তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

ইতিহাস শিরোমণি রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪ – ১৯৬৩)

অসম্ভব মেধাবী ও বহু বিষয়ে পারদর্শী রাধাকুমুদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৪ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে। পিতা গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ওই শহরেরে বিখ্যাত আইনজীবী। মাত্র তেরো বছর বয়সে কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে মাত্র পনেরো বছর বয়সে এফ. এ. পরীক্ষায় পাশ করেন। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী ইতিহাস ও ইংরাজি দুটি বিষয়েই অনার্স নিয়ে যখন বি. এ. পাশ করলেন তখন তার বয়স মাত্র আঠারো বছর। ওই একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাস ও ইংরাজি তে এম. এ. পাশ করলেন। সেই সময় মেধাবী ছাত্ররা ইচ্ছা করলে একই বছরে দুটি পরীক্ষা দিতে পারতেন।
   মাত্র আঠারো বছরের সদ্য যুবক রাধাকুমুদ প্রথমে কলকাতার রিপন কলেজে ও পরের বছর লেকচারার হিসেবে বিশপস কলেজে যোগদান করেন। তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে মোয়াট পদক লাভ করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন। পড়াশোনার সাথে সাথে ছাত্র থাকাকালীন তিনি স্বদেশী যুগে ডন সোসাইটিতে যোগদান করেন। সেই সময় তাঁর সঙ্গে এর সদস্য ছিলেন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং অধ্যাপক বিনয় সরকারের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বরা। এই ডন সোসাইটির আদর্শেই গঠিত হয়েছিল ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’। তিনি ওই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত জাতীয় বিদ্যানিকেতনের অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও নানা কারণে ওই বিদ্যানিকেতন বন্ধ হয়ে যায়।
   রাধাকুমুদের ভারতবিদ্যচর্চার প্রথম নিদর্শন ছিল ১৯১২  সালে ‘ History of Indian Shipping ‘ নামক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। প্রাচীন হিন্দু জাতির ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য জলপথে বহির্বিশ্বে যাতায়াতের প্রেক্ষাপট ছিল এর বিষয়বস্তু। এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন বিখ্যাত ভারততত্ববিদ পন্ডিত ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। এর পর তিনি বিলেত থেকে প্রকাশ করেছিলেন ১৯১৪ সালে ‘Fundamental Unity of India ‘ । এর ভূমিকা লিখেছিলেন ভারতবন্ধু ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামজে ম্যাকডোনাল্ড। এই বইটি ভারতবিদ্যাচর্চার ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন স্বরুপ। ভারতীয় সভ্যতার মর্মবানী বিঘোষিত হয়েছিল এই গ্রন্থে। এই একই সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৬ সালে বারাণসী বিশ্ববিদ্যালয় এ ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক পদে যোগদান করেছিলেন। এরপর লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়-এর ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। দীর্ঘ সিকি শতাব্দী তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়-এ কৃতিত্বের সঙ্গে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি সামগ্রিক ভাবেই তাঁর কর্মকাণ্ড ভারতবিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯১৭ সালে লন্ডন থেকে তাঁর ‘Local Government of Ancient India’ নামে আর একটি বিখ্যাত বই বের হয়েছিল। এই বইয়ের বিষয়বস্তু ছিল যে বর্তমান ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার মতো সেই প্রাচীন কালেও ভারতীয় সমাজে স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল তাকে তুলে ধরা। এই বইয়ে তিনি শিলালিপি ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থের আলোকে তাঁর মূল্যবান মত তুলে ধরেন। ১৯২১ সালে লন্ডন থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Nationalism in Hindu Culture ‘ যেখানে প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতার মর্মবাণী উদ্ভাসিত হয়েছিল। ১৯২৪ সালে  প্রকাশিত ‘Men and Thought in Ancient India’ গ্রন্থে তিনি উপনিষদের প্রবক্তা যাজ্ঞবল্ক্য থেকে শুরু করে মহামানব বুদ্ধ, অশোক , তারপর গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত হয়ে হর্ষবর্ধন পর্যন্ত বিচরণ করেছেন। এই মহা গ্রন্থে তিনি প্রাচীন ভারতের মহান সন্তানদের সঙ্গে দেশের সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
   বড়োদার মহারাজা স্যার সায়াজি গাইকোয়ার রাও ছিলেন রাধকুমুদের অনুরাগী এবং গুণমুগ্ধ। তাঁর আমন্ত্রণে তিনি বড়োদায় গিয়ে অশোকের উপর কয়েকটি মূল্যবান বক্তৃতা করেছিলেন। বিভিন্ন প্রত্নতাত্বিক ও বৌদ্ধ সাহিত্য মন্থন করে তিনি তাঁর বক্তৃতার তথ্য আহরণ করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতা গুলি পরবর্তীতে একত্রিত করে ‘গাইকোয়ার লেকচারস ‘ নাম দিয়ে ১৯২৮ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতবিদ্যাচর্চায় তাঁর সারা জীবনের এক অবিস্মরণীয় অবদান ছিল হিন্দু সভ্যতার নানা দিকের বিস্তৃত আলোচনা করে লেখা বিশাল আকর গ্রন্থ ‘Hindu Civilisation’. এই মহা গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেছেন কি ভাবে সুপ্রাচীন কাল থেকে নানা জাতি ও  ধর্ম গোষ্ঠী তাদের সাংস্কৃতিক আত্তিকরণের মধ্যে দিয়ে কি ভাবে এক মহাজাতিতে পরিণত হয়েছে। তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে চন্দ্রগুপ্ত  মৌর্য এর উপর কিছু বক্তৃতা করেছিলেন। সে বিষয়কে তিনি সংঘবদ্ধ করে রচনা করেছিলেন ‘Chandragupta Mourya and His Times’. তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ের গ্রন্থ ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘Ancient India’ যেখানে প্রাচীন ভারত সর্ম্পকে তাঁর সামগ্রিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। এই বইটি ছাত্রসমাজ, শিক্ষকমহল, সাধারণ পাঠকবর্গ সব কাছে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাঁর কৃতিত্বে অভিভূত হয়ে বড়োদার মহারাজ রাধাকুমুদকে ‘ ইতিহাস বিশ্ব শিরোমণি ‘ উপাধীতে ভূষিত করেন। একজন ঐতিহাসিকের এই অবিস্মরণীয়  কৃতিত্ব ভারতবিদ্যাচর্চার প্রাঙ্গনে মহীরূহ রোপন করেছে। তাঁর ভারতবিদ্যাচর্চা আজকের প্রজন্মের কাছে ততটা পরিচিত না হলেও ইতিহাসের জগতে যারা একটু খোঁজ খবর রাখেন তাদের কাছে নিশ্চয় ইতিহাসবিশ্বশিরোমণি রাধাকুমুদ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান নি। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *