অলোকপর্ণা
অনেকদিন ধরেই খুঁজছে, আজ পেয়ে গেল সুবর্ণ– সাদাকালো নির্মম লোক। খবর এনেছিল জ্যোৎস্না, লোকটা কুকুরের সঙ্গে মারামারি করে খাবার খায়, শিয়ালের সঙ্গে বাজি লড়ে আর হায়নার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোয়, সকাল হলে নেকড়ের বুক থেকে দুধ চুরি করে বিক্রি করে দেয় সব মমত্ব স্থানীয় বাজারে। ভোরবেলা তাই সুবর্ণ বাজারে এসে লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। নির্মম লোক তার বড়ই প্রয়োজন। কারণ তার কাছে কাজ আছে, কাজ যা কেবল এক নির্মম মানুষই করতে পারে।
নির্মমতা সে দেখেছে অনেকখানে, মানুষ মানুষকে কষ্ট দেয় অহেতুক, মজার ছলে, সর্বোপরি লোভের বশে মানুষ মানুষকে নিয়ে, পশুকে নিয়ে, পাখিকে নিয়ে খেলা করে, তার মনে পড়েছে সেই শিম্পাঞ্জি মেয়ের কথা যাকে বন্দী করে বছরের পর বছর ধরে ধর্ষণ করা হত এই পৃথিবীরই এককোণে। অনেকে মাইলের পর মাইল বন ধুয়ে মুছে সাফ করে কারখানা বানিয়েছে, অনেকে সুনীল সাগরে ছড়িয়েছে পেট্রল, মাছেরা গলায় প্লাস্টিক জড়িয়ে মরেছে– পৃথিবীতে এমনও হয়েছে।
সাদাকালো মাছের বাজারে দাঁড়িয়ে সুবর্ণ অপেক্ষা করতে থাকে লোকটার জন্য। মাছের গন্ধ যুবক হয়ে ওঠে, বিড়ালেরা, কাকেরা ঘোরাফেরা করে দালালের চোখ নিয়ে। সুবর্ণ দেখতে পাচ্ছে লোকটাকে, সে মাছের কানকো কেটে পিত্ত বের করে আনছে। আঁশ ছাড়িয়ে কেটে ফেলছে মাছের পিচ্ছিল দেহ। ভিড় গলে তরল হলে সুবর্ণ লোকটার সামনে এসে দাঁড়ায়। লোকটার ভ্রূক্ষেপ নেই।
“জ্যোৎস্না আমায় পাঠিয়েছে তোমার কাছে।”
লোকটা মুখ তুলে চায়।
বাচ্চাদের সাদাকালো পার্কের বেঞ্চে বসে লোকটা একটা বিড়ি ধরিয়ে সুবর্ণকে এগিয়ে দিল।
ইতস্তত সুবর্ণ বিড়িতে এক টান মেরে বলল, “কাজটা কঠিন নয়, কিন্তু বেশি ভাবা চলবে না।”
লোকটা বোবা হয়ে আছে।
সুবর্ণ বলে চলে, “আমি প্রথমে যার কাছে গেছিলাম, সে শোনার পর আমার তাড়িয়ে দিয়েছিল, দ্বিতীয় জন আমার দিকে এমন ঘৃণা ভরে তাকালো যে আর কথা এগলো না, তৃতীয় জন পাত্তা দিল না আমায়, চতুর্থ জন বলল তার পেটের সমস্যা চলছে, পঞ্চম জন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় করে দিল, ষষ্ঠজনকে আমি নিজেই হাত পা বেঁধে নিয়ে এসেছিলাম আমার কাছে, সে ভয়েই আধমরা, তাকে কাজের কথা খুলে বলার পর হার্ট ফেল করে মরে গেল, অনেক ঝামেলা পোহাতে হল আমায় সেই নিয়ে। আর সপ্তম জন হলে তুমি।”
“কাকে মারতে হবে?”
লোকটা বুদ্ধিমান,- সুবর্ণ মনে মনে খুশি হয়, আশায় বুক বাঁধে, পকেট থেকে একটা সাদাকালো ছবি বের করে লোকটার মুখের সামনে ধরে।
লোকটা একবার ছবির দিকে, একবার সুবর্ণর মুখের দিকে চায়। ভাবলেশহীন।
সুবর্ণর মুখে হাল্কা হাসি ফুটে ওঠে। সে বলে, “এখন এই কটা টাকা দিচ্ছি, কাজ হয়ে গেলে জ্যোৎস্না বাকিটা তোমায় দিয়ে দেবে।”
দুলালের হাতে এক তাড়া নোট তুলে দেয় সে।
সুবর্ণর যমজ ভাইকে হত্যা করার জন্য দুলাল তৈরি হতে থাকে। প্রথমে সে সাদাকালো চার নম্বর ঝিলপাড়ে দিনরাত পড়ে থাকে। সেখানে মাছ ধরতে আসা শৌখিন সাদাকালো জেলেদের সঙ্গে কথা বলে। তারপর আশেপাশের বাড়ির ছাদে কখন কখন কাপড় মেলতে আসে সাদাকালো মেয়ে বউ বুড়ো বাচ্চারা সেসব নজরে রাখে। এরপর লোকটা ওঁত পাতে চারনম্বর ঝিলপাড়ের চারপাশের সাদাকালো রাস্তায়। কখন সেসব পথ বিজন হয়ে ওঠে– সে জেনে নেয়। এরপর সে রাতে, গভীর রাতে একটা টেলিস্কোপে দেখে নেয় সাদাকালো নক্ষত্র- ছায়াপথের গতিবিধি। তারপর পঞ্জিকা খুলে কোন তিথিতে শুভকাজ সম্পন্ন করতে হবে সে বুঝে নেয়। এসব তথ্য জোগাড় হয়ে গেলে কালো লোকটা ধার দিতে থাকে তার সাদা ভোজালিতে। লোকটা ধার দিয়েই চলে, দিয়েই চলে, যতক্ষণ না ধার লেগে ভোজালি আর লোকটা এক হয়ে ওঠে, ততক্ষণ।
পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম মানুষটা নিজেই অস্ত্র। সে শহরের পর শহর ধ্বংস করেছে, সে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে শিশু হাসপাতালের উপর, সে বছরের পর বছর অর্থের বিনিময়ে নিজেকে শান দিয়েছে, ভেদ করে ঢুকে গেছে অপর মানুষের পেটে, ঘিলুতে, হৃদয়ে। অথবা লালসায় সে বুক দিয়ে ঢুকে শিকারের পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে অপর পৃথিবীতে। দুলাল ভোজালি হয়ে ওঠে এক সন্ধ্যেবেলা।
জ্যোৎস্না আসে সুবর্ণর বাড়ি। এসে গ্যাস ধরায়, ভাত চাপায়, আনাজ কাটে, রুটি বেলে, প্রশ্ন করে, “কাজ হলো?”
- “কাজ হবে।” হৃষ্ট চিত্তে জবাব দেয় সুবর্ণ।
একথা বলে একার পৃথিবীতে ফিরে যায় সে। ওখানে কোনো নির্মমতা নেই, এটাই ওখানকার নির্মমতা। সুবর্ণ নিজেকে ধূর্ত হতে দেখে, নিজেকে তঞ্চক হতে দেখে, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম মানুষ সুবর্ণ পিতৃপরিচয়হীন, মাতৃপরিচয়হীন, কেবল মানুষ পরিচয়ে বেঁচে থাকে।
দুলালের চোখের সামনে সুবর্ণর যমজ ভাই চার নম্বর ঝিলপাড়ে এসে জামা, প্যান্ট একে একে খুলে ফেলে দেয় জলে ঝাঁপ। মিনিট কুড়ি সাঁতরে সে ডাঙায় উঠে আসে যখন তার সারাগায়ে রোদ পড়ে আঁশ চকচক করে। দুলালের ইচ্ছে হয় সুবর্ণর যমজ ভাইয়ের কানকো কেটে পিত্ত বের করে আনতে। সে সুবর্ণর ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ছেলেটা দু হাত জড়ো করে চোখ বুজে দাঁড়ায় দুলালের সামনে, যেন দুলাল দেবতা, আর সে দুলালকে প্রার্থনা করছে একমনে– মুখে তার এখন সন্তুষ্টির হাসি। দুলাল ভোজালি বের করে সুবর্ণর যমজ ভাইয়ের পেট ফুঁড়ে ঢুকে যায় তার অন্তরে। আর বেরিয়ে আসে রক্ত হয়ে, ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক।
লাশ চার নম্বর ঝিলে ফেলে দিয়ে দুলাল ফিরে যায়। জ্যোৎস্না বকেয়া টাকা নিয়ে সাদাকালো দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
দুলালরা জানে পৃথিবীতে ইতিপূর্বে মানুষ অসংখ্য মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে দরজা, নিজের চর্বিতে মানুষ নিজে দগ্ধ হয়েছে। জ্ঞানত মানুষ অন্যকে অনাহারে রেখেছে মাসের পর মাস। ইচ্ছের বশে সে পাচার করেছে অপর মানুষকে। জন্মের আগেই মানুষ নিজেকে জন্মাতে দেয়নি, ছিন্ন করে এনেছে সে নিজেকে মায়ের গর্ভ থেকে। সে চক্র নিক্ষেপ করে কেটেছে নিজের গলা, সে সহস্র সূর্য ঢেলে গলিয়ে ফেলেছে নগর, বিষ ঢেলেছে সে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে। বাতাসে এখন কেবল গরলের ঘ্রাণ।
“জমিজমার ব্যাপার না কি? পৈত্রিক সম্পত্তি?” জ্যোৎস্নার থেকে বাকি টাকা রপ্ত করতে করতে প্রশ্ন করে দুলাল।
“না, জমিজমা নেই কোনো, উনি অনেক দিন ধরেই লোক খুঁজছিলেন, আমি ভাবলাম তোমায় বলি।”
“তবে বিবাদ কী নিয়ে?”
“কীসের বিবাদ?”
“নিজের ভাইকে কেউ এমনি এমনি খতম করতে চায়?”
“কার ভাই?”
“যার বাড়ি রান্না করো তুমি…”
“দাদাবাবুর তো কোনো ভাই নেই…”
“যমজ ভাই, নেই?”
“না…”
“এই দেখো ছবি–” দুলাল বুক পকেট থেকে সুবর্ণর দেওয়া ছবি বের করে জ্যোৎস্নাকে দেখায়।
“এটা তো গতবছর লক্ষ্মীপুজোয় তোলা! ওনার তো কেউ নেই তিনকুলে, তাই আমিই তুলে দিয়েছিলাম…” জ্যোৎস্না একথা বলেই শিউরে ওঠে, “দুলাল দা, তুমি কাকে মারলে!”
দুরাত পর যখন চাঁদ তুঙ্গে আর কালো জলের উপর তার সাদা ছায়া টালমাটাল, পৃথিবীর নির্মমতম মানুষের দেহ তখন চার নম্বর ঝিলে ভেসে ওঠে। তার সাদাকালো ভেজা স্ফিত দেহে জ্যোৎস্না লুটোপুটি খায়। এ দৃশ্যেও সৌন্দর্য বোধ করার মত অঢেল চোখ ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন।