শাহাব আহমেদ
১.
বাড়ির নিকটবর্তী পার্কের একটি ঝোপের মধ্যে পাওয়া গেছে তাকে। গুলিতে মাথাটা ছত্রভঙ্গ, মগজ ছড়িয়ে পড়েছে এদিক সেদিক, লাথি দিলে চারিদিকে কাদা ছিটকে পড়ে যেমন, ঠিক তেমন। মাথাটি শুয়েছিল জমাট রক্তের বালিশে।
ঘটনাটি ঘটে করোনা কোয়ারেনটাইনের ২৩তম ভোরে। পৃথিবী স্তব্ধ, কাজ নেই, অর্থ নেই, কথা বলার মানুষ নেই, খাদ্যও শেষ হয়ে আসছে। প্রতিটি মানুষ ডিপ্রেশনের তলানিতে শিং মাছের মত। প্রকৃতপক্ষে তখনও ভোর হয়নি, যদিও রাত প্রায় কেটে গেছে। আকাশে সবগুলো তারা নেভেনি, কিছু গেছে, কিছু যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চাঁদ ছিলো না। ২৩ দিন ধরে ঘরে বন্দী থাকার পরে মুক্তি। মুক্তি ও মৃত্যু অনেক সময় একার্থক হয়।ওর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে কিনা বলা মুশকিল।
২
গত রাতেই সে মায়ের বাড়িতে গিয়েছিল। মুড তার যদিও ছোটকাল থেকেই আবহাওয়ার মত আপডাউন করে, মায়ের মনে হয়নি সে সুইসাইডাল। মা-ই লালন-পালন করছে ওর ১৫ মাস বয়সের ছোট মেয়েটিকে। ইচ্ছায় নয়, রাষ্ট্র সাময়িকভাবে নিকোলের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নানীকে দিয়েছে। রাষ্ট্র যখন নেগলেক্ট, এবিউজ বা অন্য কোনো কারণে মনে করে পিতা-মাতা বাচ্চাদের যত্ন নিতে অক্ষম তারা অপরিচিত কোনো পরিবারে না পাঠিয়ে, প্রথমে পরিবারের আপনজনকে দায়িত্বটি দেয়। তাদের ভরণ-পোষণের অর্থও দেয় রাষ্ট্র।
নিকোলের ৬ বছরের ছেলেটি থাকে তার বাবার সঙ্গে। তাকে সে হারিয়েছে চাইল্ড নেগলেক্টের মামলায় ৩ বছর আগে। সে তাকে গাড়িতে একা রেখে কয়েক মিনিটের জন্য ঢুকেছিল এলকোহলের দোকানে। কিন্তু একটা অপ-নক্ষত্র সততই তার পিছু পিছু ঘোরে গুপ্তচরের মত। যেখানে বিপদে পড়ার কথা নয় সেখানেও বিপদ আসে মুষল ধারার বৃষ্টির মত। কেউ পুলিশে কল করে দিয়েছিল। ব্যাস! এখন মাসে একবারমাত্র দেখতে পায় ছেলেকে, তাও সুপারভাইজড ভিজিটেশনের মাধ্যমে, সরকারি এজেন্সির কোনো প্রতিনিধির উপস্থিতিতে।
৩
থাকতো সে বয়ফ্রেন্ড ক্রিসের সঙ্গে, সে-ই ১৫ মাসের মেয়েটার বাপ। ক্রিস ড্রাগ ও মদ পছন্দ করে। নিকোলও। মাদক সমমনা মানুষগুলোকে কাছে টানে। তাদের মধ্যে সাম্য ও মৈত্রি স্থাপিত হয়।
কোনো এক ‘বারে’ পরিচয় হয়েছিল ওদের। কয়েক পেগ হুইস্কির দাম ক্রিসই পরিশোধ করে দিয়েছিল এবং নিকোলের তাকে খুব বন্ধুত্বপরায়ন ও উদার মনে হয়েছে। ফলে রাতের অবশিষ্ট অংশটুকু তার ক্রিসের সঙ্গে কাটে। পরে ক্রিসই প্রস্তাব করেছিল তার সঙ্গে থাকতে।
সে গ্রহণ করেছে। নিকোলের নিজস্ব বাসস্থান নেই। কোকিলের মত কাকের বাসায় থাকা জীবন।কোথাও আশ্রয় না হলে মায়ের কাছে গিয়ে ঘুমায়। কিন্তু মা যেহেতু নীতিকথা শোনায়, সে চেষ্টা করে যতক্ষণ সম্ভব সেখানে না যেতে।
ক্রিস আসলে ভালোই। খুবই উদার, যখন মুড ভালো থাকে। আদর করে, ভালোবাসার কথা বলে কিন্তু খুব সন্দেহপ্রবণ। তার ধারণা নিকোল শহরের প্রতিটা পুরুষের সাথে হয় ইতিমধ্যেই ঘুমিয়েছে, নয় ঘুমাবে। সুতরাং সে রেগে গেলে নিকোলের হাড় মাংসগুলো পৃথক করে দেয়। নেড়ি কুকুরের মত নিকোল কয়েকদিন ব্যথায় কোঁকায় তারপরে দুজনে আবার একসঙ্গে থাকে। যদিও ক্রিসও শহরের প্রায় প্রতিটি মেয়ের সাথে হয় ইতিমধ্যেই ঘুমিয়েছে, নয় ঘুমাবে, এ ব্যাপারে ওর মধ্যে একটা আশ্চর্যজনক স্মৃতিভ্রম কাজ করে। ওর প্রতি নিকোলের কোনো ভালোবাসা নেই। কখনই ছিলো না। একসাথে থাকা ভালোবাসা নয়। সেক্সের বিনিময়ে আশ্রয়, খাদ্য ও পানীয়- সহজ ও আধুনিক সমীকরণ। ওর মায়ের মত বোরিং ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন উটপাখি-মানুষগুলো বিষয়টাকে খুব বেশি জটিল করে তোলে।
৪
নিকোলের মনে একটি অদ্ভুত রসায়ন কাজ করে। মাঝে মাঝে সে নরমাল, মাঝে মাঝে ভীষণ ডাউন এবং মাঝে মাঝে তার মনের উচ্চতা আকাশের সিলিং ছুঁই ছুঁই করে। তখন তার নিজেকে পাখাওয়ালা পরী মনে হয়। এত হাল্কা লাগে এবং শরীরে এত এনার্জির প্লাবন বইতে থাকে যে, আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ওড়া ওর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। উঁচু উঁচু দালানের এক ছাদ থেকে অন্য ছাদ লাফ দিয়ে পার হওয়া পান্তা ভাত। কোনো ভয় কাজ করে না, কোনো বিপদ হতে পারে, ভুলেও মনে হয় না। সে হাসে সে হা হা করে, কথা বলে দ্রুত ও জোরে। সারারাত না ঘুমালেও কিছু আসে যায় না, নাচতে পারে ক্লান্তিহীন। ওর মা মনে করে, সে ভাবে না। কিন্তু কথাটি সত্য নয়, সে আসলে ভাবতে পারে না, তার চিন্তনের ক্ষমতা সম্পূর্ণ উবে যায়। তারপরে কয়েকদিনের মধ্যেই সবকিছু থিতিয়ে আসে, সে বলহীন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। শুধু ঘুমায় আর ঘুমায়, ওঠার শক্তি নেই, ক্ষুধা নেই, লিবিডো নেই, সমস্ত পৃথিবীটা কালো আলকাতরার প্রলেপ দেয়া মনে হয়। কিচ্ছু ভালো লাগে না, বাঁচতে ইচ্ছে হয় না কিন্তু বিছানা থেকে উঠে গিয়ে মরণকে আলিঙ্গন করার শক্তিও সে খুঁজে পায় না। তাই মৃত্যু কামনা করেও সে বিষণ্ণ পৃথিবীতে ছত্রাকের মত বেঁচে থাকে।
৫
নিকোলকে আমি চিকিৎসা করেছি ১৩ বছর বয়স থেকে। সব রোগীর কথা কোনো ডাক্তারেরই মনে থাকে না কিন্তু কারো কারো কথা ইচ্ছা করলেও ভোলা যায় না। নিকোল ছিল ইউনিক ও আমার সবচেয়ে জটিল এবং সবচেয়ে চার্মিং রোগীদের একজন। প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছে ওর বয়েস হাঁটে তো শরীর দৌড়ায়। বয়েস ১৩ অথচ ১৬-র কম তাকে দেয়া যায় নি। লম্বা ও তন্বী, কিন্তু পাটখড়ি লিকলিকে নয়। সুন্দর চেহারা, ভালো জামাকাপড় পরা। কথা বলার ধরন খুবই ভদ্র ও মিষ্টি। এক কথায়, তার মধ্যে অসুন্দর কিছু নেই। চট করে মনে পড়ে চেখভের কথাটি, “একজন মানুষের সবকিছু সুন্দর হওয়া চাই -তার চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, তার মন ও মনন।”
কিন্তু তখনও তথ্যের অভাব ছিল। প্রথম ইমপ্রেশন সব সময় সত্য নয়। আমারও ভুল হয়েছিল। ওর মন ও মননে সমস্যা ছিল।
আমি কিছু প্রশ্ন করি তার মেন্টাল স্ট্যাটাস, মনন-ক্ষমতা, স্মরণশক্তি, মনো-সংযোগ ইত্যাদি অনুধাবন করার জন্য। তারপরে ওর মায়ের সাথে একা কথা বলি। “নিকোল অসম্ভব ছটফটে ও অস্থির, অবাধ্য ও ক্রুদ্ধ, রেগে যায় চট করে এবং হিংস্র উত্তেজনায় জিনিস-পত্র ছুঁড়ে মারে বা ভেঙে তছনছ করে। তাকে তখন চেনাই যায় না। তারপরে নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে সে হয় ঝড়-পরবর্তী পরিবেশের মত শান্ত, শিথিল ও আনত। এমনকি চোখের দিকে পর্যন্ত তাকায় না। এ ছিল তার একদিক। অন্যদিকটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত, অসম্ভব নম্র, সহানুভূতিশীল ও ভালোবাসায় উজ্জীবিত, একটি ছোট প্রাণির কষ্টেও কেঁদে ফেলে। ওর মধ্যে যেন একটা অন্তর্নিহিত সুইচ ছিল, কোনো এক অজানা ডেমন সেই সুইচের অন-অফ করে এবং ওর তাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।”
৬
নিকোল স্বীকার করে তার এক্সট্রিম মুড-সুইং ও নিয়ন্ত্রনহীন রাগের কথা। সময় সময় সে ঘুমায় খুব কম, রাতের পর রাত প্রায় সারারাত জেগে থাকলেও দিনে ক্লান্তি লাগে না। স্বপ্ন দেখে প্রচুর, মূলত দু:স্বপ্ন, যেগুলো অসম্ভব জীবন্ত, সিনেমা হলের রঙিন পর্দায় দেখা মুভির মত। ভয়ংকর সব ঘটনা, রক্ত আর রক্ত, ভায়োলেন্স ও সীমাহীন রক্তের খেলা। কেউ কারো পেটে ছুরি মারলো এবং সেই ছুরিটি কিভাবে তার পেটে ঢুকছে, এবং কিভাবে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে এবং কিভাবে পেটের অন্ত্রগুলো বের হয়ে ঝুলে আছে সে স্পষ্ট দেখতে পায়। স্বপ্নের এত ‘ভিভিড’ বর্ণনা খুব একটা শোনা যায় না। এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে সে সবকিছু স্পষ্ট মনে করতে পারে। একটা স্বপ্ন সে দেখে প্রায়ই, কে যেন তাড়া করছে পিছু পিছু, সে ছুটছে কিন্তু এগুতে পারছে না এবং সেই ‘কে যেন’টি তাকে ধরে ফেলে, খুব কাছে থেকে গুলি করে মাথা লক্ষ্য করে এবং সে দেখতে পায় সারাটা গুলির গতিপথ, কিভাবে তা তার মাথা দিয়ে ঢুকছে এবং মগজগুলো চারিদিকে ছিটকে পড়ছে।
৭.
আমি তার চিকিৎসা করি কিন্তু সে অসম্ভব ‘নন-কমপ্লায়ান্ট’। ওষুধ খেতে রাজি হতেই চায়নি। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেও ওষুধ খেতে ভুলে যায়। ফলো-আপে আসে না। মায়ের সাথে ঝগড়া নিত্য দিনের। ওষুধ খাবার বা ডাক্তারের অফিসে আসার কথা উঠলেই বাসায় দক্ষযক্ষ বেঁধে যায়। সর্বশেষ আমি তাকে দেখি ১০ বছর আগে। ঐদিন সে অসম্ভব হাসিখুশী ও বাকপটু ছিল। মিনি স্কার্ট এবং সংক্ষিপ্ত টপ পরা। তার লম্বা পা এবং তিনচতুর্থাংশ থাই উন্মোচিত। ‘বারে’ বা নাচের অনুষ্ঠানে যাবার উপযুক্ত হলেও ডাক্তারের অফিসে আসার সঠিক বসন নয়। তার ঠোঁটে ও নাভিতে পিয়ারসিং। চোখ রং দিয়ে মাজা। চুল সবুজ, অনেকটা টিয়াপাখির পিঠের মত। কথা বলছিল দ্রুত, জোরে জোরে, ঝর্নাধারায় অবিরল জল ঝরার মত।
কেমন আছো, নিকোল?
ভালো আছি, হি হি হি।
মাকে দেখছি না, মা কই?
কাজে। আমি একাই এসেছি, এই দেখ আমি এখন এডাল্ট, বলে একটু উবু হয়ে তার বুকের ক্লিভেজে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বুঝতে পারি সে তার আপ সুইং বা ম্যানিক মুডে আছে, অযৌক্তিক ও রিস্কি ব্যবহারের মুড সেটা।
কম্পিউটারে দেখি আসলেই তার ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, নি:সন্দেহে আরো সুন্দর ও পূর্ণবতী হয়েছে কিন্তু আগের সেই পবিত্রতাটা আর নেই।
বলি, শুভ জন্মদিন। সত্যই তুমি বড় হয়েছো, এখন ভোটও দিতে পারবে, তার মানে দায়িত্বশীল নাগরিক।
সে হা হা করে হাসে।
অনেকদিন আসোনি, ওষুধ খাও?
না।
কেন?
ভালো লাগে না।
কী ভালো লাগে না?
পার্সোনালিটি বদলে যায়। মনে হয় আমি আর আমি নই। কোন অনুভূতি নেই।
বার্থকন্ট্রোল পিলের প্রেসক্রিপশন নিতে এসেছে, মনোরোগের জন্য নয়।
এরপরে আমার শহর ছেড়ে চলে যায়।
৮
ক্রিস বীর পুরুষ। একবার ওকে খুব প্রহার করে। নিকোলের গায়ে অজস্র দাগ ছিল। ডিপার্টমেন্ট অফ চাইল্ড এন্ড ফ্যামিলি জড়িয়ে পড়ে। “ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ও শিশুর জন্য অনিরাপদ পরিবেশ” বলে উল্লেখ করে ১৫ মাসের শিশুটি যায় নিকোলের মায়ের কাছে। ক্রিসের বিরুদ্ধে পুলিশের রিস্ট্রেইন অর্ডার ইস্যু হয়। নির্যাতিতার একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যেও তার আসতে পারার কথা নয়। ক্রিস উকিল ধরে। নিকোলের পুরনো রেকর্ড খুব খারাপ। তার বরাত দিয়ে নিকোল যে, “আন-স্ট্যাবল” তা প্রমাণ করে রিস্ট্রেইন অর্ডার বাতিল করতে সক্ষম হয়। পবিত্র ইস্টার রাতে সে বিজয়ীর দর্পে বাসায় ফিরে আসে। সাথে নিয়ে আসে বন্দুক। পুলিশে করোনার মড়ক, আইনশৃংখলা ভেঙ্গে পড়া, ফুড রায়ট ইত্যাদির আশংকায় আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির দোকানগুলোতে এখন করোনা-উৎসব। ক্রিসও সেই উৎসবের সুযোগ ছাড়ে নাই।
দুজন আবার মুখোমুখি, প্রাক্তন দুই সেক্স পার্টনার এবং একটি যৌথ সন্তানের জনক জননী।
যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে এগিয়ে এসে সে নিকোলের গায়ে হাত দেয়, “তোমাকে খুব মিস করেছি, ডার্লিং। সব ঠিক হয়ে যাবে”, লিবিডো তাড়িত জন্তুর মত ভেজা গলায় বলে সে।
নিকোল হাতটা সড়িয়ে দেয় ঝট করে, আমাকে স্পর্শ করবে না, খবরদার! তোমার বিরুদ্ধে রিস্ট্রেইন অর্ডার, আমি পুলিশ ডাকবো। ক্রিস হাসতে হাসতে ওর দিকে রিস্ট্রেইন অর্ডার বাতিলের কাগজটি এগিয়ে দেয়। নিকোল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে এবং ক্ষুধার্ত জন্তুটি ঝাঁপ দেয়।
ভোর ৫ টায় নিকোলের মায়ের দরজায় পুলিশের কলিং বেল বাজে।
“ইওর ডটার শট হারসেলফ” তাকে বলা হয়।
বোবা, করোনাক্রান্ত, স্তব্ধ সকাল এক মায়ের তীব্র চিৎকারে খান খান হয়ে যায়।