সুতপন চট্টোপাধ্যায়

     হিমেল

বাড়িতে যে মেয়েটি ফুল দিতে আসে রোজ সকালে, তার মুখটি খুব মায়া মাখানো। বয়স কত? বারো কি তেরো হবে। রোগা, লম্বা বিনুনি, গভীর চোখ আর সহাস্য মুখ । বেল বাজিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুললে বলে, ফুল। কথাটা জানা তবু ও বলে। আর বললেই তার এক মুখ সরল হাসির ছটায় দিনটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। গালে একটা ছোট্টো টোল পরে । মুখটা প্রতিমার মত দেখায়।

নাম তার হিমেল। প্রথন দিন তার নাম বলতে আমি চমকে উঠে ছিলাম। হিমেল কারো নাম হয় নাকি? শুনিনি তো? তোর ভালো নাম কী? 

-হিমেল। একটা’ ই নাম। 

-কে রেখেছে? 

-মা কোথায়? 

আকাশের দিকে আঁঙ্গুল তুলে দেখাল। ওই হোথায়। আমার জন্মের দু বছর বাদেই ওপরে চলে গেছে।

ওহো। মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে এসেছিল । 

হিমেলের বসার জায়গা আমাদের আবাসনের উল্টো দিকের একটা ধাপিতে। দূর বড় কাছারি থেকে সে ভোরবেলা ফুল এনে বসে । এ তার নিত্য দিনের দোকান। কোন দিন সঙ্গে বাবা আসে, কোনদিন তাও আসে না। বার বছরের হিমেল রাস্তার উল্টো দিকে সাজিয়ে বসে ফুলের সঙ্গে  তুলসীপাতা, বেল পাতা, জবা,গাঁদা ফুলের মালা আর দুর্বা ।

প্রথমে যাদের রোজের  অর্ডার তাদের আলাদা করে তবেই সওদাগিরি। দোকান শেষে বাড়ি বাড়ি তার ফুল দেওয়া। এই হিমেল একদিন আর এলো না। সকালে বেল বাজায় আটটায় । সেদিন আটাটা  বেজে গেছে । নয়টা ছুঁই ছুঁই । তাও হিমেলের  দেখা নেই। সুমনা বলল, কী হল বলত, কী দিয়ে পূজো করব! মেয়েটার কী যে আক্কেল ? 

আমি বললাম, দেখ, হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে। ওদের কী শরীর নয়? খারাপ হতে পারে না? আমি গিয়ে ফুল নিয়ে এলে পুজো হল। তার আর দেখা নেই এক সপ্তাহ। খুব চিন্তায় পড়লাম আমি। ফুলের জন্য না। কেমন আছে মেয়েটা? সুমনা বলল, তুমি খবর নিলে না? কেউ কী খবর জানে না? এ কেমন কথা। ওর সঙ্গে কেউ না কেউ এখনের বাজার আসে। তারা জানে না?

কী উত্তর দিই? কিছু তো খবর পাচ্ছি না। আবাসনে অন্য ফুল ওয়ালা ঢুকে গেছে। তাদের কাছেও কোন খবর নেই। আর থাকলেও তারা বলবে না। উলটে বলল, ও নেই তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি?

যে প্রান্তিক গ্রাম থেকে হিমেল আসত সে গ্রাম কেমন তার প্রকৃত ধারণা করা মুশকিল। রাস্তায় গাড়িতে বা বাসে যেতে যেতে দু পাশে যে গ্রাম পড়ে সেইসব গ্রামের ভিতরে  গ্রাম থাকে, যাদের দেখা যায় না। ঘরের মধ্যে যেমন ঘর থাকে, গ্রামের মধ্যেও গ্রামের চেহারা যে সব সময় শান্ত, সরল , শান্তি ঘেরা  তা কিন্তু নয়। গ্রাম উত্তাল হলে তার চেহারা আলাদা, হিংসে, মারামারির গোপন চোরা স্রোত  চলতেই থাকে। পরবের সময় ফুরফুরে থাকে গ্রাম । এইটুকু জানা কিন্তু অনেক কিছু অজানা, গ্রামের মানুষই  জানে। সেখানে তার কিছু হল না তো?

সুমনা একদিন বলল, হিমেলটা কোথায় যে গেল? মেয়েটা খুব মায়া কাড়া। থাকলে আমাদের সঙ্গে দিল্লি নিয়ে যেতাম। আমাদের সঙ্গে থাকতো, টুকটাক বাড়ির কাজ করতো, ফুল নিয়ে আসতো। আমি বললাম, সে আমাদের সঙ্গে সব ছেড়ে ছুড়ে যাবে কেন? ওর বাবা আছে। আর তাছাড়া তার বাড়িতে কে আছে তাই তো জানি না। নাবালক মেয়ে নিয়ে যাওয়া সাধারণ ব্যাপার নয়। গ্রামের অনেক জটিলতা আছে। গ্রাম পঞ্চায়েত আছে। কিছু হলে কে দিল্লি থেকে আসবে এই সব ঝামেলা সামলাতে? 

গোপন ইচ্ছে অনেক সময় ফুল ফোটার মত ফলে যায়। তাই হল। হিমেল একদিন এসে হাজির হল।মা নেই জানতাম। বাবাও যে নেই সেটা বলল। সুমনা জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় ছিলি? সে হাসতে হাসতে বলল, মাসির বাড়ি বসিরহাট। 

-তোর দোকান কী হবে?

-কাল থেকে আনব। তাই তো তোমাদের মন বুঝতে এসেছি। আমার কাছ থেকে নেবে তো?

সেই সুযোগে সুমনা কথাটা ঠিক বলে বসল। হিমেল বলল, একটু সময় দাও। কাকিকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। ওরাই আমাকে দেখে। 

হিমেল আর আসে নি। আমার ট্রান্সফারের অর্ডার বেড়িয়ে গেছে । যাবো যাবো করেও এক মাস ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর? আর তো রোখা গেল না। চলে গেলাম দিল্লি। দিল্লির জীবন কলকাতার থেকে অনেক আলাদা। প্রথম প্রথম খুব একা লাগত। মানুষ কেবল কাজের পিছনে দৌড়য়। সারা দিন নিস্তার নেই। একজনের একটি চাকরি করে জীবন চলে না। দুজনকেই কাজ করতে হয়। দিনের শেষে অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফেরা। প্রতিটি মানুষ  সবের মধ্যে ফায়দা খোঁজে। এই  ফায়দা খোঁজার অভ্যাসটা আমাদের ছিল না। সুমনা তো কোন দিন চাকরি করেনি। দিল্লিতে সেও কোন উপায় না  দেখে চাকরিতেই যোগ দিয়ে নিজেকে স্রোতের মধ্যে  ভাসিয়ে দিল। এতে সুমনার লাভ হল অনেক। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে কখন আমারা হিমেলের কথা ভুলেই গেলাম।  

অবসর নেবার পর দিল্লিতে কয়েক বছর কাটিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে আসার প্রবল আকুতিতে দিল্লিতে বাড়ি করি নি। আপামর বাঙ্গালীর মত অবসরে দেশের মাটিতে ফিরে আসার গোপন ইচ্ছা চিরকালই জাগ্রত ছিল প্রবাসে। ফিরে এসে আবার নতুন করে বসবাস আমাদের   আবাসনে। আমুল বদলে গেছে আবাসন। অনেকে চলে গেছে ওপারে। নতুন ভাড়াটে এসে ভর্তি করেছে শূন্যস্থান। প্রবীণ নাগরিকরা হয় ছেলে বা মেয়ের কাছে হাদ্রায়বাদ, পুনে গুরগাঁও বা বিদেশে গিয়ে স্থিতু হয়েছে। তারা আর আসবে বলে মনে হয় না। আমার ফ্ল্যাটের পাশেই তো তিন দিকে নতুন  পরিবার। তাদের কাউকে চিনি না। ফ্ল্যাট কিনে তারা আবসিক। আমি যে জগৎটা ছেড়ে গিয়েছিলাম সেই জগৎটার আর কোন অস্তিত্ব নেই। 

এক দিন সকালে বাজারের রাস্তায় অখিলের সঙ্গে দেখা। আমাদের আবাসনের পাশেই সাতগ্রামে সে  অনেক দিন আগে জমি কিনে নিজের বাড়ি করেছিল লোন নিয়ে। আমাকেও বলে ছিল। করি নি। অখিলের নতুন বাড়ির গৃহ প্রবেশে নেমতন্ন খেয়েছিলাম। মনে আছে। অখিল আমাকে দেখেই  বলল, 

-আরে তুই? কবে এলি?

-এই তো? মাস খানেক।

-পাকাপাকি?  

-অবসর, আর কি? পাকাপাকিই বলতে পারিস। কোথায় আর যাব?

– আরে দূর, এলি কেন দিল্লি ছেড়ে? কেউ গেলে তো আর ফিরতে চায় না। এখানে কেউ ফিরে আসে? 

-সবাই তা নয়। বলে হেসে উঠি। অখিল ও হেসে বলে, আবার  এতদিন পরে বৃত্তে ফিরে  আসা। 

এক বিকেলে অখিলের বাড়িতে গেছি। বাড়ির প্রবেশের দ্বারে একটি ছোট্টো মন্দির। ভিতরে বিগ্রহ। দেখে মনে হয় পুজো হয় নিয়ম করে। ভিতরে বসার ঘরে বসাল অখিলের স্ত্রী। বলল, আপনার সঙ্গে  দেখা  হয়ে আপনার বন্ধু খুব খুশি।  বসুন, আপনার জন্য গরম সিঁঙ্গাড়া আনতে গেছে।

বলতে বলতেই অখিল এসে হাজির। ঘরের ভতরে যেতে যেতে বলল, বস বস, আজ জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে। 

আমরা দুজনে গল্প করছি। আমাদের অতীতের গল্প, কলেজের, ভারসিটির, চাকরির। মাঝে মধ্যে সহপাঠী, বান্ধবী সব’ই উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ পরদা সরিয়ে একজন এগিয়ে এসে চা আর সিঁঙ্গাড়া রাখল টেবিলে। অখিল বলল, আমার মেয়ে হিমেল। 

হিমেল শব্দটা কেমন আশ্চর্যের সপ্তম তারে বেজে উঠল। হিমেল? আমি তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখছি। অখিল বলল, এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  পি এইচ ডি  করছে। বটানি নিয়ে। 

বাহ বাহ দারুণ খবর। পুর্ণ যৌবনা টগবগে সুন্দরী একটি মেয়ে। বিজ্ঞানে বিদুষী । কি অদ্ভুত মিল? মনে হতেই দেখি সেই রোগা পাতলা মেয়েটির মুখের আদল।

ভিতরে চলে গেল হিমেল। 

অখিল বলল, আমাদের তো সন্তান হয় নি তাই ও আমাদের দত্তক মেয়ে। খুব মেধাবী। এতো ভালো হবে আমরা কল্পনাই করিনি। ভালই কেটে গেছে ওকে নিয়ে। কিন্তু এখন একটাই সমস্যা।

আমি জিজ্ঞাসা করি, কী সমস্যা তোর?

আরে, এবার ওকে বিয়ে করতে বলছি। কিছুতেই করবে না। বলে আমাদের কে দেখবে? আমি বলি আমাদের তো বয়স হচ্ছে। আমরা তো থাকব না।

আমি বললাম , দুজনেই তো দু দিক থেকে ঠিক।

-তুই একটু বুঝিয়ে বল না। তোর কথা শুনতেও পারে।

-আমার কথা? আমার কথা সে শুনবে কেন? ওতো আমাকে চেনে না। আজ ই আলাপ। 

পর্দা সরিয়ে হিমেল ঘরে ঢোকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আপনি নির্মল  এপার্টমেন্টেরর এগারো তলায় থাকেন না? 

আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আমি দেখতে পাই হিমেল দাঁড়িয়ে আছে আমারই দরজার সামনে। হাতে ফুল আর বেলপাতা। ঠিকই তো ওর বটানির ছাত্রী হওয়ারই কথা!

সজল মামা

আমাদের বড়িতে মধ্য রাতে কেউ কোনদিন আসে নি। আমরা দেখিনি। তাই আমাদের বাড়ির দরজা ভিতর থেকে হুড়কো দিয়ে আটকান থাকে। বাবা রোজ সকালে খোলে এবং রাতে বন্ধ করে। সে দিন এমনি রাত। দরজা বন্ধ।  

মধ্য রাত। ধুপ করে শব্দ হল বাইরে। বাইরে না ভিতরে ঘরের ভিতর থেকে বোঝা দায়। মা’র ঘুম  পাতলা, রাতে শব্দ আরো জোরে বাজে। মা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমাকে বলল, দেখ তো নারকোল গাছ থেকে কে যেন লাফিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে। চোর হবে। বাবাকে ডাক। বাবা ততক্ষনে উঠে পড়েছে।  

কোনদিন চোর পড়েনি, ডাকাত তো কল্পনার অতীত। ভয়ে গা ছম ছম করছে। বাবা চৌকীর নিচ থেকে বাঁশের লাঠি নিয়ে বারান্দার দরজা খোলার তোরজোর করছে। বাইরে থেকে চাপা গলা, ভয় নেই আমি চোর নই। আমি সজল। বাড়ির দেওয়াল টোপকে বাড়িতে ঢুকেছিল সজল মামা। সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতে এক চাপা উত্তেজনা। সজল মামা আমাদের বাড়িতে মধ্যরাতে? রহস্যের বেড়াজালে মোড়া হয়েছিল আমাদের বাড়ি। কে প্রথম জানবে সজল মামার আসার কারণ টা কী? 

সজল মামা বাড়ির ভিতরে একটা টুলের উপর বসল। মা, জল এনে মাথায় একটু ছিটিয়ে দিল। সজল মামা মায়ের ছোট ভাই। তিন বোনের পর দুই ভাই। কমলমামা থেকে বর্ধমানে। সজল মামা বাঁকুড়ায় ডাক্তারি পড়ে। ছোট ভাই সবার আদরের । তার একটা প্রধান কারণ সে মাধ্যমিকে জেলার প্রথম হয়েছিল বলে বোনেরা গর্বে বিভোর । মাকেও মাঝে মাঝে আমাকে বলতে শুনেছি, ছোট  মামার মত হতে হবে। এই আপ্ত বাক্যটা মনের মধ্যে ঘড়ির কাঁটার মত  টিক টিক করে নড়ত। সেদিন রাতে কেন যেন তার ছিঁড়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম সজল মামা এমন চোরের মত রাতে আমাদের বাড়িতে কেন? কিছু কী অন্যায় করেছে তাই পালিয়ে এসেছে? কী হতে পারে? মারামারি, চুরি, শুনেছিলাম সে হোস্টেলে থাকত। সে কী হোস্টেলে কিছু করেছে?

কে জিজ্ঞেস  করবে? দেখি বাবা মাকে বলছে। তুমি জিজ্ঞাসা কর। মা বলছে, আমায় বলবে না,তোমায়  শ্রদ্ধা করে, ভয় ও খায়, তোমাকেই বলবে। এর মাঝেই সজল মামা বাথরুম থেকে চোখে মুখে  জল দিয়ে মাকে বলল, কিছু খেতে দে দিদি, দুপুর থেকে খাই নি।

মা সব ছেড়ে রান্না ঘরে চলে গেলে বাবা সজল মামাকে বলল, কী ব্যাপার বলত সজল, এত রাতে তুমি কোথা থেকে? কী করেই বা এলে। বাস তো রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায়? 

সজল মামা একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। আমি বাসে আসে নি। একজন আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে বাইকে। 

কেন এলে তা তো বললে না। সজল মামা বলল, সেটা পরে বলব। এখানে ক’ দিন থাকব জামাই বাবু।

বাবা বলল, সে তুমি যত দিন থাকতে চাও থাক। তোমারই তো দিদির বাড়ি। 

সজল মামা অনেক দিন ছিল আমাদের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে এতোদিন থাকাটা কেউ আপত্তি করে নি। কলেজে পড়তে পড়তে এক বিপ্লবী রাজনৈতিক দলে ভিড়ে গিয়েছিল সজল মামা। তাদের  কলেজে একটা খুন হয়েছিল সে কারণে পুলিশ খুঁজছিল তাকে। সে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে থেকে আমাকে অঙ্ক ও ইংরাজী পড়াত । সজলমামা যে খুব মেধাবী ও তুখোড় তা তাঁর পড়ানো দেখলেই বোঝা যেত। অনেক অনেক দিন পর কলেজে ফিরে গিয়েছিল সজল মামা। আর আসে নি।

সেই সজল মামা ডাক্তার হয়ে অনেক কাল ইংল্যান্ডে। আমাদের দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সেই দেশে । কয়েক বছর দেশে আসে নি। ছেলে মেয়ে বড় হতে তবেই আসা আরম্ভ করেছে। বিদেশী বউ, দুই ছেলে নিয়ে এবার কোলকাতায় আসছে সজল মামা। আমাদের বড়িতে থাকবে দু দিন তার পর একদিন হোটেলে থেকে রাজস্থান বেড়াতে যাবে। সেই মত আমি বিমান বন্দরে আনতে গেছি। বাবা নেই, মাও শয্যাশায়ী। তবু বিদেশ থেকে কৃতী ভাই আসছে শুনে বেশ চাঙ্গা। দু দিন থেকে ঘর বার করছে, কুঁজো হয়ে এক হাঁটুতে  হাত রেখে। চুল সব সাদা। মাঝে মাঝে বলছে, সজলটা  আমাকে  দেখে খুব দুঃখ পাবে, এত শরীর খারাপ, চুল সব সাদা। চিনতে পারলে হয়। খুব ইচ্ছে ছিল তালের ফুলুড়ি বানাবো। সজল খুব খেতে ভালোবাসে। কিন্তু তাল মারার লোকই নেই!

ঠিক সময় বি্মানবন্দরে আমি হাজির। সপরিবারে সজল মামা এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে এসেই চিৎকার করে উঠল, বিলটু? আমারা এখানে। বলে এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে  দিল আমার। আমি একটা বড় গাড়ি নিয়ে  গিয়েছিলাম। সবাই ফিরে এলাম  বাড়িতে।

মায়ের কোথায় যেন একা দ্বিধা ছিল। আমাদের মত ছোট্ট বাড়িতে সজল মামার পরিবার থাকতে পারবে তো? বাড়ি পৌছনোর পর অব্দি সেই ধন্দ কমে নি। তাই বাড়িটা  দেখিয়ে মা সজলমামাকে বলল, হাঁরে, আমার বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হবে না তো তোদের?

বিদেশিনী মামিমা বলল, না না একবারিই নয়।

আমরা সবাই চমকে গেছি তার বাংলায় কথা বলা দেখে। ভেবেছিলাম মামিমার ও ছেলেদের সঙ্গে আমদের ইংরাজি তেই কথা বলতে হবে। মামিমার কথা শুনে মা অবাক হয়ে বলল, ওমা তুমি তো ভালো বাংলা বলতে পার?

মামিমা বলল, আপনার ভাই শিখিয়েছে। আমি পড়তেও পারি।

আমাদের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

মামিমা আবার বলল, বিয়ের পর হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে বাংলা শেখাত। 

শুনে আমাদের কি আনন্দ। মামিমা কে যেন তিন গুন ভালবেসে ফেললাম। মামিমা ও ডাক্তার তবে মামার মত সার্জেন নয়। ডারমাটোলজিস্ট । দুই ছেলে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের বাড়িতে সেদিন উৎসবের আবহাওয়া। মামা বাবার লুঙ্গি পড়ে সোফায় বসে টেলিভিসন দেখছে। মামিমা মায়ের সঙ্গে রান্না ঘরে খাবার তদারকি করার চেষ্ঠা করছে। মা কিছুতেই করতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝেই পছন্দের  খাবার করে নিয়ে আসছে। মা আর সজল মামার গল্পের শেষ নেই। তাদের ছোট বেলা, দেশের বাড়ি, দাদার কথা, অন্য বোনেদের কথা নিয়ে মশগুল । এর মধ্যে আমি বাজার করে ফিরেছি। নানা রকম বাজার করে এনেছি । মা লিস্ট করে দিয়েছে। সজলমামা  কী কী খেতে ভালো বাসত তার লিস্ট ধরে। চন্দনা সেগুল ধুয়ে, মুছে সব একে একে সাজিয়ে রাখছে ফ্রিজে। মায়ের আদেশ মত সে ব্যবহার করবে।  

এমন সময় দুই জমজ ভাই ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মামিমার কোলে। কে বড় কে ছোট বোঝা মুশকিল। মামিমার কোলে মুখ ঘসে এবার আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, চল আমরা বাইরে ঘুড়ে আসি। 

দু জনেই এক কথায় রাজি। মা দুজনকে আদর করে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও?

দু জনেই এক স্বরে বলল, ডাক্তার।   

মা অবাক হয়ে বলল, ওমা ওরাও বাংলা বলতে পারে! মামিমা বলল, ওই সব শিখিয়েছে।  

মা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, সজল, এটা দেখে মা যে কী খুশি হত। খুব খুশি হত। তুই এতো বড় ডাক্তার হয়েছিস, কিন্তু মাতৃভাষা ভুলিস নি।   

1 thought on “পথে পথে মোহর ছড়ানো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *