অমিয়ভূষণ মজুমদার
এই একটা দেশ। সব চাইতে কাছের রেলপথ পঁচিশ ক্রোশ দূর দিয়ে গেছে। বহু বহু ক্রোশ চললেও কৃষকের দেশ শেষ হয় না। মকাই-জোয়ারের দেশ। বৃত্তের পরিধির মতো পাহাড় এবং শাল-মহুয়ার বন। সেই পাহাড় এবং অরণ্য যদি পায়ে হেঁটে পার হও তবে সভ্যতার প্রান্তগুলি চোখে পড়তে পারে।
সেই দেশে ভুখন কৃষকের জমিতে মজুরের কাজ করে, ভইসা টহলআয়।
ভুখন একা নয়, তার সঙ্গে দুলারহিনও থাকে। ভুখন আর দুলারহিন নিজেদের ভাইবোন ব’লে ভাবতে শিখেছে। ওরা সহোদর নয়। ভুখনের মায়ের মৃত্যুর পরে ভুখনের বাবা সর্বস্বান্ত হ’য়ে যাকে ঘরে এনেছিলো তারই ওপক্ষের মেয়ে কিংবা বেটা-বউ দুলারহিন।
দুলারহিন যখন এই কুড়েঁটিতে প্রথম তখন ভুখনের বয়স ছ’বছর, দুলারহিনের নিজের আট/দশ হবে। দুলারহিন ভুখনের বাবা ও তার সৎমাকে ভুখনের মতোই বাবা-মা বলতো। ভুখনের যখন আট বছর এবং দুলারহিনের বছর বারো প্রায় একদিনেই এই কুঁড়ের বাপ-মা প্রাণী দুটি বিদায় নিলো। এখন এমন কেউ নেই যে ওদের সম্বন্ধের জট খুলে দিতে পারে।
ভুখনের বয়স এখন একুশ বাইশ হ’লো, দুলারহিনের আরও দু’বছর বেশি। প্রায় পনেরো বছর গড়িয়ে গেছে ওদের জীবনের। যাদের সম্বন্ধ নিয়ে এত খুঁটিনাটি তাদের জীবনের পনেরোটা বছর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কি মুক্তি? বিশ্বাস করো, এ সময়ের মধ্যে কিছু ঘটেনি।
ভুখনের চেহারা নিম্ন প্রকারের : তামা ও ছাই রঙে মিশানো একটা রঙের ত্বক। স্ফীতপেশী দেহ, মস্ত বড়ো মুখে ছোট একটা নাক। মাথার চুলগুলি ধুলোয় কটা, আর সেই খোঁচা খোঁচা ছোট ছোট চুলের মাঝখানে প্রকাণ্ড এক গোছা কড়কড়ে টিকি। পরনে দেড় হাত চওড়া কাপড়ের ফালি কতকটা পালোয়ানী ঢঙে পরা।
দুলারহিনের স্বাস্থ্য ভালো। বয়সের চাপে ত্বক যেন ফেটে যাবে। তার মুখাবয়বেও শাস্ত্রোক্ত সৌন্দর্য আছে বলা যায় না। গত পনেরো বছরের একটি মাত্র ঘটনা-তার বসন্ত হয়েছিলো। দাগ রেখে গেছে। তার ফলে ফুটকিতে আচ্ছন্ন তার মুখ বেলে পাথরের বহু পুরাতন প্রতিমূর্তির মতো।
ওদের সংসার মন্দ চলছিলো না। সংসারে লোক বাড়বে এমন সম্ভাবনা চোখে পড়ে না। ভুখন বিয়ে করতে পারছে না, অন্তত তিন কুড়ি টাকা লাগবে যে কোন রকম একটা বিয়ে করতে, তার কমে কি মেয়ে ছাড়ে কিংবা বোন। সদ্ভাবেই দিন যাচ্ছিলো।
এমন নয় যে ঝগড়া হয় না, হয়, ইতিমধ্যেই একদিন হ’য়ে গেলো। একই কুঁড়ের মেঝেতে খেজুর পাতার দু’খানা চাটাই পেতে শোওয়া। বাপ-মা চ’লে যাওয়ার পরে ভুখন বহুকাল দুলারহিনের বক্ষলগ্ন হ’য়ে ঘুমিয়েছে, ইদানীং ছোট জায়গায় শুতে ভুখনের অসুবিধা হ’তো, অতবড় হাত পাগুলোকে দুমড়ে ছোট ক’রে সে এখন ঘুমোতে পারে না। কিন্তু এক রাত্রিতে সে খুব বেকায়দায় প’ড়ে গেলো। চাল ফুটো করা, বর্ষায় তার অংশের মেঝেটুকু কাদা হ’য়ে আছে। সে ভাবলো দু’একরাত তার মস্ত শরীরটাকে গুটিয়ে কোন প্রকারে দুলারহিনের পাশেই কাটিয়ে দেবে, কিন্তু আপত্তি তুললো দুলারহিন, নেহিন। – দেখ, দুলারী, দুলারি করো না। এমন অবস্থা নয় আমার একদিনে চালটা সারিয়ে নেবো। দু’ একদিনই তো অসুবিধা হবে আমার, সে কিছু নয়।
দুলারহিন ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কুঁড়ের শুকনো জায়গাটায় ভুখনের চাটাই পেতে দিয়ে ঘরের ঝাঁপ তুলে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। রাগে ভুখনের ঘাড়ের শিরাগুলি অবধি ফুলে উঠলো। লাফিয়ে গিয়ে দুলারহিনের কাঁধ দুটো তার দুই থাবা দিয়ে চেপে ধরলো। দুলারহিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললো, ছোড়দে, বহিনকো ছোড়দে। কি আশ্চর্য! বহিন ব’লেই না ভুখনের এত রাগ – অভিমান। এই বাদলা রাতে বাইরে থাকা কত কষ্টের তা বোঝে ব’লেই না এত পীড়াপীড়ি করা। বেটাছেলে বাড়ির মালিক ভুখনের দায়িত্বজ্ঞানকে অপমান করা দুলহারহিনের উচিত নয় অন্য বিষয়ে সে যত ছেলেমানুষি করতে চায় করুক।
– যা ইচ্ছা হয় কর, শুধু কাঁদিস না।
হাল ছেড়ে ভুখন শুয়ে পড়লো।
কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে চলে বেটাছেলের। কাঁচা কাঁচাই হোক, আহারের সংস্থান না করেও কাঁচা কাশ কেটে বোঝা বোঝা মাথায় ব’য়ে এনে স্তূপাকার ক’রে ফেললো ভুখন কুঁড়ের সামনে। তারপর সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা, অনেক রাত অবধি অস্পষ্ট আলোয় ব’সে নতুন করে চাল ছাইলো ভুখন।
দুলারহিন একদিন বললো, ঘর ছেয়েছিস, এবার সাদি কর।
– তাহ’লে তুইও একটা কাস্তে নিয়ে চল।
– কাস্তে দিয়ে আবার কি হবে?
– কেন দু’জনে মেলা মেলা ঘাস কাটবো।
– ঘাস কাটবি কেন? আমি তো তোকে সাদি করতে বললাম।
– আমি ভাবলাম ও দুটো একই কাজ।
কিন্তু সহজে ভুলবার মেয়ে নয় দুলারহিন। যখন তখন একই কথা বলতে লাগলো। অবশেষে একদিন বললো, পৃথিবীতে চাঁদ আর সুরয ছাড়া আর কে আছে তাদের ? বাপ-মা কোথায় গেলো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই-বেলায় ভুখন যদি বিয়ে করে, কম দামে মেয়ে পাবে, বুড়ো হ’লে বুড়ি ছাড়া আর যা পাবে তার জন্য চড়া দাম দিতে হবে না ? আর সব কথার উপরে বড়ো কথা : একজনের মৃত্যুর পরে আর একজনের কি উপায় হবে যদি ইতিমধ্যে তৃতীয় একজন এসে আপন না হয়ে যায় ?
মুখ গম্ভীর ক’রে বুড়োদের মতো চিন্তাক্লিষ্ট মুখ ক’রে ভুখন শুনলো সব যুক্তি, তারপর বললো, টাকা যদি যোগাড় হয় সাদি করবো, কিন্তু বউ যদি তোর সঙ্গে মারামারি করে তবে আমি কিন্তু দু’জনকেই পিটবো ।
টাকা জমানোর চেষ্টায় মানুষ কি না করে ? এমনকি হঠাৎ মানুষ নিজের একটা বিশেষ গুণও আবিষ্কার করতে পারে। এইরকম ভাবে ভুখন কাঠের পুতুল গড়ায় মন দিলো।
ওস্তাদের বাড়িটা ছিলো ভুখনের ঘরের কাছেই। ভুখন মাঝে মাঝে শীতকালে আগুনের কাছে বসতে তার বাড়িতে যেতো। ব’সে ব’সে দেখতে দেখতে ভুখন একটা পুতুল একদিন বানিয়ে ফেলেছিলো। কাঠের এক চিড়িয়া। টাকা জমানোর কথায় ভুখনের মনে হ’লো পুতুল তৈরির কথা। মাথা ঝাঁকিয়ে সে মনঃস্থির ক’রে ফেললো। ওস্তাদ যেসব বড় বড় পুতুল তৈরি করে সেই সব চিড়িয়া, জানোয়ার, আদমি-জনানা সে সে ছোট ছোট ক’রে তৈরি করবে। বিক্রির ভার ওস্তাদের।
– আর শোন, দুলারহিন, এ পয়সা দিয়ে খাওয়া চলবে না। খাওয়ার জন্য সকাল-সাঁঝ খেতির কাজে যা হয় তাই।
পুতুল বিক্রির খুচরো পয়সাগুলি রোজ সন্ধ্যায় গুণতে বসে দুজনে। একদিন থাক থাক ক’রে সাজিয়ে রেখে ভুখন এমন চিৎকার ক’রে উঠলো যে দুলারহিন ভয়ে বাঁচে না। ছুটে কাছে এসে ভুখন বললো, ষোড় বৌ, কুড়িসে চার কম, স্রিপ চার।
ওদের জীবন ঠিক এরকম সময়ে একটা মোড় নিলো। সন্ধ্যায় ব’সে কথা হচ্ছিলো। ভুখন বললো, যব কত শশুরা লোহার বআক্সআ একটা না দেবে, ততক্ষণ কোনো শশুরাকে পুতই খিচুড়ি খাবে না। অর্থাৎ বিবাহ-ব্যাপারটা সমাধা হ’তে সে দেবে না।
অযুক্তির কথা নয়, ভাবলো দুলারহিন, হয়তো সেই রূপকথার কনোয়ারের মতো ভুখনের ভাগ্য নয়, হয়তো কোন মেয়ের বাপ মেয়ে আর টাকা নিয়ে সাধাসাধি করবে না, যেমন সেই রূপকথার নায়কের বেলায় ঘটেছিলো, তার হ’লেও ভুখনের পক্ষে একটা লোহার রংদার বাক্স চাওয়া অন্যায় নয়। তবু বিয়ের ব্যাপারে একটু হাসি-ঠাট্টা করতে হয়, দুলারহিন বললো, তুইতো ভেরুয়া হ’য়ে যাবি, টাকা দিয়ে বউ আনবি, আর ফির হঁ, হঁ, সে দেখা যাবে। তারই খিদমৎ করবি। সেই রাত্রিতেই কিংবা তার দু’এক দিন বাদে জ্বর হলো দুলারহিনের। অল্প অল্প জ্বর প্রথমে, সেই জ্বর দিনকে দিন বাড়তে লাগলো। একদিন সারারাত দুলারহিন বেহুঁশ। সেদিন সকালে ওস্তাদের কাছে ভুখন শুনে এসেছে তাদের গ্রাম থেকে চার-পাঁচখানা গ্রাম পার হ’য়ে গেলে যে বড়ো গ্রাম সেখানে এক ওস্তাদ-ডাংদার আছে সে নাকি সব জ্বর ভালো করতে পারে। তার মনে হ’লো কি অন্যায়ই সে করেছে এতদিনেও ডাংদার না এসে। ডাংদার কথাটাই সে জানতো না – নিজেকে প্রবোধ দেবার মতো এ যুক্তিও তার মনে এলো না। দুলারহিনের পায়ের কাছে ব’সে কাঁদতে কাঁদতে তার বার বার মনে হ’তে লাগলো বিশঠো রূপয়া যার ঘরে তার দুলারহিন নাকি এমনি ক’রে মরে।
ভোর ভোর রাতে ভুখন উঠে দাঁড়ালো, দুলারহিনের অজ্ঞান দেহের দিকে হাত বাড়িয়ে সে বললো, দেখ, দুলারী, দুলারী করিস না। ডাংদার আনতে চললো তোর ভুখনোয়া; যদি ফাঁকি দিয়ে ম’রে যাস –
চোখের জল মুছতে মুছতে ডাংদারের গ্রামের দিকে ছুটতে লাগলো ভুখন। ডাংদার এসেছিলো। বিশঠো রূপয়াতো গেছেই, আর বিশঠো তার কাছে ধার হয়েছে। সে ধার আবার বছরে পান রূপয়া ক’রে বাড়বে ; অর্থাৎ ভুখন সেই পুরনো জালে জড়িয়ে পড়লো। তা হোক দুলারহিন তো বেঁচে আছে।
আগের মতোই তারা সংসার করতে শুরু করলো। মাঝের কয়েকটা দিন যেন স্বপ্ন। একটা নতুন আসার উত্তুঙ্গতা থেকে আছড়ে পড়ার ব্যাপারই যেন কতকটা।
কিন্তু অদ্ভুত মেয়ে দুলারহিন। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবার একদিন সে বললো, তুই তো আর পুতুল বানাস না ?
– কি হবে ?
– সাদি করবি না ?
– ডাংদারের সঙ্গে সাদি করলাম যে।
দুলারহিন লজ্জিত হ’য়ে মুখ নামিয়ে নিলো।
আবার চেষ্টা করার কথা ভাবতে গিয়ে ভুখনের যে অনুভবটা হ’লো সেটা এই : ছ’মাসের যত্নে যে বিশ টাকা জমে সেটা বিশ টাকা নয়, ছ’মাসের ঘর্মাক্ত শ্রমও বটে।
আর সেই ঘর্মাক্ত শ্রমকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কোনো বুদ্ধিমানই করে না।
তার উপরে এলো সেই ডাংদার যাকে রোগী দেখতে আনতে গিয়ে ভুখনকে পায়ে লুটিয়ে প’ড়ে সাধ্যসাধনা করতে হয়েছিল। সে এলো না ডাকতে।
– ভুখন, আছো, ভুখন ?
– হ্যাঁ, সব ভালো আছি আমরা, দুলারহিন তো দিনকে দিন মোটা হ’চ্ছে।
একটি নিটোল হাসি ফুটলো ভুখনের মুখে।
– বেশ, তার হ’লে সুদের টাকা ক’টা দাও। কোথায় পাবে? সে কি আমি ব’লে দেব ? টাকা যতক্ষণ না দিচ্ছ আমি নড়ছি না। সহর চেন, সহর ? সেখানে থাকে পুলিস, তাদের ডেকে পাঠাবো। ঘরে দু’চার পয়সা যা ছিলো এনে দিল ভুখন । সব শুনে দুলারহিন চুপ ক’রে রইলো।
ছ’মাস পরে ডাংদার এলো। আড়াই টাকা পাওনা হয়েছে, দিতে হবে।
– আড়াই পয়সা নেই।
– দেখো ভুখন, ধার বাড়িও না, বাড়তে বাড়তে ধার এমন হয় যে কোনদিনই ও আর শোধ দেওয়া যায় না। বেশ, আড়াই টাকা যখন দেবে না তখন আমার বিশ টাকা দিয়ে দাও, আর তার সঙ্গে ওই আড়াই টাকা।
– কি হবে যদি আমি না দি ?
– যদি তুমি না দাও? (ডাংদার কথাটা উচ্চারণ করলো যেন আর একবার কানে শুনে অর্থটা পরিষ্কার করার জন্য।) বেশ যদি তুমি না দাও, ভগবান আছে মাথার উপরে। টাকা দেবে ব’লেই, ওষুধের দাম তো, তোমার দুলারহিনকে ভালো করেছে ভগবান, টাকা যদি না দাও তা হ’লে।…
– হেই ডাক্তার, খারাপ বোল না। টাকা আমি দেবো, তুমি কিছু বোল না।
ঝাঁপের আড়াল থেকে সব শুনছিলো দুলারহিন।
ভুখন ঘরে ঢুকতেই সে বললো, ডাংদারকে তুই আর টাকা দিবি না।
– টাকা দেবো না তো তোর যদি আবার অসুখ হয়।
– টাকা তুই খরচা করতে পারবি না।
– টাকা আমার, যা ইচ্ছে আমি করবো।
– কেন করবি? আমি তোর কে? তোর আপনার বহিন যে আমার জন্য টাকা বরবাদ করবি?
– কি বললি?
– না, একশ’বার না। তোর সৎমায়ের বেটা-বউ আমি।
– আমার কেউ না ?
– না, না।
ভুখন কথা বললো না, ঘর ছেড়ে চ’লে গেলো।
কিন্তু ঝগড়া করার জন্য হ’লেও মুখোমুখি হ’তে হ’লো তাদের। অবশেষে পুরুষালি প্রীতির চোখ-রাঙানির কাছে দুলারহিনের মেয়েলি স্নেহ হার মেনে স্বীকার করলো, আর সে নিজের অসুখের কথা বলবে না, আর কখনও আত্মীয়তা অস্বীকার করবে না তবে সে রাত্রিতে ভুখন রোটি খেলো।
খুব ভালো জোড়া লাগলেও কখনও কখনও একটা অস্পষ্ট দাগ থেকে যায় – দুলারহিনের কথাটাও সেই দাগ।
দুলারহিনের স্নেহ বাইরে হার মেনে গভীর হওয়ার অবকাশ পেয়েছে। সেই গভীর স্নেহ তার মাথায় বুদ্ধি এনে দিলো। সে স্থির করলো নিজে আগে সাদি ক’রে সেই টাকা দিয়ে ভুখনের সাদি দেবে। নিজে সাদি ক’রে টাকা পাওয়া সহজ নয় যদি এপক্ষ থেকে কোন যোয়ান বেটাছেলে দাম না চড়ায়। এদিকে ভুখনের বুদ্ধি যদি না খেলে দুলারহিন নিজেই তাকে বুদ্ধি দেবে। অবশ্য যোয়ান কোনো বর হবে না তার, মুখে যেরকম দাগ ; আর তাদের কেউ রাজি হ’লেও গরজ দেখাবে না টাকা দিয়ে। কয়েকদিন নিজের মনে কথাটা তোলপাড় ক’রে একদিন দুলারহিন সেটাকে প্রকাশ করলো।
ভুখন শুনে হো হো করে হেসে উঠলো, তোর সাদির ইচ্ছা তাই বল।
– না হয় তাই হ’লো। তুই তা হ’লে আগে আমার ইচ্ছা মিটিয়ে দে। ডাংদারের টাকা, তুই সেই টাকা শোধ কর। তারপরও যে টাকা থাকবে সেগুলো গেঁথে আমারই না হয় হার বানিয়ে দিস।
দিন যেমন যায় তেমনি যায় ভুখনের চাড় নেই। তার উপরে নতুন একটা উপসর্গ জুটেছে পয়সা পেলেই দুলারহিনের জমাতে ইচ্ছা করে আর ভুখনের খরচা করতে। এরই মধ্যে একদিন ওস্তাদকে দিয়ে একজোড়া কাপড় আনিয়ে নিয়েছে ভুখন। শুধু কি তাই, নিজের খানা ছুপিয়েছে হলুদ রঙে আর দুলারহিনের খানা পাতলা লালে। সারাদিন সে খেতির কাজ ক’রে মাঝ রাত অবধি ব’সে ব’সে কেরোসিনের কুপির আলোয় পুতুল খোদাই করে, তার সখকে কিছু বলা যায় না। দুলারহিনকে তাই চুপ ক’রে থাকতে হয়।
কিন্তু চুপ করে কতোই-বা থাকা যায়।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় ভুখন ঘরে ঢুকে বললো, দেখি, এদিকে আয় তো, আরও কাছে আয়।
দুলারহিন ভেবে অন্ত পায় না। হাত জোড় করে সে, প্রায় যেন আড়ষ্ট হ’য়ে যায়।
ভুখনই এগিয়ে এলো।
– আরে ছাড় ছাড়, হাত জোর ক’রে মিনতি করতে লাগল দুলারহিন, ততক্ষণে কাসার মল জোড়া দুলারহিনের পায়ে পরিয়ে দিয়েছে ভুখন।
– এ তুই করলি কেন ?
– হামার হিচ্ছা।
প্রতিদান না দিয়ে কি ক’রে থাকা যায় বলো। একদিন সকালে দুলারহিন একটা অচিন্তনীয় কাজ করে ফেললো। লাল শাড়িখানা প’রে পায়ে কাঁসার মল দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরুলো সে ভুখন যখন ভইসা টহলাতে গেছে। আর ফিরবে না দুলারহিন, যতদিন না টাকা আনতে পারে সে। যেখানে যত স্বজাতীয় আছে ডেকে ডেকে সকলকে জিজ্ঞাসা করবে তারা কেউ বিয়ে করতে চায় কিনা তাকে। যদি কেউ বলে : বিয়ে করবো, অমনি সে বললে, কত টাকা দেবে ? যদি বলে পাঁচশ’, অমনি সে বলবে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলো, অত কমে হবে না।
নিজের গ্রাম ছাড়তে ছাড়তে সূর্য প্রখর হ’য়ে উঠেছিলো, তবু দুলারহিন তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলেছে, এখনও ভিনগ্রামের স্বজাতীয়দের সঙ্গে দেখা হয়নি। সাহস খানিকটা যেন ইতিমধ্যে কমে এসেছে। দুপুর নাগাদ ভিনগ্রামের স্বজাতীয় বস্তিতে পৌঁছালো সে। এইবার তাকে বিক্রি শুরু করতে হবে। প্রথমে দেখা হ’লো একজন বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে, জল তুলছিলো সে চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। দুলারহিন কুয়োর পাশে গিয়ে আঁজলা পেতে দাঁড়াতেই সে জল খেতে দিলো। তারপরে প্রশ্ন করলো, কোন জাত কোথায় ঘর। দুলারহিন পরিচয় দিলো।
– একা একা কোথায় যাচ্ছো ?
দুলারহিন এদিক-ওদিক চেয়ে নিচু গলায় নিজের উদ্দেশ্য ব’লে বললো, সাহায্য করতে পারো বহিন ?
বউটি হেসে বাঁচে না। একা একা কত আর হাসা যায়, একসময় থামতে হ’লো তাকে। তখন সে বললো, তুমি খুব বোকা বহিন, আমি হ’লে ঘরের বাইরে যেতাম না ; দুজনেরই সাদি দরকার, কি করতাম বলো তো?
দুলারিন উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়ালো ভালো ফিকিরটা শোনার জন্যে, বউটি হেসে হেসে চোখ ছোট-বড়ো ক’রে বললো।
দুলারিন কাঁদো কাঁদো মুখে তার দিকে একবার চেয়ে হাঁটতে শুরু করলো। মনে মনে সেই স্থির করলো, কোন মেয়ের কাছে সে নিজের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করবে না। ছিঃ ছিঃ মেয়েছেলের জিভে হুল আছে।
গ্রাম ছাড়তে দুপুর শেষ হ’লো। শরীরের সঙ্গে মনও ক্লান্ত হয়েছে। ক্লান্ত মনে সে ভাবলো : এত যে সে করছে, সব কি মিছে নয় ? ভুখন তো একবারও জোর ক’রে বলেনি সে সাদি করতে চায়। কিন্তু আর একখানা গ্রাম এসে পড়েছে সামনে, এমন সময় আবার সাহস ফিরে এলো। না হয় নাই বলেছে সে, তাই ব’লে কি তার ইচ্ছা পূরণ করতে হবে না ? আর না বলার কথা বলছো ? বলে না ব’লেই তার সাধ মেটাতে আরো সাধ যায়।
সামনের বড় বড় কাশির ঝোপে ভরা মাঠখানি পার হ’লে আর একখানি ভিনগ্রাম। আলো মুছে যাওয়ার আগেই এই গ্রামে পৌঁছে একটা নিষ্পত্তি করতে হবে। এখনই আলোর রং প্রায় বাদামি হ’য়ে উঠেছে। এই ভাবতে ভাবতে জোরে জোরে কয়েক পা যেতে না যেতেই পিছন থেকে কে বললো, কে যায় ? দুলারহিন ফিরে দাঁড়ালো।
– কোথায় যাচ্ছো একা ?
লোকটি এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়ালো।
– বাড়ি থেকে রাগ ক’রে এসেছো নাকি, বাপ-ভাই বিয়ে দেয় না ব’লে ?
– না, নিজেই আমি বিয়ে করতে বেরিয়েছি।
– সাবাস। আমার সঙ্গে করবে ?
– আমি টাকা চাই, অন্তত চার কুড়ি তো বটেই। ভাইকে টাকা দেবো আমি।
– চার কুড়ি? বেশ তাই হবে। আমার সঙ্গে বিয়ের পরেও ভাইকে টাকা দিতে ইচ্ছা হয়, দেখা যাবে।
– না টাকাটাই আগে দিতে হবে।
– ও, খুব দাম বাড়াতে পারো যা হোক। আগে দেখি কত দাম হ’তে পারে।
এই ব’লে দুলারহিনের আঁচলের একপ্রান্তে চেপে ধরলো লোকটি।
কিছুক্ষণ থেকেই দুলাহিনের মাথায় একটা কষ্ট হচ্ছিলো। একটা গোটা দিনের রোদ গেছে মাথার উপর দিয়ে। তবুও জেদ ক’রে লোকটির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার চোখের পিছনে ক্লান্ত মস্তিষ্কের যে ধোঁয়াটে ছাপটা পড়েছিলো তার চাহনিতে সেটাই বিবশ তন্ময়তায় মিথ্যারূপ নিয়েছিলো। বোধহয়, সেটাই লোকটির এত আকর্ষণ। কিন্তু কাঁধের কাছে আঁচলটায় টান পড়তেই দুলারহিনের পা দু’খানাও বিবশ হ’লো। সে লোকটির গায়ের উপরে প’ড়ে গেলো, আর সেখান থেকে মাটিতে। তখন তার কষ বেয়ে ফেনাও গড়াতে লাগলো।
যখন ঘুম ভাঙলো দুলারহিনের, সম্বিত ফেরার সময়ে তাই মনে হ’লো তার, তখন মাঝরাত। চারিদিকে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। লোকটির কথা মনে পড়তেই সে শিউরে উঠে স’রে বসলো। কিন্তু লোকজন দূরের কথা, ধারে কাছে বোধহয় পোকামাকড়ও নেই। নতুবা ঝিঁ ঝিঁটা অন্তত ডাকতো। আর বহুদূর থেকে কিসের একটা অদ্ভুত অর্থহীন শব্দহীন শব্দ আসছে। ভয়ে দুলারহিনের নিঃশ্বাস বড় বড় হ’য়ে পড়তে পড়তে সেটা অবশেষে চাপা কান্নায় পরিণত হ’লো। কাঁদতে কাঁদতে মনে হ’লো যেদিন বাপ-মা চ’লে যায় সেদিনও এমনি কেঁদেছিল সে, কিন্তু তখন শক্ত পৃথিবীর বদলে বুকের কাছে যে দৃঢ়তা অনুভব করেছিল সেটা প্রায় শিশু ভুখনের ধূলিমলিন মুখখানা। নিঃশেষে শূন্য বুকে বোধহয় বেশিক্ষণ কাঁদাও যায় না। সেই ভুখনের মঙ্গলের জন্যই আজ সে পথে বেরিয়েছে।
চাঁদ উঠলো। সেই আলোতে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ মেলে দুলারহিন দেখলো সে কাশবনের মধ্যেই প’ড়ে আছে। লম্বা লম্বা ছায়া সজীব হ’য়ে দুলছে চারদিকে। রাত্রির শব্দহীন ভাষা এবার প্রত্যক্ষ হ’য়ে উঠলো। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল যেন।
হুরার?
কিন্তু দুলারহিন ভয় পাবে না। ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে তবু চোখের জল মুছে সে সোজাসুজি দেখতে চেষ্টা করলো। যদি হুরারই হয় হোক। বাধা দেবে না, পালাবে না, সর্বাঙ্গ আঁচল দিয়ে ঢেকে গলাটা বাড়িয়ে দেবে। হুরারদের তো আঁচলের উপরে লোভ নেই। যদি খুবলে খুবলে খায়ও ততক্ষণে দেহের দুর্গতি দেখার জন্য প্রাণ থাকবে না। গলাটা সব প্রাণীরই সবচাইতে দুর্বল অংশ শরীরের। হঠাৎ ভুখনোয়ার কথাটা যেন মনে পড়ছে। আর একবার তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হ’তো। আর রান্না ক’রে রেখে আসেনি সে। খেতির কাজ ক’রে ফিরলে বড় ক্ষুধা পায় বেটাছেলেদের। তখন মুখের সামনে খাবার না পেলে রাগই হয় পুরুষদের। কিন্তু তারপর সে হয়তো দুলারহিনকে খুঁজতে এ পথেই আসবে। হয়তো এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। আর যেমন লোক, হয়তো সঙ্গে একটা লাঠি পর্যন্ত আনেনি। আর দেখো তেমনি ভয় এদিকে হুরারের। এই দুশমনের ব্যূহে নিরস্ত্র ভুখন । চোখের জলে মজ্জিত হ’য়ে আবার সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। হা ভগবান, হা ভগবান, সে নিজেই তো ভুখনের মৃত্যুর কারণ।
ভুখন ঘরে ফিরে প্রথমে ভাবলো দুলারহিন অবেলায় জল আনতে গিয়েছে। রাগ হ’তে লাগলো তার প্রতীক্ষার সময় যত দীর্ঘ হ’লো। সন্ধ্যা যখন গড়িয়ে গেলো তখন সে কুঁড়ের ভিতরে দুম দুম ক’রে পা ফেলে বেড়াতে লাগলো।
রাত যখন প্রথম প্রহর, তখন সে ভাবলো : ঠিক তাই হয়েছে, ও গিয়েছে নিজের সাদি ঠিক করতে। কেন বাপু, আমি কি বলেছিলাম ডাংদারের টাকা আমি শোধ করতে পারবো না। তুমি শোধ করো সাদি করে? না-খেয়ে আছি তা যদি দেখতে না এলে, তবে তোমার টাকা নিয়ে এসো দেখব মাথা কোথায় রাখো।
কিছুক্ষণ পরে নিজের মাদুরখানা ঝেড়েঝুড়ে ঠিক ক’রে নিয়ে শুতে গিয়ে সে ভাবলো : আসলে ওসব কিছুই নয়, তোমার নিজেই সাদি করার ইচ্ছা, একা- একা ভালো লাগছিলো না আর। আমি তোমাকে কখনো বলেছি, দুলারহিন আমি বউ চাই। মনে হবে না কেন, সব পুরুষের মনেই হয়। তাকে জলের ধারে দেখে আমিও এগিয়ে জলের ধারে দাঁড়িয়েছিলাম। সেও হেসে, রাগ ক’রে কথা বলেছিলো। কিন্তু আমি তো জানি বাপ-ভাইয়ে মিলে তার ছ’জন আছে, দু’কুড়ি টাকার কমে তারা রাজী হবে না। আমি হাত জোড় ক’রে বলেছিলাম – মাপ্ কাঁদিয়ে। কিন্তু তার কথা তোমাকে বলেছি? বেশ তো গিয়েছি, তোমার ভালো হোক। প্রায় মাঝরাতে অনিদ্রিত ভুখন ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে চমকে উঠলো। সেই নীরব রাত্রির রহস্যময়ী ভাষা। চকিতে সে উঠে দাঁড়ালো। দুলারহিন যদি অন্ধকারে আশ্রয় না পেয়ে থাকে।
আর কিছু ভাববার সময় পেলো না ভুখন। দরজার ঝাঁপ ভেঙে কোনো ক্রমে রাস্তায় প’ড়ে অন্ধকারে ছুটতে লাগলো সে, দু-লা-র-হি-ন।
দুজনের দেখা হ’লো সংযোগ হারানোর দ্বিতীয় দিনের দুপুরবেলায়। দুলারহিন তখন ক্লান্ত দেহে তার চাইতেও ক্লান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরবার পথ ধরেছে। চোখমুখ ব’সে গেছে, তামাটে চুলগুলি উড়ছে বাতাসে।
দুলারহিন বললে, তুই এলি কেন আবার আমিই তো ঘরে যাচ্ছিলাম।
ভুখনের মুখে দু’হাজার দাঁত হো হো ক’রে হেসে উঠলো, এলাম এমনি।
সামনে একটা খাল, নদীর মতো তাতে স্রোত। সেটাকে পাশে ক’রে কিছুদূর গেলে একটা গ্রাম। যখন ধুলো উড়ছে না তখন সেখানে একটা গোয়ালার দোকান চোখে পড়ছে। ওখানে যা হোক কিছু খাবার পাওয়া যেতে পারে।
ভুখন বলল তুই স্নান করে নে চেহারা খুব খারাপ দেখাচ্ছে দুলারীনেরও খুব ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু ইতস্তত করতে হলো তাকে।
ভূখন্ড বললো, এক ক্রোশের মধ্যে কোন লোক নেই।
তীরে শাড়ি দেখে তখন দুলারহিন জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানকৌড়ির মতো।
– বাস্ । আর গেলে ডুবে যাবি।
ডুবে যাওয়ার ভঙ্গিতেই তবু আর একটু সাঁতার কেটে, ভুখনকে ভয় দেখিয়ে তারপর দুলারহিন উঠলো। তীরে দাঁড়িয়ে দু’হাত জড়ো করে চুলের জল ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে সে ভুখনকে স্নান করতে পাঠালো। স্নান শেষে তীরে উঠে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দুলারহিন বললো, যদি ডুবে যেতাম।
–আমিও ডুবে মরতাম।
দুলারহিন হাত বাড়িয়ে ভুকনের একখানা হাত জড়িয়ে ধ’রে হাঁটতে লাগলো। গাঁয়ের দোকানে তারা ভইসা দহি পেলো আর মকাইয়ের খৈ।
একটি গাছতলায় ব’সে যত না খাওয়া তার চাইতে বেশি কোলাহল ক’রে তারা আহারপর্ব সমাধা করলো।
গাছতলায় হাত পা ছড়িয়ে বসে ভুকন প্রশ্ন করলো – দুলারী, আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবি না, বল।
– না।
রোদের ঝাঁজ ক’মে এলো। ঝিরঝিরি হাওয়ায় পথ চলতে শুরু করলো তারা। এত হালকা মন তারা বহুদিন অনুভব করেনি। ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই, যেন সখ করে দু’জনে বেড়াতে বেরিয়েছে। কয়েক পা গিয়ে ভুখন বললো, দুলারী, এখন যদি কোন মহুয়াই-এর দোকান পেতাম —
– তুই তো নেশা করিস না,তবে ও কথা বলছিস কেন?
– কিছুতেই যেন ঠিক ফুর্তিটা হচ্ছে না।
নিজেদের গ্রামে পৌঁছানোর আগে সন্ধ্যার আগেকার বাদামী আলোয় কাশের বড়ো বড়ো ঝোপে ভরা মাঠটিতে তারা এসে পৌঁছালো। দিনের বেলায় ভইসা থাকে, ভইসা নিয়ে রাখালরা এখন ফিরে গেছে। ছোটবেলায় যখন দুলারহিন ভইসা তাড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ পারত না, তখন এখানে একটা ভারি মজার ব্যাপার হ’তো। ভুখন যখন ডাকতো তাকে, সে লুকিয়ে বেড়াতো এক ঝোপের আড়াল থেকে অন্য ঝোপে আড়ালে। আর মাঝে মাঝে কুই করে সাড়া দিতো।
মাঠটা পার হ’তে হ’তে ঝিকমিকিয়ে হেসে দুলারহিন বললো, আমি যদি এখানে লুকিয়ে থাকি খুঁজে বার করতে পারিস ?
– না, পারি না। এখনো তেমনি ছোট আছি, হাঁটতে হোঁচট খাবো।
দুলারহিন কয়েক পা আগে চলছিলো, হঠাৎ ধাঁ করে সে লুকিয়ে পড়লো। ভুখন মনে মনে হাসলো ছোটবেলায় খেলতাম, এই মনে করলেই কি আর তেমন খেলা হয়। এখন সে হাত বাড়ালেই ঝোপের এপার থেকে ওপারের ঘাস সরিয়ে দুলারহিনকে দেখতে পাবে। কিন্তু দুলারহিন ভারি সুন্দর লুকাতে পারে। আর তার পায়ের গোড়ালি যেন ধনুকের ছিলায় তৈরি। একটি ঝোপের আড়ালে তার সাড়া পেয়ে তার কাছে গিয়ে দেখলো ভুখন সে ততক্ষণে অন্য আরেকটির কাছে স’রে গেছে। তার শাড়ির একটুখানি দেখা যাচ্ছে। সেখানে যেতে দুলারহিন উধাও। দু তিনবারের চেষ্টায় একবার ভুখন দুলারহিনকে ছুঁতে পারলো।
– নে এবার চল।
ভুখন ভেবেছিলো খেলা শেষ হয়েছে, কিন্তু দুলারহিন আবার অদৃশ্য হয়ে গেল হাসতে হাসতে।
খেলাটা বাল্যের মতো দুর্দম হ’য়ে উঠেছিলো।
ইতিমধ্যে একবার দুলারহিনকে সে দু’হাতে চেপে ধরেছিলো বুকের উপরে, কিন্তু হাতের ফাঁক গলিয়ে দুলারহিন আবার লুকিয়ে পড়লো। খেলার উত্তেজনায় ভুখনও ছুটতে শুরু করলো। কি একরকম ঘাস পায়ের তলায় দ’লে দ’লে যাচ্ছে, একটা সুঘ্রাণ উঠছে। কি একটা উত্তাপ বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেই শুকনো খটখটে ঘাসের বাদামী আলোর পৃথিবী থেকে। এইমাত্র ভুখন ছোটবেলার পাকড়ানোর কায়দায় পাকড়ে ধরেছিল কিন্তু এবারও রাখতে পারলো না। দুলারহিন হাত ছাড়িয়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দৌড়ে পালালো, তারপর হাসতে হাসতে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হ’য়ে আতপ্ত ঘাসের উপরে শুয়ে পড়লো। দুলারহিন ছোটবেলাকার ভঙ্গিতে শুয়ে আছে – যেমন ক’রে ছোটবেলায় বলতো, আমি ম’রে গেছি। উরু দুটি প্রসারিত, অর্ধনিমীলিত দৃষ্টি, ঈষৎ মুক্ত ঠোঁট দুটি, বুক কাঁপছে থর থর ক’রে।
কিন্তু দুলারহিন ধড়ফড় ক’রে উঠে বসলো। বল নিয়ে লুফতে লুফতে যদি হঠাৎ সেটা কুয়োয় প’ড়ে যায়, তাহ’লে সেই কুয়োর চারদিকে ঘুরে ঘুরে কুয়োর অন্ধকার মনে নিয়ে যেমন ফিরে যায় খেলুড়েরা – তেমনি মন নিয়ে ফিরে চললো ভুখন আর দুলারহিন।
দুলারহিন একবার বললো, ভুখন পিছিয়ে পড়ছিস। কিন্তু সেটা যেন ভাষা নয়, ভাষার খোলস শুধু।
ভুখন মুখ নিচু ক’রে থাকে, কথা বলে না। দুলারহিন ভাবে, কখনো কপালে হাত রেখে।
একদিন খুব সাহস ক’রে দুলারহিন ভাবলো, ভগবানের সামনে দাঁড়িয়ে সে বলবে ভুখনোয়ার কোন দোষ নেই, বয়সে সে-ই বড়ো। আর এই কথা বলে যদি ভুখনকে মুখ দেখাতে না পারে, মরবে সে। মরা যত সহজ বলা তত হয়। ভগবানকে যদি বলা যায়, মানুষকে নয়।
দুলারহিন রান্না করতে করতে ভুখনের পিঠের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, আহা সংকোচ যেন ভেঙে পড়েছে। সে ভাবে, তোর জন্য আমি কি না করেছি। ছোটবেলায় একবার আগুনের মধ্যে গুলি ফেলে দিয়ে তুই কেঁদে উঠেছিলি আর তোর সেই গুলি খুঁজে দিতে হাত দিয়ে জলন্ত আঙরা সরিয়েছিলাম, দাগটা ছিলো কিছুদিন। তাও কি তোর মনে নেই।
এক সময়ে দুলারিনের চিন্তার পথ কিছু বদলালো। চিন্তায় সাহস আগে ছিলো না, এমন নয়। কিন্তু স্নেহের করুণরসে মজ্জিত হ’য়ে সে সাহসও হ’য়ে উঠতো করুণ। সমস্যাগুলোকে একদিন জীর্ণ বাসের মতো তুচ্ছ মনে হ’লো। নিজেকে অসীম ক্ষমতার উৎস ব’লে অনুভব করলো সে। সাহসে এত প্রাণ, এত পূর্ণতা এ কে জানতো ? এতদিন পথে-পথে ঘুরে আজ তবে পথ দেখা গেলো। আবার সেই স্নেহগুলো ফিরে আসতে লাগলো। অনস্বাদিত এক আস্বাদে বর্ণাঢ্য হ’য়ে হ’য়ে। দুঃসাহসী হওয়ার জন্য নিজের ভিতরে প্রেরণা এল তার।
সন্ধ্যার পর ভুখন ফিরে এলো তেমনি গম্ভীর মুখে। পায়ের শব্দে দুলারহিনের স্নায়গুলো রিনরিন ক’রে উঠলো। নাগরদোলায় কয়েক পাক ঘুরে হঠাৎ মাটিতে দাঁড়াতে গেলে যেমন পরিচিত পৃথিবী অপরিচিতের মতো টলমল করতে থাকে তেমনি হ’লো দুলারহিনের।
দুলারহিন ভুখনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, – ভুখনোয়া।
ভুখন অবাক হ’য়ে গেলো। রুক্ষ চুলগুলি ভিজে-ভিজে পাট পাট করা, বোধহয় তেলজাতীয় কিছু দিয়ে বাঁধা। পরনে লাল সেই শাড়ি। কপালে কালির টিপ। আর চোখ ! সে চোখ কোনদিনই দেখেনি ভুখন। অনুচ্চারিত হাসির মতো তেমনি আভাযুক্ত কিছু দুলারহিনের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়লো মুখের বসন্তের দাগগুলোকে অস্পষ্ট ক’রে। ভুখনের মনে হলো প্রবল একটা আক্ষেপ বোধহয় আসছে তার সারা দেহে। ভুখন নিরুদ্ধ গলায় মৃদু গর্জন ক’রে উঠলো।
দুলারহিন একটা হাত রাখলো ভুখনের কাঁধে।
ভুখন দু’হাতের সবটুকু জোর দিয়ে দুলারহিনের হাতখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। যা কোনো দিন সে কল্পনাও করেনি, তেমনি ক’রে দুলারহিনের আধখোলা ঠোঁটের উপরে প্রচন্ড একটা চড় মারল সে। আঘাত একটা দেওয়ার জন্যই মন যেন উন্মুখ হ’য়ে উঠেছিলো। একটা কিছু প্রাবল্য দরকার – এই সে অনুভব করেছে এ কয়েকটি দিনের প্রতিটি ক্ষণ।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হ’লো – আহা এ কি করলো সে। দুলারহিন, বহিন। পৃথিবীতে কে আছে তার দুলারহিন ছাড়া। আর যে দুলারহিন নাকি তার মুখ চেয়ে তারই আশ্রয় থাকে, এত কোমলা, এত দয়াবতী। ছোটবেলায় দুজনের একজনকে বাবা মারলে অন্যজন তাকে জড়িয়ে ধ’রে কেঁদে উঠতো, তেমনি হ’লো।
ভুখন কেঁদে কেঁদে হেঁচকি তোলার মতো ক’রে বললো, আর কখনো তোকে মারবো না। এই প্রথম, এই শেষ। দুলারহিন দুলারহিন বহিন।
দুলারহিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, মেরে লাল মেরে ভুখনোয়া, ভাইয়া।
অনেকক্ষণ কেঁদে মনের নিরুদ্ধ পীড়াগুলিকে ধুয়ে মুছে দু’জনে নিজের নিজের চাটাইয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম ভাঙলো ভুখনের। ঠিক যা মনে করেছিলো তাই – এই ভাবলো সে। বাবা মারলে তারপর কয়েকদিন খুব কাজে মন হ’তো দুলারহিনের; ভোর থাকতে উঠে কাজে লেগে যেতো। আজ বোধ হয় তাই করছে, জল আনতে গেছে।
ভুখন ভাবলো : কি বোকা মেয়ে রে বাবা। অনেক বেলা হ’লেও যখন দুলারহিন ফিরলো না তখন ভয় হ’লো ভুখনের, সে খুঁজতে বার হ’লো।
কিন্তু সব সময়ে খুঁজে বার করা সহজ নয়। কয়েকদিন স্নান হওয়ার ত্যাগ ক’রে খুঁজেও দুলারহিনকে সে পেলো না। ভুখন বরং বুঝতে পারলো ওগুলোকে বর্জন করলে খোঁজার পরিশ্রমকেও বাদ দিতে হবে। তখন সে স্নানাহারের দিকে নজর দিলো। হাতের পয়সা কয়েকটি এক সময়ে ফুরিয়ে গেলো। ততদিনে সে বহুদূরে এসে পড়েছে। গাঁয়ে ফিরে গিয়ে খেতির কাজ করে আবার হাতে পয়সা ক’রে বেরুতে গেলে দুলারহিনকে বোধহয় আর কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। তখন সে পথ চলতে চলতে কাজ করতে শুরু করলো। যখন যে-গ্রামে গিয়ে পৌঁছায় সে-গ্রামেই খেতির যে কাজ পারে জুটিয়ে নেয়। কাজ ফুরিয়ে গেলে চলতে শুরু করে। একবার খুব বিপদে পড়েছিল। এক চায়ের বাগানে কাজ করতে গিয়ে তিন বছর একনাগারে খাটতে হয়েছিলো, পথ চলবার উপায় ছিলো না। ভুখনের ধারণা সেই সময়েই দুলারহিন সব চাইতে দূরে গিয়ে পড়েছে। তাকে একজন মুরুব্বি বলেছে দুলারহিন যে বছর হারিয়ে যায় সেবার প্রায় দু’তিন হাজার মেয়ে পুরুষ নাকি মরিসাস দ্বীপে কাজ করতে গিয়েছে। ভুখনের ইচ্ছা সে একবার মরিসাস দ্বীপটিও খুঁজে আসবে।
আসল ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়।
দুলারহিন পথে বেরিয়ে এক বুড়োর দেখা পেল। বুড়ো তাকে প্রশ্ন করতেই দুলারহিন কেঁদে ফেলে তাকে বললো, সে ভাইকে সুখী করার জন্য পথে বেরিয়েছে।
– কি করলে সে সুখী হয়, বিটিয়া ?
– যদি অন্ততঃ ষাট সত্তর টাকা দিতে পারি তাকে।
– আচ্ছা তুই আমার গোরুবাছুরের তদ্বির কর, দুধ দো, দুধ বেচ, আমি টাকা দেবো ধীরে ধীরে।
সেই বুড়োর কাছে থাকতে থাকতে বুড়োর ছেলে একদিন কেড়ে নিল দুলারহীনকে। বুড়ো খুব হুঁশিয়ার, সে ছেলে ব’লে রেয়াত করলো না। টাকা নিলো চার কুড়ি ছেলের কাছে বুঝে। সেই টাকা আঁচলে বেঁধে বুড়োর ছেলের ঘর কর’ছে দুলারহিন। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আঁচলে বাধা টাকা নিয়ে দুলারহিন অপেক্ষা করতে লাগলো। এ-লোক সে-লোকের মুখে সংবাদ দিয়েছে সে ভুখনকে ঘরে ফেরার জন্য। ভুখন ফিরলেই সে যাবে। লোকগুলো খবর দিয়েছে নিশ্চয়ই।
এখন দুলারহিন আর চট ক’রে যেতে পারে না কোথাও। মাটিতে শিকড় বসিয়ে দিয়েছে সে। তিন চারিটি ছেলেমেয়ে তার। তারা সবাই তার দেহকে এবং অধিকাংশ মনকে নিজের পরিবারে দৃঢ়বদ্ধ ক’রে দিয়েছে। এখন বড়জোর মনের একটা উন্মুক্ত অংশ তার ছোটবেলাকার গাঁয়ের দিকে বাতাসে বাতাসে আগ্রহের পল্লব মিলে ডাকতে পারে। প্রথম শীতের মাটির রসে কোনো কোনো গাছ যেমন শিউরে ওঠে – তেমনি কখনো অনুভব হয় তার ; শূন্যতা যেন শীত অন্ধকার একটা প্রবাহের মতো মাটি থেকে উঠে তার হৃদয়মূলকে শিথিল ক’রে দেয় কখনো কখনো।
আর ভুখন। বল দেখি যে ব্যবধান এসে গেছে তাদের জীবনে সে কি মরিসাস দ্বীপের সাগরের চাইতে কম দুস্তর ? আর একটি পরিবারের দেহগুলোর ক্রমায়াত শৃঙ্খলের একটি বৃত্ত যার দেহ, তাকে কখনো ফিরে আনা যায় পারতো তাই ভুখন, যদি জানতোও সে ? তার চাইতে মরিসাসের দূরত্ব-কল্পনাও ভালো।
কিন্তু ভুখন এখন আর দুলারহিনকে খুঁজে বেড়ায় না। তবু কি খোঁজে একটা। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো নেশায় দাঁড়িয়েছে। মরিসাসের কথাও বলে না। দু-এক বছর পর পর শহর বদলে কাজ ক’রে বেড়ায় সে। ভালো লাগে না অনেকদিন এক জায়গায় থাকতে। কিছুদিন সে বাঙলাদেশের গ্রামে মাটিকাটার কাজ করে বেড়ালো পথের ধারে ধারে। সন্ধ্যার অন্ধকারে কুপি জ্বেলে কড়াইয়ে ভাত চাপিয়ে সঙ্গীরা যখন দিনজমানার গল্প করে, দেশের গল্প করে, কোনো কোনোদিন সে চাটাই বিছিয়ে নীরবে অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকে। তারপর শুধু গল্পটাই থাকবে।
(পুনর্মুদ্রিত)