তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
মহামোহপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী (১৮৭৮ – ১৯৫৯)
ভারতবিদ্যাচর্চার এক অবিস্মরণীয় নাম বিধুশেখর শাস্ত্রী। জন্মেছিলেন মালদহ জেলার হরিশচন্দ্রপুরে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৭৮ সালে। তাঁর পিতা এবং ঠাকুরদা উভয়েই ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত। ছোট বেলা থেকেই তাঁর মধ্যে দুটি গুন লক্ষ্য করা যায়, এক প্রবল অধ্যয়ন স্পৃহা এবং দুই সংস্কৃত এর প্রতি অনুরাগ। এই দুয়ের সম্মিলন তাঁকে পণ্ডিত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ছিল।
চতুষ্পাঠীতে ‘ কাব্যতীর্থ ‘ পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করে তিনি বারাণসী যান সংস্কৃত সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানে তিনি বেদান্ত অধ্যয়ন করেন। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি ‘ যৌবনবিলাস ‘ ও ‘ চিত্তদুত ‘ নামে দুটি সংস্কৃত কাব্য রচনা করেছিলেন। ন্যায়, বেদ, বেদান্ত প্রভৃতি নানা শাস্ত্রে পারদর্শী হবার পর তিনি বারাণসীতে ‘ মিত্রগোষ্ঠী ‘ নামে একটি উচ্চ মানের মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। এই পত্রিকাতে ভারতবিদ্যাচর্চা বিষয়ক লেখনী প্রকাশিত হতে থাকে। এগুলির মধ্যে দিয়ে দেশের অতীত গৌরব নিয়ে আমাদের চোখের সামনে একটা স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে।
১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে আসেন এবং সেখানে তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে সংস্কৃত শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে বিধুশেখরের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর জ্ঞান ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়। তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ শাস্ত্রী ‘ বলে ডাকতে থাকেন। পরে তিনি সবার কাছে শাস্ত্রীমহাশয় নামেই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। কবিই তাঁকে পালি ভাষা ও বৌদ্ধ সাহিত্য সম্পর্কে উৎসাহিত করে তোলেন। তার পর কবির উৎসাহেই তাঁর প্রথম কাজ হল পালি ভাষায় রচিত বিখ্যাত বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘ মিলিন্দ পনহো ‘ – র বঙ্গানুবাদ করা। এটি ছিল গ্রীক নরপতি মিরান্ডার ( ভারতীয় নাম মিলিন্দ) সঙ্গে বৌদ্ধ পন্ডিত নাগসেনের কথপোকথনের কাহিনী। বিধুশেখরই ছিলেন প্রথম যিনি এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি উপনিষদের মূল বিষয়গুলি নিয়ে, তার সাথে টিকা টিপ্পনী সংযোজন করে ‘ উপনিষদ সংগ্রহ ‘ নামে প্রকাশ করেন। এরপর তিনি ‘ শতপথ ব্রাহ্মণ ‘ এর বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। বিশ্বভারতীর যে মূল ভাব বৈদিক স্তোত্র ” যত্র বিশ্বম ভবত্যেক নীড়ম ” তা বিধু বাবুই নির্বাচন করে দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিদ্যা ভবনের অধ্যক্ষের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ইতিমধ্যে তিনি তিব্বতী ও চৈনিক ভাষাটাও রপ্ত করে নেন এবং উক্ত ভাষাগুলিতে লিখিত বৌদ্ধ শাস্ত্রমূলক গ্রন্থের ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন এবং কিছু কিছু বাংলা ভাষাতে অনুবাদ করেছিলেন।
সে সময় পুনের ওরিয়েন্টাল ভান্ডার রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে মহাভারতের একটি প্রামাণিক সংস্করণের উদ্যোগ চলছিল, সেখানে সারা ভারত থেকে যে সব পন্ডিতদের উপর দায়িত্ব ভার অর্পিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিধুশেখর। ১৯৩৬ সালে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান করেছিলেন। ঐ বছর ভারত সরকার তাঁকে ‘ মহামোহপাধ্যায় ‘ উপধিতে ভূষিত করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি অদ্বৈত বেদান্ত সম্প্রদায়ের প্রাচীনতম আচার্য গৌরপাদ রচিত ‘ আগমশাস্ত্র ‘ এর টিকা ভাষ্য সহ ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে হিন্দু বিবাহ রীতির মূল বৈদিক মন্ত্রগুলিকে সংকলন করে ‘ বিবাহ মঙ্গল ‘ নামক একটি অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন।
বহুভাষাবিদ অজস্র গ্রন্থের রচয়িতা সুপণ্ডিত বিধুশেখর ১৯৫৯ সালে মারা যান। ভারতবিদ্যাচর্চার এই কৃতি সন্তান তাঁর সংগ্রহের প্রায় ৩৫০০ মূল্যবান বই গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার কে অর্পণ করে যান যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম কাজে লাগাতে পারে।