প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেড়াতে গিয়ে কংসাবতীর স্বচ্ছ জলের থেকে মা’কে উঠে আসতে দেখে সুচিতা খুব অবাক হয়েছিল। কোনো ভুল হচ্ছে না তো! অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। নাঃ- মা-ই তো! সেই মুক্তোর মতো দাঁত বার করা হাসি। একপিঠ এলো চুল। সিঁথিতে লাল সিঁদুর। কপালে গোল লাল টিপ। গোটা মুখ জুড়ে এক অদ্ভুত সারল্য। মা এসে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। অনেকদিন পর মা-মা গন্ধটা পেয়েই বিহ্বল হয়ে পড়ল। “তুমি আমায় ছেড়ে মাঝে মাঝে কেন চলে যাও মা?” অভিমানী সুচিতা মাকে জড়িয়ে ধরে বলে। মায়ের সেই ভূবন ভুলানো হাসি।
“যাইনা তো, তোর কাছেই থাকি।“
“ আমি যে দেখতে পাই না” ।
“তুই আনন্দে থাকলে আমায় দেখতে পাবি না মামণি, যখন দুঃখ তোকে গ্রাস করবে তখন আমি আসি।”
“আজ আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা মা, সুরজিৎকে এত করে বললাম আসতে ও গেস্ট হাউসে রয়ে গেল।”
“আমার সোনা মেয়ে, পাগলি মেয়ে”, সুচিতা চুপটি করে মায়ের আদর খেতে থাকে। কি প্রশান্তি! সমস্ত ক্লেদ ধুয়ে মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে কংসাবতীর জলের ঢেউয়ে। জলের ওপর পড়ছে পড়ন্ত সূর্যের আলো সেই আলো সুচিতার নরম হৃদয়কে ছুঁয়ে দিচ্ছে। সে আরও আবেগি হয় সোহাগী হয়, লোকে বলে মা নেই তাই বাপ সোহাগিনী। মা কি সত্যিই নেই! এই যে জলের থেকে উঠে মা তাকে আদর করছে এটা তবে কী ? এই যে মায়ের স্নেহ শীতল স্পর্শে গোটা শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে এটা তো এই মুহূর্তে চরম বাস্তব । তবে কেন সুরজিৎ এই বাস্তবতাকে স্বীকার করেনা ।
“তুমি কোথায় ?” সুরজিতের চিৎকারে সুচিতা সচকিত হয়। পিচ রাস্তা থেকে অনেকটা ঢালুপথ দিয়ে নেমে তবে কংসাবতীর কোলঘেঁষে বসা যায়। ওপরে ব্রিজ। তার উপর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। কিছুটা এগিয়ে কংসাবতী জলাধার । জায়গাটার নাম মুকুটমণিপুর । গেস্টহাউসে শুনেছে বিশ্বের বৃহত্তম জলাধার এই মুকুটমণিপুর । পাশেই একটা ছোট্ট পাহাড়, তার মাঝে সোনাঝুরির জঙ্গল । অনেকটা হেঁটে এসে কংসাবতী জলাধার দেখতে এসেছে ।
চেঁচিয়ে সুচিতা নিজের অবস্থান জানান দেয় । ওপর থেকে টর্চের আলো এসে পড়ে। আলোর বিন্দু এগিয়ে আসতে বুঝতে পারে সুরজিৎ নেমে আসছে । সুচিতার কোনো তাড়া নেই। ও জানে আর পাঁচটা সাধারণ অনুভূতি থেকে সে একটু অন্যরকম। সুরজিৎ এর ভাবনার সাথে ওর ভাবনা মেলে না। তাই বলে সুরজিৎ যে তাকে অবহেলা করে তা নয় । আবার সুরজিতের সংসারটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার পেছনে তার অবদান কম নয় । অর্ক যে আজ ভালো কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে তাও সুচিতার জন্য । ছোটবেলায় পড়িয়েছে, তাই মায়ের প্রতি ছেলের টানটা একটু বেশি।
“বালিশ বিছানা আর রাতের খাবারটা এখানে এনে দিই ?”
“ কি ভালো হয় গো, তুমি আমি দুজনে পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী হয়ে যাবো। ”
কথাটা বলেই সুচিতা বুঝতে পারে সুরজিৎ এর গলায় শ্লেষ এর সুর ছিল। ওটা সে বুঝতে পারেনি । সুচিতা উঠে পড়ে। টর্চের আলোয় পথ দেখে পা বাড়ায় । ছোট ছোট পাথরে পা দিয়ে উপরে আসতে হচ্ছে । নামার সময় দিনের আলো ছিল তাই সহজেই নামতে পেরেছিল । এখন অন্ধকার, তার ওপর এখন অল্পে হাঁপিয়ে যায়, বাঁদিকের বুকের নীচটা কেমন মাঝে মাঝে চিনচিন করে ওঠে।
সুচিতার খুব ইচ্ছা করছিলো সুরজিৎ ওর হাতটা ধরুক। জানে এটা হবার নয়। পাকা রাস্তায় উঠে কিছুটা দম নেয় সে। সুরজিৎ কিছুটা এগিয়ে যায়। “দাঁড়াও একটু সামলে নিই”। তার কথায় সুরজিৎ দাঁড়িয়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হলে চলতে শুরু করে। রাস্তার দু’পাশে একটা-দুটো দোকান। ওরা জেলা পরিষদের গেস্ট হাউসে উঠেছে। সুরোজিতের এখন বাঁকুড়ায় পোস্টিং। ওই বলেছিল দু দিনের ছুটিতে মুকুটমণিপুর বেড়িয়ে আসি । অফিস থেকে গেস্ট হাউস বুক করে দেয়। শীতের মরশুমে গেস্টহাউসগুলোতে ভিড় থাকে। এখন অফ সিজন। তাই এলাকাটা বেশ নির্জন। নির্জনতারও একটা ভাষা থাকে। সুচিতা সেটা উপভোগ করে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বাঁকুড়ার এই জঙ্গলমহল এলাকাটা ছিল মাওবাদীদের দখলে। এখন কিছুটা ভয় মুক্ত। তবুও স্থানীয়রা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বার হয় না বললেই চলে। শুধু যে মাওবাদীদের ভয় ছিল তা নয়, পুলিশ আর যৌথবাহিনীর ধরপাকড়ের ভয় ছিল। সেসব গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার মধু বলে ছেলেটার কাছে শুনেছে।
রাতে অনেকক্ষণ ঘুম এলো না। আজ আবার মাকে দেখতে পেয়ে সেই ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো মনে ভেসে ওঠে। মা যখন মারা গেল সুচিতা তখন সবে ক্লাস ফোর থেকে ফাইভ এ উঠেছে। মায়ের আদর, গল্প বলা, খাইয়ে দেওয়া, চুল বেঁধে দেওয়া এসব স্মৃতিগুলো রোজ মনে পড়তে লাগলো। বাবা স্নেহ দিয়ে মায়ের অভাব পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তবুও বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। ঠাকুমা ঠাকুরের পূজার্চনার কাজে সুচিতাকে ব্যস্ত রাখত। দায়িত্ব দিত পুণ্যিপুকুর করার। সেই ছোটবেলায় নিজের মনের ভাবনাগুলো কেমন যেন অন্যরকম মনে হতো। তার মানুষের থেকে গাছপালা পশুপাখি এসব বেশি ভালো লাগতো। চিলেকোঠার ঘরে আপন-মনে পুতুলদের সাথে গল্প করত। নিজের একটা জগত তৈরি করে নিয়েছিল। আর ঐ চিলেকোঠায় সে প্রথম মাকে দেখতে পায়। মায়ের আদর খায়, গল্প শোনে। ঠাকুমাকে সে কথা বলতে ঠাকুমা ভয় পেয়ে যায়। তারপর বাবা আর ঠাকুমার মধ্যে কী যেন আলোচনা হল। চিলেকোঠার ঘরে তালা পড়ে গেল। অনেক অনুরোধেও ওটা খোলানো গেল না।
স্কুলে গল্প বলার ক্লাসে মায়ের বলা গল্পগুলো সে বেশ গুছিয়ে বলতে পারতো। শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয় অনেক সময় স্যারেরাও তার গল্প শুনে মোহিত হয়ে যেত। ক্রমশ গল্পের স্টক শেষ হয়ে আসে। তবুও তাকে গল্প বলতে ডাকলে অনায়াসে গল্প বলতো। সব গল্পগুলো আপন মনে বানিয়ে নিত। সুচিতা নিজে নিজে অবাক হয়ে যেত তার এই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার ব্যাপারটাতে। চিলেকোঠার আড্ডাটা যখন উঠে গেলো বিকালে বড় পুকুরের পাড়ে যেত। ছেলেমেয়েরা ওখানে খেলা করে। দূর থেকে ওদের খেলা দেখত। জায়গাটাতে প্রচুর গাছপালা পাখিরা কিচিরমিচির করত। গাছেদের বাতাসে দুলে ওঠা, পাখিদের কলতান সব যেন তার কাছে অর্থবহ একটা ভাব নিয়ে আসতো। এখানেও মায়ের সাথে দেখা হতো, কথা হতো। ঠাকুমাকে আর বলে নি। বললে যদি এখানে আসাও বন্ধ করে দেয় ।
সেদিন আপন মনে খেলা দেখছিল। হঠাৎ কার গলার আওয়াজে চমকে ওঠে। দেখে বড় অশ্বত্থগাছটা সামনের তালগাছকে জিজ্ঞাসা করছে “ভাই আবহাওয়ার খবর কী?” তালগাছটা উত্তর দেয় “ঝড় হবে মনে হচ্ছে”। অশ্বত্থগাছটা আবার বলে “এবার তাহলে পাতা কাঁপা থামিয়ে দিই”। শিকড়টা শক্ত করে মাটিতে বেঁধে রাখি। অবাক কান্ড তালগাছের কথা শুনে শুধু অশ্বত্থগাছ না আশেপাশের সব গাছের পাতা থেমে যায়। সুচিতা এক দৌড়ে বাড়ি যায়। ঠাকুমাকে বলে ‘ঝড় উঠবে’
‘তুই কী করে জানলি?’
‘তালগাছটা অশ্বত্থগাছটাকে বলছিল’।
‘কী! কে কাকে বলছিল’?
‘আরে বাবা তালগাছ, তালগাছ বোঝনা? ও অশ্বত্থগাছকে বলছিল, আমি নিজের কানে শুনেছি’।
‘তুই গাছের কথা শুনতে পেলি’?
‘ হ্যাঁগো। তাড়াতাড়ি ঘরের জানালা দরজা গুলো বন্ধ করো’।
ঠাকুমা কোন গুরুত্ব দেয় না দেখে নিজেই বন্ধ করতে লেগে পড়ে। ঠাকুমা আপন-মনে বিড়বিড় করে ‘মেয়েটার কি যে হলো’। সব কথা সুচিতার কানে যায় না। জানালা দরজা বন্ধ করে হারিকেনটা ঠিক করে নেয়। জানে বিদ্যুৎ চলে যাবে। সেই হারিকেনের আলোতে যখন পড়তে হবে তখন আগেভাগেই ঠিক করে রাখা ভালো। একটু পরে সুচিতার কথা মিলে গেল। প্রবল ঝড় উঠলো। ঠাকুমা অবাক বিস্ময়ে সুচিতাকে দেখতে থাকে।
সুরজিৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। সুরজিৎ আজ খুব রেগে ছিল। আর রাগবেই বা না কেন? কারো বউ যদি মাঝে মাঝে এমন পাগলামি করে কোন বরের তা ভালো লাগে। সুচিতাও চায় সুরজিৎকে সুখে রাখতে, কিন্তু এই পাগলামিটা তো তার বশে থাকে না। কোথা থেকে কীভাবে যে হারিয়ে যায় নিজেও জানে না। অথচ আজ এত বছর মন দিয়ে সংসার করছে। টাকা-পয়সার হিসাব, সংসারের কাজ ছেলেকে মানুষ করা সব তার হাত দিয়েই হয়েছে। দুর্গাপুরে নতুন একটা ফ্ল্যাট তো সুচিতার বুদ্ধিতে কেনা আছে। তখন যা দাম ছিল এই তিন বছরে তিনগুণ দাম বেড়ে গেছে।
সুচিতা সন্তর্পনে বিছানা ছাড়ে । জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে । এটা কী পক্ষ কে জানে? কোন তিথি তাও জানেনা। ঠাকুমার কাছে এসব খুব মন দিয়ে শিখেছিল। ঠাকুমা বলতো ‘বার ব্রততী সব মেয়েদের জেনে রাখতে হয় শ্বশুর ঘরে কাজে লাগে’। তবে ওর শ্বশুর বাড়িতে এসব নেই। একমাত্র কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হয়। তাই বাংলা মাসের তারিখ সব ভুলে গেছে।
ঠাকুমা শিখিয়েছিল পৌষ মাসের শেষ দিন পৌষকে আগলিয়ে রাখার গান। এই গান গেয়ে পুজো দিলে বছরের পর বছর ঘরে লক্ষী বাঁধা থাকে। আজ হঠাৎ এতদিন পর এই গানের কথাগুলো মনে ভেসে উঠলো –
‘এসো পৌষ যেও না
জনম জনম ছেড়ো না
যদি বা ছাড়িবে তুমি
পরানে মরিবো আমি
পৌষ পৌষ লক্ষ্মীপৌষ
বড় ঘরের দাওয়ায় বোস’।
একটা বর্ণ সে ভোলেনি। জানালার ধারে চেয়ারটা নিয়ে বসে পড়ে খুব আস্তে আস্তে ব্যাগ থেকে লেখার খাতা আর কলমটা বার করে। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না খাতায় এসে পড়ে। কত লেখা জমে গেছে। গত কবিতা, কত গল্প। এখন শুধু লিখছে প্রকৃতির মনের ভাব। গাছেদের, মাছেদের, পশুপাখি, জীবজন্তু সকলের মনের কথা। তাদের দুঃখ আনন্দ সব মিলিয়ে একটা বিরাট লেখা বার হচ্ছে তার কলম থেকে। প্রকৃতির মনের ভাষা জেনে তার কথাগুলো এখন আর কাউকে বলে না। কি হবে বলে? কেউ তো বিশ্বাস করে না। সকালেই রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট বুনোফুলে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ফুলটা সব গাছগুলোকে বলছিল ‘মেয়েটা কি ভাল দেখ, অন্যরা আমায় ছেড়ে খোঁপায় গুঁজে দেয়। এ কেমন আদর করছে’। কথাটা শুনে সুচিতা খুব মায়া হয়। আলতো করে একটা চুমু খেয়ে নেয়। একটা কেমন ডুকড়ে ওঠার শব্দ পায়। বোঝে ফুলটা তার আদরে কেঁদে ফেলেছে।
চাঁদের আলোতে লিখতে শুরু করে। লিখতে লিখতে ভোর হয়। পাখিরা কথাবার্তা শুরু করে। সুরজিৎ ওঠার আগেই খাতা পেন ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। গেস্ট হাউসের মূলগেট সকাল সাড়ে পাঁচটার আগে খুলে না। একটু দেরি আছে। সুরজিৎ সাতটার আগে বিছানা ছাড়বে না। টয়লেটে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নেয়। জুতোটা গলিয়ে বাইরে পা বাড়ায় ।
জায়গাটাকে বিদায় জানাতে সুচিতার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আবার সেই বাঁকুড়া। শহরটা দিন দিন কেমন জানি হয়ে উঠছে। গাছপালা নেই বললেই চলে। তারচেয়ে দুর্গাপুরে যেখানে ফ্ল্যাট কিনেছে ওখানে অনেক গাছপালা। অর্ক ফোন করেছিল ‘মা তিন দিন ছুটি আছে, যাচ্ছি’। ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে। ছেলেটার জন্য বাজার সুচিতা নিজে হাতে করে। হোস্টেলে কি খায় কে জানে। ছেলে আসার আনন্দে মনের কষ্ট টুকু ভুলে যায়।
দেখতে দেখতে দুটো দিন পার হয়ে গেল । ছেলেটা আজ মা’কে কিছুতেই ছাড়েনা। রাত্রে মায়ের খাটে শোয় । ওর মাথায় সুচিতা হাত বুলিয়ে দেয়।
“মা তুমি আমায় গল্প বলো।”
“পাগল ছেলে তুই কী আর ছোট আছিস যে গল্প বলবো” সুচিতা হেসে বলে। “তোমার লেখা গল্প বলো”।
সুচিতা চমকে ওঠে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে “আমার লেখা গল্প কিরে, আমি কি গল্প লিখি”?
“লেখ, পাহাড়ের কথা ,গাছেদের কথা পশুপাখি জীবজন্তু সবার মনের কথা দিয়ে তুমি সুন্দর একটা উপন্যাস লিখেছে”।
“ তুই কি করে জানলি”? অসহায় ভাবে সুচিতা বলে।
“ আমি পড়েছি আজ ওগুলো জেরক্স করেছি কলকাতা নিয়ে যাবো”।
“ পাগল ছেলে, না না ওসব করতে হবেনা, আমি মরে গেলে যা পারিস করিস”। “পাগলী মায়ের পাগল ছেলে হবে না”? ছেলের কথায় সুচিতা কোন উত্তর দিতে পারে না।
এক সপ্তাহ হল ছেলেটা চলে গেছে। সুচিতা অনেক করে জেরক্স কপিগুলো নিতে চেয়েছিল। পারেনি। সুরজিৎ বলে উঠেছিল ‘কি এত দেওয়া-নেওয়ার কথা হচ্ছে’? সুরজিৎ এর এই মেজাজকে খুব ভয় পায়। আর জোর করতে পারে না। এই ভয় নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিল। আনমনে বসে বসে কত কথা মনে ভিড় জমাচ্ছে। মা বলেছিল তোর কষ্ট হলে তোকে দেখা দেবো। কই এখনতো তার খুব কষ্ট হচ্ছে মা তো এলো না। মোবাইলটা বেজে ওঠে ওপাশ থেকে এক পুরুষ কন্ঠে বলে “আপনি কি সুচিতা রায় বলেছেন?”
“ হ্যাঁ বলছি বলুন”।
ওপাশের পুরুষ কন্ঠে এবার নিজের পরিচয় দেয়। প্রথম সারির ম্যাগাজিন আর প্রকাশনার নামটা শুনে চমকে ওঠে ।
“ শুনুন আপনার উপন্যাসটা এবার আমাদের পূজা সংখ্যায় থাকছে। আর এর মধ্যে ওটা আমরা বই বের করে দেব। এত ভালো লেখা বই বার হলে আমরা এবার ওটাকে পুরস্কার কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেবো”।
পাগল ছেলেটা এসব কি করেছে। সুচিতা কোন কথা বলতে পারে না। দেখে সামনে দাঁড়িয়ে মা মিটিমিটি হাসছে। “চুলগুলো কি অবস্থা করেছিস রে। আয় ভালো করে বেঁধে দিই”
“আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন”?
“বলুন বলছি”।
“কপিরাইট কার নামে হবে”?
“কার নামে করা যায় বলুন তো”?
“ আপনার স্বামী আপনার ছেলে-মেয়েদের নামে করতে পারেন”।
“অর্কপ্রভ রায়।”
“আস্তে, লাগছে।”
“ লাগবেনা চিরুনি নেই সব জট পাকিয়ে বসে আছিস।”
“ আপনি কি ব্যস্ত আছেন”?
“ না না বলুন কি জানতে চান?”
“ উৎসর্গটা কার নামে করব?”
সুচিতা চুপ করে থাকে। মা তখন চুলের বিনুনি পাকাতে শুরু করেছে। “হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন?”
“মায়ের নামে।”
“ কি লিখবো পুরোটা যদি বলেন।”
“তুমি না থাকলে আজ আমি হতাম না। তাই তোমাকে প্রথম সৃষ্টি উৎসর্গ করলাম ‘মা’।”