সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ১৩
শিবরাম চক্রবর্তীর একটি উপন্যাস ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ অবলম্বনে পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ১৯৫৮ সালে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই ছবিতে প্রধান ভূমিকায় রয়েছে একটি শিশু চরিত্র। শিশুর ভূমিকায় অভিনয় করেন পরমভট্টারক লাহিড়ী। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, কেষ্ট মুখোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, শ্রীমান দীপক, শৈলেন ঘোষ, কৃষ্ণা জায়া, নীতি পণ্ডিত, পদ্মাদেবী ও জহর রায়। একশো সতেরো মিনিটের এই চলচ্চিত্রটির সুরকার ছিলেন সলিল চৌধুরী।
কাঞ্চন নামের একটি আট বছরের ছেলে গ্রামের বাড়িতে সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে বেড়ায়। মা কিছুটা প্রশ্রয় দিলেও বাবা কাঞ্চনের এই দুষ্টুমির শাস্তি স্বরূপ কঠোর দণ্ড দেন। মাঝেমাঝেই তাকে গৃহবন্দি করে রাখেন। কাঞ্চন বাবাকে একজন নিষ্ঠুর দৈত্য বলে মনে করে। সে মনে মনে কলকাতা মহানগরীর একটি ছবি কল্পনা করে, যা তার কাছে রূপকথার রাজ্য এল ডোরেডো। কাঞ্চনের আবেগপ্রবণ মন ও বাবার শাসন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সে একদিন ক্ষোভে, অভিমানে তার স্বপ্নের এল ডোরেডো রাজ্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

কোনক্রমে কাঞ্চন কলকাতায় পৌঁছে বিশাল অট্টালিকা, দোকান, বাজার, সেতু, শহুরে জাকজমক দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায়। কিন্তু এত বড় শহরে তাকে বাবার মত শাসন করারও কেউ ছিল না। সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারত। আবার মায়ের মত আদর করে খেতে ডাকারও কেউ ছিল না। গ্রাম্য ছেলেটির সঙ্গে শহুরে উচ্চবিত্ত মানুষের কোনরকম যোগাযোগের সুযোগও ছিল না। তাই শহরের প্রান্তিক মানুষদের সাথেই তার পরিচয় ঘটে, যাদের তার মত গ্রামের বাড়িটাও নেই।
দেশ ভাগের সময় ওপার বাংলা থেকে ঘরবাড়ি, জমিজমা এমনকি দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারের মানুষজনকে পর্যন্ত হারিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে কলকাতা শহরে অনেক মানুষ জীবনযাপন করছে। কাঞ্চনের আলাপ হয় বহুরূপী হরিদাসের সাথে যে মুখোশ পরে বুলবুল ভাজা বেচে। এছাড়া ফুটপাতের জাদুকর, ভবঘুরে বাউল, চোর ব্যবসায়ী এবং ছোট্ট মেয়ে মিনি এবং তার পরিবারের সাথে। মিনি ও তার পরিবার কাঞ্চনকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। কাঞ্চনের স্বপ্নের ডোরেডোকে সে চেনে একটি আজব নগরী রূপে।
এদিকে গ্রামের বাড়িতে কাঞ্চনের মা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার বাবা ছেলের হারিয়ে যাওয়ার বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন। ফলে শহরে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।
যে শিশুসুলভ রঙিন স্বপ্ন নিয়ে সে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল সেই স্বপ্ন পুরোপুরি চুরমার হয়ে যায়। এই সময় কাঞ্চন আবেগময় স্বপ্নের জগত ছাড়িয়ে বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে উপলব্ধি করে তার গ্রামের বাড়ি, বাবা মায়ের সুরক্ষা বলয় অনেক ভাল। সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে চায়। বুঝতে পারে তার বাবা কোনো দৈত্য নন বরং দারিদ্রের সাথে সংগ্রামরত এক স্নেহময় পিতা।
কাঞ্চনের কলকাতা ভ্রমণ মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই তাকে আবেগপ্রবণ শৈশব থেকে পরিপক্ক মানুষে পরিণত করে। খবরের কাগজের বিজ্ঞপনে মায়ের অসুস্থতার খবর জেনে কাঞ্চন বাড়ি ফিরতে উদ্যোগী হয়। বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় হরিদাসের কাছ থেকে একটি মুখোশ উপহার পায় সে।
শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসে শিশুমন এবং বাস্তবতার কাহিনী বিন্যাস দারুন ভাবে ঘটিয়েছেন লেখক। ঋত্বিক ঘটক তাঁর সিনেমায় পুরো বিষয়বস্তু একটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। একের পর এক ঘটনা নিখুঁত দৃশ্য নির্মাণে দর্শককে টানটান কৌতূহলে বেঁধে রাখে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)