জয় ভদ্র
সাবেক জেরুজ়ালেম কফি হাউস, অর্থাৎ যা আমাদের ভালোবাসার কাছে যার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ইন্ডিজ কফি-শপ’— সেখানে জয়েন করা মেয়েটার আজ প্রথম দিন। ম্যানেজমেন্ট-সহ ক্যাফের যে পাঁচ-ছ’ জন কর্মী ছিল, তারা আগেভাগে ভাবতেই পারিনি এই নতুন কর্মীটির নিয়োগের ব্যাপারে। তবে বিস্ময় অথবা রহস্যজনক যাই বলা হোক না কেন, যোগদানকারীর অলক্ষে এই পাঁচ কর্মীরা ম্যানেজারকে এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সে নিজেও খুব হতাশ— না, আগে থেকে কিছুমাত্র সে জানতে পারিনি! এ-ক্যাফের মালিকপক্ষ আগেভাগে তাকে কিছুই জানায়নি। তবে ম্যানেজারসাহেবের এ-নিয়ে খুব একটা বিরাট আপত্তি বা মাথাব্যাথা নেই। কারণ, এই আপত্তি না-থাকার তার প্রথম ও একমাত্র শর্ত হল চেহারায় চামড়ার জেল্লায় সমগ্র মুখশ্রী ও উদ্ধত যৌবন সবমিলিয়ে মেয়েটি নিতান্তই সুন্দরী। বরং পাঁচ-পাঁচটা পুরুষ মৌমাছির মধ্যে মেয়েটি যেন রানি মৌমাছি।
যাই হোক, ইন্ডিজ কপি-শপে মেয়েটির জয়নিং হবার বেশ কিছু দিন পেরিয়ে গেল। এদিকে মেয়েটি আসাতে ক্যাফের ম্যানেজার-সহ সকল স্টাফেদের সময়কাল বলতে গেলে ভালোই যাচ্ছিল। স্টাফেদের সেই দশ সাড়ে-দশ ঘণ্টার একঘেয়ে ডিউটিতে এক পূর্ণ যুবতীর দৃষ্টিনন্দন মুখশ্রী তাদেরকে যেমন কাজের ক্লান্তিকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করত, তেমনি এক নিরবচ্ছিন্ন উদ্যমে টানা প্রায় ১১-১২ ঘণ্টার কাজ করার অনুপ্রেরণাও জোগাত। এর কারণ একটাই কারণ সম্ভবত, প্রত্যেকেই মেয়েটিকে মনে মনে চাইত। চাইত মেয়েটির সঙ্গে গভীরভাবে মিলিত হতে। কিন্তু ঘটনা হল, এদের কারণেই মেয়েটিকে এই শহরের অন্যতম একজন রহস্যময়ী বলে মনে হয়নি। এক সহজ সরল এদেশীয় ভদ্রতা ও শিষ্টাচার মেয়েটির কথায় ও কাজে ফুটে উঠত, আর তাইতে ইন্ডিজ কফি-শপের ওই পাঁচ জন স্টাফের মধ্যে একজন সবার আগে মেয়েটির প্রেমে পড়ল।
মেয়েটির নীল চোখ। দু-হাতের নকল বিচিত্র রঙের নখগুলো বাজপাখির ঠোঁটের মতো তীক্ষ্ণ। চেহারায় ও পোশাকে এদেশীয় ছাপ স্পষ্ট। ইন্ডিজ কপিশপের কিছু দূরে শহরের পশ্চিম প্রান্তে যে-নদীটা বয়ে চলেছে তার ধারে নয়নাভিরাম এক হোটেল। হোটেল ‘ব্লু নাইট’। একদিন রাতে তারা কফি-শপের কাজের শেষে ওই হোটেলে উঠেছিল। যে-স্যুটটি ওরা পছন্দ করেছিল তার নম্বর ছিল ১১১, যার প্রশস্ত নিরিবিলি ব্যালকনিটা আমাদের শহরের পশ্চিমের নদীটার বলতে গেলে একেবারে গা ঘেঁষে— যেন দিন ও রাতের সারাটা সময় ধরে ওরা দু-জনে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে নির্বাক কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে…
কফি-শপের ওই জনৈক স্টাফটিকে খুবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নজর করছে… মেয়েটির সঙ্গে শয্যাসঙ্গী হতে হতে ছেলেটি আবেগে অনেক কথাই বলে চলেছিল… সুতোবিহীন শরীরের মেয়েটা যখন ওর মুখে মদের পাত্র তুলে দিচ্ছিল ঘড়িতে তখন রাত ১১টা বেজে ৫৮ সেকেন্ড। ঘরের বহু পুরোনো মডেলের আরসি লাগানো একটি ড্রেসিং টেবিলে রাখা টেবিল-ক্যালেন্ডারে যে-যে সংখ্যাগুলো ছিল তার মধ্যে সেদিন নির্দিষ্ট ছিল ৩১ ডিসেম্বর, ২০৪৫। আর কিছুক্ষণ পরেই নতুন বছরের শুভ সূচনা হবে। মেয়েটি আর ছেলেটি এখন নগ্ন অবস্থাতেই স্যুটের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। ১৫ তলার স্বর্গ থেকে তারা দেখে শহরের নদীর পাড় মানুষে মানুষে ছয়লাপ, আর তাদের হাসি-হল্লায় আর মস্তিতে ছেয়ে রয়েছে। আর মেয়েটিও চায় নতুন বছরের শুরুর মুহূর্তগুলিতে ছেলেটি যেন তাকে জড়িয়ে ধরে, আর অবিরাম সময় ধরে যেন তাকে সঙ্গম করে। হয়ত-বা সে এই আশা নিয়ে এটা করতে চেয়েছিল ইন্ডিজ কফি-শপের কাজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও তার নিজেরও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সম্পর্কে অনেক কিছু সে তাকে জানাবে।
যাই হোক, ১ জানুয়ারি, ২০৫০, জেরুজ়ালেম কফি হাউস সকাল দশটায় খুললে অন্যান্য স্টাফেরা হাজিরা দিলেও নীল চোখ মেয়েটির প্রেমে পড়া ওই জনৈক স্টাফটি তখনও আসেনি। কিন্তু মেয়েটি যথাসময়ে হাজির হয়ে তার নিজের ও অনুপস্থিত কর্মচারীটির কাজ সে একা হাতে সামলাতে থাকে। কিন্তু সারাদিন পার হয়ে গেল, এমনকি পরের দিন অথবা আগামীর দূর ভবিষ্যতের জন্যও ছেলেটিকে আর-কোথাও কখনো দেখা গেল না!
এসবের জন্য জেরুজ়ালেম কফি হাউসের কিচ্ছু যায় আসেনি। কর্মরত এই স্টাফটি গায়েব হয়ে যাবার পরে পরেই শপের অন্দরসজ্জা যেমন আরও চাকচিক্য হয়েছে, তেমনি খাবারের পদেরও বৈচিত্র্য এসেছে; কফি পান অথবা খাদ্য রসিকদের ভিড়ও তত বেড়েছে। এমন অবস্থায় বেশ কিছুদিন চলার পর, বর্তমানের চার জন স্টাফের আরেকজনের সঙ্গে মেয়েটির অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল। তার একটাই কারণ, কফি সার্ব বা খাদ্য পরিবেশন ও সুপারভাইজিং-এর দায়িত্ব চলাকালীন মেয়েটিকে এখন এই স্টাফটির কাছাকাছি থাকতে হয়। আগের স্টাফটির সঙ্গে শেষ বারের জন্য মেয়েটি হোটেলের যে-ঘরে সহবাস করতে এসেছিল, তার বছর খানেক পর, মেয়েটি সেই একই নম্বর ঘরে আবারও আসে, সঙ্গে জেরুজ়ালেম কফি হাউসের বর্তমান স্টাফটি। সময়টা মধ্যে বসন্তকাল, মেয়েটি যে-যে প্রশ্ন ছেলেটিকে করেছিল, সেটা ছিল অনেকটা প্রথমবারের প্রথম প্রেমেরই পুনরুচ্চারণ:
তোমার জীবনে কি আমিই প্রথম?
…
তাই জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে অমন করে চেয়ে থাকো?
…
স্বপ্ন দেখো?
…
আমার চোখ? তোমার এত ভালো লাগে?
…
নিজেকে এত কুৎসিত ভাবো কেন? জানো, কুৎসিত লোকেদের সুন্দর বউ জোটে! জানবে পুরুষরা সুন্দর টাকায়।
…
স্বপ্ন দেখো, অনেক বড়ো হবার স্বপ্ন… এই সামান্য ইন্ডিজ কপি শপে থেকে সারাজীবন কী করবে?
মেয়েটি তখন শরীরের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলেছে, ছেলেটি সেই কামনায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি— মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে ওর সুতোহীন শরীরের ওম নিচ্ছিল, আর ওকে অজস্র চুমায় ভরিয়ে দিচ্ছিল। নীল চোখের মেয়েটি তখন বলেছিল, নারীর নগ্ন শরীর পুরুষের যেমন ভালো লাগে, তেমনি জানবে পুরুষের নগ্ন শরীর মেয়েদেরও আকর্ষণ করে।
এই বক্তব্যের পর মেয়েটিকে তার আর কী-বা বলার থাকতে পারে! কারণ ছেলেটি তখন নিজের পোশাক খুলতে ব্যস্ত, আর তা করতে করতে ওরা পরস্পরে নিজেদের স্বপ্নকে বিলি করছিল, আর রাতের সুস্বাদু মুহূর্তগুলো খুব দ্রুতই ওদেরকে তাড়া করে ফিরছিল, আর এই আবেগভরা মুহূর্তগুলো শুনেছিল মেয়েটির কথা, ‘সে বলেছিল, আমার নীল চোখে সারা জীবনের জন্য পেতে গেলে তোমাকে আরো অনেক বড়ো হতে হবে…’
…
সেদিন রাতের এই মুহূর্তগুলোর পরে, রাত শেষে শহরে যখন নতুন ভোর এসেছিল, ইন্দিজ কফি শপের প্রথম স্টাফটির মতোই এই কর্মীটিকেও আর হাউসে দেখা যায়নি। কফি শপে আসা কাস্টমারেরাও যেমন তাকে দেখতে পায়নি, তেমনি এই কর্মীটির ব্যক্তিগত স্তরের পরিচিতমহলও তাকে দেখতে পায়নি। শুধুমাত্র দেখতে পেয়েছিল এই শহরের পশ্চিমের ওই নদীটার তীর ঘেঁষে থাকা ওই বিলাসবহুল হোটেল— ‘হোটেল ব্লু নাইট’-এর সেই নির্দিষ্ট ১১১ নম্বর স্যুটের ঘরটি। সেই ঘরটিই একমাত্র দেখতে পেয়েছিল, বলা যায় জীবন্ত সাক্ষী ছিল— ছেলেটি পরে একা এসেছিল, বেশ কয়েক মিনিটের জন্য। প্রথমেই সে এসে তার মোবাইলে কথা বলেছিল। তারপর দেখা গেল ছেলেটি তার দূরভাষের অপর প্রান্তের বক্তার সঙ্গে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছিল… এরপর সে মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছিল, আর গুম হয়ে বসেছিল বেশ কিছুক্ষণের জন্য, হয়ত-বা সে অপেক্ষা করছিল ওই ১১১ নম্বর স্যুটে তার প্রেমিকা যদি করুণাবশত শেষ বারের মতো ছুটে আসে তার জন্য। কিন্তু যখন দেখল তার প্রেমিকা আর আসার প্রয়োজনবোধ করছে না, এরপর সে তার ঘর অন্ধকার করে দিয়েছিল, যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পূর্বের সেই আদি অন্ধকার… এরপর ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে যে-আলো আসছিল, হোটেলের এই ১১১ নম্বর ঘরটি তখন দেখল তার ছাদের ফ্যানের সিলিং-এ ওই যুবকটিকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলতে।
দুর্ভাগ্যই বলতে হবে ১১১ নম্বর ঘরটির। এই ঘটনায় টিভি মিডিয়া থেকে শুরু করে থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সবাই উঁকিঝুঁকি মারে। এই সুইসাইডাল কেসের পর, আরও বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। শুধু শহরবাসী কেন, আশেপাশের অঞ্চলের কাছে হোটেলের এই ঘরটি তখন আর নিছক ঘর নয়, নাম হয়ে যায় শুধুই ‘১১১’ নম্বর।
জেরুজ়ালেম কফি হাউস ও আমি
ক-দিন ধরে আমার মনটা খুব খারাপ, কারণ ইন্ডিজ কফি শপে এই যে দুটো অনভিপ্রতে ঘটনা ঘটে জাওয়াতে। সব দেখে-শুনে এখন আমার মাঝেমাঝেই আমার মনে হয়— অনেক হয়েছে, আর নয়! কোথাও শুরু করলে, কোথাও-না-কোথাও তাকে শেষ করতে হয়। আসলে, আমার সঙ্গে জেরুজ়ালেম কফি হাউসের সম্পর্ক বহুদিনের। যদিও এই কফি হাউস আমাদের কাছে অর্থাৎ আমরা যারা পুরোনো বা নতুন এই কফি হাউসে আসি আমাদের কাছে শুধুই তা ‘ইন্ডিজ কফি শপ’। যদিও একসময়ের এই অভিজাত কফি হাউস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ১৮০০ শতকের প্রায় শেষের দিকে। ঔপনিবেশিক শাসকরা অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী ও সেনাবাহিনীর লোকজনরা এদেশে তাদের পায়ের তলার মাটি ধীরে ধীরে শক্ত হতে শুরু করেছিল— তখন তো প্রায় যুদ্ধজয়ের বছর ত্রিশেক তো হবেই। সাহেবসুবোধের হোমসিকনেস তখনও যায়নি। তাদের মনস্তত্ত্বে তাদের এই কলোনি হয়ে উঠুক তাদেরই লন্ডন শহরের মতোই— সে বাড়ির অবকাঠামো থেকে শুরু করে জীবনাভ্যাস পর্যন্ত। যদিও সুরা পানের অভ্যাসটি সাহেবরা এদেশে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে এসেছিল। সাহেবদের বাড়িতে বাড়িতে তাদের সেই জাতীয় অভ্যাস বজায় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু অভাব বোধ করছিল কফি পানের পারিবারিক সংস্কৃতিতে। আমার এই শহর রামলা তখন দেশের রাজধানীতে পরিণত হয়নি। নিছকই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের কোম্পানির ব্যবসায়িক সদর দপ্তর ও শ্বেতাঙ্গ সেনাদের সেনানিবাসকে নিয়ে মাত্র কয়েক কিলোমিটার এক অর্থনৈতিক রাজধানী গড়ে উঠছে বলা চলে। এরই মধ্যে রাজকর্মচারী-সহ যত রাজ্যের সাহেবদের বাসস্থান। লন্ডনের দেশীয় স্থাপত্যের রীতিতে তখন একটা চার্চ অলরেডি তারা বানিয়েও ফেলেছিল। সাহেবসুবোধের যে-বসতি গড়ে উঠেছিল সেখানেও নিখাদ ভিক্টোরিয়ান গথিক স্থাপত্যের ছোঁয়া। পুরো আস্ত লন্ডনেরই একটা রেপ্লিকা ওরা এখানে নির্মাণ করতে চাইছিল। ওই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো অবস্থা আর কী! এই নিয়েই গড়ে উঠছিল আমার শহর রামলা— পশ্চিমের নদীটার একদম তীর ঘেঁষে। তখন ছিল মাত্র তিন-চার বর্গ কিলোমিটারের এক অতি ক্ষুদ্র শহর। এর বাইরে তখন সুদূর সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত কোথাও নিবিড়, কোথাও পাতলা বনাঞ্চল, অজস্র প্রাকৃতিক জলাভূমি আর ভেড়ি, আরও দক্ষিণে সুদূর বদ্বীপ অঞ্চল, নদী আর সমুদ্রের সঙ্গম ক্ষেত্র। মার্গারিটার মুখে শুনেছিলাম এই শহরটাতে বনের চিতাবাঘ পর্যন্ত চলে আসত, আর শোনা যেত গভীর রাত্রে শেয়ালদের রহস্যময় মৃত্যু ডাক! কে এই মার্গারিটা? আসছি— ওর কথায় একটু পর আসছি। ঠিক এইরকম একসময় নির্মিত হয় জেরুজালেম কফি হাউস। প্রথমদিকে এ দেশের নেটিভদের ঢোকারই অনুমতি ছিল না সেখানে… প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্রেফ এদেশে কলোনি করা ব্রিটিশ বানিয়াদের সাংস্কৃতিক দিক বজায় রাখার জন্য। আবার অপরদিক বিচার করলে এটাও সত্যি যে আমরা নেটিভরা কফি বা কফি পান কী জিনিস সেটাই জানতাম না। আমাদের মননে ও সাংস্কৃতিক জীবনে এর কোনও অস্তিত্বই ছিল না। যদিও কফি চাষের ক্ষেত্র প্রাকৃতিকভাবে প্রস্তুতই ছিল— সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল ঔপনিবেশিক শাসকরা। কফি বীজ এখানে তারা নিয়ে এসেছিল, এ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে সমুদ্র লাগোয়া পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে দাসসম কৃষকদের দিয়ে ঘাড়ে ধরিয়ে চাষ করিয়ে নিয়েছিল। তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে চাষ যারা করল তারা নিজের ফলানো ফসলের স্বাদ কি তারা কখনও নেয়নি? হয়তো নিয়ে থাকতেও পারে, কিন্তু এর ওপর কোনও লিখিত ডকুমেন্টস বা ইতিহাস বই আমি অন্তত দেখিনি বা পাইনি। আমার ধারণা, হয়তো কোনও গরিব কৃষক তার নিজের হাতে ফলানো কফি বীজের স্বাদ এদেশে প্রথম নিয়ে থাকতে পারে… এটা ইমাজিন করার জন্য আর যাই হোক কোনও পণ্ডিতের প্রয়োজন হয় না। যাই হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশের কৃষকদের ফলানো কফি বীজ ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করে ভালোই রোজগার করত। এর কারণে টানা ১০০ বছর ধরে জেরুজালেম কফি হাউসকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কোম্পানির নিজস্ব স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। জেরুজ়ালেম কফি হাউস থেকে সেই অর্থে কোনও প্রফিট না-আসলেও ঘুর পথে কোম্পানির পকেটে পুরো লাভের টাকাটাই ফিরে আসত। এর পরের ১০০ বছরে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে— বিশেষত শিক্ষিত ধনী জমিদার শ্রেণি ও মধ্যবিত্ত সমাজে। এদের কেউ কেউ আবার ব্রিটিশদের সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতি বলে ভাবতে শুরু করেছিল। সেহেতু তারা যে মনিবের পাশে বা পায়ের তলায় বসে কফি পানের চর্চা করেনি এটা তো হতে পারে না— এই অনুভূতি আমার সত্য বলেই মনে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রভুর পাশে বসে জেরুজালেম কফি হাউসে গিয়ে জমিদার শ্রেণির নেটিভরা একসঙ্গে কফি পান করেননি এমনটা মন থেকে মেনে নিতেও কষ্ট হয়। এই যুদ্ধের মুহূর্তকালে ভারতীয় কফির বাজার অনেকটাই পড়ে গেল। কফি রপ্তানি প্রায় শূন্যে গিয়ে ঠেকল— সাপে বর হল এদেশের নেটিভ এলিট শ্রেণিদের। ব্রিটিশ সরকারের তখন যেনতেন প্রকারে কফির বাজার চাই— সুতরাং এদেশের মানুষদের কফি গেলাতে হবে। সময়টা ছিল ’৪২-এর শেষের দিক কিংবা ’৪৩-এর গোড়ায়।
’৪২-এ আমি সদ্য ২০ বছরের, এক অভিজাত জমিদার বংশে আমার জন্ম। এর কিছু আগে আমার সঙ্গে আলাপ হয় মার্গারিটার স্মিথের। আমার থেকে সে বছর তিনেকের বড়ো, জন্ম এখানেই— আমাদের এই রামলায়। নীল চোখের অভিবাসী অ্যাংলো, নদীর স্রোতের মতো ঝরঝরে বাংলা বলে। আসলে ওর মা ছিল বাঙালি। শুনতাম ওর পূর্বপুরুষ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের এদেশের প্রথম বিজয়ের ইউরোপীয় সেনাদের অন্যতম এক মেজর। এই তথ্য ও ওর ঠাকুরদাদার কাছ থেকে শুনে থাকলেও কোনও জোরালো প্রমাণ মার্গারিটার কাছে ছিল না, অন্তত ওর কথায়, আবার এমনও হতে পারে— দেখাবার জন্য আমায় কোনও আগ্রহ দেখায়নি। কেমন একটা নির্মোহ উদাসীন হতে দেখি এই ব্যাপারে। যদিও এই নিয়ে ওকে খুব একটা মুখ কোনোদিনই খুলতে দেখিনি আমি শত বার জেরা করলেও। সে যাই হোক, ওর মা যেহেতু নেটিভ ছিল, সেই জিনবশত ও আমাকে ভালোবেসে ছিল কি-না বলতে পারব না, তার আরও একটা কারণ থাকতে পারে, সেটা হল, ওর মা ছিল ওর বাবার অবৈধ স্ত্রী। অনেক চেষ্টার পর চোখ আর গায়ের রঙের কারণে ও ‘স্ফিথ’ টাইটেল আদায় করে নিয়েছিল। যাই হোক, ১৯৪২ সালের আগে ও আমাকে একবার জেরুজ়ালেম কফি হাউসে নিয়ে গিয়েছিল। ওর কোন তুতো সম্পর্কের ভাই ওই ক্যাফের ম্যানেজার ছিল। সেখানে গিয়ে আমার চোখ তো চরক গাছ! এ কফি হাউস, না কোনও হোটেল বার! কফি পানের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছিল অর্কেস্ট্রার দল, ছিল বল নাচের গোল চত্বর, বিলিয়ার্ড রুম। দেওয়াল জুড়ে ছিল বড়ো বড়ো অয়েল পেইন্ট— রানি ভিক্টোরিয়ার ক্যানভাস থেকে শুরু করে ব্রিটিশদের বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের অয়েল ক্যানভাস। ছিল স্পেনীয়দের হটিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের উত্তর আমেরিকা দখলের মুহূর্ত চিত্র-সহ আরও অসংখ্য ক্যানভাস। যে-হলঘরটায় ও আমাকে ঢোকালো, দেখলাম বিশাল বৃত্তাকার এক ঘর। প্রান্তের মাঝখানে ইউরোপীয় নাটমঞ্চ, কফি পানের টেবিলগুলো প্রান্ত বরাবর গোল করে সাজানো। কফি টেবিলের সারির মাঝখানে নাটমঞ্চের পাদদেশে অর্কেস্ট্রা ও ভায়োলিন বাদকের দল, আর এরপর মাঝখানের গোল চত্বরে দাপিয়ে বেড়াত ব্যালে ড্যান্সের নারী ও পুরুষ সঙ্গীরা। মার্গারিটার হাত ধরে সেদিনই প্রথম আমি আমার স্বপ্নের জেরুজালেম কফি হাউসে প্রবেশ করতে পেরেছিলাম, যদিও পরবর্তীকালে আমরা যারা এই কফি হাউসে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতাম, এই কফি হাউসকে ‘ইন্ডিজ কফিশপ’ নাম দিয়েছিলাম। এই নাম আজও সরকারি রেজিস্ট্রেশন পায়নি— ওই প্রাচীন ‘জেরুজ়ালেম কফি হাউস’-ই আছে। ওখানেই দেখেছিলাম ব্রিটিশ আভিজাত্য কাকে বলে। এর কিছুদিন পরেই লেগেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এদেশের উৎপন্ন কফি বীজের রপ্তানিতে ধস নামল। মাথায় হাত বৃটিশ বানিয়াগুলোর। অগত্যা কী করা— আছে তো নেটিভ জনগণ— তাদের সংস্কৃতি পালটাও। সময়টা ১৯৪২, মার্গারিটার সঙ্গে সেই যে ইন্ডিজ কফি হাউসে যাতায়াত শুরু করলাম তা আজও বহাল আছে। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বা প্রণয় যাই বলি না কেন, তা তো ১০০ বছরের বেশি হয়ে গেল! এই ১০০ বছরের সময়কে ঘিরে, নিজের ঘরে যখন মার্গারিটাকে মনে করে একাকিত্বে সময় কাটাই, তখন মূল্যায়ন করতে থাকি— সারা বিশ্বের, এমনকি বোধহয় সারা ব্রহ্মাণ্ডের, যদি সেখানে কোনও প্রাণ থেকে থাকে, তাহলে মার্গারিটা হল আমার কাছে সর্বকালের আশ্চর্যময় এক জাদুর দেবী! না-হলে এই ১০০ বছর পার হয়ে গেলেও, মার্গারিটা সঙ্গে প্রথম আলাপের সময়, যখন ওর বয়স ছিল মাত্র তেইশ, আর আমার কুড়ি, তখন ওকে যেমনটি দেখেছিলাম, আজও তা তেমনটিই রয়ে গিয়েছে। সূর্য থেকে নির্গত আলোকরশ্মি যেমন চির বহমান, সীমাহীন অতীতের মহাকালের অন্ধকারের সবচেয়ে গভীরতম অন্ধকার থেকে ধেয়ে আসা যে-আলোকরশ্মি আজও অম্লান ও চির যৌবন, মার্গারিটার রূপও তেমনি— আপতিত দৃষ্টিতে যার লয় ক্ষয় কোনোটাই যেন নেই, বৃদ্ধত্বপ্রাপ্তি তো কোন ছাড়, প্রৌঢ়ত্বপ্রাপ্তি থেকেও সে আজও অনেক দূরে! ওর বয়স চূড়ান্ত যৌবনের মধ্য গগনে আটকে আছে, মাত্র তেইশে! সেই নীল চোখ, নেটিভ আর ইউরোপীয় জিনের মিশ্রণে উজ্জ্বল বর্ণের মসৃণ ত্বক, মাথায় একরাশ কারলি প্রায় সোনালি চুল যা ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, ওর পটল চেরা চোখ দুটো যেন মহাকালের আকর্ষণ। আমি আজও পর্যন্ত মুহূর্তকালের বেশি ওর চোখে চোখ রাখতে পারি না! মার্গারিটা যদি রূপ ও জাদুর দেবী হয়, তাহলে তার প্রভাব আমার ওপরেও পড়েছে। কারণ আমারও বয়স অতীতের কোনও এক মুহূর্তের মধ্যেই থমকে আছে…
সে যাই হোক, মার্গারিটার সঙ্গে দীর্ঘ ১০০ বছরের অধিক কাটিয়ে দেওয়া, ইন্ডিজ কফি হাউসে সময় করে আসা-যাওয়া— তার মধ্যে কত কিছুর যে সাক্ষী আমি আর মার্গারিটা…! এখন ২০৫২। আজও আমি আর ও জেরুজ়ালেম কফি হাউসে অর্থাৎ ইন্ডিজ কফি শপে আসি। গান্ধীজির আগস্ট মুভমেন্ট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেতাজীর অন্তর্ধান ও তার আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ, ১৯৪৮-এর চায়নার সমাজতান্ত্রিক বিজয় অর্জন, তার কিছুকাল পরে কিউবা… এরপর আমাদের দেশভাগ, তেভাগা ও তেলেঙ্গানা আন্দোলন, তারপর ’৬৭ হাংরি আন্দোলন, ’৭০-এর নকশাল আন্দোলন, ’৮৪ ইন্দিরা গান্ধী হত্যা-সহ খালিস্থানি মুভমেন্ট ইত্যাদি। সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ, এদিকে তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি, বর্তমানের ইলিয়াস ও শহীদুল জহির… চলচ্চিত্রে লেভ কুলেশভ, আইজ়েনস্টাইনের যুগান্তকারী আবিষ্কার, অথবা, বার্গম্যান-কুরোসাওয়া, কিংবা ইতালির নয়া-বাস্তবতা, ফেলিনি কিংবা আন্তোনিয়নি, বা তার পরবর্তী পাসোলিনি, কিজ়লস্কি, এদিকে আমাদের সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক কিংবা গিরিশ কাসারাভাল্লী বা আদুর গোপালকৃষ্ণাণ… জেরুজ়ালেম কফি হাউসের যে প্রায় জনা চল্লিশেক স্টাফ ছিল তারাও আমাদের এই সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের একাকীভূত ছিল। আসলে আমার আর মার্গারিটা-সহ সেই সময়ের তরুণ যুবক-যুবতীদের প্রজন্মটা নিজেদের ঘরের বাইরে ইন্ডিজ কফি শপের সকলকে নিয়ে একটা স্বতন্ত্র পরিবার বানিয়ে ফেলেছিলাম, যে-পরিবারটাকে, যা আমরা সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিকতারই একটা অংশ বলে মনে করতাম।
কথাগুলো বলতে বাধ্য হলাম এই কারণেই, ক্রমশ যখন এই জেরুজ়ালেম কফি হাউস তথা ইন্ডিজ কফি শপ আজ ভয়ংকর ধ্বংসের মুখে। হাউসের আভ্যন্তরীণ শ্রমিকবিরোধী নীতি যা আমাকে আর মার্গারিটাকে ক্রমশ ব্যথিত করে তোলে। কখনো-কখনো মনে হয় ইন্ডিজ কফি হাউস যেন আর আমাদের নয়, এখানকার কোনও স্টাফ খুন হলে বা গায়েব হয়ে গেলে অথবা আত্মহত্যা করলে তাদের হয়ে বলার আমাদের যেন আর কোনও অধিকার নেই! অতীতের দিনগুলোতে যা আমরা ভালোবাসা ও অন্তর দিয়ে অধিকার করেছিলাম, আজ তা আমরা হারাতে বসেছি— এ-কথা আমি আর মার্গারিটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
যাইহোক, দ্বিতীয় স্টাফটি যখন আত্মহত্যা করল, তার কিছুদিন পর এই নীল চোখের মেয়েটি ইন্ডিজ কফি শপের আরেকজন স্টাফের প্রেমে পড়েছিল, সেটা কানাঘুষো আমরা শুনতে পেয়েছিলাম, বিষয়টা আমাদের পরিপূর্ণ গোচরে আসার আগেই সেই স্টাফটিও সেই হোটেল ব্লু-নাইটের ১১১ নম্বর ঘরে খুন হয়ে যায়! কোনও প্রমাণ না-থাকায় ইন্ডিজ কপি শপে কর্মরতা নীল চোখের মেয়েটি দিব্যি ছাড়া পেয়ে যায়। উলটে দেখলাম নীল চোখের মেয়েটির পদোন্নতি হয়েছে, কফি শপের প্রায় প্রৌঢ় ম্যানেজারটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই মেয়েটির সঙ্গে আলোচনা করে তবেই ইন্ডিজ কপি শপের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দিকটি সিদ্ধান্ত নিতে, আর নীল চোখের মেয়েটির সঙ্গে আরও একটি মেয়েকে রিক্রুট হতে দেখলাম। সেও অল্পবয়স্কা, ফর্সা, সুদর্শনা। দুঃখের বিষয় হল, ইন্ডিজ কফি শপের এই পরিবেশের সঙ্গে আজ অতীতের কোনও কিছুই মেলাতে পারি না!
আজ এই সময় দাঁড়িয়ে অতীতের কথা ভীষণ মনে হয়। সেই সময় আমাদের যারা যুবক বন্ধু বা বান্ধবীরা ছিল, আজ তাদের অনেকেই বৃদ্ধ, অনেকে এ-পৃথিবী ছেড়ে চলেও গেছেন… তবু আজও তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের একসাথে বসতে হয়, আড্ডা মারতে হয়, সেইসঙ্গে চলে কফি পানও, কারণ তারা জানেও না আমার আর মার্গারিটার বয়স ১০০ বছরের অধিক হয়ে গেছে! আড্ডায় আমরা উভয়ই পরস্পরের সহমর্মী, তবুও কোথায় যেন আগের সেই চিন্তাভাবনার স্বর্ণযুগকে ছুঁতে পারি না। এখনকার তরুণ প্রজন্ম, যারা এখন আমাদের বলতে গেলে বুজ়ুম ফ্রেন্ড তাদের সঙ্গে আগের মতোই রাজনীতি-সাহিত্য-সিনেমা সবকিছুই আলোচনা হয়। কিন্তু কোথাও যেন আগের মতো প্রাণ নেই। আলোচনা ও জীবনদর্শনের আবর্তন সবটাই যেন এক ভোগমুখী সমাজের উৎস মুখের চারপাশে। সমাজের প্রতি আত্মদানের বিষয়টি এখন অতীত। আমি আর মার্গারিটা আশ্চর্য হয়ে যাই, এই ১০০ বছরের অধিক সময় ধরে আমরা নিজের চোখেই দেখলাম— জেরুজালেম কফি হাউসের মতো এক ম্যামথ আকারের অধিকাঠামোটি ক্রমাগত ছোটো হতে হতে বলতে গেলে যেন এক পায়রার খোপে পরিণত হতে! আগের সেই রাজকীয় বিশাল অ্যালবার্ট হল আজ আর নেই, বাড়ির পুরোটাই জুড়ে শপিংমল, যদিও এ-বাড়ির বয়স প্রায় ৩০০ বছরের। আমি আর মার্গারিটা— আমরা নিজেরাই তো এক শতাব্দী পার করে দিলাম। বাড়িটার সাবেক ভিক্টোরিয়ান যুগের স্থাপত্যের নকশা, তা এখন সম্পূর্ণ উধাও— বাইরের অবকাঠামোটি এখন তা হাল আধুনিক সময়ের সম্পূর্ণ কাচ দিয়ে ঘেরা এক নতুন স্থাপত্যে পরিণত হয়েছে, যদিও, এটিও পাশ্চাত্য রীতির আধুনিক নকল। বরং বর্তমানের যে-অংশটিতে ইন্ডিজ কপি শপটি আছে, বলতে গেলে তার ভেতরটা এখনও অবিকৃত রয়েছে। তবে আমরা যে ৪০-৪৫ জন বয় বা কর্মীকে কাজ করতে দেখেছিলাম আজ সংখ্যায় ক্রমশ চার-পাঁচ জনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি ইন্ডিজ কফি শপের সাম্প্রতিক কালের যে অনভিপ্রেত ঘটনার কথা বলছিলাম তার চূড়ান্ত পরিণতির কথা এবার আমি পাঠকে জানাতে চাই, যা আমার চেতনাকে বহু সময় ধরে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যে-সময়টার কথা আমি বলছি সেটা ছিল ২০৪৭ সাল, এখন সময়টা ২০৫২। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪-৫ বছর আগেকার হবে, যে-যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল ইন্ডিজ কফি শপকে ঘিরে প্রথমে তা না-বুঝতে পারলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে নীল চোখের মেয়েটি কাজ করতে আসে, মূল গণ্ডগোলটা তাকে ঘিরেই। যে-পাঁচ জন বয় ইন্ডিজ কফি শপে কাজ করত, তার মধ্যে তিন জন নীল চোখের পাল্লায় পড়ে পুরো গোল্লায় গিয়েছিল। শেষ দু-জন স্টাফের একজন এবং ম্যানেজার নিজে— দু-জনেই একইসঙ্গে বর্তমানে ওর পাল্লায় পড়েছে। আমার যা অনুমান ছিল, তাতে মনে হতো— ম্যানেজার হয়তো আর দু-এক বছরের মধ্যেই ছবি হয়ে যাবে, আর তখন হয়তো মার্গারিটা আমায় প্রশ্ন করবে, এবার কি তোমার পালা?
এটা কিন্তু ঘটনা, ওই নীল চোখের মেয়েটি একদিন আমাদের টেবিলে সার্ব করতে আসার সময় মেয়েটির চোখে আমার চোখ পড়েছিল, আর সেটা মার্গারিটা ভালোভাবেই খেয়াল করেছিল।
মার্গারিটা বলে বসেছিল, “কী, ওই নীল চোখ তোমার পছন্দ?”
না না, ওসব কিছু নয়, এটা নেহাতই বা নিছকই এক ঠাট্টা। আর ঠাট্টা বলেই আমিও তখন ওকে বলে বসেছিলাম, “এর’ম হলে তো আমার তোমায় হারাতে হবে!”
যাই হোক, আসল কথায় আসি, একদিন আমি আর মার্গারিটা রাস্তায় গল্প করতে করতে ইন্ডিজের কফি শপের এনক্লোজ়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তার আগেই দূর থেকে একটা যে ভয়ংকর গোলমাল হয়েছে— বুঝতে পারছি, রাস্তায় লোকজনেরা চাপাস্বরে তা আলোচনা করছে, কোনও অজানা আশঙ্কায় তারা কেমন চুপ মেরে আছে। কিন্তু সেটা কোথায় হয়েছে তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি। ইন্ডিজ কফি শপের সামনের দিকটায় এসে দেখছি এখন বেজায় ভিড়! মানুষে মানুষে ছয়লাপ। তবে কি রাজনৈতিক কোনও কেস? মালিককে ধরে নিয়ে কি… পাবলিক চাপ, ধোলাই দিচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমি আর মার্গারিটা, ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখি বীভৎস দৃশ্য! ওই নীল চোখের মেয়েটির লাশ পড়ে আছে মাটিতে!— মাথা আর ধড় বিচ্ছিন্ন হয়ে খানিক দূরে পড়ে রয়েছে। নাহ্, কোনও রক্তচিহ্ন নেই! সারা দেহটা পুড়ে গেছে, শরীরের ভেতরের লোহার হাড়-সহ জড়ানো তারের কঙ্কালটা বেরিয়ে এসেছে, আর সিলিকনের কৃত্রিম মাংসগুলো পুড়ে ঝলসে গেছে! আর ওই মাথাটা, সেটা পড়ে আছে খানিক দূরে, যার থেকে খুলে পড়েছে প্লাস্টিকের চোখটা, যা পড়ে রয়েছে আমারই পায়ের কাছে। সেই নীল চোখ, মনে হয় যেন আমার দিকে সে তাকিয়ে আছে…
আরও অবাক হবার বাকি ছিল
ঘটনাটা ঘটল ১৪ আগস্ট ২০৪৭-এ। পরের দিন ১৫ আগস্ট আমি আর মার্গারিটা যখন ইন্ডিজে যাই, আশ্চর্য, দেখি, আগের কেউ নেই! সেখানে তিন-তিন জন অতি অল্পবয়স্কা সুন্দরী মহিলা সার্ভার। শুনলাম, ম্যানেজার ও শেষ কর্মীটি দু-জনেই উধাও। তাদের কথা কেউ বলতে পারল না। এমনকি ব্লু-নাইট হোটেলের ১১১ নম্বর ঘরটিও না।