয়ে সারা পৃথিবী তে ছড়িয়ে আছে। তেমনই। আমিও ঠিক পারব।
–কিন্তু তোমার বর এখানে …
কাভেরী আর আমাকে বলতে দিল না। বলল, আমাদের একটা সিস্টেম আছে। আমরা যেখানেই যাই সেখানে প্রথম পৌঁছই। একটা বাসস্থান খুঁজে নেই। তার কিছু দিন পর দেশের বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম পাঠাই।, রিচড সেফ, গট্ এ জব, ফাউন্ড এ প্লেস, সেন্ড জন। জন আমার ভাই, বোন, পড়শি, গ্রামের পরিচিত যে কেউ হতে পারে। জনের পৌঁছনের কিছুদিন পর ঠিক এমনি একটি টেলিগ্রাম যায় তাদের বাড়িতে। এমনি করে আমার বর ও চলে যাবে দুবাই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। বলে তাকাল আমার দিকে। আপনাকে বলেছিলাম না, আমরা ভাষা, রাজ্য ও সংস্কৃতি বাইরে খুব মিস করি?
তার আত্মবিশ্বাস দেখে মনে হল এই কাভেরীকে আমি ঠিক চিনি না।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine