শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ ‘ উপন্যাস।)
মনের ঘরে মানুষ খোঁজে কোন জনা
ওরে তোরা খুঁজবি কখন আপন ঠিকানা
কত দিন তো গেল, কত রাইত তো গেল, বড় ঘরটা টুকরা টাকরা হল। বড় হাঁড়ি বড় কড়াই ছোট হইতে হইতে আরও ছোট হইল। লম্বা চিড় ধইরছে কন একতাখান কেউ কইত হারে নি। কইব কি, দেয়ে ন তো কোনদিন। ভিতরে ভিতরে যে হাল্টি যার, নতুন নতুন গন্ধ আই হক্কলের ঘরের কোণায় কোণায় জমা হর, হেইডা টের হাওন যার না যে আর। খালি চোয়ে দেয়া যায়, হুরান কাঠ যিগাইন ঘুনে ধইরছে, যার ভাগে যে কাঠাল গাছ হইড়ছে, হিগাইন চিরাই হাল্টাহাল্টি হইছে হেই কাঠ, তাইতে ঘরের সৌন্দর্য বাইড়ছে ঠিক কথা, হুরান ঘ্রাণ, হুরান ভাব উবে গেছে এট্টু এট্টু করি। হেই হরিবর্তন এত সূক্ষ্ম যে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যন ধাক্কা মারে তন ধাক্কা মারে। বড়া উঠান খান দেয়া যার, আবার দেয়া যায়ও না। খড়ের গাদা ইয়ানে হিয়ানে নতুন করি গজায়। তুরুল হোকা যে মাডি ফুডা করি বার হয় হেইডা আর কে নজর করে। ঘরের মাইঝখানে মাইঝখানে এত পার্টিশন হইলে কার এত দরকার হইরছে গরজ করি চাইব। তবুও কি আকাশের রঙ হাল্টায় না, হাল্টায় তো। তনই তো শুরু হয় আকাশের কোলে কালা মেঘের খেলা। আর ইয়ানে তো আকাশ নয়, স্যাঁতলানো মাডি, হিচল খাইলে আর রক্ষা নাই। দ্যাশভাগ হইছে কমদিন কী হইছে! মনে থাইকবার কথা কি ? সেঝ দেয়রের হৌড় বাড়ির দিক তুন লতায় পাতায় আত্মীয় চম্পক কোন বাইচ্চাকালে বেড়াইতে আইছিল। চম্পকের দুষ্টামির জ্বালায় অতিষ্ঠ হই আঁর হৌড়রা হেথেরে আর রায়নের সাহস করে নি। অন এতদিন হরে ইন্ডিয়ার তুন আই অচেনা মানুষটা হরিচয় দেয় চম্পক বলি। ইনায় বিনায় এমন গল্প ফাঁইদল বেগ্গুনের চোয়ের জল বার করি ছাইড়ল। হক্কলের মনের মধ্যে একটাই হশ্ন হেথে অত দূর তুন বর্ডার হার করি আইল ক্যামনে যন আঙ্গ দ্যাশে টালমাটাল অবস্থা। হিন্দুদের হায়ের তলার জমি দিন দিন সরি যার। দ্যাশের জন্য ওর দরদ নাকি উথলি উইঠছে। দেশভাগের সময় মুসলমানরা ওর বাবা মা কাকারে কচু কাটা করি নদীর জলে ভাসাই দিছে, অনেক খোঁজাখুঁজির হরেও ভাইয়ের খোঁজ হায় ন, জাইনত হাইরছে হেথাগো বাড়ির অন্য মাইয়াদের যে দশা হইছিল বোইনটারও হেই দশা হইছে, নিজের মুয়ে হেই লজ্জার কথা হেতে আর ক্যামনে কইব।
এই তো দেইখছি উল্টা হুরান। দ্যাশ তুন হলাইবার লাই যুগী বাড়ির দুই ঘর গোপনে শলা পরামর্শ চালার। হুইনতেছি অল্পস্বল্প যা চাষের জমি আছে রায় বাবুদের মেঝ হোলা আর ইব্রাহিম মোল্লার কাছে জলের দরে বিক্রিও করি দিছে বুদ্ধি করি চুপিচুপি। এই দুইজনের খাতিরের কথা কে না জানে। একজন হইল ধানের কারবারি আর একজন হইল ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার। হেথেনদের উপর কথা কইব কার এত বুয়ের পাটা। ঘরদোর ভিডা ছাড়ি চলি গেলে কে কব্জা কইরব কে জানে। অন কতা হইল চম্পক উইঠব কনডাই। সেঝ দেওরের ভাগে যে তিনখানা ঘর, হোলা দুইডা বড় হইছে, এক ঘরে থায় আর বাকি দুই ঘরে স্বামী স্ত্রী আর মাইয়া। আগের দিন হইলে না হয় কতা ছিল, এক লগে ঘর ছিল, কোনো এক ঘরে না হয় জায়গা হই যাইত। দিনকাল হাল্টি গেছে, অন যার যার তার তার, কে আর আগ বাড়াই দরদ দেখাইব। তবে কিনা চম্পকের গপ্প গ্ৰামশুদ্ধ মাইনষের মধ্যে ছড়াই গেছে। সন্দেহ দানা বাঁইধতে দেরি হয় না এই চম্পক আসল চম্পক কিনা কে কইব, হেই কবে দেইখছেে, শেষে ঘরে থাইকত দিই আর এক বিপত্তি।
গোয়ালঘর আর কাঁচারিঘরের মাঝখানে একখান ঘর আছে। দলিল মিঞা গরুগোতান আর বাগান দেখভাল করে, হেতে দিনেদুপুরে হেই ঘরে ভাতঘুম দেয়। গরুর গোবর আর চনার গন্ধে ঘরে থাওন যায় না। দলিলের গোয়াল ঘরের গন্ধ ত্রিশ বত্রিশ বছরে গা সয়া হয়ে গেছে। এর তুন ভালা গন্ধ কিছু হইত হারে হেতের কল্পনায় আয়ে না। অবস্থা বেগতিক দেই হেতের মাথায় একটা বুদ্ধি আইল। বইলব কি বইলব না করি বলিই হালাইল।
বাবু ছোট মুয়ে একখান বড় কতা কই। চম্পক বাবু না হয় আঁর ঘরে থাক। আর দেওর কইল, এইডা দলিল তুই ক্যামন কথা কস? তোর কোনও মুয়ের ট্যাকস নাই! দলিল মাথা নিচু করে দাঁড়াই থাইকল কিছুক্ষণ। ভালার বুলি কতাডা হাইড়ল, হেই কতার যে এমন মানে হইব কে জাইনত। চম্পক হড়ি গেল বিপদে।
দ্যাশের মায়ায় হড়ি চোরাহতে দ্যাশে হিরল, ভাইবল কোনও না কোনও একটা থাইকবার জায়গা জুডিই যাইব, এমন টানাটানি হইব জাইনলে দ্যাশেই আইত না। আত্মীয় স্বজন যে এমন হর হই যাইব, হেই কথাডা তো কষ্মিনকালেও ভাবে নি। চেনা দ্যাশটা দিনে দিনে অচেনা হই গেছে হেতের কাছে। আঁইও চম্পকরে যে সান্ত্বনা দিমু তেমন কোনও উপায় খুঁজি বার কইরতে হাইরলাম না। আঁর যদি বাড়তি ঘর থাইকত, দিতাম ওরে ঠাঁই। ঠেস দিই বই রইল হর্মুলের মাচায়। মচর মচর শব্দ হয়, আর হেতে হিচ মোড়া হই গা চুলকায়। দলিল মিঞা হুক্কা খায় আর ধোঁয়া ছাড়ে। আঁই কত চেষ্টা চরিত্র করি ছাল ছাড়াইবার লাই, হারি না, আরও বেশি করি সংসার আই আঁরে বেড়াই ধরে। না হয় কত চেষ্টাই তো কইরলাম, হাড়া হতিবেশীরে ভালোবাসুম, হরেরে আপন করি লমু, হাইরলাম কই, কে যেন আঁরে কয়, লক্ষ্মণরেখার বাইরে যাইস না কিন্তু, মনের মধ্যে যে এত গিঁট আছে, হিয়ের লাই এনা বারে বারে উষ্ট্রা খাই। না হইলে চম্পকরে কইতাম হারিয়েন না কিল্লাই – চিন্তা করিও না আঁই তোঁরে একখান ঘর বানাই দিমু। দলিল মিঞা গলা খাকারি দেয়, কী যেন কইত যাইও দম আঁটকাই আইয়ে। শেষমেশ ঢোক গিললাম মনের কতাডা সাহস করি কয়, দাদা, আমনে আঙ্গ বাড়ি থাইকবেন। বাড়ির হুরুষরা মাইয়ারা হক্কলের এই কথা হুনি মাথায় বাজ ভাঙি হড়ে। এমন একখান কতা দলিল কইত হাইরল। দলিল বুইঝত হাইরল কতাখান হাড়ি হেতে বড় অপরাধ করি হালাইছে, বেআক্কেলের মতো কতা কিনা। দলিল মিঞারে এমনিতে হক্কলে আপনই ভাবে, হেতের দুঃখে মনও কাঁদে, মোসলমান বলি কোনো তফাতও করে না। কিন্তু যে কতাখান হেতে কই হালাইছে এর অর্থখান কী জানে! আঁই খালি ভাবিয়ের চম্পক এই কতাখান কেমন করি নের। চম্পকরে যদি কলমা হড়াই মোসলমান বানাই দেয় হক্কলে মিলে তন কী হইব! আঁর নিজের মধ্যেই ক্যামন হইতে লাইগল। হেতে তো কোনও খারাপ কথা কয় ন। হক্কলে যন তাড়াই দিত চায়ের হেতে তো বুয়ে টানি লর। কারও মুয়ের তুন যন কোনও কতা বার হন না তন আঁইই কইলাম আমনেরা হক্কলে আর একবার ভাবেন, চম্পকরেও ভাইববার অবসর দেন।
দলিল মিঞার প্রস্তাবে যে দোটানা তৈরি হইছে হের সমাধান দূর অস্ত। তাইলে চম্পক থাইকবার জায়গা না হাই হিন্দুস্তানে হেরত চলি যাইব? দ্যাশের মাটির টানেই তো হলাই আইছে ; এই কতাখান আপনজনরা ভাইবত ন একবার। যেতেরা সম্পর্কে আত্মীয় হেতেরাই মুখ হিরাই নিছে অন্যরা ভাইবত যাইব কোন দুঃখে। তার হরেও কতা থাকি যায়, এই যে আঙ্গ দ্যাশে হিন্দুরা বিপদে আছে বলে চেঁচায়, চম্পকের বেলায় এত দরদ কনডাই গেল! যুগী বাড়ির পরেশ আই খবর দিছে, মাঝ রাতে কারোগরে কিছু না জানাই না হোনাই বিভূতি আর নান্টুরা শলা পরামর্শ করি মাঝরাতে বাড়িঘর ছাড়ি চলি গেছে ভারতে। বিলোনিয়াতে হেতাগো আত্মীয়স্বজন আছে যারা ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় চৌমুহনী তন কোনরকমে হরান বাঁচাই হিয়ানে জমিজমা কিনি আছে। হোনা যায় হিয়ানে যাই মাথা গুঁইজব। পরেশ কয়, জেডি, এক কাম করেন যত দিন না অন্য কোন বন্দোবস্ত না হর, হেথাগো ঘরখান তো খালি হড়ি আছে, চম্পক না হয় হেই ঘরে থাক। কতাটা পরেশ কেবল খারাপ কয় ন। চম্পকের মনে দুঃখ হইল। শেষমেশ, জানা নাই হোনা নাই এমন বাড়িতে বাস কইরত হইব; বড় আশা ভরসা করি আইছিল কিনা। চম্পকের লগে আঁইও গেলাম। ঘর দুইখানার অবস্থা দেই চোয়ের জল আর ধরি রাইখতাম হারিয়েন না। জানলা দরজায় মাকড়সার জাল বিছাই আছে। তেলাপোকা গা’র উপরে আই আছড়াই হড়ে। টিকটিকির গু হারা ঘরে দেই শরীল ঘিনঘিন করি উডে। হায় ভগবান এমন ঘরে হেতে থাইকব কেন্নে!
হশ্নটা এইখানে নয়, নানা হশ্ন আরও মাথাচাড়া দিই উডের। চম্পক যুগীদের বাড়িতে কেন্নে থাইকব। হেতাগো আঁচার ব্যবহারের লগে চৌধুরীদের টক্কর লাইগব কতায় কতায়। কেউ মানিও লইত ন। তবুও নাই মামার চাই কানা মামা ভালা। এমন একখান জাত সংকটে যে হড়ি যাইব, কোনদিন ভাইবত হাইরছে নি। ভালারা বুলি জন্মস্থানে থাইকব বলি হেরত আইছে, দ্যাশের মাডি, আলো বাতাস গায়ে মাইখব বলি মনডা উদাস হই গেছিল, কেউ যে অন এমন করি মুখ হিরাই নিব, কে আর জাইনব। চম্পকরে আর কে খাওন দেয়। আঁই ভাত তরকারি রাঁধি দলিল মিঞারে দিই হাডাই দিই। দলিল মিঞা কয়, হেতেনে হুয়াই কাঠ হই গেছে, চোয়ে দেওন যায় না। কিছু একখান কাম করি খাইত হইব তো, বইয়াই বইয়াই কদ্দিন আর কে খাওয়াইব। চম্পক এমাথা ওমাথা ঘুরি ঘুরি বেড়ায়। শেষমেশ ঠিক হইল আঙ্গ জামাইয়ের দোয়ানে খাতা লেওনের কাজ কইরব। চম্পক ভারতে থাওনের সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরি ঘুরি ছাত্র হড়াইত; হেতের কী এই কাম পোষায়! ভাগ্যের লিখন কে আর খণ্ডাইব। যুগী হাড়ার রতন আঁঙ্গ শহরের বাড়িতে মাস মাহিনায় ঘরের কামকাজ করে। হেতে গাল গপ্পে কত কথা কয়।
হুইনছেননি জেডি চম্পকদার চালচলনের কথা। দোয়ানে যায় না, হাগলের মতো গান গাই বেড়ায়। হোলামাইয়াগুন গান হুইনবার লাই হেথেনের হিচন হিচধন ঘোরে। আঁই ভাবি এই হোলাডার হইলটা কী! একলা হই যাই মাথাটাথা খারাপ হই যায় ন তো। এত প্রশংসা হুনি হেতের গান হুইনতে গেলাম। বেডার গলায় নাকি সুর আছে। আমরা তো গান হুনি ; হেই গান হুইনতে হুইনতে রাইত হই যায়, ত্রিনাথ ঠাউরের গান – ও তিন পয়সাতে হয় তার মেলা, কলিতে ত্রিনাথের মেলা। এক পয়সার সিদ্ধি দিয়ে তিন কল্কি সাজাইয়া, গাঁজায় মারছে দোম, বো বোম্ বোম্, বোবোম্ ভোম্ ভোম্, ভোম্ ভোলা।। হেথে আবার কী গান গায়। খঞ্জনি বাজাই গান গার। হেই গানের কলি মাঠঘাট বন বাদার টপকাই চলি আই আঁর কানে বাজে –
হিন্দু আর মুসলমানে, মিলন ছিল প্রাণে প্রাণে
পরস্পর সুখে দুখে সাথী।
উৎসবে কি পালাপার্বণে, নানারকম বাদ্যগানে
আনন্দে কাটাতাম দিবারাতি।
আহাঃ কী গাইল চম্পক! হরান জুড়াই গেল। মনে হইল চুপ মারি বই থাই। হক্কলের অনুরোধে আর একখান গান ধইরল –
সময় গেলে রে ও মন সাধন হবে না।
দিন ধরিয়ে তিনের সাধন কেনে করলে না ।।
জানো না মন খালে বিলে
মীন থাকে না জল শুকালে
কি হয় তারে বাঙ্গাল দিলে
শুকনো মোহনা ।।
আঁর এইডা বুইঝতে দেরি হয় ন, কিয়ের লাই ও হিরি আইছে। মনের আগুন আর গান ছাড়া কে নিভাইব। বুঝিয়েননা মাইনষে কিয়ের লাই ছন্নছাড়া কয়। আহারে আঁর সুযোগ থাইকলে হেথেরে আঁই হিয়ানে হালাই রাইখতাম না। মানুষ মাইনষের মনই চিনল না, কেবল শরীল লই টানাটানি করে। চম্পকরে লই পশ্চিমাপন্থী মোসলমানরা ক্ষেপি যাই যা নয় তাই চার গ্ৰামে হচার করা শুরু করি দিছে – হালার বেটা হালা মালাউন, ভারতের চর, ইয়ানে আই গাঁড়ি বইছে, হেথেরে আচ্ছা করি সবক শিখাইতে হইব।
কতাগাইন হচার করার আগে হেতেরা ভুলি গেল চম্পকরে কারা বাড়ি ছাড়া কইরছে, হেতের বাড়ি কারা অন দখল করি বই আছে। হিরাই দিব নি হেতের অধিকার। কেউ দিতে হাইরত ন এর উত্তর। উল্টা থানার মাধ্যমে সরকারের কাছে খবর গেছে হেতেরে যদি গারদে না হোরে গ্ৰামের বিপদ বাইড়ব। এই বিপদে কে বাঁচাইব ওরে। আওয়ামী লীগের এক নেতা রহমত আলী আই মাথায় হাত বুলাই আশ্বাস দিল – কোনো চিন্তা করিয়েন না আমনেরা আঙ্গ দল চম্পকরে রক্ষা কইরব। ব্যাপারটা যে এত সোজা হইত ন, আঁই জাইনতাম। মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা হুকুম দিই গেছে, ‘তোরা যদি হেতেরে না তাড়াস, যুগী হাড়ার দফা রফা করি দিমু আমরা। হেগুনরে কে বুঝাইব হেথাগো সন্দেহর কোন প্রমাণ আছে নি। দোষটা হইল হেতে ওর নিজের দ্যাশে থাইকত আইছে। বুক ঢিপ ঢিপ করে বেচারার কন আই কোতল করি দিব। যুগী হাড়ার মাতব্বর স্বপন আই হুনিয়ে গেছে উল্টাসিধা কতা ।
তোর লাই আঙ্গ বিপদ হই যাইব, বাড়ি ভাঙচুর কইরব, তুই রাইতের বেলা হলাই যা। তোরে একটা উপায় কই দি, যদি হরানে বাঁইচতে চাস, তাইলে ইউসুফ মাষ্টারের বাড়ি চলি যা।
মাষ্টার হুইনছি ভালা মানুষ, হেতেনেরে আঁই কেন্নে জানিহুনি বিপদে হালাই কন চাই।
তাইলে গুলি খাই মর।
দলিল মিঞা কইল, বুইঝলাম, আমনেগো জাতের কেরামতি। হিল্লাই তো আঙ্গ জাতের মাইনষে আমনেগো ঘরছাড়া করে। কোনো একতা আছেনি আমনেদের, একটা ভালা মাইনষেরে জায়গা দিতে হারেন না, হেতারা আই ধমকাইল আর ডরাই গেলেন। আমনে আঁর বাড়ি চলেন। দেই কার বাপের কত খেমতা আছে আমনের টিকি ছোঁয়।
রাতখাইন কাইটল কোনোমতে। যাই উইঠল দলিল মিঞার ঘরে। বিপদ বলে বিপদ, আর একটা উড়া কথা আই চাউর হই গেল। চম্পকের বোইন স্বপ্নার খোঁজ হাওন গেছে। বেডি কার কাছ তুন খবর হাইছে চম্পক দ্যাশে আইছে। হের তুন হেতির মন উচাটন হই গেছে কেন্নে দাদার লগে দেয়া কইরব। মোসলমানের ঘর তুন কেন্নে কেন্নে হলাই যাই অন্য জেলায় এক হিন্দুর ঘরে আশ্রয় হাইছে। হাইলেই কী হইছে, বদনাম তো ঘোচে ন, হিচন হিচন তাড়া করি মাইরছে। মাইয়া কেন্নে কেন্নে আই আঁঙ্গ বাড়িতে আই হাজির। হিগাইন লই কত কথা। ইগাইন কিচ্ছু হইত ন যদি না চম্পক আই এই দ্যাশে উইঠত। দাদারে না দেই তো আর থাইকত হারে না। হেতের লাই বোইনের শনির দশা, রাহুর দশা এক লগে আই ঘেঁডি চাপি ধইরছে। স্বপ্নার আগের জীবন লই মুসাবিদার শেষ নাই। মা বাপ হারা এই মাইয়ারে ঘরে উডাইবার আগে প্রায়শ্চিত্ত কইরত হইব, মোছলমানের ঘরে থাইকছে। হুরোহিতের বিধান না মাইনলে সমাজে থাকা চলে না। গ্ৰামের মাইয়াদের ভেতরের কতা জাইনবার লাই কত আকুলি বিকুলি, কর্তাদের কতা আর কি কমু, হাইরলে মাইয়ার হেডের নাড়িভুঁড়ি বার করি হালায়। বেচারি এক কোনায় বই নিজের ভাগ্যের উপর দোষ দিই কপাল চাপড়ায়। ভাইবছিল এদ্দিন বাদে দাদার মুখ দেইখব, দাদারে জড়াই ধরি বেবাক জমানো দুঃখ কষ্ট জুড়াইব, দাদারই এতাগো বাড়িতে জায়গা হন অ, হেতির গায়ে তো কত গন্ধ।
স্বপ্নার জায়গা হইছে গোলা ঘরের এক কোনায়। মাইয়া মানুষ কনডাই আর যাইব এমন দোহাই হাড়ি নয়, হিন্দুর মাইয়া বেঘর হইব, কর্তারা এই চিন্তাতেও তাড়াই দিতে হারে ন। ঝিগিরি করি হেতির দিন কাটে। এদ্দিন হইল, দাদার মুখ দেয় ন। দলিল মিঞাদের ঘরের বার হইলে শাস্তির খাড়া নামি আইব, হেইডা তো আর অজানা নয়। পশ্চিমাদের লোক শকুনের মতো ঘুরি বেড়ার হিন্দুর বাড়ি বাড়ি, সুযুগ হাইলেই ঝোপ বুঝি কোপ মাইরব। বোইনের আওনের খবর চম্পকের কানেও গেছে। বোইন যে বাঁচি আছে এইকথা হইলা ওর বিশ্বাসও হয় ন। হেতির লগে বাড়ির বউঝিরা মন খুলি কথাও কয় না। খালি মনে হয় জীবনটা কি হরের খিদমত খাডিই চলি যাইব। কত কতাই হেতি আঁর কাছে কয়। স্মৃতি মনে হেথিরে কুরি কুরি খায়।
যেদিন কলমা হড়াই হেতিরে মুসলমান বানাইবার চেষ্টা কইরল, এক হোলার লগে বিয়া দিব ঠিক কইরল, হেতাগো বাড়ির এক চেনাজানা দাদাই হেইদিন মাঝরাতে লুকাই সাত আট মাইল দূরে এক হিন্দু গ্ৰামে হাডাই দিল।
আঁই মুসলমান হইনি গো, দেয়ন চাই জাতে তুইলবার লাই আমনেরা প্রায়শ্চিত্ত করাই ছাইড়লেন।
কইতে কইতে স্বপ্নার চোয়ের জলের বান আইল। আঁই কইলাম, তুই যাবি নি বৈষ্ণবদের আখড়ায়, তোর মন ভালা হই যাইব। নিতাই-গৌর রাধা-মাধবের বন্দনা হয় হিয়ানে। দেইখবি নি ক্যামন সুন্দর গুণ গুণ করি গান গাইছে, হাখিদের ডাকেও হরেক রকমের সুর, হক্কলের মনের কথা মিলিমিশি একাকার –
দেখে যা নাগরী তোরা কি রসের গৌরা।
গৌরা হাসে কাঁদে নাচে প্রেমে, মুখে বলে রা রা রা ।।
সুরধনীর কুলে কুলে, নাচে হরি হরি বলে,
যারে দেখে তারে বলে, নাম নেই রে তোরা ।।
দলিল মিঞা স্বপ্নারে সান্ত্বনা দেয়, দিদি আমনে কাঁদিয়েন না। আঁই কতা দিচ্ছি, আমনের ভাইয়ের লগে আইজ না হয় কাইল দেয়া করাইয়ুমই করাইয়ুম।
স্বপ্নার ঘোর কাডে না। দিন রাইত এক মনে হয়। কত ছায়ারা ঘুরি বেড়ায়; হেতাগো বাঁধন টপকাই যাওন এত সোজা কতা ন। চম্পক পশ্চিমাদের খপ্পরে হড়ি গেলে ওরে আর কে বাঁচাইব, হেতাগো রাজত্ব চইলছে। ভয়ে চিমসাই আছে। দুই কলি গান যে গাইব তারও জো নাই। মনের দুঃখ ক্যামনে চাপি রাইখব। দলিল মিঞার বউ রুকশানা বিবি যত্ন আত্তী করে এমন করি যাতে হর না ভাবে। রুকশানা কয়, যদি একবার লীগের মেম্বাররা জাইনত হারে, আমনে চম্পকদারে জায়গা দিছেন, আমনের মুণ্ডু চটকাইব। হুইনলাম হিন্দু হাড়াতে ঘোষণা দিছে, ‘কেউ যদি ভারতের চরেরে ঘরে থাইকত দেয়, আল্লার কসম তারে দ্যাশছাড়া করুম।’ আমনে কিন্তু হুঁশিয়ার হই থাইকবেন। হিন্দু বাড়িতে গরু গোতান সামলান, চাষবাসের কাম করেন, হেতাগো চোখা নজর আছে। অবস্থা বেগতিক দেখি আঁই হরামর্শ দিলাম, বিপদ বুইঝলে তোঁর খালাতো ভাই বুলি হরিচয় দিও।
আমনে হুদা হুদা চিন্তা কইরতেছেন, কারও আব্বার সাহস নাই আঁর সামনে দাঁড়াইব, সাচ্চা মোসলমানের বাচ্চা আঁই, বেইমান নয়। হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই। দলিলের চোখ মুয়ের ভঙ্গি দেই মনে বল হাই, ভাবি, নিজের দ্যাশ ছাড়ি কনও যাইতাম ন। মইরতে হইলে ইয়ানেই মরুম।
দলিল মিঞা কয়, দিদি হা চালাই আইয়েন, ভয় হাইয়েন না, আঁই আছি তো আমনের হাশে। আঁই স্বপ্নারে সাহস যোগাইলাম, যা স্বপ্না যা, নিজের দাদারে দেই আয়। আঁই চাই থাইয়ুম তোর লাই। স্বপ্নার চোয়ে মুয়ে আনন্দ, এক যুগ বাদে দাদারে দেইখব, বুকের মধ্যে ভয়। ভরা আঁধার, ডালে ডালে হাখিরা চুপ মারি আছে, হুইরের হাড়ে জঙ্গলের মধ্যে হিয়ালরা কোচর মোচর করে। স্বপ্না বেতাল হা চালাই চলে। জমিতে জমিতে সবুজ রঙে আঁধার ডুব দিছে। দুই মাইল পথ হার করি যাওন তো সোজা কথা নয়। জলা জঙ্গল খাল বিল আরও কত মরা রাস্তা হার করি যাইত হইব; দলিল মিঞা হত্যেক দিন এমন করি আইয়ে, এমন করি যায়, হেতের জীবনের ত্রিশটা বছর ঝড় বৃষ্টি রোদে হার করি আইছে আর আঙ্গরে দিছে বালতি বালতি গরুর দুধ আর গোলা ভরতি করি ধান। দলিল মিঞা লাফাই লাফাই চলে, চেনা হতে হাঁইটতে কত না মজা। আইজ যেন এট্টু অন্যরকম, স্বপ্নার দুঃখটা হেতে হজম করি নিছে বোধ হয়।
আয়েন দিদি আয়েন, হা চালাই আয়েন, মোটেও ভয় করিয়েন না, আঁই আছি তো। স্বপ্নার অবস্থাখান বাঁধা গরু ছাড়া হাইবার মতো। খালের জল চলাচলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হোনে। এত রাতে কারা এমন করি ভাবনারে ভাঙি চুরমার করি দেয়। থৈ থৈ জল, থকথকে হেঁক। ভেয়াল জাল হালাই টঙ্গির উপরে বই ঝিমুয়, জেলে হুঁকো টানে, এই বুঝি কেউ আইল। স্বপ্না যেন দূর গ্ৰাম তুন নাইয়ুর যার। অন্য সময় হইলে জিগাইত, ‘আইয়ে কইথুন, যাইব কোন ঠাঁই’। আইজ কোন হিসাব মিলের না। কোনটা স্বপ্নার দ্যাশ, কোনটা নয় ঠিক কইরব কে? কত জীবনের আড়ালে জীবন, কত ঘরের আড়ালে ঘর, হেই ঘরে বই চম্পক নিজের ঠিকানা খুঁজি মরে –
আমার গেল রে সব ভরসা, আর নাই আশা,
সর্বনাশা দরিয়ার পেটে।
আমার সোনার ক্ষেত ভাঙ্গিয়া করে নোনা জলের চর,
অসময়ে ভাঙল আমার অতি সাধের ঘর।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)