স্বপ্ননীল
তার কপালের টিপটি যেন ভালোবাসার আকাশ নিয়ে বসে আছে।
জানতে চাইলাম কী রঙ টিপটির? সে বললো খয়েরী।
খয়েরীতে তোমায় বেশ লাগছে কিন্তু।তবে কি জানো আমাদের পাড়ায় খয়েরী রঙের টিপ পরা একটি মেয়ে ছিল।ঠিক তোমার মতই।খুব সুন্দর।বিয়ের প্রথম প্রথমও সে খয়েরী পরতো।দেখলে মনে হয়না ভেতরে একটা চাপা কান্না আছে তার।সবাই জানত তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির নাড়ী নক্ষত্র ঠিকুজী।তাই মাড়ায়না ওপথে কেউ।তবে বরটি ভালো।কিন্তু একবছর হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্টে বরটা মারা গেল,আর কপাল খসল মেয়েটার।ধীরে ধীরে তার কপাল থেকে খয়েরী টিপটা চলে গেল।শুধু কপালটাই খয়েরী লাগে এখন।
তাই বলছিলাম লাল হয় না?লাল রঙে কপালটা খুব চকচক করে।যেন ভরা ভরা আকাশ।
শুনে মেয়েটি বলল,আমাদের পাশের গ্রামের একটি মেয়ে ছিল। সে যখন লাল টিপ পরে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেত আমাদের বারান্দাটা পুরো আলো হয়ে উঠতো।যেন চৈত্রের শেষ বিকেল। মো মো হয়ে উঠতো পলাশ। চোখের কোনা দুটো যেন গভীর হয়ে উঠতো ডোবা সূর্যে। ভরা ভরা বসন্ত। কিন্তু একদিন মোড়ের চারটি ছেলে মিলে ছিঁড়ে তছনছ করে দিল ওর ভেতরের পলাশটা। সূর্যটা সেই থেকে আর লাল হয়ে ফোটেনি!
শুনে মন খারাপ হল লোকটির। বলল- যদি বেগুনি হয়?
মেয়েটি বলল, বেগুনি রঙের শাড়িটি সেই মেয়েটিরও খুব প্রিয় ছিল। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলায় যেদিন সে ফিরে আসবে ওবাড়ি,বেগুনি শাড়িতে সেজেছিল মেয়েটা। গলায় চকচকে সোনার হার। কানে দুল। হাতে গাছা চুড়ি। বেরিয়ে পড়ল বরের বাইকে বসে। ঝাঁ চকচকে রাস্তা পেরিয়ে খুব খুশি নিয়ে ফিরছিল। কিন্তু সে জানত না সেটা তার শেষ ফেরা।
বেগুনি শাড়িটি তার গলার পোঁচ হয়ে এল তার বর আর বরের প্রাক্তন প্রেমিকার সুকৌশলে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- যদি নীল হয়?
বলল,সেই মেয়েটারও খুব প্রিয় রঙ ছিল নীল। সেদিন আকাশটাও খুব নীল ছিল। মনও উদাস ছিল। তার একফোনে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। একটা লেকের ধারে গিয়ে বসল ওরা। কথা হল অনেক। দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এল ওদের মাঝে। তারপর আরো অন্ধকার.. হয়তো মেয়েটা নিজের সীমাটিকেও ভেঙে ফেলেছিল সেদিন। তারপর, পরদিন সকালে তার লাসটি সেই নীল আকাশের নিচে পড়ে থাকল কেবল। ছেলেটি বেপাত্তা।
একটা চাপা বেদনা নিয়ে লোকটি বলল- যদি গোধুলী হয়?
গোধুলী রঙের টিপটি পরে যেই তার পাশে বসলো মেয়েটি,অমনি যেন ভয়ে লজ্জায় দুরুদুরু কেঁপে উঠেছিল বুক। ছেলেটি কাছে এল। খুব কাছাকাছি। ওড়নাটা ছেয়ে দিল মাথায়। কী রূপ! যেন দেবীর মতো। অন্য দেবী। হাতে অস্ত্র নেই। চোখে আগুন আছে অথচ প্রতিশোধ নেই। আছে হৃদয়ের ভালোবাসা। কিন্তু সেই গোধুলী রঙটিও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হতে শুরু করল। ভোররাতের আকাশটা ম্লান হয়ে উঠেছিল সেদিন। পাড়ার লোকেরা পরদিন দেখল তার গোধুলী রঙের টুকটুকে কপালে অজস্র ভোজালির দাগ!
এখন আমার খয়েরীটিই লাগে বেশ। খয়েরীতে কোন পুরুষ নেই। কোন সমাজ নেই।
খয়েরী নিজেই নিজের। বেঁচে থাকার লড়াই আছে। মর্যাদা আছে। জীবন আছে।
যে মেয়েটির কপালটা খয়েরী হয়ে গেছে তাকে বলবেন, এখন থেকে একটা খয়েরী টিপ পরতে।
খয়েরীর একটা আগুন আছে। আত্মমর্যাদার আগুন। সে হয়তো খুব লাল নয়। কিন্তু মরা মাঠের মতো সৌখিন। পিটা রোদের মতো উজ্জ্বল। ধুলোর মতো চুরমার।
.
চুরমার ধুলোয় কপাল আবিরের মতো লাগে। দশমীর দূর্গা ঠাকুরের মতো।মহিষাসুরমর্দিনী।
.
তাকে বলবেন বেগুনি, লালা, কিংবা নীল রংগুলি এখন থেকে সে যেন খয়েরী রঙে বদলে নিতে শিখে নেয়।