তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
অধ্যাপক সুশীল কুমার দে (১৮৯০ – ১৯৪৮)
বাংলা প্রবাদ চর্চার প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সুশীল কুমার দে। তবে শুধু প্রবাদ চর্চার ক্ষেত্রেই নয়, ভারতবিদ্যাচর্চার আঙিনায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর জন্ম ১৮৯০ সালে কলকাতার এক সংস্কৃতিবান পরিবারে হয়েছিল । সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ছিল আবাল্য অনুরাগ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সুশীল কুমার আইন পরীক্ষাতেও বি. এ .এবং এম.এ.তে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক থাকলেও মূলত বাড়ির পরিবেশের কারণে বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষার প্রতি অনুরাগ তাঁর জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেই কারণে শুধুমাত্র ইংরেজি সাহিত্যের একজন কৃতি অধ্যাপক হবার বদলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার এবং বাংলা প্রবাদ সংগ্রহের ও প্রবাদ চর্চার প্রবাদ পুরুষ।
১৯১৫ সালে সুশীল কুমারের নিবন্ধ ‘ দা আওয়ারলি ইউরোপিয়ান রাইটার্স ইন বেঙ্গলি ‘ তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহীত পুরস্কার এনে দিয়েছিল। আর ১৯১৯ সালে তাঁর গবেষণামূলক নিবন্ধ ‘ হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি লিটারেচার ইন দি নাইনটিন্থ সেঞ্চুরী ‘- র জন্য তিনি পেলেন প্রেমচাঁদ রায় চাঁদ স্কলারশিপ। সে বছর তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে লন্ডন স্কুল অফ oriental studies এ গবেষণা শুরু করেছিলেন। অধ্যয়ন এবং গবেষণার জন্য তিনি সেখানে ১৯২১ সাল পর্যন্ত অতিবাহিত করেছিলেন। তারপর জার্মানিতে গিয়ে কিছুদিন সেখানকার বন বিশ্ববিদ্যালয়র অধ্যাপক আকবির কাছে পাঠ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি লন্ডনে থাকাকালীন প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য বিচারের ধারা নিয়ে কাজ করেছিলেন। তাঁর গবেষণালব্ধ বিষয় দুটি আলাদা খন্ডে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ স্টাডি ইন দা হিস্ট্রি অফ সংস্কৃত পলিটিক্স ‘ নামে। এই অসাধারণ গবেষণার জন্য সুশীল কুমার লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. উপাধি পেয়েছিলেন। প্রাচ্যবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ তাঁকে নিয়ে গেল অন্য এক জগতে। অলংকার শাস্ত্রের বিখ্যাত পন্ডিত কুন্তক রাজনাকের জন্ম দশম একাদশ শতাব্দীর কাশ্মীরে। তাঁর লেখা অলংকার শাস্ত্র নিয়ে বিখ্যাত বই ‘ বক্রক্তি জীবিতম ‘ ভারতের নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে অত্যন্ত পরিশ্রম করে এবং মেধার সাহায্যে সুশীল কুমার সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। পন্ডিতদের মতে সুশীল কুমারের শ্রম এবং মেধার ফলেই এই দুর্লভ গ্রন্থ প্রকাশিত হতে পেরেছিল। এছাড়া তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল আরও দুটি দুর্লভ গ্রন্থ, একটি ছিল দেববোধচার্যের ‘ জ্ঞান দীপিকা ‘ ও কালিদাসের ‘ মেঘদুত এবং ‘আরেকটি ছিল বিলমঙ্গলের ‘ কৃষ্ণকরনামৃত ‘।
সুশীল কুমার ১৯২৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতর অধ্যাপক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকাকালীন অবস্থাতেই পুনের ভান্ডার কার ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের অনুরোধে প্রায় দু বছরের মতন ছুটি নিয়ে সেখানে গিয়ে মহাভারতের দ্রোন পর্ব ও উদ্যোগ পর্ব বর্ণনা করেছিলেন। একটি ছোট্ট উদাহরণ থেকে এ কাজের বিশালতা বোঝা যায়। তা হল এ দুটি পর্ব সাত হাজার শ্লোকের সমষ্টি, এর প্রতিটি শব্দের পাঠ নির্ণয় ভারতের নানাস্থানে পাওয়া বিভিন্ন বর্ণমালায় লেখা প্রায় ৬০টি পুঁথি মিলিয়ে করতে হয়েছিল। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে তিনি ১৯৪২ সালে রচনা করেছিলেন আরেকটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ আরলি হিস্ট্রি অফ বৈষ্ণব ফেথ এন্ড মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ফ্রম সংস্কৃত টু বেঙ্গলি সোর্স ‘ ৭০০ পৃষ্ঠার এই বইটি বাংলার ধর্মীয় এবং সামাজিক ইতিহাসের এক অসামান্য দলিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে তিনি কিছুদিন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরপর ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত নব প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক-এর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। ১৯৬১ সালে তিনি ‘ ঠাকুরস্মৃতি ‘ বক্তৃতামালা প্রদানে আমন্ত্রিত হয়ে আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নন্দনতত্ত্বের সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের উপযোগিতা বিষয়ে কয়েকটি মনোজ্ঞ ভাষণ প্রদান করেছিলেন। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র বা রসতত্ত্বচর্চার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পণ্ডিত মহলে সুশীল কুমার এক উজ্জ্বল নাম হয়ে বিরাজ করেছিলেন। মাতৃভাষা বাংলাতেও তাঁর রচনার পরিমাণ অনেক। সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যে গ্রন্থ গুলি ভারতবিদ্যাচর্চার পক্ষে এক অন্যতম দলিল হয়ে রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদত্ত তাঁর ‘শরৎস্মৃতি বক্তৃতামালা ‘ সিরিজে তিনি অনেকগুলি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন যেগুলি পাঠক মহলে প্রচুর সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘দিপালী ‘,’ সায়ন্তনী ‘,: লীলায়িতা ‘ এবং ‘ প্রাক্তনী ‘। ভারতবিদ্যাচর্চায় তাঁর উজ্জ্বল কাজ গুলির জন্য দেশ-বিদেশের পণ্ডিত মহলে তিনি তো বরনীয় ছিলেনই তবে সাধারণ গবেষক থেকে শুরু করে গড়পরতা বাঙালির কাছে তাঁর পরিচয় মূলত বাংলার হাজার প্রবাদের ভান্ডার হিসাবে। নয় হাজারেরও বেশি বাংলা প্রবাদ সংগ্রহের পর সেগুলি সম্পাদনা করে প্রকাশ করা তাঁর জীবনের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল।
ভারত বিদ্যাচর্চার এই অসামান্য পণ্ডিত সুশীল কুমার দেশ-বিদেশের যে সমস্ত সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, লন্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য পদ লাভ, লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের পরিদর্শক অধ্যাপকের পদ লাভ, ভারত সরকারের সংস্কৃত কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি প্রভৃতি। পরিণত বয়সে এই কলকাতা শহরে অধ্যাপক সুশীল কুমার দে প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৬৮ সালে। কিন্তু আমরা বোধহয় প্রয়াণের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই তাঁকে প্রায় ভুলতে বসেছি। প্রয়াণের পূর্বে তিনি তার বিশাল অমূল্য গ্রন্থভান্ডার পুনের ডেকান রিসার্চ ইনস্টিটিউট কে দান করে যান যাতে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাজে লাগে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন