সুতপন চট্টোপাধ্যায়

নীরজ

হিমাচল প্রদেশের চাম্বা জেলার ডালহৌসির কাছে রবি নদীর উপর  বিখ্যাত চ্যামেরা ড্যাম। সম্ভবত ১৯৯২ সালে এই বাঁধের  প্রথম পর্যায় নির্মিত হয়েছিল। সেই প্রথম পর্যায়ের কথা।  এই বাঁধের কাজ, জল থেকে জলবিদ্যুৎ তৈরি।  জলকে  বিশাল টারবাইনে ফেলে  তা থেকে বিনা খরচে বিদ্যুৎ তৈরি  আধুনিক সভ্যতার প্রধান অঙ্গ। সেটা অনেকদিন আগেই ঘটে ছিল এই অঞ্চলে। ড্যামের খুব কাছে বানীপুর, যেখান থেকেই চ্যামেরা বাঁধের  সব কিছু দেখা শোনা হয়। প্রধান ইঞ্জিনিয়ার থাকেন ডালহৌসিতে। আধ ঘন্টার পথ। বেশ চলছিল। জলাধারে বিশাল জল রাশি, বাঁধের থেকে উপরের দিকে তাকালে স্ফটিক জলের রেখা  দেখা যায় অনেক দূর । হিমালয়ের অনেক উপর থেকে এই জলরাশি প্রবল বেগে ধেয়ে আসে রবি নদী ধরে সমতলে বয়। তার মাঝে বাঁধ বেঁধে তার গতিকে আটক করবে কেন মানুষ? কথাটা বাপ বলেছিল তার বেটা নীরজকে। নীরজ বলেছিল, তুমি এসব বুঝবে না  বাপ। জগতটা চালাতে হলে শুধু জলে হয় না, আলো দরকার হয়? বাপ ঘাড় নেড়ে ছিল সে দিন। মুখে কিছু বলে নি। মনে মনে ভেবেছিল আজ নয় তো কাল প্রকৃতি এ সব মানবে না। অঘটন ঘটাবেই। ততদিন সে হয় তো থাকবে না। চোখে না দেখতে পেলে না হয় উপর থেকে দেখবে! প্রকৃতির সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়াটা বেইমানির সমান।   

বাঁধ মানে বাঁধের উপরের রাস্তা, অনেক নিচে পর পর একাধিক স্পিলওয়ে। স্পিলওয়ের মাথাটা  বেকানো উঁচু।  যেখান গিয়ে বাঁধের প্রবল বেগের ছাড়া জল ছাড়া ধাক্কা খায়। তারপর সেই জল  অনেক দূরে প্রবাহিত নদীর উপর আছড়ে পরে।  সেই জল মনের আনন্দে লাফাতে লাফাতে বয়ে যায় সমতলে। এই স্পিলওয়েগুলো  অনেক নিচে। উল্টো দিকে বাঁধে গেট লাগিয়ে  ধরে রাখে  বিশাল  জলরাশি।  মাটির নিচে টারবাইনের উপর পড়ে গড়িয়ে আসে বাইরে। মাঝে মাঝে জল ছাড়ে না হলে জল বন্যায় ভাসিয়ে দেবে চারপাশ। এই  জমা জলে থেকে বিদ্যুৎ জেলা, প্রদেশের পাহাড়ে পাহাড়ে চলে যায়। 

যে বছর নীরজের বাবা মারা গেল সেই বছর স্পিলওয়ের  ফাটল দেখা দিলো। পর পর আটটা স্পিলওয়ের ফাটল চোখে পরতেই জলছাড়া বন্ধ করে দিল বাঁধের প্রধান। কয়েক মাস বন্ধ রইল। কেননা এর নিরাময় কি জানতে মাসে মাসে এক্সপার্ট-এর দল  আসতে লাগল। জমির বদলে এই বিদ্যুৎ অফিসে বেয়ারার চাকরি পেয়েছিল নীরজ। দিল্লী থেকে আমিও একদিন হাজির হলাম সেখানে। সমাধান সুত্র বের করতে। কতদিন আর বাঁধ বন্ধ করে রাখা যায়।  

                                                             ২)

আমার আগে অন্য কোম্পানি থেকে চার জন পরামর্শদতা ঘুরে গেছে। তাদের দু জনের প্রস্তাব এসে  দপ্তরে পৌঁচেছে। একজন এসেছে বম্বে থেকে ,অন্য জন নাগপুর । আর একজনের প্রস্তাব আসে নি। এর মধ্যে আমি হাজির হয়েছি । নিজের ইচ্ছেতে নয়, চাকরির  সুবাদে । প্রথমে আমাকে নিয়ে বাঁধের প্রধান বাঁধের উপর থেকে  দেখালেন। একদিকে জল অন্যদিকে শুকনো নদী। জল ছাড়তে পারছেন  না। বললেন, দেখছেন নিচে কেমন স্পিলওয়ে শুকিয়ে গেছে। তারপর বাইনাকুলার চোখের উপর নিয়ে বললেন, দেখুন, আপনি দেখুন, স্পিলওয়ের  উপর ক্র্যাক। এই ফাটা শুধু স্পিলওয়ে দিয়ে জল ছাড়লে বাঁধ ভেঙে যাবে। কী করা যায় বলুন তো ?  

আমি অনেকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি একবার নীচে নামতে চাই।  নীচে যেতে চাই। এখান থেকে দেখে আমার বলা অসম্ভব।

আঁতকে উঠলেন প্রধান। বললেন, বলেন কী? আপনি নীচে যাবেন? কি করে যাবেন? আমাদের তো ব্যবস্থা  নেই। 

আমি জেদ ধরলাম, না গিয়ে কোন প্রস্তাব দেওয়া বেকার। আমাকে খুব কাছ থেকে না দেখে কমেন্ট করা মুশকিল। 

তিনি বললেন, ভেবে দেখুন , জায়গাটা অনেক নিচে। ওখানে ঠিক ঠাক দাঁড়ানোর জায়গা নেই।  তাছারা পা পিছলে পরে গেলে বাঁচবেন না।  তার চেয়ে বায়নাকুলার দিয়ে যতক্ষণ পারেন দেখুন। আমাদের কোন অসুবিধা নেই। দুতিন দিন লক্ষ করার জন্য থাকতে চান, আমি ব্যবস্থা করে দেব। আমদের দারুণ গেস্ট হাউস আছে ডালহাৌসিতে। গাড়ি দিয়ে দেব। রোজ ইন্সপেক্সান করবেন, পাহাড়ে ঘুরবেন ।। ভালো লাগবে। 

নীরজ সঙ্গে ছিল। সে হঠাৎ বলল, যাবার রাস্তা আছে স্যার। দশ মাইল দূরে একটা প্রোজেক্টে একটা ক্রেন আছে। ওটা নিয়ে এলেই ওই ক্রেনে চরে ওই নীচের  লেবেলে   সোজা পৌঁছে যাওয়া যাবে। আপনি বলেন তো খবর করি? 

একটু  তির্যক তাকিয়ে নীরজকে বললেন, তাদের কাজ নেই?  আমাদের তারা দেবেন কেন? 

নীরজ বলল, চেষ্ঠা করে দেখতে ক্ষতি কী? কাছেই তো?

প্রধান বললেন, ক্রেনে করে কে যাবে? আমি যাব না। 

নীরজ বলল, আমি যাব স্যার। ওখানে ফোন করি?

অগত্যা নীরজের কথা ফেলতে পারলেন  না প্রধান। বলে দিলেন , দু জন যাবার যেন ব্যবস্থা থাকে তবেই লাগবে। না হলে নয়। আচ্ছা, বলে চলে গেল নীরজ। 

সে দিন ডালহাৌসির গেস্ট হাউসে আমায় থাকতে হল। রাতে খবর পাঠাল নীরজ, পর দিন দশটায় যেন  আমি বাঁধের কাছের অফিসে চলে যাই। 

                                                             ৩) 

পরদিন সকালে গিয়ে দেখি বাঁধের পাশে একটি  দৈত্যাকার ক্রেন দাঁড়িয়ে। ক্রেনের মাথায় দোলনার  মত কি একটা ঝুলছে।  দোলনার  ভিতর  দু জনে দাঁড়ানোর জায়গা। দুটো পা রাখার রড। আমি আর নীরজ সে ক্রেনে চড়ে বসলাম। ক্রেনটি  আমাদের নিয়ে বাতাসে ভেসে গেল। ধীরে ধীরে আমরা   অনেক নিচে একটা স্পিলওয়ের উপর নেমে পড়লাম। দেখি দিব্বি নামার জায়গা আছে। সেখান থেকে পর পর স্পিলওয়ে গুলো দিনে আলোর মত স্পস্ট। নীরজ বলল, দেখুন স্যার, কেমন ফেটে  গেছে উপরটা ? 

সত্যি তাই। কোথাও দু ইঞ্চি, কোথাও বা তিন ইঞ্চি  চওড়া ফাটল। সব কটা স্পিলওয়ের উপর  দিয়ে লম্বা ক্রাক বা ফাটা এঁকে বেঁকে চলে গেছে বাঁধের ভিতর। তাঁর ফাঁকে ফাকেঁ শুকনো শ্যাওলার চিহ্ন। নীরজ পকেট থেকে একটা ছুরির   বের করল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটু নেড়ে  চেড়ে দেখবেন নাকি ভিতরে। আমার পকেটে টর্চ আছে। 

আমি প্রথমে নীরজকে দেখে অবাক। সে আর কী নিয়ে এসেছে কে জানে। আমি বললাম, এই রোদে টর্চের আলোয় কিছুই দেখা যাবে না। 

নীরজ বলল যাবে। বলে সে  কালো ছাতা বেড় বের করল। বলল, আমি আড়াল করে ছায়া দিচ্ছি, আপনি আলো ফেলে দেখুন।

 সেই ভাবেই দেখি ফাটল শুধু উপরে নয়। অনেক গভীরে নেমে গেছে। কত দূর বোঝা অসম্ভব। ।   মনে মনে ভাবছি কি করা যায়। কিছুই  মাথায় আসছে না। হঠাৎ নীরজ বলল, স্যার, এবার স্পিলওয়ের  একে বারে নিচে নেমে দেখবেন? এই ফাটল ততদূর অব্দি গেছে কি না?  সেখানে কিছু আছে কি না।

কথাটা  মাথায় আসে নি আগে। সত্যি তো, এই ক্রাক যদি নীচে অব্দি বিস্তৃত হয় ত গভীর চিন্তার  ব্যাপার। 

ক্রেনের ড্রাইভারকে বলা হল, নদীতে নামিয়ে দিতে আমাদের। অনেকটা নীচে নেমে মাটির উপর দাঁড়িয়ে  অবাক হয়ে দেখি, এই নীচ ওব্দি ফেটে  গেছে কংক্রিট । এই বিশাল স্পিলওয়ের  কংক্রিটে চিড় ধরেছে। অনেক জায়গায় কংক্রিট  খসে পরেছে, হয়ত জলের তোড়ে আলগা হয়ে ভেসে গেছে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে নীচের এক একটি স্পিলওয়ে। 

এ এক ভয়নক বিপদের সম্ভবনা। যারা সারাবে তাদের কাজের পরেই বাঁধ  খুলে দেবে। আর বেশি দিন তো বাঁধ বন্ধ রাখা যায় না। একে জলের চাপ তার উপর বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকার আর্থিক ক্ষতি। দু দিক তো আর সরকার সামলাবে  না। আমি নদীর নিচে অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে এক একটা স্পিলওয়ের  গঠন নিখুত ভাবে লক্ষ করলাম। তাড়াতাড়ি এই স্পিলওয়ে  না সারালে বাঁধ  যে কোন দিন হাতের বাইরে চলে যাবে। কেননা রবি বা প্রাচীন কালের এই ইরাবতী নদী ভারতের উত্তর পশিম ভাগ ও পাকিস্থানের পুর্ব ভাগ দিয়ে প্রবাহিত। এই ঐতিহাসিক অবস্থান ও ভারত পাকিস্থানের সম্পর্কের সঙ্গে  যুক্ত। এই নদীর জল আটকে থাকলে একসময়  সেই জল সামলানো যাবে না। ভেসে যাবে জনপদ।

আমি সারা রাত কি ভাবে প্রস্তাব দেওয়া যায় সেই চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। পর দিন সকালে একবার প্রধানের সঙ্গে দেখা করে চলে যাব। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়  আমার গেস্ট হউসে এলো নীরজ। তাকে  আমি বসতে বললাম। তার পর জিজ্ঞাসা করলাম , স্যার কি কোন খবর  পাঠিয়েছে?  

নীরজ বলল, না স্যার। আমি নিজেই এসেছি। আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।

–বল। বলে চায়ে চুমুক দিলাম। নীরজ বলল, স্যার আমার একটা রিকোয়েস্ট  আছে। আপনি এমন ভাবে প্রস্তাবটা দিন যাতে আপনারটা নিতে বাধ্য হয় । 

আমি হেসে প্রশ্ন করি,  সে আমি কি করে জানব আমারটা একসেপ্টেড হবে কি না?

নীরজ বলল, সেই কারণেই তো আপনাকে আমি নীচে নিয়ে গেলাম। অন্যরা সব উপর থেকে  টেলিসস্কোপ  দিয়ে দেখেছে, আর প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ওই সব প্রস্তাবে কিচ্ছু হবে না। নিচের  থেকে সারতে হবে, উপর উপর হবে না। বাঁধ থাকবে না। দু দিনে ভেঙে যাবে। বলে না আগুন আর জল পোষ মানানো এত সহজ নয়। 

আমি বললাম , কী করে জানলে?

নীরজ বলল, আমার বাপ বলত প্রকৃতির সঙ্গে পাঙ্গা নিলে প্রকৃতি রেহাত দেয় না। তাই তো এই বিভ্রাট। কিন্তু আমাদের তো বাঁচতে হবে। ড্যাম বন্ধ হলে আমরা খাবই বা কি আর অন্ধকারে বাঁচবোই বা কি করে? শুধু বাঁধ নয় স্যার, আমার বিশ্বাসেই  ফাটল ধরে গেছে। তাই তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে চলে এলাম। স্যারকে বলবেন না আমি আপনার সঙ্গে দেখা করেতে এসেছিলাম। বলে সে শীতের রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *