সৌমিতা রায় চৌধুরী

পর্ব – ৯

ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পৌঁছে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর অপু ত্রয়ী এবং ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ নিয়ে বিগত সংখ্যাগুলিতে আলোচনা হয়েছে। তাঁর আরো কয়েকটি কালজয়ী ছবির নাম ‘হীরক রাজার দেশে’, যা মূলত গুপী বাঘার ধারাবাহিক কার্যক্রম। এছাড়া ‘সদগতি’, ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘আগন্তুক’ ভিন্ন মাত্রার ছবি। 

গুপী বাঘা জুটি রাজ জামাতা হওয়ার পরে হীরক রাজ্য থেকে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য রাজদরবারে আমন্ত্রিত হয়। এদিকে শুন্ডী ও হাল্লার দুই রাজ জামাতা গুপী এবং বাঘা মনে মনে হীরক রাজ্যের হীরার খনি দেখার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। গানের সভায় আমন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুযোগ এসে যায়। হীরক রাজ্য হীরক রাজার মনের মত করে চালিত হয়। হীরা কোষাগারে জমা হয়। আর প্রজারা যথেষ্ট পরিমাণে পারিশ্রমিক পায় না। তারা ক্ষুধার্ত হয়ে কষ্ট পায়। প্রতিবাদী মানুষকে ‘যন্তরমন্তর’ ঘরে পুরে রাজ বিজ্ঞানীকে দিয়ে মগজ ধোলাই করানো হয়। যার ফলে প্রতিবাদী প্রজারা রাজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। একজন মাত্র শিক্ষক উদয়ন পন্ডিতকে কিছুতেই বাগে আনতে পারে না হীরক রাজা। সে পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাজাকে জব্দ করার ব্যবস্থা করতে থাকে। 

এই সময়ে উদয়ন পন্ডিতের সঙ্গে দেখা হয় গুপী এবং বাঘার। উদয়ন পন্ডিত ও তার ছাত্ররা এবং গুপী বাঘা মিলে শোষক রাজার কবল থেকে দেশকে রক্ষা করার ব্রত নেয়। গুপী বাঘা তাদের জাদুকরী সংগীতের মাধ্যমে শুধু মানুষ নয়, এমনকি একটি বাঘকেও গানের ছন্দে জব্দ করে হীরক রাজার কোষাগার লুঠ করে। লুঠ করা হীরা হীরার খনির শ্রমিক ও রক্ষীদের মধ্যে বন্টন করে তাদের রাজার বিরুদ্ধে কাজ করতে প্ররোচিত করে। উদয়ন পন্ডিত এবং তার ছাত্রদের রাজা যখন যন্তরমন্তর ঘরে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে তখন রাজ বিরোধী মন্ত্র যন্তরমন্তর মেশিনে দিয়ে হীরক রাজারই মগজ ধোলাই করা হয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় রাজার মূর্তি উদ্বোধনের দিনে অন্যান্য প্রজাদের সঙ্গে রাজাও স্লোগান দিতে থাকে, “দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান”। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোষাগার লুঠ করার সময় যে বাঘটি কোষাগার পাহারা দিচ্ছিল, সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সেই বাঘটি আসল ছিল। 

গুপী বাঘার চরিত্রে তপেন চ্যাটার্জী ও রবি ঘোষ, হীরক রাজার চরিত্রে উৎপল দত্ত, বিজ্ঞানীর চরিত্রে সন্তোষ দত্ত ও উদয়ন পন্ডিতের চরিত্রে সৌমিত্র চ্যাটার্জী অভিনয় করেন। সমগ্র সিনেমাটি পরিচালনা করেন সত্যজিৎ রায়। এই চলচ্চিত্রের প্রত্যেকটি গানের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন সত্যজিৎ রায়। 

১৯৮০ সালে এই চলচ্চিত্রে সেরা প্লেব্যাক গায়কের জন্য অনুপ ঘোষাল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। সেরা সংগীত পরিচালনা এবং শ্রেষ্ঠ বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সত্যজিৎ রায়। 

এই চলচ্চিত্রে মোট বারোটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। শিল্পী অমর পালের গাওয়া “কতোই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়” ছাড়া বাদবাকি সমস্ত গান অনুপ ঘোষালের গাওয়া। তাঁর গাওয়া গানগুলি হল, “মোরা দু’জনায় রাজার জামাই”, “আর বিলম্ব নয়”, “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”, “আহা সাগরে দেখো ছায়ে”, “এ যে দৃষ্টি দেখি অন্য”, “এবারে দেখো গর্বিত বীর”, “এসে হীরক দেশে”, “ধরো নাকো সান্ত্রী মশাই”, “পায়ে পড়ি বাঘ মামা”, “নহি যন্ত্র” এবং “মোরা গুপী বাঘা দু’জন ভায়েরা ভাই”। এই গানগুলি বাংলা চলচ্চিত্রের চিরকালীন সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *