জয় ভদ্র

নজ়র বক্সী সম্পর্কে যে-গল্পটা চালু ছিল তা হল সে ছিল এক দেয়াল ভেদী মানুষ। কথাটা কতটা সত্যি অথবা কতটা ভেজাল— এই এলাকার যারা বর্তমান প্রজন্ম তারা বলতে পারবে না। যদিও কথাগুলো তাদের কানে আসে পথচলতি, রকে বা চায়ের দোকানে আড্ডা মারার সময় ক্বচিৎ কখনো-বা, তা-ও কানাঘুষো, কিংবা কোনো ব্যাপারে মোক্ষম কোনো তুলনা টানতে হলে তাদেরকেও শেষমেষ ওই শোনা কথাই বলতে হয়— ‘ওই তো নজ়র বক্সী…’

    হ্যাঁ, একটা সময় ছিল বটে, সে তখন কী না কী করত! বিশেষ করে নজ়রের যৌবনের সময়গুলোতে যারা তাকে সচেতনে সচক্ষে দেখেছিল। আজ তাদের অনেকেরই তিন কাল গিয়ে এক কাল ঠেকেছে, এমনকি কেউ কেউ এই ধরাধাম ছেড়েই চলে গেছে, বেশ কিছুকাল হল। 

    যাইহোক, তাদের মুখ থেকে যে-কথাটা বলতে গেলে লোককথার মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল তা হল— ‘নজ়র বক্সী একজন দেয়ালভেদী মানুষ।’ কথাটা কতটা সত্যিই অথবা কতটা মিথ্যে সে-সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের কেউ-ই বিশেষ কিছু বলতে পারবে না। কথাগুলো তাদের কানে আসে, পথ চলতি অথবা রকে বা চায়ের দোকানে আড্ডা মারার সময়— ক্বচিৎ কখনো-বা কানাঘুষো, অথবা কোনো ব্যাপারে বিরামহীন আড্ডা মারার সময়, ‘ওই তো নজ়র বক্সী  তখন কী না কী করত… শুনতাম তো ও দেয়াল ভেদ করতে পারত!’ যাইহোক নজ়র বক্সী সম্পর্কে তাদের এই যে মন্তব্য তাতে এইটুকু বোঝা যায় দেওয়াল ভেদ করার ব্যাপারে তার এই ক্যাপদারিপনাকে অশরীরীর মতো এক অলৌকিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই মান্যতা দিয়েছিল।

    তাই আমাদের মতো সদ্য তরুণ প্রজন্মের কাছে নজ়র বক্সী শুধুই এক মিথ মাত্র। সে যেন হাজার-কোটি বছরের এক উজ্জ্বলতা ধরে থেকে থেকে যেন আজ ম্লান হয়ে আসা নক্ষত্রের মতো। তাই যদি হয় তাহলে সে কি সুপারনোভা হয়ে দিগ্‌বিদিক ফেটে পড়েছে, না-কি সে আজও বেঁচে আছে? এখনো শহরের এ-তল্লাটে যারা প্রাচীন মানুষজন নজ়র বক্সীর নাম শোনামাত্র ভয়ে বা শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তাদের স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট আছে নজ়র বক্সী। সে প্রায় ৫০ বছর আগের সময়কার ঘটনা:

পুলিশের লোক তারা করছে কালো কুচকুচে নজ়র বক্সীকে। প্রায় ছয় ফুটের উপর লম্বা। বাঁ-হাতের চওড়া কবজিতে এক তাগড়াই স্টিলের বালা। মাথাভরতি কোঁকড়া চুল। টিকালো নাক। শকুনের মতো ভাটার দৃষ্টি। তলায় চেইন দেওয়া রঙচটা এক কালো টেরিকটের বেলবট্‌স পরনে। শরীরের ওপরেও কালো গেঞ্জির টি-শার্ট যার পিঠের দিক ঘামের নোনায় সাদা হয়ে থাকত। এক চরমপন্থী রাজনৈতিক দলের সাধারণ সক্রিয় সদস্য ছিল সে। ঠিক যেন রুপোলি পর্দার হিরো, অথবা এই অনাসৃষ্টির দুনিয়ায় এক মূর্তিমান প্রেত! 

    পুলিশের দল তাড়া করছে। সামনে ছুটছে নজ়র বক্সী। প্রাণপণ ছুটছে। সামনে এক বড়ো দেওয়াল। অনেকটা উঁচু। প্রাচীন। প্রায় দশ ইঞ্চি মোটা গাঁথনি। পলেস্তরা খসানো। সে প্রথম অসাবধানতা বা অসচেতনবশত দেওয়াল টপকানোর চেষ্টা করে। পারল না। মুহূর্তে পেছনে তাকাল সে। প্রায় শ-দেড়েক গজ দূরে পুলিশের দল, এগিয়ে আসছে। এক্ষুনি গুলি ছুটে আসবে। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে নজ়র বক্সীর স্বপ্ন মাখানো হৃদপিণ্ড। কিন্তু বিদ্যুৎ চমকের মতো সে পকেট থেকে রিভলবার বের করে ফায়ার করে— বন্দুক উদ্যত পুলিশের আঙুল লক্ষ্য করে বাঁ-হাতের এক অভ্যর্থ টিপ! তারা মুহূর্তের জন্য থমকে যায়, আর দেখে দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে নজ়র বক্সী উধাও! ভ্যানিশ! 

    ছোকরার অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার পুলিশ জানতই। ওদেরই দলের অন্য এক ছোকরা পয়সার লোভে পুলিশের কাছে টিপ দিত নজ়র বক্সী সম্পর্কে। কিন্তু তারা যে স্বচক্ষে এমন কাণ্ড দেখবে তাদের ধারণারও বাইরে ছিল। ইস্‌, মাথার দাম পঁচিশ হাজার টাকা। হাতের নাগালে পেয়েও ধরা গেল না! 

    এসব ঘটনা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার। সেই শুরু। তখন থেকেই লোকমুখে চাওর হয়ে গেল নজ়র বক্সীর অলৌকিক ক্ষমতা। আর এরপর থেকেই নজ়র বক্সীর বিশ্ববিখ্যাত ‘গুস্‌সা’ শহরের এ-তল্লাটের জনপদকে সচকিত করে তুলত। যদিও এ-হেনও বদরাগী নজ়রের প্রতি মানুষজনের ক্ষোভ যেমন ছিল, আবার কারোর কারোর ভেতরে বিশেষ সহানুভূতিও ছিল।

    শত্রুর মুখোমুখি হলে নজ়রের শকুনে চোখ প্রথমে খেয়াল করত তার হাতে কিংবা গোপন কোনো জায়গায় কোনো অস্ত্র আছে কি-না। অব্যর্থ অনুমানে যখন সে বুঝে যায় অস্ত্র ছাড়াই শত্রু ওর মুখোমুখি হয়েছে, সে তখন তার পা-টাকেই বিশেষ অস্ত্র বানিয়ে নিত। লম্বা গোদা পা তার গদার মতো ভারী ও মজবুত ছিল। আর তাই দিয়েই সে অনেক কাজ সারত। তারপর তার হাতের খেল দেখাত। এভাবে শত্রুকে সে নিমেষে ঘায়েল করে ফেলত। তারপর প্রয়োজন মনে করলে পকেট থেকে ধারালো চাকুটা বের করে দিব্যি কণ্ঠের হাড়ের উপরের নরম তুলতুলে অংশটায় দিব্যি সুন্দর করে টেনে দিত…

    দোকানের চায়ের আড্ডায় প্রাচীন মানুষগুলো ক্বচিৎ মাঝেমধ্যে নজ়র সম্পর্কে এই গল্পই করত তরুণ প্রজন্মের কাছে। এই প্রাচীনেরা সবাই যে তাদের যৌবনে সরাসরি নজ়রকে প্রত্যক্ষ করেছিল এমন নয়। এদের কেউ কেউ তার পাশের বন্ধু বা আত্মীয়দের কাছ থেকে শুনেছে নজ়র সম্পর্কে। সে আবার আরেক জনকে বলেছে। এইভাবে নজ়রের কাহিনি শ্রুতি মারফত শুনতে শুনতে বা বলতে বলতে শহরের এ-তল্লাটে নজ়র নিজেই এক শহুরে আধুনিক লোককাহিনির নায়ক হয়ে গিয়েছে।

    আমি নিজেই নজ়র সম্পর্কে ঠিক এরকম একটা ঘটনা শুনেছিলাম এক বয়স্ক ব্যক্তির কাছ থেকে। যদিও সে সরাসরি এ-কাজটা নজ়রকে করতে দেখেছিল।  লম্বা দশাসই নজ়র বরাবরই কালো রঙের পোশাক পরত। সে যাইহোক… যাকে ঘিরে ঘটনার সূত্রপাত সে ছিল গাল-কাটা স্বপন। নিরীহ শান্ত মানুষ…

    আমি বরং সেই প্রাচীন কথকের মুখ থেকেই শুনি উনি যে’রম যে’রমভাবে বিষয়টা আমাকে বলেছিলেন: 

‘তোমরা এ-প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা খুনখারাপির কী-বা দেখেছ। কিছুই নয়। আমাদের ওই সময় গাল-কাটা স্বপন বলে একজন ছিল। বুঝলে… কালো বেঁটে গাট্টাগোট্টা। বয়স ছিল প্রায় আমাদেরই বয়সি। একদিন আমাদের এই বাজারে এসেছি। দেখি ও-ও এসেছে। মাসে একবার-দু’বার করে আসত। সবচেয়ে বড়ো দোকানেই হোক আর ফুটপাতের দোকানিই হোক— প্রত্যেকের কাছে আসত। তবে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা হিস্যা ছিল। না, তাকে কোনোদিন কাউকে চোখ রাঙানো বা ধমক দিতে দেখিনি। দোকানিদের সামনে এসে দাঁড়াত শুধু। হাতে একটা ইয়া বড়ো লোহার তলোয়ার থাকত। দু-তরফের পক্ষ থেকেই বলার কিছু-আর থাকত না— একজন বুঝে নিত সে কী চায়, আর-একজন বলতে চায় তার জন্য কী করতে হবে। স্বপনের সামনে উপস্থিতিটাই যথেষ্ট। তো যাইহোক, দিনটার তারিখ-খন আজ আমার সঠিক মনে নেই। সম্ভবত দোলের ঠিক হপ্তাখানেক পর-টর হবে। তবে এই দিনটা মনে হয় রোববার ছিল। আমি বাজারে গেছি। দেখি ও-ও এসেছে। তরবারি হাতে নিয়ে… সিনেমার আর দোষ দেব কী! তো দেখি, মাটিতে বসা এক মাছ-ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা তুলছে। কত ঠিক জানি না। তবে বেশ মোটা টাকা। মাছ-ব্যাপারী টাকাটা দিতে দিতে বলছে, ‘দাদা, এবারটা একটু সামলে নাও। দেখছি আবার পরে।’ শান্ত নিরীহ গাল-কাটা স্বপনকে শুধু বলতে শুনলাম, ‘ঠিক আছে, পরেরবার যেন আর ভুল না-হয়।’ লোকটা তখন ভয়ে বা শ্রদ্ধায় দু-দিকে মাথা নাড়াতে সে এবার পাশের দোকানে চলে যায়। 

    ‘এমন সময় দেখি গাল-কাটা স্বপনের পেছন দিক থেকে বিড়াল বা বাঘের মতো চুপিসারে এসে নজ়র ওর পেছনে সজোরে এক লাথি কষায়। বেঁটে গাট্টা শরীরের গাল-কাটা স্বপন পাশে ছিটকে পড়ে যায়। হাতের তলোয়ারটা একটু দূরে ছিটকে পড়ে। নজ়র বক্সী মুহূর্তের মধ্যে সেই তলোয়ারটা তুলে নিয়ে গাল-কাটা স্বপনের গলায় মারল এক কোপ। তারপর ওই তলোয়ার হাতে নিয়েই ছুটল সামনের দিকে। আমাদের বাজারের প্রান্তসীমায় যে-পুরোনো পাঁচিলটা রয়েছে, দেখেছ কি তুমি সেটা? না, সেটা আজ আর নেই, নতুন হয়েছে… সেটা ওকে টক্কাতে হল না—দেখলাম, ওর গায়ের মধ্যে শরীর ঢুকিয়ে দিব্যি অদৃশ্য হয়ে গেল! 

    ‘এর’ম অবাস্তব অলোকিক ঘটনাটা দেখলাম একেবারে জলজ্যান্ত দিনের আলোয়। নিজের চোখে তখনও কেন, আজও বিশ্বাস করতে পারি না!! যেন চোখের পলক ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটা ঘটে গেল আমাদের সকলের চোখের সামনে। আমাদের চারপাশের লোকজন সবাই একপ্রকার হিপটোনাইজ়ড হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সম্বিৎ ফিরতেই  দেখলাম গাল-কাটা স্বপনের লাশটা উপুর হয়ে পড়ে আছে রাস্তার ধারে। ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা। গলা থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত— ধারের নালাটায় গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে… সে-দৃশ্য দেখা যায় না!! তোমরা বইয়ের পাতায়, সিনেমায় থিয়েটারে অলৌকিক দৃশ্য দেখো। আমরা নিজের চোখে সেদিন এর’ম অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিলাম ভায়া।

    ‘কী যে চণ্ডালের মতন রাখছিল নজ়রের! এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এতটুকু উনিশ-বিশ হবার জো-টি পর্যন্ত নেই। বেগতিক কোনো কিছু দেখলেই রাগ যেন প্রথমে ওর পায়ের নখের গোড়া দিয়ে ঢুকবে, তারপর সেই রাগ পায়ের শিরা বেয়ে কোমর, সেখান থেকে পেট বেয়ে বুক, বুক ফুঁড়ে হৃদপিণ্ডে, তারপর গলা বেয়ে মুখ-চোখ নাকের ডগা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। যেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্টোটা। সবশেষে কাঁধ বেয়ে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে কনুই বেয়ে কবজি, হাতের পাতা আঙুল নখ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। কী-বা বয়স তখন ওর। ওই বাইশ-তেইশ— ওই তোমাদেরই বয়সি। মা-টা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করত। বাবাটা করত স্টেশনের মুটে বওয়ার কাজ— শুনেছিলাম এককালে চেহারাটা ছিল ওই ছেলের মতোই পেটানো দশাসই। ওই ধেনো মদে শরীরে টিবি বাধাল। মল্ল যখন, তখন ওর আরেক ভাই ও বোন তখনও বেশ ছোটো। নজ়রের বাপ তো মুসলমান, কিন্তু হিন্দুর মেয়েকে বিয়ে করেছিল। ওরা থাকত কোথায় জানো? তোমাদের পাড়া ছাড়িয়ে ওই যে রেল কলোনির বস্তিটা আছে না? সেইখানে। যদিও বহু কাল হল, এখন জানি না ওরা ওখানে থাকে কি-না।’

    তো নজ়র বক্সীর এখন খবর কী? বেঁচে আছে?

    ‘তা-ও ভায়া বলতে পারব না। বহুকাল হল তাকে দেখি না। আদপে বেঁচে আছে কি-না তা-ও বলতে পারব না। আশির দশকের ওই প্রথম দিকটা পর্যন্ত ও এই এলাকাটায় দাপিয়ে বেরিয়েছিল। শুধু গাল-কাটা স্বপন কেন— ওকে নিয়ে এরকম বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী ছিলাম আমরা। সেগুলো আজ আর স্পষ্ট মনে নেই। আ-রে বাবা, আমাদেরও তো বয়স হয়েছে! তিনকাল গিয়ে এক কাল ঠেকেছে। কিছুদিন পর হয়তো শুনবে, আমাদেরও সগ্গের টিকিট কেটে পাকাপাকি চলে যেতে হয়েছে।

‘তো কী বলব ভায়া তোমায়, দিনকাল তখন অন্যরকম ছিল। দেয়ালের মধ্যে দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় ও এই সারা তল্লাটটায় মাত করে রেখেছিল। তখন তো এখনকার মতো এত টেলিভিশন মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল— এসব তো আর ছিল না। বলতে গেলে টিভি ঢোকেনি তখন। ছিল বলতে একমাত্র খবরের কাগজ, রেডিয়ো, আর অভিজাত দু-একজনের বাড়িতে সেই পুরোনো আমলের ল্যান্ড ফোন। কিন্তু এরপরেও নজ়রের কুখ্যাত বা বিখ্যাত হওয়া থেমে থাকেনি। থেমে থাকিনি ওকে নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ার চর্চা, থেমে থাকেনি ওকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের ফেউবৃত্তি করার লোকজনরাও।

    ‘নজ়র বিখ্যাত হলেও সবাই যে নজ়রকে ভালোবাসতো বা ভালো নজরে দেখত এমনটা মোটেও নয়। বিশেষ করে আমরা যারা মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। বলতে গেলে নজ়র কত খারাপ ছেলে আমাদের কালে সেই চর্চাই চলত রাতদিন। তা ভায়া, তুমি তো এখনকার জ়েন-ওয়াই প্রজন্মের। বিখ্যাত ‘শোলে’ সিনেমাটা কি দেখেছ?’

    দেখেছি। মোবাইলে। 

    ‘মনে পড়ে গব্বরকে? গ্রামের বউ-ঝি’রা তাদের বাচ্চাদের সময় মতন না-ঘুমালে বা দুষ্টুমি করলে গব্বরের নাম নিয়ে তাদেরকে-ভয় দেখাত। নজ়রের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এইরকম বলা যায়। এটা যখন শুরু হয়েছিল তখন তোমাদের ‘শোলে’-ও মার্কেটে আসেনি। অন্যের কথা কী বলব— আমারই খুড়তুতো ভাইবউকে দেখেছি সে তার বাচ্চাটাকে বেশি রাত অব্দি জেগে থাকলে নজ়রের নাম নিয়ে ভয় দেখাত।

    ‘তবে বাপু যাই বলি না কেন, এই এলাকায়, মানে এই পুরো তল্লাটায় চুরি, রাহাজানি, বাটপারি, মেয়েদেরকে উত্তপ্ত করা, ধর্ষণ, গরিবের বা সাধারণ মানুষকে ঠকানো— সব স-ব একেবারে বন্ধ হয়ে গেছিল। এখন এই বয়সে এসে নিজের কাছে নিজেরই খুব অপরাধবোধ জাগে। আমরা যারা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষ নজ়রের মূল্যায়ন হয়তো ঠিকমতো করতে পারিনি।’

    নজ়র বক্সী কি ম্যাজিক বা জাদুটোনা এসব কিছু জানত?

    ‘বলতে পারব না। কিচ্ছু বলতে পারব না— কী করে ও ওই অলৌকিক শক্তি অধিকারী হল! কিন্তু ভায়া, ধম্ম সাক্ষী রেখে বলছি কী সহজ কী অনায়াসে দেয়ালের মধ্যে দিয়ে নজ়রকে ভ্যানিশ হয়ে যেতে দেখেছি!!’

    নজ়র বক্সী সম্পর্কে আর-কি কোনো ঘটনা মনে পড়ে?

    ‘ওই যে বললুম, বয়স তো বেড়েছে ভায়া। স্মৃতি আর আগের মতো কাজ করে না। ঘটনা তো অনেক কিছুই ঘটে গেছে… তবে আর-একটা ঘটনা আমার এখনো কিছুটা প্রমিনেন্ট মনে আছে, সেটা অবশ্যি আমি নিজে সাক্ষী ছিলাম না, ঘটনাটা আমার বন্ধুবর আমাকে বলেছিল— যদিও সে এখন এই ধরাধামে নেই, প্রায় বছর দুই হল এ-পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।

     ‘সালটা প্রায় ’৭২-এর প্রথম দিকের হবে। এই যে তুমি এই শহরটাকে দেখছ, তখন এই এলাকাটা এতটা ঘিঞ্জি কনজাস্টেড ছিল না। চারদিকে গাছপালা পুকুর এসব ছিল। এই যে তোমার রেলকলোনি বস্তি তারপরেই আবার ধানক্ষেত শুরু হয়ে গিয়েছিল। বেশ একটা গ্রামীণ পরিবেশ ছিল। সে যাইহোক, তো যা বলছিলাম, ঘটনাটা ঘটেছিল এই বর্ডার লাইনটায়। তখন চারপাশের রাজনৈতিক উত্তাল আরও বেড়েছে, বলতে গেলে চরম আকার ধারণ করেছে। এমনই একদিনে এক বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে ঘটনাটা ঘটেছিল। এক অনাথ মেয়ের বিয়ে। মামা বাড়িতে মানুষ। কোনোরকমে মেয়েটাকে যার কারুর কাছে গছিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। ব্রাহ্মণ বর। বেশ বয়স্ক, তাই মদ্যপ। শোনা যায়, আগের পক্ষের দুই বউ আছে। থাকে তার সঙ্গেই। আমাদের এই মেয়ে হবে তাদের সতীন। পাঁচ হাজার টাকা পণ চেয়ে বসেছিল। কিছু দিয়েছিল। বাকিটা বিয়ের দিন লগ্নের আগে মেয়ের পক্ষ থেকে মিটিয়ে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মেয়ের মামারবাড়ি বিয়ের দিন ওই প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারেনি। এই শুনে হবু বর ওই টাকা না-পেলে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি নয়। বরের বাড়ির লোকজন তখন বিস্তর ঝামেলা করতে শুরু করে দিয়েছে। এদিকে লগ্ন আসন্ন। মেয়ে পক্ষের মহিলামহলে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখার মতো খবর ছড়িয়ে পড়ে। নজ়রের কানে যায় এসব কথা…

    ‘নজ়র যখন আসে সবকিছু শোনামাত্রই তার এক বিশেষ পরিচিতকে মেয়ের পাত্র হিসেবে ঠিক করে। তারপর সরু কাঠের তক্তা দিয়ে ওই হবু বরটাকে মারতে মারতে খালপাড়ের দিকে নিয়ে গিয়ে প্রায় মেরে ফেলার মতো অবস্থা তৈরি করে। এদিকে বরের বাড়ির লোকজন ও এলাকার নজ়রের শত্রুরা পুলিশে খবর দিলে তারা আসতে শুরু করে। নজ়র দূর থেকে পুলিশকে দেখতে পেয়ে আবার চম্পট দেয়। খালপাড়ের গলি দিয়ে ছুটতে ছুটতে পুরোনো বাড়িগুলোর কোনো একটা দেয়ালের মধ্য দিয়ে শরীর ঢুকিয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে গেল! পুলিশ যখন লোকটার কাছে পৌঁছোল সে তখন অলরেডি মারা গেছে।

    ‘এভাবে পুলিশকে ও ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল। ততদিনে ওর মাথার দাম আরো বেড়ে গিয়েছিল। শুনেছিলাম তো ডবল— পঞ্চাশ হাজার টাকা!!! ওর এই তাণ্ডব চলেছিল আশির দশকের ওই প্রথম দিক পর্যন্ত, যতক্ষণ না সে জেলে গেল।’

    নজ়র বক্সী জেলে? বলেন কী?

    ‘হ্যাঁ, নজ়র জেলে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে। কারণ ওকে না-পেয়ে পুলিশ শেষমেষ ওর মা-ভাই-বোনগুলোকে টানতে শুরু করেছিল। অকথ্য অত্যাচার শুরু করেছিল তাদের ওপর। নজ়র বক্সী সেই কারণেই পুলিশের কাছে নিজে এসে ধরা দেয়। যদিও তার আরও একটা কারণ ছিল— শহরে ওদের রাজনৈতিক দলটা নানা কারণে একেবারে ছত্রখান হয়ে গিয়েছিল।

    ‘কিছুদিন হইচইয়ের পর আপাতত সব শান্ত চুপ। জেলে যাওয়ার ঠিক বছর দুই-তিনেক হবে। নজ়র বক্সী আবার শিরোনামে। একদিন সকালে খবরের কাগজগুলোতে দেখি প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে নজ়রের ছবি— নজ়র উধাও! সে জেল ব্রেক করেছে!

    ‘মজার ব্যাপার হল রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে নজ়রকে ওরা জেলে পাঠায়নি। ডাকাতি বা খুনের ভয়ংকর দাগী আসামি আর এলাকার ধর্ষকবাজ হিসেবে নজ়রের ফাইল তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা হল, যেটুকু খবরের কাগজের মাধ্যমে জেনেছিলাম, নজ়রের সতীর্থ যারা রাজনৈতিক বন্দি জেলে ছিল, তাদের দুরবস্থা ছিল চরমে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরম অত্যাচারেরও সম্মুখীন ছিল। ঠিক এই ব্যাপার নিয়েই নজ়রের সঙ্গে জেল-কর্তৃপক্ষের শুধু বিরোধ নয়, চরম দাঙ্গা বাঁধল। ওর তীক্ষ্ণ ধীশক্তি নিয়ে জেলের সান্ত্রীকে তো খুন করলই, উপরন্তু ওর বন্দুক নিয়ে নজ়র বেপাত্তা। জেল সীমান্তের ওই মোটা উঁচু পাঁচিলের মধ্য দিয়ে নজ়র ভ্যানিশ!!

    ‘যখনই নজ়র দেয়ালের মধ্য দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন বেজে উঠেছিল, জেল-পার্শ্ববর্তী পুরো তল্লাটাই পুলিশের ব্যারিকেড গড়ে উঠেছিল, সেইসঙ্গে এলাকায় এলাকায় পুলিশের প্যাট্রোলিং। ঘটনাটা ঘটেছিল গভীর রাতে। জেল-সীমান্তের বিশাল উঁচু মোটা প্রাচীরের ধারেই খাল— সেই খাল থেকে শুরু করে, মানে ওই গভীর রাতে, বাড়ি বাড়ি খানাতল্লাশি শুরু হল, হুলিয়া জারি হল সারা দেশজুড়ে, ওই অন্ধকারে পুলিশের এনকাউন্টার চলল, কিন্তু না, নজ়রকে ধরা গেল না জ্যান্ত অথবা মৃত অবস্থায়। সেই যে দেয়ালের মধ্য দিয়ে উধাও হয়ে গেল নজ়র বক্সী ওই-ই শেষ। তার পাত্তা আজও আমরা কেউ পেলাম না। 

    ‘যদি তোমায় বলি, নজ়র বক্সী পুলিশের এনকাউন্টারে মারা গিয়েছিল, তাহলে তার লাশ কোথায়? এমন নয় যে বহুল পরিচিত নজ়রের ছবি তাদের কাছে ছিল না। আর নজ়রের জীবন ছিল একপ্রকার খোলা খাতার মতো। এত কিছু সত্ত্বেও তারা নজ়রের়় লাশটাকে উদ্ধার করতে পারেনি, তাদের আঁটোসাঁটো গোয়েন্দা দপ্তর আর গোপন খোচরবাহিনী থাকা সত্ত্বেও।’

    এরপর নজ়র বক্সী সম্পর্কে বলে চলা এই প্রাচীন কথক একেবারে চুপ হয়ে যায়। ঠিক যেন এই মুহূর্তের শহরটার মতোই। এক শান্ত গুমোট আদ্র আবহাওয়া, যেখানে মিশে আছে আমাদের শ্রান্ততা, বিষণ্ণতা আর ব্যর্থতা। ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ কি? 

    চুপ হয়ে যাই আমিও। হঠাৎই এক অনাস্বাদিত অপরাধবোধ আমার মধ্যে কাজ করতে থাকে— স্বাধীনতার ৭৫ বছর, আমার আর আমরার অস্তিত্ব লুট হয়, আমার শহর লুট হয়, চাকরি লুট হয়, ঘুষের হাতছানিতে স্বপ্ন লুট হয়, প্রতিবাদের ঝলকানিতে প্রাণ লুট হয়… এমন সময়টা যদি নজ়র বক্সী আমাদের পাশে থাকত!

    আসলে অর্ধশতাব্দি পর শহুরের লোকগাথার এই কিংবদন্তিসুলভ খুনিটার ব্যাপারে আমাদের মনে তোলপাড় তোলার একটাই কারণ: ছোট্ট এক ব্রেকিং নিউজ়।

    আমাদের রেলসেতুর পাশে বিশাল হোর্ডিং-এ ‘সত্যকে গোপন করতে ঘৃণা বোধ করে’ বলে যে জাহির করা যে-বৈদ্যুতিন মাধ্যম ২৪ ঘণ্টা খোলা হাওয়া — তারাই করেছিল এই ব্রেকিং নিউজ় [টেলিভিশনের এই চলন্ত ভিডিয়ো ফুটেজে লেখা ছিল “২৪ ঘণ্টা খোলা হাওয়া এই ভিডিয়ো ফুটেজের সত্যতা যাচাই করে দেখেনি”]

    রাতের শহরে রোড-ক্যামেরায় ধরা পড়েছে এক অদ্ভুত দর্শন মানুষের ছবি। ঠিক ছবি নয়— ছায়া! কালো পোশাক পরা। বেশ লম্বা। হাতে পঞ্চাশ বছরের পুরোনো মডেলের এক রাইফেল। মাথায় টাক। সামনের দিকে ঝুকে পড়া শরীরটাকে এখনও টানটান হয়ে সোজা হয়ে চলার চেষ্টা। রাস্তায় হাঁটছে আর উদাস নয়নে চারিদিকে তাকিয়ে থাকছে, আর এইভাবে হঠাৎই তার মুখ ক্যামেরার মধ্যে চলে আসে— আবছা আবছা, কাটা দাগ, বীভৎস তার মুখ… মানুষ কি? মানুষ নয়, যেন মূর্তিমান এক বহু যুগের প্রেত!!!

    পুলিশ প্রশাসনের কেন্দ্রীয় দপ্তর নড়েচড়ে বসে। ভিডিয়ো ফুটেজ ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেকার চাপা পরা ধুলোয় ভরা ফাইলগুলো আবার সামনের দিকে চলে আসে। বহু পুরোনো মুখের সাদা-কালো রং-চটা ছবি, কেস-হিস্ট্রি নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ…

    গভীর রাতে টেবিলের ওপর স্কচের বোতল সাজিয়ে শিক্ষামন্ত্রী টেলিভিশনে এসবই দেখে চলছিল…

    কিন্তু হঠাৎই বিস্ফোরণ। ভয়ংকর। ভূমিকম্পের মতো। দেওয়াল ফুঁড়ে ঢুকে পড়ে এক মাংসপিণ্ড। পড়ে টেবিলের ওপর। আস্ত এক নরচক্ষু! আগুন লাল। তীক্ষ্ণ নজর। দেখছে। জ্বলছে। পুড়ছে। দাউ দাউ করে!! প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *