শিশির আজম

গদারের আত্মজীবনী না নন্দনতত্ত্বের টেবিলে বিষ্ঠা

ফরাসি নিউ ওয়েভের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড গদারের শেষ সিনেমা The Image Book (Le Livre d Image) কি আসলেই সিনেমা? গদার নিজে কি এটাকে সিনেমা মনে করেন, না দর্শন ও শিল্পের গবেষণাগার? প্রচলিত যে চলচ্চিত্র কাঠামোর সঙ্গে আমরা পরিচিত তার কোন ছকেই একে ফেলা যাবে না। হতে পারে এটা আত্মজীবনী অথবা ওর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের এক দার্শনিক সারাৎসার? তার প্রথম চলচ্চিত্র Breathless (1960) থেকে শুরু করে  Contempt (1963), Pierrot Le Fou (1965), Weekend (1967) সহ সবগুলো কাজেই এই আলামত আমরা পেয়েছি। স্বীকার করা ভাল, গদারের প্রথম সিনেমা ‘ব্রেথলেস’ই ফরাসি সিনেমাকে নতুনভাবে দর্শকের সামনে দাঁড় করিয়েছে, বিশেষত জাম্প-কাটের সাহসী ব্যাবহারের কারণে। সেইসঙ্গে ফরাসি সিনেমার নতুন পথের কান্ডারি হিসেবে তার জায়গাও মজবুত হয়েছে। যে কারনে পরবর্তীতে সিনেমা করতে গিয়ে তাকে আর প্রযোজকের পেছনে ঘুরতে হয়নি। কেন না সিনেমা এমন এক শিল্পমাধ্যম যার সফলতার জন্য অনেকগুলো উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেকের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর্থিক পুঁজি এখানে বড় এক ফ্যাক্টর।

যা হোক, ‘দ্য ইমেজ বুক’ দেখতে গিয়ে বাঙালি চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র কথা দর্শকের চোখে ভেসে ওঠাটা স্বাভাবিক। কাকতালীয় হলেও সত্যি, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ঋত্বিকের শেষ ছবি। হ্যা, এই সিনেমায় ঋত্বিক নিজেকে দিয়ে পুরোটাই বলিয়ে নিয়েছেন, তার একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাষায়। আর্ট তো আমাদের আনন্দ দেয়। আমাদেরও তো উচিত আর্টের ভালমন্দ একটু দেখা, উৎসাহ দেওয়া, উশকানি দেওয়া। হাসিঠাট্টা-চড়থাপ্পড় মন্দ কি! কবি নিকানোর পাররা যেমন কবিতাকে মাউস্ট অলিম্পাস থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিলেন তেমনি গদার আর্টের গজদন্তমিনার থেকে সিনেমাকে নামিয়ে এনে বসিয়েছেন পাড়ার চায়ের দোকানে। সিনেমা মুক্তি পেয়েছে নন্দনতত্ত্বের বন্দিশালা থেকে। এতোদিন আমরা জানতে চেয়েছি কীভাবে সিনেমা হয়? এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারছি কীভাবে সিনেমা হয় না? ক্যামেরা তোমার হাতে। তুমি যা ইচ্ছে যখন ইচ্ছে দর্শককে দেখাও। এমন কি দর্শকের হাতেও ক্যামেরা ছেড়ে দিতে পারো। কাঁধে ক্যামেরা হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে শ্যুট করছো। ক্যামেরা কাঁপছে? কাঁপুক। ওটাই ফিল্ম। ঘরে পর্যাপ্ত আলো নেই। জানালা দিয়ে যেটুকু আসছে ওতেই সই! ওটাই ফিল্ম।  দর্শক এই জায়গাটাই এই দুই ছকভাঙা ফিল্মমায়েস্ত্রো মিলিয়ে নিতে চাইবেন হয় তো। ঋত্বিক ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ নির্মান করেন ১৯৭৭ সালে আর গদার The Image Book নির্মাণ করেন ২০১৮ সালে। আর এই দুজনের চলচ্চিত্রভাষা আপাদমস্তক আলাদা। তবে ঋত্বিক সুসমন্বিত কাহিনীর গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি। আর গদার গল্পকে পরিত্যাজ্য মনে করেছেন। গল্প বাদে চিত্র, শব্দ, কাট, নীরবতা — কোন কিছুতেই তার অনীহা নেই। গদার প্রশ্ন করেন, ক্রমাগত প্রশ্ন করেন, উত্তরের অপেক্ষা না করে। আর এই প্রবণতা কি ভয়ংকররূপে ছড়িয়ে পড়েছে ফিল্মপাড়ায় তা তারান্তিনো, স্করসেজি বা নোলানের মতো ফিল্মমাস্টারদের সাম্প্রতিক কাজ দেখলে সহজেই টের পাওয়া যাবে।  যা হোক গদার তার এই শেষ কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়েছেন, তার আপাত বিদ্ঘুটে চলচ্চিত্রকাঠামোসহ। একে সিনেমার প্রবন্ধ বলা যেতে পারে। এই সিনেমা যতটা না সাধারণ দর্শকের জন্য, তার চেয়ে বেশি নিরীক্ষাপ্রেমী পরিবর্তন-উম্মুখ, বোদ্ধা সাহসী দর্শকের জন্য। অজস্র কোলাজ আর প্রতিকৃতি দিয়ে ভর্তি এই সিনেমা। দর্শক দ্বিধায় পড়ে যাবেন, তারা কি চলচ্চিত্র না চিত্রকলা দেখছেন? জীবনের শেষাংশে অঁরি মাতিসের যে অজস্র কোলাজের কাজ তা যেন গদার তার দুর্বিনীত ক্যামেরা দিয়ে এঁকে চলেছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে, যথেষ্ট অপরিশীলিত প্রক্রিয়ায়। আর রঙের কম্পোজিশানে বাড়াবাড়ি রকমের বিচ্যূতি। এই বিচ্যূতি উপভোগ করেন গদার। যেন দর্শককে বিরক্ত করতে পারা বা ক্ষেপিয়ে তুলতে পারাটা তৃপ্তিজনক। কয়েকবার দেখা গেছে স্ক্রিন ঝিরঝির করে কাঁপছে। যেন ঝড় আসছে। যেন আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারের সবেধন নীলমনি টিভির সামনে আমরা হা করে বসে আছি। ওটা যথেষ্ট পুরোনো হয়ে গেছে। প্রায়ই বিগড়ে যায়। তখন ওটাকে ম্যাকানিকের  বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ওটা বদলিয়ে নতুন টিভি কেনার সামর্থ্য নেই আমাদের। পরিস্থিতিটা এমন। 

সিনেমার চিরাচরিত নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার ওপর বলা যায় বিষ্ঠা লেপে দেওয়া হয়েছে। কাহিনীর পারষ্পরিকতা নেই, বুনট অসংলগ্ন, আছে যথেচ্ছ হিংসাত্মক ক্র্যাক আর রাজনৈতিক-সামাজিক প্রোপাগান্ডা। তাহলে, এতো কিছুর পর শেষ অব্দি স্থাপত্যসুলভ এক ধরণের স্থৈর্য্য কি এই চলচ্চিত্রকাঠামোর ভিতর রয়ে গেল? কীভাবে এটা সম্ভব? অথবা একে কবিতা বলাই শ্রেয়। রাজনৈতিক কবিতা। কী নেই এই ছবিতে? বিভিন্ন মুভমেন্ট বা সংবাদ ফুটেজ, বিখ্যাত ব্যক্তির ফটোগ্রাফ, ভিঞ্চি বা গগাঁর পেইন্টিং  ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যা, ভ্যান গগের হলুদ রঙের বাড়িটিও যেন দেখতে পাই আমরা। এই সিনেমায় কাহিনীর ধারাবাহিকতা নেই। কাহিনীই নেই। আছে টুকরো টুকরো কোলাজ আর অজস্র বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি। আর রঙের কথা কী বলবো। রং নিয়ে রীতিমতো তাচ্ছিল্য করেছেন গদার। মানে সিনেমায় রং কতোটা বাজেভাবে ব্যবহার করা যায় তা এই সিনেমা না দেখলে বোদ্ধা দর্শকগণ অনুভব করতে পারতেন না! একক মানুষের জীবনও তো বাজে সব রঙের সমাহার, না কি! রং আর আলোছায়ার মুন্সিয়ানা তো বিশ্ব চলচ্চিত্রের দিকপালদের কাজে কম আমরা দেখিনি। গদার গোটা ব্যাপারটাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর্টের ওসব ক্লাসিক ফাংশনাল ব্যাপারগুলো থেকে নিজেকে সদম্ভে সরিয়ে নিয়েছেন। আর্টকে পারফেক্ট হবার দরকার নেই। পবিত্র হয়ে উঠবার প্রবণতা আর্টের এ্যাটিচুডের সঙ্গে যায় না। এই জায়গাটায় ঋত্বিক এসে যান।

রামকিঙ্কর বা অগুস্ত রোঁদা হাজির হন দর্শকের মনোজগতে। কীভাবে আর্ট বা সিনেমার মুখোমুখি সচরাচার আমরা দাঁড়াই? বিশেষত সিনেমা নিয়ে ট্রাডিশনাল এক ধরণের প্রতিমুর্তি তো গড় দর্শকের চেতনায় জারিত আছেই। এমন কি তথাকথিত বোদ্ধা দর্শকও চলচ্চিত্রের ফর্ম ও টেক্সচারের ধারাবাহিক বিবর্তনের বাইরে ভিন্নতর চলচ্চিত্রভাষাকে ন্যায্যতা দিতে দ্বিধান্বিত, বিব্রত, বিরক্ত। আর্টের বিষয়ে একটা কথা তথাকথিত নন্দনতাত্বিকদের কাছ থেকে শোনা যায়, আর্টে শ্লোগান থাকে না। অর্থাৎ শিল্প সরাসরি কিছু বলে না। শিল্পের কোন উদ্দেশ্য নেই। শিল্প চেঁচামেচি করে না, শ্ল্যাং বলে না। শিল্প নিষ্কলঙ্ক। কিন্তু এই মাস্টারদেরকে দৃঢ়চেতা,  সাহসী ও নিবেদিত শিল্পীরা কখনো মেনেছে? ‘বালজাক’কে রঁদা বেঢপ আকৃতিতে তৈরি করেননি, তৎকালীন প্যারির রুচির গালে থাপ্পড় মেরে? ব্রেখট তার মঞ্চকে বুর্জোয়ার ভাগাড় বানিয়ে ফেলেননি? আর বাংলার সুবিমল মিশ্র? ওর গল্প তো মাতিসের কোলাজ, সিনেসাপ্তাহিকে জনপ্রিয় নায়িকার অর্ধনগ্ন শরীর আর দিনদুপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত যুবকের তাজা লাশের সহনশীল টেক্সচার। ব্রেখট যেমন বলেন, মঞ্চে আমার চরিত্ররা আরও বেশি শ্ল্যাং বলতে চায়, আয়ত্ব করতে চায়, হয়ে উঠতে চায় আরও আরও আরও বেপরোয়া। শিল্পকে থোড়াই কেয়ার করে ব্রেখট চেয়েছেন মঞ্চের উচ্ছেদ। দর্শক আর আর্টিস্টের মধ্যে কোন দেয়াল থাকবে না। ভারতবর্ষে এটা পেরেছেন বিজন ভট্টাচার্য –গিরিশ ঘোষ, শিশির ভাদুড়ী, শম্বু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্তের উত্তরসুরী হয়ে, ‘নবান্ন’ নাটকের মাধ্যমে। হ্যা, গদার কয়েকটা ম্যাসেজ বেশ কড়াকড়িভাবেই দিয়েছেন এই সিনেমায়। যেমন আর্টের গতানুগতিক ফর্মের বিনাশ, টেক্সচারের নতুন উপাদান বা যা কিছু অছ্যূত-পরিত্যাক্ত তাকে অগ্রাধিকার। আরব সংস্কৃতির প্রতি পশ্চিমাদের উন্নাসিকতা। যেন আরব বলতেই বর্বর। ব্যাপারটা যে অতি সরলীকরণ আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা গোদার দেখিয়েছেন, তার নিজস্ব শিল্পভঙ্গিতে। বলা যায়, চলচ্চিত্রে গল্প বলার যে মোহ সেটা থেকে বেরিয়ে এসেছেন গদার। বরাবরই তার কাজে করণকৌশলের নিজস্বতা রয়েছে। রয়েছে অস্বীকারের প্রবণতা। দর্শকের জন্য এ বড় অস্বস্তি। আর এটা গদারের কাছে গ্রাহ্য করবার মতো কোন ব্যাপার না। গদার নিজেকে চলচ্চিত্রকার হিসেবে দেখতে চান না, চান না তার কাজ নিছক সিনেমা হয়ে উঠুক। সিনেমা না হয়ে উঠতে চাওয়াটাই যেন এর প্রতিজ্ঞা। এটা দর্শকের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *