তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

রমাপ্রসাদ চন্দ (১৮৭৩-১৯৪২)

প্রবাদপ্রতিম স্যার আশুতোষ যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম. এ. ক্লাসে সিলেবাস প্রণয়ণ করেছিলেন, তখন তিনি এমন মানুষকে এই বিষয়ে অধ্যাপক মনোনীত করলেন আদপে যিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। দুরদর্শী, সাহসী, গুণীর কদর জানা স্যার আশুতোষের এই নিয়োগ যে একেবারে অভ্রান্ত ছিল তার প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনাকালে তাঁর অসাধারন প্রতিভার প্রকাশ এবং ছাত্রমহলে তাঁর অসম্ভব গ্রহণযোগ্যতা। শুধু ইতিহাস নয়, তার সাথে নৃতত্ত্ব, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংশ্লেষ ঘটিয়ে তিনি তাঁর মনীষাকে অনেক উচ্চাঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭৩ সালে ঢাকাতে। প্রথম পর্বের শিক্ষা ঢাকাতে শেষ করে তিনি বি. এ. পড়তে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ এ ভর্তি হন।
   বি. এ. পাশ করে তিনি প্রাইভেট টিউশন ছাড়া সে অর্থে কোনো কাজ জোগাড় করতে পারছিলেন না। পড়াশোনার প্রতি একান্ত আগ্রহে তিনি প্রতিদিন পায়ে হেঁটে সেই সময়ের ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীতে যেতেন। অবশেষে কলকাতার হিন্দু স্কুলে তিনি সহকারী শিক্ষকের পদে চাকরি জোগাড় করেন। অর্থচিন্তা কিছুটা দূর হবার পর তিনি আরো বেশি করে গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করেন। ইতিমধ্যে তিনি বদলি হলেন রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলে, সেখানে তিনি পরিচিত হলেন দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর পন্ডিতপ্রবর শরৎ চন্দ্র রায়ের এবং ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এর সাথে। এই ত্রয়ীর চেষ্টায় রাজশায়িতে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাঙালি জাতির উত্তপত্তি সম্পর্কে অসাধারন প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। এই তিনজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব রাজশাহীর অদূরে প্রত্নতাত্বিক অভিযান চালিয়ে পালযুগের অপরূপা পার্বতী মূর্তি এবং বত্রিশটির মতো ভাস্কর্য উদ্ধার করেছিলেন। বলা যেতে পারে এ ভাবেই তাঁর ভারতবিদ্যাচর্চার সূচনা ঘটে। ১৯১০ সালে তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি ‘। শরৎ চন্দ্র রায় এর সভাপতি, অক্ষয় মৈত্রেয় সম্পাদক এবং রমাপ্রসাদ এর পরিচালক নিযুক্ত হন। এই সমিতির অনুসন্ধান ও প্রকাশিত পুস্তাকাবলীর মধ্যে দিয়ে ভারত অন্বেষণের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিলো। এই সমিতির প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল রমাপ্রসাদ রচিত ‘ গৌররাজমালা ‘। এই গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তিনিই প্রথম প্রত্নতাত্বিক প্রমাণের সাহায্যে দেখালেন পাল রাজাদের রাজ্যের সীমানা খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর ভারতেও বিস্তার লাভ করেছিল। এই সিরিজের  পঞ্চম বই রমাপ্রসাদ লিখিত  ‘Indo-Arian Races’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে। এই বইটির বিলেতে পর্যন্ত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। বিখ্যাত ইন্দোলজিস্ট স্যার কিথ কর্তৃক বইটি ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। তিনি এই বইটির প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
    ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন অধিকর্তা স্যার জন মার্শাল রমাপ্রসাদের কাজের পরিচয় পেয়ে তাঁকে তাদের স্কলার হতে অনুরোধ করেন। তিনি স্কুল শিক্ষকতা থাকে ছুটি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে যোগদান করেন। তিনি সাঁচি স্তুপের থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নবস্তু নিয়ে একটি বিস্তৃত ক্যাটালগ প্রণয়ণ করেন। আর এই বিষয়ে সেখানকার গবেষণা পত্রে দুটি অসাধারণ নিবন্ধ রচনা করেছিলেন, যা বিদগ্ধ মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর ভারতবিদ্যাচর্চা মধ্য গগনে উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করেছিল। তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে মার্শাল সাহেব রমাপ্রসাদকে  বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির সংগ্রহশালার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছিলেন। তবে স্যার আশুতোষের আহ্বানে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির সাথে তাঁর সংযোগ ক্ষীন হয়ে যায়। অত্যন্ত সুনামের সাথে রমাপ্রসাদ ১৯২১ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব সামলানোর পর মার্শাল সাহেবের আবারও অনুরোধে তাকে সেখান থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিযুক্ত হয়েছিলেন কলকাতা মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ পদে। তাঁরই প্রচেষ্টায় মিউজিয়ামটি কে বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছিল। বিস্তৃত ক্যাটালগ প্রণয়ণ করা হয়েছিল। ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ইতিহাস শাখার সভাপতি হিসেবে বাংলার ‘মূর্তি ও মন্দির ‘ শীর্ষক যে বক্তব্য রাখেন তা পড়ে বই আকারে প্রকাশ পেলে তাঁর পাণ্ডিত্যের গভীরতা আরও উন্মোচিত হলো।
    ১৯৩৪ সালে লন্ডনে যে বিশ্ব নৃতাত্ত্বিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে তিনি দেশের প্রতিনিধি হয়ে যে অসাধারণ ভাষণ প্রদান করেছিলেন তা পরে লন্ডন থেকে ‘Race and Cult in India’ নামে পুস্তকাকারে বের হয়েছিল। এরপর ১৯৩৬ সালে লন্ডন থেকেই ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সহযোগিতাই মধ্য যুগের ভারতের ভাস্কর্য নিয়ে লেখা আরো একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ Medieval Indian Sculpture in the British Museum ‘ প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় প্রত্নতত্ব সন্ধানের অন্যতম পথিকৃৎ রমাপ্রসাদ ১৯৪২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল ভারতবিদ্যাচর্চার। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *