এস.আজাদ 

সদ্য বাংলা নতুন বছরে পদার্পণ করেই সূর্য যেন ভীষণ তেজে জ্বলতে শুরু করেছে। কেবিনের বাইরে বেরোলেই  গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। একে গরম তারপর প্যাচপ্যাচে ঘাম। তাই খুব প্রয়োজন না হলে নিজের কেবিনের বাইরে বেরোয় না স্বর্ণাভ রায়। বার্ষিক হিসাব-নিকাশের কাজ শেষ হয়ে গেছে। মাঠে পুরোদমে ধান কাটার কাজ চলছে  গ্রাহকদেরও  যাতায়াত একটু কম। কাজ বলতে তাই বিশেষ কিছু নেই। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের রসুলপুর শাখায় ম্যানেজার হিসেবে মাস তিনেক হল জয়েন করেছে স্বর্ণাভ। এর আগে দু বছর প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে ছিল গোবিন্দপুর শাখায়। এখানে কাজের চাপ বেশি থাকায় দুইজন অতিরিক্ত অফিসার আছে তাই তার উপর অতটা চাপ পড়ে না। বাড়িতে এসি গাড়িতে এসি কেবিনেও এসি ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে স্বর্ণাভ ভাবে ব্রাঞ্চের ভিতরটাও এসি হয়ে গেলে খুব ভালো হয়। ব্রাঞ্চের ভিতর অবাধে বিচরণ করা যাবে যে কোনো জায়গায়। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে এটা সে করতেই পারে। ব্যাংকে চাকরি করতে না এলে সে জীবনের বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করার সুযোগই  পেত না। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বাড়ি থেকে ব্রাঞ্চ প্রতিদিন যাওয়া আসা উনিশ উনিশ আটত্রিশ  কিলোমিটার পথ ভ্রমণেও বাইরের জগৎটাকে প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাওয়া দেখতে বেশ রোমাঞ্চকর লাগে।

প্রথম যেদিন এখানে আসে, সেদিন দেখেছিল ঘন সবুজের চাদরে ঢাকা বিস্তীর্ণ মাঠ রাস্তার দু’ধারে। তারপর সেই সবুজ ক্রমশই একটু একটু করে বদলাতে বদলাতে হলুদ, হলুদ থেকে সোনালী, বর্ণ থেকে বর্ণান্তরে পরিবর্তিত হয়েছে মাঠ। রাজ্যের ধান ভাণ্ডারে জন্মানো স্বর্ণাভ আগেও দেখেছে এসব দৃশ্য, মাঝখানে ক’বছর কলকাতার হোস্টেলে থাকলেও বাড়ি ফিরেছে নিয়ম করে। সময়ের সাথে সাথে ট্রেন লাইনের দুপাশের জমির রংয়ের বদল দেখেছে। তবুও এ দেখা যেন অন্য রকম দেখা। কৃষক কেটে নিয়ে গেছে ধান। রিক্ত নিঃস্ব মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে হারভেস্টার এর উদগার উচ্ছিষ্ট। স্বর্ণাভ ভাবে মাঠের প্রকৃতির সাথে মানুষের এক অদ্ভুত যোগ আছে। নিজেকে রিক্ত করে মাঠ যেমন অন্যের গোলা ভরায় মানুষও তেমনি একজন মানুষ নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেয় অন্য অনেকের জীবন গোলা আনন্দে ভরিয়ে দিতে। এখনো দু একটা হারভেস্টার চলছে জমিতে।

কৃষি ক্ষেত্রে বছর পাঁচের আগের অবস্থাও আজকে আর নেই। চাষের পদ্ধতি ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির আমূল বদল ঘটেছে। শ্রম নির্ভর কৃষি কাজ আজকে যন্ত্র-নির্ভর হয়ে উঠেছে। ধান রোয়ার মেশিনের ব্যবহার এদিকে সেভাবে  শুরু না হলেও জল সেচ লাঙ্গল দেওয়া ধান কাটা ও পরিবহনের কাজে  মানুষের শ্রম আজ ব্রাত। ব্রাত্য হয়ে পড়েছে কৃষকের নিবিড় কৃষি নির্ভর কথকথা, ভাষায় এসেছে শহুরে টান। হারাতে বসেছে অন্তজ শব্দ ভান্ডার। বদলেছে নিবিড় শ্রম নির্ভর কৃষির সাথে যুক্ত মানুষের জীবন যাপন সাথে পারস্পরিক ভাবনা ধারণা। গ্রামে গ্রামে দৈনিক মজুরিতে কাজ করা ক্ষেতমজুররা কর্মহীন হয়ে পড়ে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মাটিকাটা, নির্মাণ শ্রমিক, পাইপ লাইনের কাজ নানা ধরনের কাজের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটছে। এও এক অভিনব ব্যাপার বটে। একদিকে নিজের ছোট্ট পৃথিবী ছেড়ে বৃহৎ জনসমাজের দিকে যাত্রা যেমন উত্তরণের পথ দেখায়, অন্যদিকে আত্মপরিচয়ের সংকটে দীর্ন মানবাত্মা হাহাকার করে পরিবার-পরিজন ছেড়ে গুমড়ে মরে পরিযায়ী শ্রমিকের তকমা সেঁটে। 

গ্রামীণ ব্রাঞ্চ হওয়ার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে কৃষকরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ। স্থানীয় হাইস্কুল ও তিনটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন ছাড়া সরকারি লেনদেন বলতে  বিভিন্ন প্রকল্পের লোন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের স্কলারশিপ এর টাকা। মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে তার ব্রাঞ্চে। সেদিন যেমন একজন গ্রাহক  খালি গায়ে মালকোঁচা মেরে মাথায় রাজস্থানীদের পাগড়ির মতো করে গামছা জড়িয়ে ব্রাঞ্চে ঢুকেই শুরু করেছে চেঁচামেচি। নির্মেদ শরীরের রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার উপর  চেঁচামেচির উত্তেজনায় গলার রগ, হাতের পিঠের, বুকের ও পেটের পেশির দ্রুত সঞ্চালন এক অপূর্ব শিল্প সুষমার সৃষ্টি করেছিল স্বর্ণাভর চোখে। নিজের কাজ সামলাতে ব্যস্ত ক্যাশিয়ার অরূপের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে। পি.ও. শ্যাম সুন্দরের টেবিলের সামনে শুরু করেছে চেঁচামেচি। নিজের কেবিনে এসির ঠান্ডা হাওয়ায় বসে মনোরঞ্জন টা খারাপ হচ্ছিল না। বাদ সাধলো শ্যামসুন্দর, হাত বাড়িয়ে ম্যানেজারের চেম্বারটা দেখিয়ে দিল। ভাস্কর্যের ছেনি হাতুড়িতে কালো পাহাড় কেটে তৈরি করা অপূর্ব দেহ সৌষ্ঠব টেবিল থেকে টেবিলে নেচে বেড়ানো সেই মূর্তি এসে দাঁড়ালো স্বর্ণাভর কেবিনের সামনে। ঠিক তখনই সবাই কে অবাক করে দিয়ে ঘটলো অদ্ভুত ঘটনাটা। নিত্যরত মূর্তি তার কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই আচমকা ভূপতিত একটা বছর দশ এগারোর বাচ্চাও যে তার সঙ্গে ছিল এতক্ষণ স্বর্ণাভর তা নজরে পড়েনি। পড়বেই বা কি করে লোকটি একাই তো তিনশোর ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখন ভূপতিত হতে জেগে উঠেছে ছোট বাচ্চাটি।  অনেকটা সাইক্লোনের আছড়ে পড়া বড় গাছের আড়ালে থাকা ছোট গাছ সুযোগ পেয়ে যায় নিজেকে প্রকাশ করার। এতক্ষণ কাচের ঘরে বসে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে  মজা দেখলেও আর বসে থাকতে পারল না স্বর্ণাভ। 

তার সরকারি কর্মচারী বাবার খুব শখ ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। মায়ের বিশেষ কোন চাহিদা ছিল না। এমনকি নিজেরও কোন মতামত ছিল না। বেশিরভাগ স্কুল পড়ুয়া ছাত্রের নিজস্ব মতামত গড়ে ওঠার বা গড়ে উঠলেও  নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার সুযোগ নেই। নিজের আর্থিক দায়ভার নিজের নয়, তাই স্পন্সরের মতামতের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। সাদা কালো মিলে বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক স্বর্ণাভর বাবা রঞ্জন রায় এর কথাই শেষ কথা এই বাড়িতে। এতদিন বাবার সাদায় সাদা আর কালোয় কালো মিলিয়ে আসা ছেলেটা একাদশ শ্রেণীতে বিদ্রোহ করে বসে। সে ঠিক করে কোনোভাবেই সে বাবার ইচ্ছায় ডাক্তার হবে না। তার নিজের সিদ্ধান্তের কথা সে নিজে ছাড়া আর কাউকেই বলেনি কখনো।  বাবা যখন যা বলেছে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছে।  কোনরকম দ্বিমত বা জোর জবরদস্তি করার জায়গা রাখেনি স্বর্ণাভ। এক্ষেত্রে সে তার স্কুলের সব থেকে কাছের বন্ধু বর্ণালীর শেখানো ট্রিকস কাজে লাগায়। বর্ণালী তাকে বলেছিল, — বাড়িতে কখনোই ভুল করেও কারোর সিদ্ধান্তের ওপর নিজের ভাবনা প্রকাশ করবি না।

— কেন?

— তুই যদি কোন কাজ করব না বলিস তাহলে সকলে মিলে তোর মাথা খাবে। তোকে বোঝানোর চেষ্টা চলবে দফায় দফায়। প্রয়োজনে বাইরে থেকে হায়ার করে আনা হবে কাকা জ্যাঠা মামা মেসো সুবিধা মতো কাউকে। সবাই মিলে তোর চিন্তার ভাবনার অসারতা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগবে। টুটি টিপে ধরবে  তোর নিজস্বতার।  বলবে স্বাধীন মতামত রাখার মতো বয়স নাকি এখনো তোর হয়নি। আর যদি  সবকিছু এক বাক্যে বিনা প্রশ্নে মেনে নিস তাহলে তোর গুরুত্ব বেড়ে যাবে তাদের চোখে। সময় ও প্রয়োজনমতো তুই তোর ভাবনা চিন্তা ও সিদ্ধান্ত কাজে লাগাবি। তখন দেখবি তোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের  আকস্মিকতায়  তারা এতটাই চমকে যাবে সেই ফাঁকে তুই তোর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবি।  এই আমাকে দেখ।  মামা বাড়ি যেতে আমার ভালো লাগেনা। মা কদিন আগে দাদুকে দেখতে যাওয়ার জন্য বলল। আমি হাঁ বলে দিয়েছি। কোন বাদানুবাদ হয়নি। আজ সকালে মা যখন আমাকে রেডি হতে বলল তখন স্কুলের প্রোজেক্টের অজুহাত দেখিয়ে স্রেফ ডুব মেরে দিলাম।  কিন্তু প্রথমেই যদি বলতাম  যাব না  বা যেতে আমার ভালো লাগেনা।  তাহলে হাজার একটা প্রশ্নে ও শেষ হতো না।

 কেন যাবে না, গেলে কি অসুবিধা, দাদু বুড়ো মানুষ কবে আছে কবে নেই, নাতনি কে তার দেখতে ইচ্ছে করেছে,  নাতনি কে তিনি কতটা ভালোবাসেন তার ফিরিস্তি শুনতে হবে। অত সময় নাই ভাই।  তাই স্রেফ বলে দিয়েছি যাব।  আজ মা একাই চলে গেল বুড়ো বাপকে দেখতে।

বর্ণালীর শেখানো সেই ট্রিক্স দুহাতে রোজগার করা ধুরন্ধর সরকারি কর্মচারী বাবার কাছে বিশেষ খাটেনি। বাবার কথামতো তাকে মেডিকেলে ভর্তির যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষায় বসতে হয়েছে। সরকারি কলেজে সুযোগ না পেলেও পাস করেছে কোনো রকমে। তাই দিয়েই টাকার জোরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে তাকে ডাক্তার বানানোর সব পরিকল্পনা  তার বাবা প্রায় করেই ফেলেছিল। বাদ সাধলো উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বাবা জানেনা যে, সে ইচ্ছা করে  উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করেছে। জানলে আর রক্ষে থাকতো না। তার বাবাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। পরের বছরের জন্য আবার কোচিং টিউশন প্রস্তুতি এ বছরে উচ্চমাধ্যমিকে পাস করে কিন্তু মেডিকেলের রাঙ্ক অনেক পিছনে চলে যায়। রাজ্যের  বেসরকারি  কলেজগুলোতে সুযোগ না পেয়ে বাবা ঠিক করে ব্যাঙ্গালোর পাঠাবে। এখানে তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে মা, একমাত্র ছেলেকে কোন মতেই তিনি কাজ ছাড়া করবেন না। মা নাকি পই পই করে বাবাকে দ্বিতীয় সন্তানের চাহিদার কথা জানিয়েছিল। বাবা রাজি হয়নি। সে কথাই বাবাকে স্মরণ করিয়ে দেয় মা। কেন স্বর্ণাভ জানে না কিন্তু তার মায়ের কথা শুনে বাবার সিংহ গর্জন মিইয়ে গিয়ে মিঁয়াও হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত নামের আগে ডাক্তার জোড়ার অদম্য আগ্রহ থেকে বাবা তাকে হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দেয়। প্রাকটিস করুক আর না করুক  বাড়ির সামনে একটা নেমপ্লেটে ‘ডাক্তার স্বর্ণাভ রায়’ লেখা থাকবে এটুকুতেই বাবা শেষ পর্যন্ত লড়াই থামায়। সেও থামায় বাবার সাথে লুকোচুরি খেলা।

সাড়ে পাঁচ বছর পড়ে শেষ পর্যন্ত নামের আগে ডাক্তার জুড়ে বাড়ি ফেরে স্বর্ণাভ। বাড়ির বাইরে শ্বেত পাথরের নতুন নাম ফলক লাগানো হয় ডক্টর স্বর্ণাভ রায়, বি এইচ এম এস। বাবা  তার এক বন্ধুকে ধরে তেঁতুলতলা বাজারে রাস্তার উপরেই একটা ডিসপেনসারি ব্যবস্থা করেছিল। প্রথম প্রথম দু চারদিন স্টেথো গলায় ঝুলিয়ে বসলেও পসার তেমন জমে নি। এমনিতেই বাজারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়ে নানান মশকরা চালু আছে তার উপর অলিতে গলিতে  বেকার ছেলেরা দুদিন কমপাউন্ডারি করে আর মেটেরিয়া মেডিকার বই পড়ে চেম্বার খুলে বসেছে। সেখানে পাশ করা না পাস করা কোন বিষয় নয়। দু শিশি ওষুধ দিলে কুড়ি কি ত্রিশটা টাকা ময়লা মাটি আর ঘামে ভেজা ন্যতানো নোট হাতে গুঁজে দেয়। কিছু বলতে গেলে উল্টে-চারটে কথা শুনিয়ে দেয়।  বলে, —  দিছতো চার ফোঁটা  ওষুধ। তার লেগে এর থেকে বেশি দেয়া যাবে না। না দিলে বলো মেলা ডাক্তার আছে। 

এই দুর্মূলের বাজারে কোন আহাম্মক চার-ছ ফোটা মাদার টিংচার বাঁচানো আর আর সাড়ে পাঁচ বছর পড়ে পাশ করা সার্টিফিকেট জাহির করার জন্য তিরিশ টাকা ছেড়ে দেয়। পনেরো দিনের মধ্যে চেম্বার বন্ধ করে দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাবে আড্ডা দেওয়া শুরু করে। হোমিওপ্যাথি ডাক্তারদের ভবিষ্যৎ তার বাবা জানে তাই জোর দিয়ে কিছু বলে না।  যাইহোক বাড়ির সামনে ডাক্তার লেখা নাম ফলকটা তো বসেছে। বন্ধুদের পরামর্শে ব্যাংকিং সার্ভিসের পরীক্ষা দেয়  এবং মেধাবী ছাত্র  স্বর্ণাভ  দু-তিন বছরের মধ্যে  প্রবেশনারি অফিসারের চাকরি পায়।

চিকিৎসা করতে চাক বা না চাক সে তো আদপে একজন চিকিৎসকই ই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পদক্ষেপে কেবিনের দরজা টা খুলে বেরিয়ে আসে। সকাল থেকে ধরে রাখা ঠান্ডার আমেজটা এক ঝটকায় চটকে যায়। দীর্ঘক্ষণ এসির থাকার পর বাইরে বেরোলে বাইরের গরম টা যেন বীর বিক্রমে টুটি টিপে ধরে। যাইহোক, তার ব্রাঞ্চে একজন গ্রাহক অসুস্থ হয়ে যাবে আর সে বাইরে বেরিয়ে দেখবে না এটা হতে পারে না। যতই হোক সে  ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। 

বাইরে বেরিয়েই চিকিৎসকের স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে অসুস্থ ব্যক্তির নারী পরীক্ষা করে এবং বছর পাঁচেক আগের শেখা বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে বোঝে এখানে আসার আগে লোকটি দীর্ঘক্ষণ চড়া রোদের মধ্যে ছিল। দীর্ঘক্ষণ জল খায়নি  সম্ভবত। পালস রেট খুব কম  সান স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।  তাই তাড়াতাড়ি কেবিনে ঢুকে নিজের ব্যাগ থেকে ঠান্ডা জলের বোতলটা বের করে নিয়ে এসে আচ্ছা করে ছিটিয়ে দেয় লোকটার চোখে মুখে।  ততক্ষণে ব্যাংকে  উপস্থিত অন্যান্য গ্রাহকরা  ভিড় জমিয়েছে  দুই একজন কর্মচারীও উঠে এসেছে টেবিল ছেড়ে। স্বর্ণাভর নির্দেশে গ্রুপ ডি কর্মচারী আবুল কাশেম পাঁজা কোলা করে ধরে লোকটাকে বসিয়ে দেয়। চোখে মুখে ঠান্ডা পানির পরশ পেয়ে জেগে ওঠে আজিমুদ্দিন। সঙ্গের বাচ্চাটা চিল চিৎকারে কেঁদে যাচ্ছে তখনও। স্বর্ণাভ আবুল কাশেমকে ফার্স্ট এইড বক্স থেকে একটা ওআরএস নিয়ে এসে লোকটাকে খাইয়ে দিতে বলে। ওআরএস খেয়ে লোকটা চাঙ্গা হয়। উপস্থিত সকলেই ডাক্তার বাবুকে ধন্য ধন্য করে। অজিমুদ্দিন  এতক্ষণ ধরে তার সেবা শ্বশুরা করা আল্লাহর ফেরেশতার মতো ম্যানেজারকে বলতে থাকে তার দুঃখের কথা। সাথে থাকা ছেলেটাকে দেখিয়ে বলে, — ছেলেটা হাইস্কুলে পড়ে দু বছর হয়ে গেল।  পাড়ার সব ছেলে টাকা পায় আর আমারটা।  ম্যাদামারা, ঢাকের বাঁ,  কোন কাজের নয়। মাঠে যেয়ে শুননু রফিকের ছেলে,  হাবুলের মেয়ে,  কেরামতের কানা বিটিটাও একগাদা টাকা পেয়েছে।  মাঠ থেকে এক দোরে ঘর যেয়ে ব্যাংকের বইটা  নিয়ে  স্কুলে গেনু ।  হেডমাস্টারকে বননু সে আর একটা মাস্টারকে দেখিয়ে দিলে।  সে মাস্টার শুধুলে, — কিসের টাকা?

— কিসের টাকা মানে! ছেলে স্কুলে পড়ে। সবার ছেলে টাকা পায়। আমার ম্যাদামারা টা পায় না। দু’বছর পড়ছে, একদিনও টাকা পায়নি। 

মাস্টার আবার কম্পিটারে  কি সব টিপে টুপে দেখে বললে, — ব্যাংকে যাও আমরা কিছু বলতে পারবেনা।

আজিমুদ্দিন হাতে ধরা পাস বইটা এগিয়ে দেয় ম্যানেজারের দিকে। পাস বইয়ের  কভার টা দেখেন স্বর্ণাভ বুঝতে পারে  এটা তাদের ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নয়। তবুও  পাস বই টা খুলে দেখে পাশের জেলা হুগলীর সেন্ট্রাল ব্যাংকের দসঘরা ব্রাঞ্চের পাস বই। একাউন্ট হোল্ডারের নাম  মোমেনা বিবি, সম্ভবত বাচ্চাটির মা। লোকটির এতক্ষণের কাণ্ডকারখানা দেখে তার হাসি পেলেও সে হাসে না। আজিম উদ্দিনের হাব ভাব দেখে আর কথাবার্তা শুনে  স্বর্ণাভ বোঝে লোকটা  লেখাপড়া না জানলেও  চৌখস আছে। ছোট ছোট প্রশ্ন করে স্বর্ণাভ যা বোঝে টা হলো বাচ্চাটা  আজিম উদ্দিনের  প্রথম পক্ষের স্ত্রীর বছর চারেক আগে পালুই থেকে খড় আনতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেছে। স্ত্রী যখন বেঁচে ছিল  তখন থেকেই  আজিম উদ্দিন এর  বড় ছেলে রাহুল মামা বাড়িতে থেকে প্রাইমারিতে পড়তো। এটা সেখানকার একাউন্ট। স্ত্রী একটা  সন্তান রেখে মারা যাওয়ার পর শালীর সাথে তার দ্বিতীয় বিবাহ হয়েছে। তারও একটি ছেলে হয়েছে। আজিমউদ্দিন বড় ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে এসে হাইস্কুলে ভর্তি করেছে। কিন্তু দু বছরে এক টাকাও ঢোকেনি। সবাই গাদা গাদা টাকা পাচ্ছে তার ছেলেটা কিছুই পাচ্ছে না। 

শ্যামসুন্দর কে আজিম উদ্দিনের ছেলে রাহুলের জন্য একটা স্টুডেন্ট একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে দিতে বলে। ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের একটা ময়লা প্যাডে গ্লোনোইন এবং ন্যাট্রাম মুর দুটো ওষুধের নাম ও ব্যবহারবিধি লিখে আজিম উদ্দিন এর হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, — মাথা ঘোরে, বমি পায়, ফিট লেগে যায় এরকম কি মাঝে মাঝে হয়? 

— না ডাক্তারবাবু।  তবে মাঝে মাঝে খুব দুব্বল লাগে। 

— নিচে তলায় ওষুধের দোকান থেকে এই ওষুধ দুটো কিনে নিয়ে গিয়ে খাবে। সব ভালো হয়ে যাবে।

—  প্রেসক্রিপশনটা আর পুরনো পাস বইটা দু’হাতে ধরে ডাক্তারবাবু কাম ম্যানেজার বাবুর দিকে দু’হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে বার তিনেক প্রণাম করে আজিম উদ্দিন। বাপের দেখাদেখি  রাহুল ও দু’হাত জড়ো করে তিনবার কপালে ঠেকিয়ে  প্রণাম করে  স্বর্ণাভ কে। 

সাড়ে পাঁচটায় সব কাজ মিটিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে নিজে ড্রাইভ করে বাড়ি ফেরে। সদর দরজা দিয়ে ঢোকার সময়  চোখে পড়ে নাম ফলক টা ডক্টর স্বর্ণাভ রায়, বি এইচ এম এস। ঘরে ঢুকে বাবার ছবির ওপর ঝোলা শুকনো  রজনীগন্ধার মালাটা খুলে ফেলে ছবির উপর জমে ওঠা ধুলো হাত দিয়ে মুছে দেয়। তারপর ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো টাটকা রজনীগন্ধার মালা টা বের করে ঝুলিয়ে দেয়। বাবার ছবিটার দিকে নিবিড় তাকিয়ে থাকতে থাকতে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার তপ্ত গাল বেয়ে। তার মনে পড়ে গত দেড় বছরে সে আজই প্রথম বাবার ছবিতে মালা পড়ালো। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *