তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
দার্শনিক শিরোমনি সুরেন্দ্র নাথ দাসগুপ্ত (১৮৮৭ – ১৯৫২)
ভারতবিদ্যাচর্চায় আজ যে কৃতি বাঙালির কথা আলোচনা করা হবে তিনি হলেন একজন শ্রুতকীর্তি দার্শনিক, সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত। জন্মেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া তে এক সম্ভ্রান্ত সংস্কৃতজ্ঞ পরিবারে। বাল্যবয়স থেকেই তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন। শোনা যায় মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার আগেই সংস্কৃত ভাষাতেই ধর্ম ও দর্শন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মেধাশক্তির প্রখরতা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯০৮ সালে তিনি সংস্কৃত তে এম. এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় হন। আবার দুই বছর পর তিনি দর্শন শাস্ত্রেও অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এম.এ. পাশ করেন। ১৯১১ সালে তিনি রাজশাহী সরকারী কলেজে সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর ভারততত্ত্বের উপর প্রথম কোনো লেখা প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে পতঞ্জলির যোগ দর্শনের উপর আলোচনা সমৃদ্ধ নিবন্ধ ‘The Study of Patanjali’. এই রচনা তাঁকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্রীফিত ‘ পুরস্কারের সম্মান এনে দেয়। ১৯২০ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি এরপর দর্শন শাস্ত্রের সামগ্রিক ইতিহাস লেখার প্রয়োজন অনুভব করেন, কারণ তাঁর মনে হলো যে মাধবচার্যের ‘ সর্ব দর্শন সংগ্রহ ‘ ছাড়া আর কোনো বই নেই। তবে সমস্যা ছিল সেই সময় তিনি যেখানে কর্মরত ছিলেন সেই চট্টগ্রামে এই সর্ম্পকে তেমন কোনো গ্রন্থাগার ছিল না। তাঁর আগ্রহের কথা জানতে পারেন মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী। তিনি এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর আর্থিক সাহায্যে ১৯২০ সালে বিলেত গিয়ে দর্শন শাস্ত্রের সুপণ্ডিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. সি. টেগার্টের কাছে পাশ্চাত্য দর্শনের পাঠ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে ভারতীয় দর্শনের উপর গবেষণা। ইতিমধ্যে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পদ লাভ করেন। সেখান থেকেই প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে ভারতীয় দর্শনের মহাগ্রন্থ ‘A History of Indian Philosophy, Vol-I’. এই গ্রন্থে তিনি বেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ ছাড়াও জৈন, সাংখ্যা দর্শন, শঙ্করাচার্যের বেদান্ত ভাষ্য আলোচনা করেন।
এরপর তিনি ১৯২২ সালে দেশে ফিরে এসে তাঁর পূর্বতন চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করেন। ঐ বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় তন্ত্রশাস্ত্রের উপর তাঁর গ্রন্থ ‘General Introduction of Tantra Philosophy ‘. ১৯২৪ সালে তিনি যোগদান করেন প্রেসিডেন্সী কলেজে। ঐ বছরই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রতিনিধি হিসেবে ইতালী তে অনুষ্ঠিত International Philosophy Congress এ যোগদান করেন। এই সম্মেলনে বিখ্যাত দার্শনিক বেনেদিত্ত ক্রোচে বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বৌদ্ধদর্শন নিয়ে ক্রোচের মতের সঙ্গে যেখানে তাঁর মতের অমিল হয়েছে, সেখানে ক্রোচে যে ভ্রান্ত তা তিনি অকপটে ব্যক্ত করেছিলেন। এরপর তিনি আমেরিকার শিকাগো বিশ্বিদ্যালয়ের Harris Foundation সিরিজের বক্তৃতামালায় ছয় টি বক্তৃতা করেছিলেন, যেগুলি পরে ‘ Hindu Mysticism ‘ (Norman Harris Foundation Lectures) নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
সংস্কৃত ও দর্শন অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে তিনি ভারততত্বের সাধনা করলেও বিজ্ঞানের নানা শাখায় তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। ১৯৩৬ সালে রোমে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চার উপর এক অসাধারণ বক্তৃতা করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে রোম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করে। কর্ম জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। অবসর গ্রহণের পর তাঁর সংগৃহীত প্রায় ১৫০০০ অমূল্য গ্রন্থ তাঁর অসময়ের সুহৃদ মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্রের স্মৃতিতে বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে যান। ইংরেজী ছাড়াও তিনি জার্মান, ফরাসী, ইটালিয়ান ভাষাও রপ্ত করেছিলেন। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েও ভারতীয় দর্শনের লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধারে ব্রতী হয়েছিলেন। দেশবাসীর দুর্ভাগ্য সেই কাজ সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই ১৯৫২ সালে ১৮ ডিসেম্বর লখনউ শহরে মারা যান। তিনি মারা যাবার পর তাঁর ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসের শেষ খন্ড প্রকাশিত হয়। তিনি ভারতের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চেতনাকে ভারতবিদ্যাচর্চার উচ্চে অধিষ্ঠিত করে আমাদের চিরঋণী করে গেছেন। প্রতিভাস ম্যাগাজিন