সৌমিতা রায় চৌধুরী

পর্ব – ১৬

মানুষের কর্মফল অনুযায়ী মৃত্যুর পর যমলোকে নিয়ে গিয়ে স্বর্গ বা নরকে থাকার বিচার হয়। কর্মফল ভাল হলে স্বর্গ এবং কর্মফল খারাপ হলে নরকে স্থান পায়। এই বিষয়বস্তু নিয়ে দীনবন্ধু মিত্রের উপন্যাস ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ অবলম্বনে প্রণয়ধর্মী একটি হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন প্রফুল্ল চক্রবর্তী। চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অন্যতম সদস্য অনন্ত শীল। রাজকুমারী চিত্র মন্দিরের ব্যানারে এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। 

‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ একটি গভীর প্রণয় ভিত্তিক এবং রূপকের আড়ালে চরম আর্থ সামাজিক সমালোচনামূলক চলচ্চিত্র। গ্রামের ছেলে সিদ্ধেশ্বর ওই গ্রামেরই মেয়ে মাধুরীকে প্রকৃতই ভালবাসে এবং তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। কিন্তু মাধুরী গ্রামের গ্রামপ্রধান বড়লোক হরির একমাত্র মেয়ে। জামাই হিসেবে সিদ্ধেশ্বরকে তার একদমই পছন্দ নয়। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরও মাধুরীকেই বিয়ে করতে বদ্ধপরিকর। প্রয়োজনে সে মাধুরীকে তুলে এনে বিয়ে করতেও পিছপা নয়। এই ঘটনা জানতে পেরে হরি কিছু লোক পাঠায় সিদ্ধেশ্বরকে মেরে ফেলার জন্য। এই ঘটনায় মাধুরী হতবাক হয়ে যায় এবং সে নিজে আত্মহত্যা করে। 

সিদ্ধেশ্বরকে মারতে এলেও সে কোনোভাবে রক্ষা পায় এবং মাধুরীর আত্মহত্যার খবরে বিচলিত হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে যমের পাঠানো দূতেরা মৃতদেহ নিতে এসে ভুল করে সিদ্ধেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায় এবং যমলোকে উপস্থিত করে। সিদ্ধেশ্বরকে যেহেতু জীবিত যমলোকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যমরাজ সিদ্ধেশ্বরকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু সিদ্ধেশ্বরও নাছোড়। সে যখন এমন একটা জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে তার মনের সুপ্ত বাসনা সে মাধুরীর সাথে দেখা করবে এবং তাকে নিয়েই পৃথিবীতে ফিরবে। এছাড়াও বিষ্ণুর সাথে দেখা করার বাসনা মনে মনে পোষণ করে। 

যমালয়ে গিয়ে সে নরক ও স্বর্গের মধ্যে বিপ্লব ঘটাতে শুরু করে। তার মৃত ষাঁড় ভোলা যা সে তার পিসিমাকে দান করেছিল সেই ষাঁড় দানের পূণ্য বলে ওই ষাঁড়কে যমরাজ ও চিত্রগুপ্তকে যমলোক থেকে বিতাড়িত করার কাজে লাগায়। সিদ্ধেশ্বর নিজে স্বর্গলোক ভ্রমণের অনুমতি লাভ করে এবং এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে মাধুরীর দেখা পায়। মাধুরী স্বর্গলোকে উর্বশী, রম্ভাদের সঙ্গে দিনযাপন করছিল। 

স্বর্গ এবং নরকের বিভিন্ন নিয়মকানুন সিদ্ধেশ্বরের পছন্দ হয়নি। বিষ্ণুলোকে গিয়ে সে প্রত্যেকটি অনৈতিক কাজের বিবরণ জানায় এবং স্বর্গ ও নরকের নিয়মাবলীতে বদল আনার জন্য সচেষ্ট হয়। যেমন নরকে চিত্রগুপ্তের খাতায় অকাল মৃত্যু নিবারণের ব্যবস্থায় জোর দেয় আবার চিত্রগুপ্ত ও বিচিত্রগুপ্তের হাজার হাজার বছরের চাকরিতে পাকাপাকিভাবে বহাল করার ব্যবস্থা করে। স্বর্গে উর্বশী, রম্ভা, অপ্সরাদের একই ক্লাসিক্যাল নাচের পরিবর্তে নিজস্ব শৈলীর “হাম হাম গুড়ি গুড়ি”  নাচকে স্বর্গমঞ্চে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করে। এই ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতি চলচ্চিত্রটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। শ্রীহরি বিষ্ণুর আশীর্বাদে সিদ্ধেশ্বর ও মাধুরী ফিরে আসে এবং মাধুরীর বাবা হরি তাদের আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। 

‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ চলচ্চিত্রটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ভানু বন্দোপাধ্যায়। সিদ্ধেশ্বর চরিত্রে একজন প্রকৃত প্রেমিক যুবকের প্রেমকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিয়ের বাসনা এবং প্রেমিকার মৃত্যুর পরে প্রতীকী অর্থে স্বর্গের দেবতাদের সঙ্গেও তর্কযুদ্ধে জড়িয়ে প্রেমিকাকে ফিরিয়ে আনার ঘটনা এক অনবদ্য চিত্রনাট্য সৃষ্টি করেছে। হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজ, অর্থনীতি এবং যৌবনের টানাপোড়েন নিখুঁত ভঙ্গিতে চিত্রিত হয়েছে। 

মাধুরী চরিত্রে বাসবী নন্দী দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। যমরাজ চরিত্রে কমল মিত্র নিজের অভিনয় ক্ষমতাকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করেছেন। বিচিত্রগুপ্ত চরিত্রে জহর রায় নিজের কমেডিয়ান চরিত্রকে দারুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নারদ চরিত্রে পাহাড়ি সান্যালকেও কমেডিয়ান চরিত্র হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় এই চলচ্চিত্রে। এছাড়া তুলসী চক্রবর্তী, হরিধন মুখার্জী, শ্যাম লাহা, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, জীবেন বোস, অজিত চ্যাটার্জী, অপর্না দেবী প্রমুখ বিভিন্ন পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *