শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
বিষয় পরিচিতি
(রেভারেন্ড জেমস্ লঙ যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)
চেনা অচেনার রঙে জীবনের ক্যানভাস
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ঘরের চালে জল পড়ার শব্দে আমার অন্তরে জাগিয়ে তুলল কত কথা। এই দেশের শিক্ষিত বাঙালিদের প্রাণপণ প্রচেষ্টাকে সাহেবসুবোরা লোক দেখানো প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও ভেতরে ওদের কার্যসিদ্ধি করার দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েছে। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক আর লর্ড মেকলে ভারতীয় প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবকে ছড়িয়ে দিয়ে যুবসমাজের মঙ্গল করেছিলেন এই প্রয়াস অযৌক্তিক ও বিতর্কিত কিনা সময় বলবে। তবে শহুরে গুটিকয়েক উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার ইন্ধন যুগিয়েছিলেন, এটা হলফ করে বলা যায়। এর গোপন রহস্যটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। অক্ষয়কুমার দত্তদের চিন্তা চেতনার সবটুকুতে আর যাই থাকুক সদিচ্ছার অভাব ছিল না। “বাহ্যবস্তর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ একপাশে সরিয়ে রাখবে এমন সাধ্য কার আছে। বিদ্যাসাগর মহাশয় “বাঙ্গালার ইতিহাস”, “জীবনচরিত” ও “বোধোদয়” মুদ্রণ ও প্রচার বাঙলা গদ্যকে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছে। রামতনু লাহিড়ীর উপবিত পরিত্যাগ করা নিয়ে দৃঢ় মনোভাবে অনেক সামাজিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন বটে তা অসহনীয় ও অমানবিক কিন্তু আধুনিকতার যে বীজ রোপণ করেছিলেন তাতে সামাজিক চরিত্র ও নীতিতে এক ঝড় তুলে দিয়েছে। ইংরেজদের এই ধারণা পুরোপুরি অমূলক যে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার গোটাটাই শুধুমাত্র পেছনেই টানছে – এই কথাটা মানতে গেলে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সভ্যতাকেই অস্বীকার করতে হয়। খোলা মন নিয়ে না ভাবলে কতটুকু গ্ৰহণ করবো আর কতটুকুই বা বর্জন করবো এটা নিরূপণ করা মোটেই সহজ কাজ হবে না। আমার চিন্তার রেখাগুলো মাঝে মাঝেই বড় অগোছালো হয়ে যায়। শুরু আর শেষের মধ্যে একটা গোলমাল লেগেই থাকে। নিজেকে নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড় করাতে গেলে যে মনোবলের অধিকারী হতে হয়, আমি বোধহয় সেই ব্যক্তি নই। যে দ্বন্দ্ব নিয়ে আমি বেঁচে থাকি, আর স্বদেশীয়রা আমাকে যেভাবে দাগিয়ে দেয়, এর মধ্যে কোন কথাটা সত্যি আমি নিজেই বুঝতে পারি না। পরাধীনতার শৃঙ্খল যে জাতিকে ক্রমশ গ্ৰাস করছে, তার মুক্তির জন্য যে আত্মবিশ্বাস তা পাশ্চাত্যের ভাবধারা থেকে উঠে আসবে এ কেমন কথা, নাকি নিজে থেকেই ওদের আরও ডুব দিতে হবে। নদীর খালবিলের এই দেশে সাঁতরে পাড়ি দেওয়া তো অভ্যাসের ভেতরেই রয়েছে। জমিদার রাজা মহারাজারা কোনো কালেই এদের দরজায় শিক্ষার আলো তো ফেলেই নি বরঞ্চ প্রজাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মূর্খ বানিয়ে রেখেই পেয়েছেন এক চরম পরিতৃপ্তি? আমাদের স্বদেশীয়রা এদের পায়ের নীচে মাড়িয়ে যায় নাকি এদের স্বদেশীয়রা সেই দায়িত্বটা পালন করে এসেছে এতকাল, চিন্তাটা আমাকে বেসামাল করে দেয়, প্রকৃতির শরীরের রঙ পাল্টানোর মতো। বৃষ্টির রকমটা যেন পাল্টে যাচ্ছে, ঝড়-তুফান হয়ে আছড়ে পড়ছে মাঠে ময়দানে, বনে-বাদাড়ে। আমার স্ত্রী আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় ডিম করে রাখা হ্যারিকেনটার সলতেটা উস্কে দেয়। আর তো চুপ করে ঘরে থাকা যাবে না। ঘরের চালটা যদি উড়ে যায় ঝড়ের দাপটে, থরে থরে সাজানো বইগুলো তো বাঁচবে না। বইখাতাগুলো ঘিরেই তো আমার যাবতীয় স্বপ্ন, এই দেশের জনগণকে দেবার মতো আমার তো এছাড়া আর কিছু নেই। বিষাক্ত সাপটাও ফাঁকতালে ঢুকে পড়েছে এক কোণে। ও বোধ হয় নিজেও কোনো আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ফণা দেখে আমাদের দুজনেরই চক্ষু ছানাবড়া। তবে এই বিশ্বাসে জড় হয়ে রইলাম ওর বোধ হয় এক সময় নিজের সঠিক ঠিকানা খুঁজে নেবে।
দিনের বেলাতেই আমি দেখতে পাই অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। চন্দ্র সূর্যের গত বাঁধা নিয়ম এখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ওরা যে আলাদা, ওদেরকে ঘিরে যে পর্দা ঝোলানো আছে তা-ও জড়িয়ে রয়েছে এমন করে, চিনতে চাইলেও যে চেনা যায় না। হুড়মুড় করে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে যদি নিজেকে জানান দেয়, তাহলে রাজা উজির মন্ত্রী সান্ত্রীদের তৎপরতা বাড়ত বই কি। আমাদের ছায়াদের নিয়ে তখন কাটাকুটি খেলা ছেড়া অন্য উপায় থাকত না। লাভ লোকসানের যে হিসাবটা নিয়ে ওরা অঙ্ক কষে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার লম্বা হাত এসে থাবা বসাত। কড়ায় গন্ডায় উশুল করে নিত দেনাপাওনা । নিজের জাতটাকে যে আমি ষোলো আনা চিনি জানি, তাঁদের আদব কায়দা মেলাতে যাওয়া যে মূর্খামি তাই নিয়ে আমি সন্দেহাতীত। খালি মনে হয় দূরত্বটা বজায় থাকুক, ওরা নিজের মতো মানুষ হোক তাতে আলপথে কিংবা কাঁচা রাস্তায় কাঁটা ফোঁটার বন্দোবস্ত অন্তত থাকবে না। না হলে কোনো সম্পদের গন্ধ যদি একবার নাকে লাগে, আমাদের মতো পাদ্রীদেরও ছেড়ে কথা বলবে না। প্রয়োজনে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে গরাদে ঢুকিয়ে দেবে। কোর্ট-কাছারির আচার বিচার কোন দিকে যে মোড় নেবে কে বলতে পারে। যা কিছু আইনের মারপ্যাঁচ সবটাই শাসকের কুদৃষ্টিকে প্রশ্রয় দেবে বলেই না তৈরি। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার যে না করলেই নয়, এই কথাটা মঙ্গলকামী মানুষের যেমন বুঝতে হবে, মঙ্গলাকাঙ্খী মানুষদেরও না বুঝলে চলবে না। ঘরের মধ্যে বসে পুঁথিগত বিদ্যা কপচালেই চলবে না, মুটে-মজুর, কামার কুমোর তাঁতী চাষী, দোকানদারদের মনের কথাও মিলিয়ে নিতে হবে যা কিছু ভাবনায় আসছে, যা করতে চাই বলে গুছিয়ে নিয়েছি সবটাই জোরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে, তা না হলে ফলাফল হবে অশ্বডিম্ব।
এত কূটকচালি আর ধর্মের ইমারত গড়া নিয়ে কিছু মানুষের আদেখলাপনা আর হ্যাংলামি শুধু নিন্দনীয় নয়, আসল নকলের তফাৎটুকুর মাঝখানের পর্দিটাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে। মানুষের মনের মুখোশকেও প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। নির্যাসটুকু চাপা পড়ে গিয়ে নিছক পাগলামিটাই দৃশ্যমান হয়। ধর্ম প্রচারক সত্তাটা বড়ই দোদুল্যমান, কোন পথে ফুলের বিছানা পাতা আছে, আর কোন পথে কাঁটা অত ঘুরপথে গিয়ে বোঝা দুঃসাধ্য, আবার সোজা পথে গিয়ে নিজের কথাগুলো বললে সবটুকু যেন বলা হয় না, আংশিক বলার দায়ে সমালোচকদের খড়গহস্ত নেমে আসতে সময় লাগবে না। এখানে অনেক উঠোন, ডানে বাঁয়ে বাগানের ছড়াছড়ি, ফুল তোলা আর ফুলের গন্ধ নিঃশ্বাসে না নিলে মানুষগুলোর রোজনামচায় কোথায় যেন অপূর্ণতা ঢলে ঢলে পড়ে। আহার জোটে কি জোটে না শুধু ভাঁড়ার ঘরে পরখ করলে হয় না, রসুইঘরের হাঁড়িকুড়িও নেড়েচেড়ে দেখতে হয়। ধর্মের জীবন আর জীবনের ধর্মে যে রাজ্যে রাজ্যে দেশে দেশে আর পৃথিবীময় যে কত তফাৎ চোখ মেললেই বোঝা যায়, কান পাতলেই শোনা যায় কত তো গুঞ্জন আর বেয়াক্কেলের বেয়াদবিতে যে কী হাল হয়, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সাধারণের মস্তিষ্কের অধিকার দাবি করে বসে, মানুষের মানুষে এই যুদ্ধ তো ছাই চাপা থাকে। দিনে মানে তাকে চেনা যায় না, আঁধার নামলেই ছড়িয়ে যায় বিন্দু বিন্দু হয়ে চোরাগোপ্তা, কে বাঁচবে আর কে মরবে, কারা কখন মারবে কে জানে! জানার কথাও তো নয়, মগজে কখন কোন ভাবনা রাজত্ব করবে, গুরুজী নিজেই ধন্দে থাকেন, মানুষ তো কোন ছার! আমার ইচ্ছাগুলো এলোমেলো হয়ে আমার নিজের সঙ্গেই কথা বলে। কথা ছুঁড়ে দিলেই কাজের কাজ হবে সে কথাটাই বলি কী করে। এক তাঁতীর ছেলের কাছে আমার ডাক গিয়ে পৌঁছেছে। সে এসেই আমাকে প্রথমেই প্রশ্ন করে – ‘আগে আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন ফাদার?’ আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম জবাব দেব বলে। কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নেয়।
প্রশ্নবান যে ছেলেটা এইভাবে ছুঁড়বে কে জানত। ছাপোষা মানুষের ঘরে বেড়ে উঠলেও মোক্ষম প্রশ্নটাই এমন ভাবে ছুঁড়ল, আমার বুকে বিঁধে গেল। আমার নীরবতা দেখে বলেই তো ফেলল, ‘ভারতের জনগণের মনের জমিতে যে ধর্মের ফসল ফলছে, তার কি কোন খোঁজ করছেন আপনারা কখনও? জানতে চেয়েছেন কী আমরা আসলে কী চাই? আমাদের ভাণ্ডারে কী মজুত আছে? আমাদের সম্পর্কের কোথায় গিঁট বাঁধা আছে?’ ওর কথার জালে জড়িয়ে গিয়ে আমি যে বোকা বনে যাচ্ছি, ও বুঝতে পেরে আত্মশ্লাঘা অনুভব করল, নাকি এতদিনের চাপা ক্রোধটা প্রকাশ করতে পেরে ভাবল আর কী কী নতুন ঢঙে বলে ওর জাত চেনাবে। এমন কথায় ও ভাবে দোষের কিছু নেই বরঞ্চ আমার মনে এমন ভাবনা দানা বেঁধেছিল – এই দেশের এত তো গাঁয়ে গঞ্জে যুবক যুবতীরা রয়েছে ওরা কীভাবে বেড়ে উঠছে, কী চিন্তা ওদের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ইংরেজদের মতো এত শক্তিশালী শাসকরা ওদের চাহিদা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে না, তবে কি কোনো সংগত প্রশ্ন ওদের মধ্য জন্মায় নি কখনও! ওদের অধিকার নিয়ে ওরা সচেতন নয়, খালি মুষ্টিমেয় ভদ্রলোকদের মনের কথা জেনে ওরা ক্ষান্ত হয়! এই যুবকের তপ্ত চোয়াল আমার অন্তরে বুদ্বুদের জন্ম দেয়। আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম ও আরও প্রশ্ন করুক। প্রশ্নের জালে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে নাস্তানাবুদ করে ফেলুক তবেই তো আমার সুপ্ত ভাবনাগুলো জেগে উঠবে, আমার চলার পথের ছন্দহীনতাকে জাগিয়ে তুলে বলবে, ‘আর ভেবো নাগো, ওই মুখগুলোতে মোলায়েম করে হাত বুলিয়ে দাও, মুছে দাও এক নিমেষে যত রাজ্যের ব্রণ, ফুসকুড়ি, কালো কালো দাগ, যা ওরা অনেক কষ্ট করেও মুছতে পারে নি।’ কারা দিয়েছে এইসব দাগ, কখনই বা দিয়েছে? দেবার আগে একটিবারের জন্যেও ভাবে নি – ওরা আমাদেরই লোক। নাকি দুমড়েমুচড়ে শরীরটাকে নিয়ে লোফালুফি খেলে পেয়েছে এক তেতো বিদঘুটে আনন্দ, যে আনন্দের ফোয়ারা ছুটিয়ে বশংবদ করে রাখার পশ্চাতে রয়েছে এমন এক অচ্ছেদ্য নিখুঁত পরিকল্পনা যা কোনো কালেই ওদের ভাবনার সুযোগই দেবে না – কত সময়ের আগে। কত পুরুষের আগে ওরা মাথা নুইয়ে ছিল, দণ্ডি কেটে পৌঁছে গিয়েছিল দেবতার থানে। আমার নজর এড়ায় না ওদের ভেজা ভেজা চোখ, আধা উলঙ্গ শরীর বাঁকিয়ে শুধুই নিস্তেজ পলক ফেলা। ওরা কালের চাকায় ঘুরে মরছে, কে এসে থামাবে সেই চাকার ঘূর্ণন? তাই তো এত ধুলোবালি গায়ে মেখেও খুঁজে পায় না ফাটা চামড়ার আসল রঙখানা – কালো, শ্যামলা না অন্য কিছু। ভাবেও নি, ভাবার তাগিদটুকু অনুভব করে নি। কারা ওরা, ওদের জমিতে গেঁড়ে বসেছে? মোগল! পর্তুগিজ! ওলন্দাজ! ফরাসি! ইংরাজ! ওরা বলে চলে, এরা শুধু কান পেতে শোনে, শুনতেই থাকে, জবাব কুলায় না, জিবের ডগায় এসে আটকে যায়। শুনতে পাচ্ছিলাম এই দেশীয়দের সঙ্গে মেলামেশায় শাসকদের গাত্রদাহ হয়েছে। ওরা আমাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়, তাই নিয়ে কত প্যাঁচই না কসছে। এসব কথা যে গায়ে মাখতে নেই আমার স্ত্রী ভালো করেই জানে। ও নিজেও উপলব্ধি করে, আমাকেও সান্ত্বনা দেয়। ‘আগে তো জানতে হবে আসলে রোগটা কোথায়? তবে না প্রতিষেধক আবিষ্কার করার উপায় খুঁজতে হবে।’ বিদেশ-বিঁভুয়ে এসে একে তো জল হাওয়ায় মানিয়ে নিতে ও যে লেজে গোবরে হয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারলেও ওর উৎসাহ উদ্দীপনায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে নি। মেয়েদের অসহায় মুখগুলো নিয়ে ও দিনরাত ভেবে মরে, ‘এদেরকে টেনে তুলতে হবে, না হলে চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। তুমি কী দেখেও দেখ না, এদেশের পুরুষরা ওদের কলুর বলদের মতো দিনরাত খাটিয়ে মরে, বিনিময়ে দুবেলা দুমুঠো ভাতই তো জোটে, এর চেয়ে বেশি আর কী। মনের কথা যে বলবে সে মানুষ কোথায়। মেয়েরা যে নিজেদের খুঁজে পাবে, সেই রাস্তায় কত খানাখন্দ, এত জোর নেই যে টপকে আসবে, অনেক সময়ের দরকার পাদ্রী সাহেব। কিন্তু মরি আর বাঁচি শুরু তো করে ফেলতেই হবে।’
সাহেবরা কত নিন্দাই না করে – ‘ বর্বর, মুর্খ, গর্দভ হাভাতের দল। যেমন নাচাব, তেমনি নাচবে, বাণিজ্যর ওরা বোঝে কি?’ না, কথাগুলো হজম করে নিতে গিয়ে আমার ঘুম উড়ে গেল। উচিত শিক্ষা দেওয়া জরুরি কিন্তু কোন পথে! হয় শত্রু না হয় মিত্র, মাঝামাঝি কিছু তো হয় না। এই দেশকে ইংরেজরা কোন চোখ দিয়ে দেখতে চেয়েছিল ওরাই জানে তবে শোষণের ভূখণ্ড হিসেবে যে বেছে নিয়েছে এই নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যে কর্মকাণ্ড ওরা করে বেড়াচ্ছে তা কেবলই নিজেদেরকে বিশ্বাঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। ওদের শোষণের স্বরূপ কতটা নিম্ন রুচির তা আমি আমার মাতৃভূমি আয়ারল্যান্ডের মাটিতেই বসেই টের পেয়েছিলাম। সভ্যতার যে রূপ ওরা বিশ্বকে চেনায়, বড়াই করে বেড়ায়, তা আসলে খোলস মাত্র, একটুখানি নাড়াচাড়া করলেই অন্তঃসারশূন্যতা বেরিয়ে আসে। ওদের বাহ্যিক চাকচিক্য আর জীবনদর্শন ওদের সীমানাতেই অটুট থাকে, বাকিটা শুধুই প্রহেলিকা। আমি একশ শতাংশ নিশ্চিত হয়ে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারি, আজ না হয় কাল ওদের প্রভুত্ব পৃথিবী আর স্বীকার করবে না। যে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আজ শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে, তা অচিরেই ছুঁয়ে যাবে লক্ষ মানুষের অন্তরে, সেদিন আমি হয়তো স্বদেশে ফিরে যাব, ভারত জেগে যাবে, জগৎ সভায় জায়গা করে নেবে। এই দেশের স্বশিক্ষিত মানুষের রুচিবোধে আছে শতাব্দী প্রাচীন সংস্কৃতির ছোঁয়া যার রেশ আকাশে বাতাসে মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রতিনিয়ত আমি টের পাচ্ছি ওদের আতিথেয়তায়, চালচলনে আর উদারতায়। হ্যাঁ নিষ্ঠুরতা আছে, কুসংস্কার আছে আবার প্রবলভাবে বিপরীত স্রোতও আছে, যার জোয়ারে এই অসহিষ্ণুতা ধুয়ে মুছে নিয়ে চলে যাবে। এক ছাত্র প্রতিদিনই নিজেকে গুটিয়ে রেখে জড়সড় হয়ে পেছনের সারিতে বসে। মুখে রা-টি কাড়ে না। সে-ই সাহস সঞ্চয় করে জানতে চাইল, ‘সাহেব-বাবা একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ নির্ভয়ে কর। ‘ এই যে প্রাচীন আর নবীন রীতির এত যে রেষারেষি আমরা কোনটাকে আঁকড়ে ধরবে।’ উত্তরটা সহজ আবার কঠিনও বটে। তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়া আমার সঠিক মনে হলো না। ছাত্রটি অসন্তুষ্ট হয়ে দিন দশেক পরে দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করল। এইবার আমি এড়িয়ে যাওয়া সংগত মনে করলাম না। তুমি কি এমন কোনো সমস্যায় পড়েছ যার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছ না। ছেলেটি গড়গড় করে কত কথা বলে গেল। যার সারমর্ম হলো এই ছাত্রটি এক দ্বাদশ বর্ষীয়া বিধবার প্রেমে পড়েছে। জানাজানি হলে একঘরে করে দেবে, এখন উপায় কী। ওর আধুনিক শিক্ষার মন বলছে, পুরণো নিয়ম ঘুমিয়ে থাকুক। ওদিকে মেয়ের বাবা জানতে পেরে নালিশ জানিয়েছে, ‘এমন শিক্ষা পেয়ে সমাজ তো রসাতলে চলে গেল সাহেব-বাবা, আপনি এর বিহিত করুন. না হলে আমরা যে সমাজচ্যুত হব।’ উভয় সংকটে পড়ে বিবেকের ডাক শুনব, না সামাজিক রীতিনীতি মেনে নিয়ে নির্দোষ ছেলেটার বিপক্ষে যাব। বললাম, বিধবা হলে প্রেম করার অধিকার নেই, আমি বিশ্বাস করি না। সমাজের সংস্কারগুলো পাল্টানো জরুরি, তবে সময়টা এখন এই চিন্তা গ্ৰহনের পক্ষে অনুকূল নয়, আরও একটু সময় নাও। ততদিনে তুমি এই এলাকায় একটা গ্ৰন্থাগার তৈরির দায়িত্ব পালন কর। ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির কাজে আসবে। যেই সমাজ তোমায় অনুমতি দিচ্ছে না, একদিন এই সমাজটাই পাল্টে যাবে। সেদিন মেয়েটিও বাঁচবে, তোমার ভালোবাসাও বেঁচে যাবে। ছেলেটি কি বুঝল জানি না, এই বিষয়ে আর কোনো কথা জানতে চাইল না। এই প্রশ্নে এদেশীয় দের মনেও উদয় হয়েছিল – কাকে বরণ করা যায়, প্রাচীন না নবীন ? ইংরেজদের পক্ষে মেকলে ও বেন্টিক নবীনের পক্ষে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে এই কথা ফেলনার নয় – লর্ড আমহাষ্টকে লেখা ১৮২৩ সালের রামমোহনের চিঠি। নবীনকে সাদরে গ্ৰহণ করতে গিয়ে প্রাচীনকে বর্জন করেন নাই, সমন্বয়ের মধ্যে খুঁজেছিলেন জাতির মুক্তি।
আমি প্রতিদিন চাই মানুষের জীবন সকল অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হোক। এমন সুন্দর পৃথিবীর স্পর্শ পাক, যে পৃথিবী মায়া মমতায় ভরা, আনন্দের ঢেউ খেলে চলে মাঠে ঘাটে, লোকালয়ে, বনে বনে। হয়তো আমি স্বপ্নের বীজ ছড়িয়ে দেবার পণ করেছি, জমি তৈরির উপকরণগুলো মনের মতো হয়ে উঠছে না। রাশিয়া ইউরোপের জনগণের বেঁচে থাকার লড়াই, বৈজ্ঞানিক চিন্তা, যুক্তিবাদী মনন আমাকে বৈশ্বিক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করেছে, আলাদা করে দেখলে মনে হয় কোথাও নিজেকে ছোট করে ফেলেছি না তো। এই প্রশ্ন আমার জাগে বই কি, যে ধর্মের ভুবনে আমি হেঁটে চলেছি সেটাই কি মুক্তির পথ, নাকি বহুত্বের মিলনায়তনে ফিরে গেলেই মিলবে নানা স্বাদের ভূমি? ফসল তো ফলাতে হবে, পাকা ধানে ভরে উঠবে শস্যক্ষেত্র। আমি শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখব সকল শোভা ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে। কোন বাছবিচার নেই, সাদা কালোর তফাৎ নেই, গুলির শব্দ নেই, রক্তের হোলি খেলছে না কেউ, নিজের মুখে নিজের ভাষায় নিজের যন্ত্রণার ছবি আঁকছে। আমি শুনতে পাচ্ছি সেই কলধ্বনি, সময়কে জাপটে ধরে মানুষ আলিঙ্গন করছে, মৃত্যুর দরজা সপাটে বন্ধ করে জীবনের জানালাগুলো খুলে দিচ্ছে একটু একটু করে – পাখি ডাকছে ডালে ডালে, ফুল ফুটেছে আপন মহিমায়, আপন সুগন্ধিতে। এমন জীবনের উপহার আমি কেমন করে দেব, কবে দেব। যে দিকে তাকাই দেখি কারা যেন দৌড়ে আসছে ওই পথ দিয়ে যে পথগুলো আমি মাড়িয়ে এসেছি, এমন করে দেখার প্রয়োজন তো অনুভব করি নি, তাহলে কি দেখায় ভুল ছিল? বুঝলাম এখনও এমন এমন জায়গা রয়েছে যেখানে আমার নজর এড়িয়ে গেছে। আমি এই দেশের ফুলের বাগান দেখেছি, ফুলের রঙ তো দেখি নি, ফুলের মধু তো চেখে দেখি নি, বাতাসের
কোমলতা অনুভব করেছি, উদ্দাম বাতাসের শব্দের ঘাত প্রতিঘাত গায়ে তো মাখি নি। কত হাঁ-এর সঙ্গে কত তো না আড়ালে চলে গেছে, আমকে তো এক এক করে খুঁজে বের করে আনতে হবে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, কার এমন দুঃসাহস তাকে ঘর বন্দী করে! আমার দেশের বণিকরা শাসকের চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে, ভাবছে এমন করে দিন গুজরান হবে, কেউ ওদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না – তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।
গভর্ণর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ মনেপ্রাণে চাইতেন এই দেশে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাক আপন গতিতে। রামগোপাল ঘোষ তাঁর প্রস্তরমূর্তি নির্মাণের স্বপক্ষে কলিকাতার টাউন হলে ১৮৪৭ সালের ২৪ শেষ ডিসেম্বর যে ওজস্বিনী ভাষায় তেজময় বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে টর্টন, হিউম, কলভিল প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ইংরাজ ব্যারিষ্টাররা পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়েছিলেন তাঁকে বলা হলো ভারতবর্ষের একজন ডিমস্থিনিস্। ভারতীয়রা নিজেদের অবস্থানকে পুনর্নির্মাণ করবেন বলে জানান দিচ্ছিলেন একটু একটু করে। বুঝলাম জাগরণের ঘন্টা ঢঙ ঢঙ করে বেজে উঠছে, আর পেছন ফিরবার কোন সুযোগ নেই। জর্জ টমসন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর যাকে ১৯৪২ সালে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তিনিও ক্রমে ক্রমে একজন ভারত হিতৈষী হয়ে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির যে গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন তাও যেন এদেশীয়দের চিন্তা চেতনাকে উন্মোচিত করেছে নানাভাবে। “কালা আইন” ( Black Acts) নিয়ে চারদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। এই আইনের উপরে রামগোপাল ঘোষ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলেন। এশীয়দের ইংরেজদের হাতে থেকে রক্ষা করাই আইনের উদ্দেশ্য ছিল। কলকাতার ইংরেজরা চটে গিয়ে তাঁকে Agri-Horticultural Society-র সহকারী সভাপতির পদ হতে অধঃকৃত করলেন। এই সভা ১৮২১ সালে শ্রীরামপুরের সুবিখ্যাত কেরীর উদ্যোগে স্থাপিত হয়।
সময়টা অনেক ভালো কিছুকেই অভিনন্দন জানিয়ে ক্রমশ ধাবমান। আমার চিন্তার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এমন সব আশ্চর্য জিনিস নিয়ে হাজির হয় যেন গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে গ্ৰাস করে বসবে, কোনটা যে তুলে আনব আর কোনটাকে দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে দেব, তার বিন্দু বিসর্গ টের পাই না। এমন সময়ও যে আসে, কিছুই টের পাই না, তাহলে কত তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, সময়কে ইচ্ছেমত আগুপিছু করে নিতে পারতাম, রহস্যময় পৃথিবীটা একে একে উন্মোচিত হতো। সহিস বলল, ‘পাদ্রী বাবা, আমি যে এতদিন টাঙ্গা চালাচ্ছি, কত রকমের লোক তো দেখলাম, ফিরেও তাকায় না, প্রশ্ন তো দূরে থাক, এই আপনাকে দেখলাম আমাদের সুখ দুঃখের কথা জানতে। এই শহরটাকে নিয়ে আপনার এত কৌতূহল কেন!’ না, এমনটা নয়, আসলে তোমরাই তো দিনে রাতে টগবগ করে ঘোড়া ছোটাচ্ছ, এই শহরের রোদে পুড়ছ, বৃষ্টিতে ভিজছ, তোমাদের চোখে এমন কী ধরা পড়ছে, যা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। ‘পাল্টাচ্ছে বাবা পাল্টাচ্ছে, কত বড় বড় ইমারত হচ্ছে, গীর্জা হচ্ছে, মন্দির, মসজিদ, গুরুদুয়ারা ভরে যাচ্ছে, কাঁচা রাস্তা পাকা হচ্ছে, কত সাহেব সুবোরা রোজ আসছে গঙ্গার ঘাটে স্টীমারে চড়ে। ত্রিশটা বছর টাঙ্গা চালাচ্ছি, এই শহরের প্রেমে পড়ে গেছি। সুখ দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণা কিছু বুঝি না, এই শহরটা হামার। এখানের মানুষরা আমার নিজের মানুষ।’ দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না? ‘ এটাই তো হামার দেশ, আর কুথায়ও যেতে মন চায় না।’ এই সহিস আমার চোখ খুলে দিল। জীবনটাকে যে সহজ করে নিতে পারে সেই তো আসল মানুষ। বললাম, এস আমরা কিছুক্ষণের জন্য নিজের জায়গাটা অদল বদল করে নি। আমার কথা শুনে সহিস দুগালে হাত চেপে বলল, ‘তওবা তওবা।’ সত্যি সত্যি নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে বুঝলাম, শরীরের পরিবর্তন তো হলোই, মনের গতি যে কোনদিকে ছুটল, অনেক চেষ্টার পরেও আন্দাজ করতে পারলাম না। সহিসের কাছে জানতে চাইলাম কেমন লাগছে। মির্জাপুর স্ট্রিট থেকে এই লম্বা পথটা অন্যদিন পায়ে হেঁটেই চলে যাই। সময় লাগলেও মানুষের মুখগুলো দেখতে দেখতেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। কত দূর দূর লোকালয় থেকে রোজগারপাতির আশায় চলে আসে, আবার দিন ফুরোতে না ফুরোতেই ঘরে ফিরে যায়। ওদের নব্য বাবুরা কত দুর ছাই করে, মানুষ বলে গণ্য করে না। সহিংস যাত্রীর সীটে বসে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে কাঁচুমাচু করে বলে, ‘পাদ্রী বাবা আপনি আমায় দোষের ভাগি করলেন, ওপরওয়ালার কাছে আমি জবাব দেব কেমন করে?’
টালির নালাকে কেউ কেউ গোবিন্দপুর খাঁড়িও বলে থাকেন। কলিকাতা আসার আগেই শুনেছিলাম কর্ণেল উইলিয়াম টালি ১৭৭৩ সালে এই ধারাটিকে গভীরতা বাড়িয়ে সার্কুলার খালের সঙ্গে যুক্ত করেন, তাই তো আদি গঙ্গার এই নাম হয়। আমার টাঙ্গা এই নালার নাক বরাবর যেতেই মনে হলো কত মানুষের স্বপ্নের চাক্ষুষ করছি আমি। এটাও মনের সুখ, আনন্দের ফোয়ারা ছিটিয়ে যত এগোচ্ছি, উৎসুক জনতা যারা খাটাখাটনি করছিল, ঘরের বউঝিরা বারান্দার রেলিং-এর ধারে ছুটে এসে সকলে আমার কীর্তিকলাপ দেখে কত কী যে ভেবে বসল কী জানি। আসলে এমন আজগুবি দৃশ্য দেখতে পাবে ওরা কখনও কল্পনাতেও স্থান দেয় নি। বুঝলাম, প্রভু ভৃত্যর সম্পর্কটাই এতকাল ওদের মনের কোণে বাসা বেঁধেছিল, বিপরীত কিছু হলেই যেন মনে হয় কোনো বিপদের আগাম সংকেত। ওরা বুঝতেই পারছিল না, অচেনা জগৎটাই চেনা জগতের উল্টোপিঠ, উড়ে এসে জুড়ে বসে নি। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)