শিশির আজম
The Seventh Seal (1957)
বায়োলোজিক্যাল স্ট্র্যাকচার ছাড়াও মানুষ এমন এক সত্তা যার খোঁজে কবি, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী সবাই হন্যে হয়েছেন। গ্রিক দার্শনিক বলছেন, Know Thyself আর কিয়ারোস্তামির এক চরিত্র (Test of Cherry) নিজের মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে স্বস্তিমতো একটা জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তেহরানের রাস্তায় রাস্তায়। বরাবর আমরা দেখেছি, কবি-শিল্পীরা মৃত্যুকে হয় মহিমান্বিত করছেন অথরা তাকে উপস্থাপন করছেন বিভৎসরূপে। কিন্তু মৃত্যু তো মৃত্যুই আর মানুষ শেষ অব্দি মানুষ। যা হোক ইঙ্গমার বার্গম্যানের The Seventh Seal মৃত্যু বিষয়ক কোন প্রতিবেদন আমাদের দেয় না। সাহসী মানুষেরা জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। গল্প-উপন্যাসেও এমনটা আমরা দেখি। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা তো এটাকে সমর্থন করেই, নারীবাদেও ওটাকে বড় পরিসরে আমরা দেখতে পাই। বার্গম্যানের এই চরিত্র কিন্তু জীবনকে না, মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। এটা আমাদের ভাবনার বৈচিত্রময় পরিসরে পূর্বে কখনও জায়গা পায়নি। জীবদ্দশায় বার্গম্যান নির্মাণ করেছেন ৪৯ টি চলচ্চিত্র যার মধ্যে ৪৫ টি ফিচার ফিল্ম আর ৪ টি ডকুমেন্টারি। এই বিপুল সৃষ্টির ফ্রেমিং ও লেন্সিংয়ে নিজেকে কখনও তিনি অস্বস্তিতে পড়তে দেননি। তাঁর দার্শনিক সত্তাকে নিজের মতো তিনি চলতে দিয়েছেন, গভীর জটিল সত্যের সঙ্গে অসততা করেননি। বলে নেওয়া ভাল, বাবা ধর্মজাজক হওয়ায় ছোটবেরা থেকেই ধর্মীয় আবহে বড় হয়েছেন বার্গম্যান। তাই ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রভাব তার চলচিত্রে লক্ষ্ণণীয়ভাবে অনুভব করা যায়। বার্গম্যান অবশ্য সামগ্রিকভাবে তার কাজকে আত্মজৈবনিক বলেই মনে করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে দেখা আর নিজের ইতি-নেতির ব্যাপারে নিজে বিচারকের আসন নেওয়া, এটা পরবর্তীতে ভর করেছিল তারকোভস্কি, কুরোসাওয়া বা কিয়ারোস্তামির কাজেও। বার্গম্যানের এই প্রভাবকে এরা অকুন্ঠচিত্তে স্বীকারও করেছেন। এদের এই খ্রীস্টীয় নৈতিকতা অবশ্য ঋত্বিক ঘটকের কাছে আদৌ ভাল লাগেনি। কেন ভাল লাগেনি সেই আলোচনায় গেলে যে আদর্শিক ও দার্শনিক পরিসরে সিনেমার এই মহাপরিচালকদের বিচরণ সেখানে অনেক দ্বন্দ্বসংঘাতে আমাদের জড়িয়ে পড়তে হবে। আমরা সেদিকে যাব না। তাহলে কি আমরা The Seventh Seal দেখার সময় খ্রিস্টিয়ো নৈতিকতায় নিজেদেরকে জারিত করে নেবো? না, এর দরকার হবে না। ভাটিক্যানের সিসটিন চ্যাপেলের নিচে দাঁড়িয়ে খ্রিস্টিয়ো নৈতিকতায় আমাদেরকে দীক্ষা নিতে হয় না। মাইকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর সামনে কোন শিল্পগ্রাহী নিজেকে ঈশ্বরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সেবক মনে করেন না। শিল্পই বরং ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে। সে ঈশ্বর অবশ্য মানুষের ভিতরই বাস করে। আসলে বার্গম্যান কি জীবন বা মৃত্যুকেন্দ্রিক কোন দার্শনিক পরিক্রমায় নেমেছেন? না। মৃত্যদূত যখন সমুদ্রতীরে লোকটার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটার ভিতর দ্বিধা বা ভীতি আমরা দেখতে পাইনি। বরং সে যেন মৃত্যুদূতকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে চায়। সে চায় মৃত্যুর আগে মৃত্যুদূত তার সঙ্গে দাবা খেলায় বসুক। সে জানে মৃত্যুদূত দাবাখেলা পছন্দ করে। তার সামর্থ্য থাকলে সে তাকে হারিয়ে দিক। এরপর সিনেমাটা যেভাবে এগোয় তাতে মানবসত্তার যে অজ্ঞেয় ল্যান্ডস্কেপ সেখানে আমরা প্রবেশ করি। আমাদের প্রচলিত যে জীবনবাস্তবতা সেটা থেকে আমরা নিজেদেরকে আলাদাভাবে উপলব্ধি করি। এটাকে বলা যেতে পারে নিজের দিকে ফিরে তাকানো। নিজেকে দেখা। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। এখন আপনারা বলতে পারেন এই কাজটা কে করেননি? এই খোঁজা বা বোঝাপড়া শ্রীচৈতন্য তার ভক্তিবাদে চারিয়ে দিয়েছেন। যদিও তা একসময যুক্তিহীনতার অকৃতিতে পানসে হয়ে গেছে তা। ভারতবর্ষে চার্বাকরা এই বোঝাপড়ার ক্ষেত্রটাকে অনেক বড় করতে পেরেছেন, স্থবির সমাজবাস্তবতায় ঢেউ তুলেছেন, আঘাত করেছেন। রেনেসাঁশিল্পীরা যে দেবতাদের দিক থেকে মানুষের দিকে ফিরতে পারলেন এটাও তো নিজের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারার কারণেই। রদাঁ যে ‘নরকের দরজা’ (১৮৮০-১৯১৭) আমাদের সামনে উম্মোচন করলেন সেখানে কি কেবলই অপরাধীদেরকে আমরা পাই? না, জগতের সব মানুষকেই আমরা দেখি। এমন কি সেখানে আমিও আছি। পূর্বে এমনটা দেখা যায়নি। সেভেন্থ সিলে বার্গম্যান এভাবে জীবন যাপনের বিভিন্ন প্রক্ষিতে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে চলেছে তার বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়া যে সব সময় ব্যাক্তির জন্য সুখকর-স্বস্তিকর-আরামদায়ক হবে এমনটাও তো না! ফ্রিদা কালো যেভাবে The Two Fridas আত্মপ্রতিকৃতিতে নিজের মুখোমুখি হয়েছেন, ব্যাপারটা তো একই। গ্রেকোরোমান ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যকর্মে মহত্ম আছে, জিজ্ঞাসা নেই। শিল্পীরা যে এতো এতো প্রতিকৃতি এঁকেছেন, এগুলো কেন? আর জিয়াকোমেত্তির কঙ্কালসার ফিগার? এসব হলো নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারা, আপন সত্তার মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস বা আকাঙ্ক্ষা। শিল্পীরা বরাবরই এটা করে এসেছেন। এঁকেছেন আত্মপ্রতিকৃতি। এমন কি এদের স্টিল লাইফগুলোতেও আপন আপন সত্তার অনুরণন-সংশ্লেষণ-বীজারণ। তারপর ধরো হোকুসাই (১৭৬০-১৮৪৯) যে মাউন্ট ফুজিকে ছত্রিশটি কোণ (Thirty Six Views of Mount Fuji / 1830-1832) থেকে দেখেছেন, সেটা কী? এই দেখার ভিতর কি জাপানি মনন নেই? নেই দ্রোহ, বিষাদ, হতাশা, পরাজয়? The Seventh Seal সিনেমায় এই আত্মজিজ্ঞাসা শুরু থেকে শেষ অব্দি জারি রয়েছে। আসলে এখানে বার্গম্যান জীবন বা মৃত্যুকে নিয়ে কাহিনী রচনা করেননি। একই মানুষের দুটি সত্তা। এদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া মানে মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখিন হওয়া। হ্যা, বার্গম্যানের সবগুলো সিনেমাতেই পাওয়া যায় এক ধরণের সুইডিশ নির্জনতা ও সান্ত্রিতিকতা। এর কেন্দ্রে আছে মানুষ। মানুষের ভিতরকার দ্বন্দ্ব-আহ্বান বরাবর ছুঁতে চেয়েছেন বার্গম্যান। আর এটা সেই কোথায়? Wild Strawberries (1957), The Virgin Spring (1960), Through a Glass Darkly (1961), Winter Light (1963), The Silence (1963), Persona (1966) সহ সবগুলো সিনেমায়ই আমরা দেখি বার্গম্যানের চরিত্ররা ওদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে উপস্থিত হয়। বার্গম্যানের ক্যামেরা আমাদেরকে দেখায় মানবিক অনুভূতির দ্বন্দ্ব-বিকাশ-বিচ্যূরণ। আর উনি যেহেতু মূলত নাটকের মানুষ (নিজের ব্যাপারে ওনার মূল্যায়ন এমনই। উনি বলতেন যে সিনেমা ওনার স্ত্রী আর নাটক ওনার প্রেমিকা।) তাই ব্যাক্তির ভেতরকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রতি উনার মনযোগী হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। দাবা খেলাটা কেবল উছলত। বলা যায়, মৃত্যুদূতের সামনে বার্গম্যান স্বাভাবিক একজন মানুষকেই উপস্থাপন করেছেন। মানুষের বেঁচে থাকা, সংগ্রাম, প্রেম, স্নেহমমতা, অপরাধপ্রবণতা সবকিছুই একজন মৃত্যুদূতের সামনে উঠে আসে। সবকিছুর সঙ্গেই সে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে পারে। হ্যা, মৃত্যুদূত আর মৃত্যুপথযাত্রী লোক কি আলাদা না একই ব্যাক্তি, দর্শকের মনে এই প্রশ্নও তো আসতে পারে এক সময়। এই খেলাটাই বার্গম্যান খেলেছেন তার দর্শকের সঙ্গে। এটাই তার নিজস্ব খেলা, নিজের সঙ্গে, একই সঙ্গে দর্শককে নিয়েও। তার খেলার ভিতর ফেলিনির নাটকীয়তা নেই, মৃণাল সেনের মার্কসীয় দ্বন্দ্ব নেই। তারকোভস্কির কাব্যময়তার স্ফূরণ কিছুটা আছে অবশ্যই, এটা না মেনে উপায় নেই। আর আছে সাদা-কালোয় ফরাসি ইম্প্রেশনিস্টদের মতো বস্তুকে দেখার, অনুভব করবার আলাদা চোখ। এটা আমরা ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি’তে দেখি, ‘পারছোনা’তেও দেখি। তবে এভাবে দেখতে গিয়ে বস্তুর সামগ্রিক সার্বভৌম অস্তিত্বকে বার্গম্যান কখনো অস্বীকার করেননি। বরং পিকাসো, ব্র্যাক বা আইনস্টাইনের সঙ্গে বার্গম্যান নিজেকে একাত্ম করতে পেরেছেন, বস্তুকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারার আলাদা চোখ নিয়েও। বার্গম্যানের সঙ্গে নরকের একটার পর একটা দরজা আমরা পার হই, সেজানের রেখা ও রঙের ঋজুতায়। কোথাও তুলি টলে যাবার আশঙ্কা নেই। শেষ অব্দি বার্গম্যান তার ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-য়ে এই রিদম ও ঋজুতা ধরে রাখতে কোন খামতি রাখেননি, সিনেমা প্রেমিদের জন্য এটা বাড়তি পাওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, বার্গম্যানের কাছে এই প্রত্যাশা খুব স্বাভাবিক।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine