সুদর্শন দত্ত
আজ আর রোদ্দুর আসবে না। রোদ্দুর, তমসার একসময়ের ভীষণ ভালো বন্ধু। আজও আছে, তবে সেদিনের সেই টান, সেই অনুভব, অতটা না থাকলেও আজও তার মনে রোদ্দুরের জন্য পরিপাটি করে বিছিয়ে রাখা আসনটা তেমনই পড়ে আছে।
সকাল থেকেই একটা কি ভীষণ ভালোলাগায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে ছিল তমসার। যখন সে খুব খুশি থাকে তখন প্রায়ই গুনগুন করে গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গানের এই কলিগুলো, ‘ আমার মল্লিকা বনে, যখন প্রথম ধরেছে কলি, আমার মল্লিকা বনে, তোমারই লাগিয়া তখনই বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলি, আমার মল্লিকা বনে…’, আজও গাইছিল।
সারাটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে মনের মত পরিপাটি করে গুছিয়ে নিচ্ছিল, রোদ্দুর এটা পছন্দ করে! এটা এখানে থাক। এই জিনিসগুলো ওর অপছন্দের! তবে চোখের আড়ালেই সব থাক। এই খাবার, এই পানীয়, এই স্মেল, এই পর্দা, এই ফ্লেভার, এমনকি বেড সীট, বেড কভার পর্যন্ত যা সে পছন্দ করে সব তমসা তার অতি প্রিয় সেই মানুষটার কথা ভেবেই গুছিয়ে রাখার সময় আনন্দ চিত্তে গাইছিল সেই গানটা। একবার ওয়ারড্রব এর পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে মিররে তার প্রতিকৃতির ওপর চোখ পড়তে নিজের আউটলুকটা একবার দেখে নিল। চোখের পাশে রিঙ্কলসের ছোপ। দ্রুত হাতে মিশ্রণের পোচ লাগিয়ে নিল। একসপ্তাহ আগেই চুলে মেহেন্দি করা হয়েছে, তবু অভ্যাসবশত একবার আঙুল চালিয়ে দেখে নিল, কোথাও কোনো পক্ক কেশরাশির উপস্থিতি নজরে আসে কিনা! যদিও ওসবে রোদ্দুরের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তার কথায়, ‘তুমি যেমনটি তেমনই আমার পছন্দ। ওসব বাহ্যিক আভরণে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।’
এর আগে কতবার এমন হয়েছে যে তমসা তার পাকা চুল বা রিঙ্কলস্ বা অবাঞ্ছিত বার্ধক্যের নিশানাকে আড়াল করতে চাইলে রোদ্দুর বলেছে, ‘কেন বৃথা চেষ্টা! সময়ের সাথে সবকিছুই মানিয়ে নিতে হয়। থাক না ওসব, ন্যাচারাল বিউটি!’
তার দিকে না ফিরেই তমসা বলতো, ‘কিন্তু আমার নিজের তো একটা ভালো লাগা আছে?’
হয়ত সেই সময় তমসা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল, তখনই প্রতিবিম্বের মাধ্যমে দৃষ্টি বিনিময় হতেই হেসে ওঠে সে। বলে, ‘তবুও তো একটা দিনও আমায় ভালো করে দেখলে না!’
‘নতুন করে আর কি দেখবো? তুমি তন্বী, রূপসী, সুন্দরীই নও শুধু, তুমি অপরূপা!’
‘তাই বুঝি?’ ঘুরে দাঁড়িয়ে খাটের ওপর আধশোয়া রোদ্দুরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে তমসা। ‘তাই যদি হবে তবে তো একটা দিনও কাছে -‘
বাধা দেয় রোদ্দুর, ‘থাক তম, ওসব কথা থাক। আমার কাছে যেটা প্রাসঙ্গিক নয় তারজন্য কেন বারবার সেই প্রসঙ্গ টেনে আনো? তুমি যে আমায় তোমার বাড়িতে তোমার ঘরে প্রশ্রয় দিচ্ছ, আমি আসছি, কথা বলছি, গল্প করছি, তোমার হাতের চা কফি টিফিন ধ্বংস করে তোমার সান্নিধ্য পাচ্ছি, সেই বা কম কিসে? এর বেশি আমিও আশা করি না, তুমিও তোমার মধ্যে সেই ভাবনার প্রশ্রয় দিও না।’
মুহূর্তে ঘরের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বদলে গেল। এক গুমোট পরিস্থিতি ঘরে ও বাইরে। সে দিনটা ছিল শ্রাবণের এক মেঘাচ্ছন্ন দিন। তখনও বৃষ্টি আসেনি। যদিও সব মেঘে বৃষ্টি হয় না। তবে অঝোরে না হলেও দু’এক ফোঁটা অন্তরে ঝরেছিল।
টি টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠতেই কণ্ঠের স্বর নামিয়ে এনে গানের সুর বজায় রেখে উঁকি দিয়ে দেখল কে ফোন করেছে? স্ক্রিনে রোদ্দুরের নামটা দেখে খুশি খুশি সেটা রিসিভ করে, ‘হ্যালো’ বলতেই অপর প্রান্তে তার চিরকালীন প্রিয় মানুষটি যখন বলল, ‘তম, আজ আমি আসতে পারছি না। সন্ধ্যার ফ্লাইটেই অফিসের কাজে ব্যাঙ্গালোর যেতে হচ্ছে। কাল দিল্লি হয়ে পরশু সন্ধ্যায় ফিরছি। স্টিল দ্যান, প্লিজ!’
কোনো উত্তর দিল না তমসা। বলতে ইচ্ছে করছিল অনেক কিছু, কিন্তু শেষমেশ তার সেই ইচ্ছেকে অবদমিত রেখে ফোনটা না কেটে সেটা বুকের ওপর ধরে রাখল। শূন্য দৃষ্টিতে জানালার বাইরে চেয়ে কত ভাবনার আঁকিবুঁকি তার হৃদয় জুড়ে।
যতবার সে রোদ্দুরের কাছে একান্ত আপনার করে কিছু চাইবে ভেবেছে, ততবার, হ্যাঁ ততবারই সে কোন না কোনভাবে রিটার্ন গিফট হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আজই যেমন! ভেবে রেখেছিল রোদ্দুর এলে সে বলবে, একটা বাচ্চা এডপ্ট করতে চায়। কারণ জানতে চাইলে বলতো, ‘তুমি তো কোনো ভাবেই আমার সাথে আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে একটা বেবি দিতে পারবে না, সে তুমি তো বলেই দিয়েছো। কিন্তু একবারও কি ভেবেছ, আমি কি নিয়ে থাকি? আমার বাকী জীবনটা কেমন ভাবে চলবে? আমার প্রত্যাশা, আমার স্বপ্ন, আমার আকাঙ্খা সব তো তোমাকে কেন্দ্র করেই ছিল, তবে কেন আমি সেই সুখ থেকে বঞ্চিত বলতে পারো?
এর উত্তরও অনেকবার দিয়েছে রোদ্দুর তমসাকে। বলেছে, ‘তুমি একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে সংসার করো। আমি তো কিছুই তোমাকে এ জীবনে দিতে পারলাম না? বলতে পারো প্রতারণাই করে গেলাম। অথচ, সবকিছুই তোমার পাওয়ার কথা ছিল।
মনে পড়ে তমসার সেদিনের কথা। ওদের ম্যারেজ রেজিস্টারের কাছে যাবার কথা। সন্ধ্যা থেকে তৈরি হয়ে বসেছিল সে। কিন্তু রাত অনেক হয়ে গেলেও রোদ্দুরের না কোনো সংবাদ না কোনো ফোন। উদ্বিগ্ন তমসা বারবার ফোন করলেও কোনো জবাব আসে নি। তারপর একসময় বিধ্বস্ত তমসা রাগে দুঃখে ক্ষোভে হতাশায় বিছানার ওপর আছড়ে পড়ে চোখ ও মনের বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। কিন্তু খবরটা পেল তার তিনদিন পরে।
একমাস আগেই গাড়িটা কিনেছে রোদ্দুর। ড্রাইভিং এর হাত পাকা-ই। এদিকে অফিস থেকে বেরোতে দেরী, ওদিকে তমসা অপেক্ষারতা, বারবার ফোন করছে। শ্রাবণের ধারাপাত ঝিরিঝিরি ঝরেই চলেছে। সবেমাত্র সিগন্যাল সবুজ হতে সামনের গাড়ি ছুটতে শুরু করেছে। তার গাড়ি বেশ পেছনে। সিগন্যালটা লাল হওয়ার আগে তাড়াতাড়ি সেটা পেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্পীড বাড়াতেই একজন পথচারী, ছাতার আড়ালে থেকে রানিং রাস্তাটা পার হতে চাইলে সজোরে আছড়ে পড়ে তার বনেটের ওপর। ব্রেক কষলেও তিনবার ডিগবাজি খেয়ে লোকটা রাস্তার উপর ছিটকে পড়ল। সাথে সাথে লোকজন চেঁচামেচি হইহট্টগোল। আর নিস্তেজ হয়ে আসা লোকটার শরীরটা বৃষ্টির জলের সাথে রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। হসপিটাল থানা পুলিশ হাজার ঝামেলা সামাল দিতে রাত কেটে গেল। ওদিকে খবর পাওয়া গেল, লোকটির মাতৃহারা একটি বিবাহযোগ্যা মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। যারা আছে তারা সব অনেক দূরের আত্মীয়। বেশ কিছু প্রতিবেশী আর তারা মিলে রোদ্দুরের মত হ্যান্ডসাম সুপুরুষ ও বিত্তবান যুবকের সাথে লোকটির মেয়ের বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। কিছুতেই তারা এ সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। কেউ কেউ তাদের এই যুক্তিও দাঁড় করায় যে, ‘বিবাহযোগ্যা মেয়ে, পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে পড়লো। এরপর তো তাকে দেখার আর কেউ রইলো না। কে তাকে দেখবে? কে তার দায়িত্ব নেবে? তাছাড়া চারপাশে যা সব হচ্ছে, এরপর তো শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে?’
‘ঠিক বলেছো? না না, এর দায়িত্ব উনাকেই নিতে হবে!’ কেউ বললো। রোদ্দুর যত বোঝাতে চায় আর তার সব দায়িত্ব নিয়ে তাকে পাত্রস্থ করবে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে, এই প্রতিশ্রুতিও দেয়। কিন্তু উন্মত্ত জনতা ও নাছোড় আত্মীয় প্রতিবেশী কেউ তার কথা শুনতে চায় না। তারপর রোদ্দুর পিতৃহীন মেয়েটিকে বাধ্য হয় বিয়ে করতে।
সেদিনও খুব কেঁদেছিল তমসা। বাইরের বৃষ্টি আর মনের বরষা এক হয়ে যেন ভেঙে পড়েছিল তার ভেতরে ও বাইরে। সেই থেকে অনূঢ়াই রয়ে গেছে সে।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে রোদ্দুরকে বিয়ে করতে হয় ঠিকই, তাই বলে তমসার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি। বারবার সে তমসাকে বুঝিয়েছে এবার একটা বিয়ে করে সংসার বসাক, কিন্তু অনড় তমসা! তার কথায়, জীবনে একজনকেই মন দিয়েছিল, ভালোবেসেছিল। তাই আর দ্বিতীয় জনকে মনের ঘরে স্থান দিতে পারবে না। তার কথা ভেবে, মনে মনে তারই স্বয়ম্বরা হয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে।
তার সাথে রোদ্দুরও প্রতিজ্ঞা করেছিল, আজীবন সে-ও তমসার বিপদে আপদে পাশে থাকবে। তাই তারা স্বামী স্ত্রী না হয়ে, বন্ধু হয়ে, একজন অন্যজনের পরিপূরক হয়ে, এক পবিত্র সম্পর্কে নিজেদের বেঁধে রেখে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে এটা স্থির করে। তবে কয়েকদিন থেকে তমসার মনে এই ভাবনা এসেছে, যদি একটা মেয়ে বেবি এডপ্ট করা যায়, তবে আর শেষ জীবনটা একা কাটাতে হবে না। আজ রোদ্দুর এলে তাকে সেটা বলবে। জানে সে, কিছুতেই তা মানবে না রোদ্দুর। বলবে, ‘তখন পইপই করে বলেছিলাম বিয়ে করে সংসারী হও। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করো! এখন, এখন কেন এডপ্ট করার কথা ভাবছো?’ তাহলেও বলবে সে। তখন ভাবে নি বলে আজ ভাবতে বাধা কোথায়? এখনো সময় আছে, সব শেষ হয়ে যায় নি এখনো!
কিন্তু আজও রোদ্দুর এলো না। তার কল রিসিভ করা অবস্থাতেই মোবাইলটা বুকে চেপে রেখে তার ভাবনা আকাশ পাতাল ছাপিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। কেন নিঠুর তার সাথেই এই প্রতারণার খেলা খেলে চলেছে আজীবন! কেন তার কোনও ইচ্ছে কোনও চাওয়া দাম পেল না কোনদিনও। কেন কেন কেন? ভাবতে ভাবতে তার দুই চোখে শ্রাবণের বারিধারা অঝোরে ঝরে চলেছে। আর ওদিকে রোদ্দুর ফোনে বলেই চলেছে, ‘হ্যালো তমসা, শুনতে পাচ্ছো?’