অমিতরূপ চক্রবর্তী

এক একদিন আমার ভেতরে কী স্বচ্ছন্দে তুমি এসে কয়েকটি অবসরের দিন কাটিয়ে যাও। চারপাশে তখন তোমার নির্জন বাতাস ছাড়া কেউ নেই। দিনের আলো মিহি সুতোর মতো লেগে আছে হয়তো কোথাও, কোনো কড়ি-বরগায়। সন্ধ্যের পর এক হাঁটু জংগলের মতো অত্যন্ত জনহীন রাত। মূক আত্মার মতো কতগুলি জানালা দরজা, নকল ফুলের উত্তাপ। হয়তো কিছুদিন তুমি মুক্তির আনন্দে থাক, শিষ- দেওয়া পাখির মতো উড়ে বেড়াও। কেউ নেই নিকটে বা দূরে তোমার। শুধু অগাধ, অগাধ শূন্যতা। তোমার পায়ের শব্দে মুখর ঘর- বারান্দা। বাথরুমে তুমি নির্দ্বিধায় পোশাক সরিয়ে নগ্ন হতে পার। চোখ বন্ধ করে ভাবতে পার আহা, এই যে তোমার শরীরে আছড়ে পড়া ধারা, এ ধারা হয়তো নয়, সৌম্যকান্তি ঈশ্বরের সুধা। আর্দ্র স্তন ছুঁলে মনে হয় সবকিছু ফুরিয়ে যায়নি এখনো। এখনো অনেকটা পথ বাকি। রঙ বদলে হঠাৎ সাদা হয়ে যাওয়া সূর্যের দৃশ্য বাকি। গলার রগ যখন নিরবিচ্ছিন্নভাবে ভিজতে থাকে তোমার, সহসা সামনে এসে পড়া প্রকাণ্ড চাঁদের মতো পিঠে কোনোকালের কলঙ্ক ভিজতে থাকে তোমার, একটি আর্দ্র ঊরু অন্য আর্দ্র ঊরুটিকে খুব স্নিগ্ধভাবে স্পর্শ করে- তখন এমন মনে হয় তোমার। মনে হয় সেই কোথায় একটি ফেলে রেখে আসা কৌমার্যভরা নদীর জলশব্দ তুমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছ। শুনতে পাচ্ছ সেই কবেকার একটি ঝিম- লাগা দুপুরে পড়শি বাড়িতে কী নিয়ে যেন খুব বচসা বেঁধেছে 

অবশ্য একসময় এই দিনগুলি ফুরিয়ে যায়। ভোরের দূত জানালার ছিদ্র দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে বিছানার বদলে তুমি কৌচে পড়ে আছ। যেন- বা নিষ্প্রাণ তুমি। পোশাক সরে গিয়ে অনেকা বেরিয়ে পড়েছে তোমার কাঁসার মতো পা। মাথার কাছে দেওয়ালে একটি পোকা বসে আছে। তার পশ্চাতের রঙ আশ্চর্য নীল। বোঝা যায় প্রথমের সুরম্য দিনগুলি ফুরিয়ে গিয়ে সেইসব দিনগুলি শুরু হয়েছিল, যখন চারপাশের বাতাস আর নির্জন নয়। একদিন বারান্দা থেকে দূরের নীলিমা দেখতে দেখতে টের পেলে, এমন থমথমে মুক্তি তুমি কখনো চাওনি। এমন মূক আত্মার মতো জানালা দরজা চাওনি। চিনেমাটির পাত্রে এমন সুগন্ধি চা, এমন স্ফটিকের চেয়েও স্বচ্ছ চিনির স্তূপ চাওনি। এমন শান্ত, অক্ষত শরীরের ঘের চাওনি। তুমি টের পেলে খাদ্য, বস্ত্রের বিনিময়ে যে একটি ভোঁতা অনুভূতির মানুষ মুখ দিয়ে লালা- পড়া, প্রতিবন্ধী শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে তোমার শরীরে উঠত, ত্রিভুবন জয় করার মতো আনন্দে ভেসে যেত- সেই মানুষটি যেন অকস্মাৎ কোথাও, কোথাও নেই। তুমি তোমার বহুমূল্য হাত চোখের নীচে ধরে দেখ তাতে যেন কবে তোমার অলক্ষ্যে একটি মাকড়সা খুদে খুদে ঘরের জাল বুনে গেছে। কী ভেবে সহসা নিজের গালে হাত ছুঁইয়ে দেখ, সেখানেও তেমনই মাকড়সার জাল। পোশাকের আড়ালে এক ঊরু দিয়ে অন্য ঊরু ছুঁয়ে দেখ, মনে হয় যেন পাথরের সরীসৃপ এসে কবে তাদের খেয়ে চুপ করে আছে

সেইসব দিন আমার ভেতরে সব ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকে। বিছানার ঝুল লুটিয়ে থাকে মেঝেতে। এঁটো কাগজের গায়ে মাছি ওড়ে। বাথরুমে খুলে রাখা কল থেকে অকুণ্ঠ জল পড়ার শব্দ বুঝি- বা কনকনে পরপার থেকেও শোনা যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *