তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

সাহিত্যাচার্য প্রবোধ চন্দ্র বাগচী (১৮৯৮ – ১৯৫৬)

যে গবেষণার মাধ্যমে বিদেশের পন্ডিত মহলে প্রবোধচন্দ্র বাগচী ভারত তথা প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার এক সফল গবেষক গ্রুপে স্বীকৃতি পান তা হল, প্যারিসে তাঁর গবেষণার ফসল দুটি চৈনিক সংস্কৃত অভিধান সম্পাদনা করা এবং চীন দেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্য সম্পর্কে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ রচনা করা। অবশ্য ইতিপূর্বেই তিনি দেশের পন্ডিত মহলে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
   বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর বিশেষ স্নেহভাজন প্রবোধন্দ্রের জন্ম হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের যশোহর জেলায় ১৮৯৮ সালে। বাবার নাম ছিল হরিনাথ বাগচী। স্কুলে থাকাকালীন প্রবোধন্দ্রের ধ্যান জ্ঞান ছিল গণিত শাস্ত্র। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে ভারতীয় সভ্যতা এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরে তিনি ভারতবিদ্যা চর্চায় নিজেকে তখন থেকেই নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯১৮ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃত নিয়ে এম.এ. সম্পন্ন করেছিলেন। এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন দত্ত ভান্ডারকার এবং হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর মত বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের। ১৯২০ সালে এমএ পরীক্ষায় তিনি যখন প্রথম হলেন তার সঙ্গে সঙ্গেই উপাচার্য স্যার আশুতোষ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগে সহকারী অধ্যাপক রূপে নিয়োগ করলেন। এরপর তার শুধুই উত্তরণ।
   স্যার আশুতোষ জানতেন প্রাচীন ভারতের সঙ্গে চীন দেশের সম্পর্কের কথা, তাঁর এটাও জানা ছিল যে প্রাচীন ভারতে ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে জানতে হলে চিনা এবং তিব্বতি দুটো ভাষা জানা প্রয়োজন। সেই কারণে প্রবোধচন্দ্রকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শান্তিনিকেতনে আচার্য সিলভালিভির কাছে তিব্বতি ভাষা শেখার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অল্পদিনের মধ্যেই প্রবোধচন্দ্র আচার্য লেভির প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। তার সঙ্গে তিনি নেপালে গিয়ে সেখানকার রাজকীয় গ্রন্থাগারে বৌদ্ধ ধর্ম সাহিত্য ও সংস্কৃত সম্পর্কে দুষ্প্রাপ্য সব গ্রন্থ পাঠ এবং গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলেন। নেপাল থেকে তিনি গবেষণার কাজে লেভীর সঙ্গে কাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, কোচিন চীন এবং জাপান প্রভৃতি প্রাচ্য দেশগুলি ভ্রমণ করেন এরপর। বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য নেভি এবং পল পোলিওর কাছে গবেষণা এবং অধ্যয়ন করেন তারই ফলশ্রুতি নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা প্রবোধচন্দ্রের সম্পাদনায় দুই খানি চৈনিক সংস্কৃত অভিধান এবং চীন দেশে বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্য সম্পর্কে দীর্ঘ নিবন্ধন কাজের জন্যই প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংক্রান্ত সর্বোচ্চ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল :Docteur et Letters’ . প্রবোধ চন্দ্রের সেই নিবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই মধ্য এশিয়া হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম চীন দেশে প্রবেশ করেছিল। পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে কাশ্যপ মাতঙ্গ এবং ধর্মরত্ন নামে দুজন ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য চীনের হ্যান্ড বংশের সম্রাটদের রাজধানী সি – নাম – ফুতে উপস্থিত হয়ে সেখানে প্রথম বৌদ্ধমঠ স্থাপন করেছিলেন। ওই দুই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পরেও দশম শতাব্দী পর্যন্ত অনেক ভারতীয় বৌদ্ধ-শ্রমণ পরিব্রাজক এবং পন্ডিত চীন দেশে গিয়েছিলেন, অনুরুপে সে দেশ থেকেও বিখ্যাত চৈনিক ভারতবর্ষে এসেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের পাঠ নিতে। উভয় দেশের পণ্ডিতদের এই পারস্পরিক যাতায়াতের ফলে সংস্কৃত এবং পালি ভাষা থেকে অনেক গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
   পরবর্তীকালে দেখা গেছে এমন বহু গ্রন্থের আদি সংস্কৃত ও পালি রূপ খুঁজে পাওয়া যায়নি বা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু চীনা ভাষায় অনুবাদের সূত্র ধরে সেই গ্রন্থ গুলির বিষয়বস্তু বা মতার্থ উদ্ভাবন করা সম্ভবপর হয়েছিল। সাহিত্য আচার্য প্রবোধচন্দ্র চীনা ভাষায় অনুবাদের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আবিষ্কার করেছিলেন। এই গবেষণায় সহস্রাধিক চিনা অনুবাদ গ্রন্থে কাল নির্ণয় ছাড়াও অনূদিত গ্রন্থ গুলির বিষয়বস্তু সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছিল। ১৯২৫ সালে প্রবোধচন্দ্র দেশে ফিরে এসে তাঁর পুরনো জায়গা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপনায় যোগদান করেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সেই দ্বায়িত্ব পালন করে গেছেন। সেখানে তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত এবং পালি বিভাগের কাজ দেখাশোনা করা।
   ১৯২৭ সালে তিনি দ্বিতীয়বার নেপাল গিয়ে সেখান থেকে বহু মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য পুঁথি উদ্ধার করে এনেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে অপভ্রংশ লেখা যে বৌদ্ধ গান ও দোহা সংগ্রহ করে এনেছিলেন যা চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষায় প্রাচীনতম নিদর্শন রূপে স্বীকৃত। ১৯৮৭ সালে ১৯২৭ সালে প্রবোধচন্দ্রের সংগৃহীত দুষ্প্রাপ্য পুথি গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সেই চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদ যার শুদ্ধরূপ মূল ব্যাখ্যা ও ভূমিকা সহ তিনি কয়েকটি অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ।যেমন – ‘Doha kosh with notes and translation’  এবং ,’Materials for a critical edition of old Charyapads’ প্রভৃতি। ১৯৩৯ সালে তন্ত্র সম্পর্কে’Studies in the Tranta ‘তার লেখা গ্রন্থ এবং ১৯৪৪ সালে ভারত এবং চীনের সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে লেখা গ্রন্থ ছিল খুবই বিখ্যাত। আসলে প্রবোধচন্দ্রই দেশের মধ্যে প্রথম গবেষক যিনি ভারত এবং চীনের প্রাচীন সম্পর্কের ইতিহাস উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর চিনা ভবনের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি আমন্ত্রিত অধ্যাপক রূপে চীন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের দেশে ফেরার পর তিনি বিশ্বভারতীর ভারতবিদ্যা বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারত সরকার বিজয়লক্ষী পন্ডিতের নেতৃত্বে চীন দেশে যে সাংস্কৃতিক মিশন পাঠিয়েছিলেন অধ্যাপক বাগচী তার একজন সম্মানিত সদস্যরূপে সেখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
   বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য তিনি মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১. ভারত ও চীন ২. ভারত ও মধ্য এশিয়া ৩ ভারত ও ইন্দ – চীন ৪. বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্য। এ ছাড়া সেই সময়ের বাংলা সাময়িক পত্রিকা গুলির বিভিন্ন সংখ্যাতে তার লেখা  প্রকারান্তরে ভারতবিদ্যা চর্চাকেই সমৃদ্ধ করেছিল।
   অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও গবেষণা আর উপাচার্য হিসেবে প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাতেই তাঁর বেশিরভাগ সময় কেটে যেত। তারই মধ্যে দেশ-বিদেশে নানা সাংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগদান করে তাঁর জ্ঞানগর্ভ ভাষণে সেই সম্মেলন গুলিকে ঋদ্ধ করেছিলেন। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ৫৭ বছর ২ মাস বয়সে এইরকম এক মহান প্রতিভাধর ব্যক্তি প্রয়াত হয়েছিলেন। তাঁর অকাল প্রয়াণে ভারতবর্ষ ভারতবিদ্যা চর্চার এক মহান বাঙালীকে অসময়ে হারিয়েছিল। 

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *