প্রদীপ সেন
ভোরের আলো ফুটতেই রোজকার মতো ওরা একে একে চৌরাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হতে থাকে। ওরা মানে বিজন, হীরালাল, মলয়, স্বপন, অজিতেশ, কমল ও ভজন। সবাই ষাটোর্ধ। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। মাস গড়ালে পেনশনের টাকা ঢোকে একাউন্টে। এটিএমে টাকা তুলে সংসার চালানো। অধিকাংশই ছেলেমেয়ের পড়াশোনায় টাকা ইনভেস্ট করে হাতেনাতে ফল পেয়েছেন। ছেলেরা চাকরি করে, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন চাকুরে বা প্রতিষ্ঠিত সুপাত্রে।
লোকে এই মর্নিং ওয়াকার দলটার নাম রেখেছে সপ্তর্ষি। ওরা সবাই সুখী, খুব সুখী। এই দুর্দিনে মানুষের রোজগার নেই, ঘরে ঘরে অভাব। সরকার দু’টাকা কিলো দরে চাল আর অতিমারির কালে ফ্রিতে কিছু বাড়তি চাল দিলেও জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। সপ্তর্ষির তাতে কিছু এসে যায় না। বাজার থেকে ইলিশ আসে, গলদা চিংড়ি আসে, বাড়ির গিন্নিদের আবদার মতো কচি পাঁঠার মাংস আসে। দিন আনি দিন খাই মানুষগুলো ওদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে মাছ বাজারে, মুদিখানায়, মিষ্টির দোকানে।
ওরা রোজ ভোরে তিন কিলোমিটার পথ হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় – রাজনীতি, দ্রব্যমূল্য, কাদের সংসারে কী কী চলছে, পেনশন বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা আছে কি না – ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথার ফাঁকে ফাঁকে সপ্তর্ষির কেউ কেউ নিজেদের গিন্নির গুণকীর্তন করে। বাড়িয়ে বলায় কেউ কারুর চেয়ে কম যায় না। শুধু কমল চুপ করে শোনে। সপ্তর্ষির মধ্যে একমাত্র বিপত্নীক সে। স্ত্রী সুভদ্রা মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। কমল মাঝে মাঝে নেশার ঘোরে সুভদ্রাকে গালাগাল করতো, দু’একবার সুভদ্রার গায়ে হাতও তুলেছে। বন্ধুদের স্ত্রী ভজনা শুনে মনক্ষুণ্ন হয়। সুভদ্রার মুখটা মানস পটে ফুটে ওঠে। বড্ড কষ্ট হয়। কান্না কান্না মতো একটা অনুভূতি বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে ওঠে। ওরা সমস্বরে বলে, তুমিও কিছু বলো তোমার স্ত্রী সম্পর্কে। তোমাদের মধুর রিলেশনের কথা। স্মৃতির ডালা খোলো।
কমল বানিয়ে বাড়িয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সুভদ্রার তারিফ করে। মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নেয় সুভদ্রার কাছে। সুভদ্রার গুণগুলো বড্ড স্পষ্টভাবে মনে ভেসে ওঠে।
আজ ছেলে আর ছেলে-বৌ বাড়িতে নেই। নাতি জয়কে নিয়ে ছেলে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেছে। কমল হোটেল থেকে ভাত-মাংস এনেছে। স্নান সেরে রান্নাঘরের পথে পা বাড়ায়। খাবারের প্যাকেটটা ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা। বেড়ালের খুব উপদ্রব। কখন মুখ লাগিয়ে দেয় কে জানে! কিন্তু যেতে যেতে কমলের পা থেমে যায়। চোখ পড়ে ওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা সুভদ্রার ছবিটার উপর। মনে হলো সুভদ্রার দৃষ্টি কমলের দিকে। যেন ওকে বলছে – আজ আমার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলার জন্য ধন্যবাদ। যদি ওই কথাগুলো আমার জীবিতকালে বলতে তাহলে আরও কিছু দিন বেঁচে থাকার চেষ্টা করতাম।
কমল ফিরে এলো। হঠাৎ মনে হলো আজ সুভদ্রার মৃত্যু বার্ষিকী। চারটি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দানিতে গুঁজে দিল। চেয়ারটা টেনে সুভদ্রার মুখোমুখি বসলো। মোবাইলে ইউ টিউব খুলে ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম.. ‘ গানটা চালিয়ে দিল! দুচোখ বোজা। খাবারের কথা ভুলে গেল। হয়তো বোবা কান্নারা বুকের ভেতর আছড়ে পড়তে লাগলো।