শরদিন্দু সাহা

লেখক পরিচিতি

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

বিষয় পরিচিতি

(রেভারেন্ড জেমস্‌ লঙ  যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)

  চলো মন নিজ নিকেতনে

কত কথাই তো শুনেছি। গা শিউরে উঠে, জিহ্বা শুকিয়ে যায়।  ‘লোনা-লাগা’ যুগ থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে কয়েক কদম এগিয়ে। অজীর্ণ রোগ থেকে রেহাই পেতে ঘরে গিয়ে কাঁচা থোড় খেত এদেশের মানুষ,ঘোল ও কল্মির ঝোল পান করত, গায়ে কাঁচা হলুদ মাখত। স্কুল ছাত্রদের এমন দুর্দশার কথা যত কম বলা যায় তত ভালো। শহরের যৌবনের তরঙ্গ এসে উথাল পাথাল করেছে বটে, তা কিন্তু একতরফা। এই তরঙ্গের গায়ে লেগে থাকে কত দাগ, আমার দৃষ্টির আড়ালে গেলেও মনের মাঝে বাজতে থাকে তানপুরার মতো। সুর আসে সুর যায় কিন্তু আমার ভেতরটা খান খান হয়ে যায়। মনে করিয়ে দেয় বারে বারে আমার দেশের মানুষের পরাধীন জীবন যাপনের কথা। তাই তো মাঝে মাঝে বলে ফেলি এই কী আমার নতুন কোনো স্বদেশ? যে যন্ত্রণা ওরা ভোগ করে চলেছে তার হদিস মেলা ভার। হ্যাঁ বলতে পারেন আমি শাদা চামড়ার মানুষ, এই দেশের মানুষদের সঙ্গে কেমন করে হিসেব মিলবে! মিলবে গো মিলবে, মেলাতে হবে। এদের অব্যক্ত ক্রন্দনের হিসাব কষতে হবে জোরকদমে। আহা! কত কিছুই তো করতে চাই। কোনটা ছেড়ে কোনটা করব, এই ধাপগুলো ছুঁয়ে ফেলা খুবই জরুরি। এটা বুঝতে পারি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরা আমাকে সেই সুযোগ দেবে না। ব্যবসায়িক ফায়দা লাভের চেষ্টায় ওরা মতিচ্ছন্ন হয়েছে, এই প্রান্তিক ছাপোষা মানুষগুলোর দিকে তাকাবার ওদের অবসর কোথায়? চারপাশে গভীর আঁধার, এই আঁধার পার করে আলোর খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবেই হবে, না হলে আমার যে নিস্তার নেই। তাই তো আমাকে নাড়া দেয় ফেলে আসা দিনের প্রতিক্ষণ।

কাঠ চেড়াইয়ের কল থেকে এক কর্মচারী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সাহেব-বাবা আপনি এই অসময়ে আমাদের এলাকায়!’ কথাটা হজম করতে সময় নিলাম। বুঝলাম বিনা মেঘে  বজ্রপাত হয় তো, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে নাকি! সে তো বলেই চলল, ‘ওই যে কৃষ্ণনগরের পাঠশালায় আমার ছেলেকে পড়ালেখা শেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, আমি সেই অমলের বাপ। হেডমাস্টারকে বলেছিলেন, ছেলেটার দিকে নজর রাখবেন মাস্টার। আপনার অসীম কৃপা না হলে ছুতোরের ছেলে কোনদিন পড়ালেখার মুখ দেখত, বলুন। সেই থেকে ভাবছি, আবার কোনোদিন যদি দেখা হয়, জিজ্ঞাসা করবো, পরদেশী মানুষদের জন্য আপনার এত দরদ কীভাবে হলো যখন কোম্পানির কর্তারা আমাদের মাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়, কুকুর বেড়ালের মতো মনে করে, আমাদের ইজ্জতের কোনো দাম দেয় না।’ কাঠমিস্ত্রি কথাগুলো বলেই ঢোঁক গেলে। হাত পা কাঁপতে থাকে। ‘সাহেব-বাবা, ভুল কিছু বললাম?’ ও আমাকে একখানা কাঠের চেয়ার টেনে বসতে দেয়। ওর চোখ দুটো ভিজে যায়। কেন যে ওর চোখ দিয়ে জল গড়ালো আমি বোঝার চেষ্টা করলাম। এই দেশের ছাপোষা মানুষগুলোর মন এত নরম, এত অল্পতেই মাথা নত করে, ভাবলাম পরম শক্তিশালী ব্রিটিশদের সামনে এরা মুখোমুখি হবে কেমন করে? তবে একটা কথা বলতেই হবে, এদের আত্মবিশ্বাসের তুলনা হয় না। কিন্তু শুধু আত্মশক্তিতে তো চিড়ে ভিজবে না। নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছে বটে, কিন্তু কামার কুমোর ছুতোররা রয়ে গেছে ঘোর অন্ধকারে, শত যোজন দূরে। এই দেশের উচ্চবর্গীয়রা নিম্নশ্রেণীর মানুষদের হিসাবেই ধরে না। এরা বেঁচে আছে কি মরে গেছে তারও খোঁজ রাখে না। সাহেব সুবোরা দিনরাত ধরে শুধু এই মন্ত্রই জপে – ‘চাষার বেটা চাষা না হলে আমাদের খাবারের যোগান দেবে কে?’ এই মনের দূরত্ব আর চিন্তার দৈন্যতা ঘুচবে কেমন করে আমার জানা নেই। এই মুহূর্তে জোড়া লাগানোর চেষ্টা যে বৃথা এই শহরের পন্ডিত ব্যক্তিগণের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নি। ওরা শুধু নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর বড় সাহেবদের তাবেদারী করতেই ব্যস্ত। এত সহজে শহরের এক কোণে পড়ে থাকা প্রান্তিক মানুষদের অভাব অভিযোগের কথা ওদের মস্তিষ্কে ঢুকবে না। অশিক্ষা কুশিক্ষায় জর্জরিত বঙ্গদেশের এই মানুষগুলো জানেই না কোন পথ দিয়ে হাঁটলে ওদের পায়ে কাঁটা ঢুকবে না অথচ কার্যসিদ্ধি হতেও বিলম্ব হবে না। ও আমার মনের কথা বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে হয়ত অনেক দূর চিনে নিতে পারত কিন্তু কোথায় যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেছে, দরদর করে ঘাম ঝরছে আর বলছে, ‘সাহেব-বাবা, আমাদের কথা কেউ আর ভাবে না, আর কোনকালে ভাববেও না, আপনি আর ভেবে মরেন কেন! আপনার এখন কত কাজ বাকি।’ আমি অবাক হয়ে গেলাম সামান্য মিস্ত্রী হয়ে আমার কাজের হদিস ও পেল কেমন করে? এই মানুষগুলোকে যত দেখছি আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, এত পিছিয়ে থেকেও এত চিন্তার স্ফুলিঙ্গ জন্ম নিয়েছে কেমন করে! নিশ্চয়ই আছে কোনো রহস্য। এই দেশের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে আমাকে যেই করে হোক দেখতে হবে, বুঝতে হবে কেমন করে ওরা যন্ত্রণার সঙ্গে ভালোবাসাকে  মিশিয়ে দেয়। 

কথায় কথায় আকাশে মেঘ জমলো। আঁধার নামলে দূরে সরে গেল কাছের মানুষ। দৃষ্টি যেন পৌঁছতেই চায় না, আমি যেখানে পৌঁছতে চাই, দেখে ফেলতে চাই অনায়াসে আমার আগত ভবিষ্যৎ। এত মায়াও জমা ছিল আমার অন্তরে! মায়ার গভীরে জীবনের অর্থই তো আমি খুঁজে চলেছি। নানা জিজ্ঞাসা যেন নিজের মতো জাল বিছিয়ে রেখেছে। একে অতিক্রম করে যে যাবো সে সাধ্য কোথায় আমার। প্রতিদিন প্রতিরাত আলো আঁধারিতে কত শত প্রশ্ন এসে জমা হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। কোনটা ছেড়ে কোনটা যে ধরব তার হিসেব কষতে বসে আমি নাজেহাল। আমি এগোব না পিছোব এর জবাবই বা কে দেবে। এখানে অনেক কর্দমাক্ত রাস্তা, কত জলাভূমি, ডোবা নালায় ভরপুর অঞ্চলের চারপাশে কত তরুলতা, কত ছায়াপথের লুকোচুরি খেলা, গাছে গাছে বসন্তের কোকিলেরা ডাক দিয়ে চলে যায়। কত কথাই তো ওরা বলে। মানুষের অন্তরে সেঁধিয়ে যেতে চায় বলেই তো ওদের এত ডাকাডাকি। আমি বুঁদ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি ওদের মিলিয়ে যাওয়া। শহরের অলিগলিতে অচেনা মানুষের ঠিকানারা উড়ে উড়ে বেড়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রতি মুহূর্তে ওরা পাল্টাচ্ছে নিজের মতো। বেঁচে থাকার যন্ত্রণা ওদের অতিষ্ঠ করে ফেলে। কোন পথে গেলে কার হাতে পায়ে ধরলে উপরে ওঠার সিঁড়ি গুলো পার করা সহজ হয়ে যাবে, ওরা তো জানে না। ফিরে যাবে না এমন সাধ্য কী আছে ! ওদের চলার পথে কত অবজ্ঞা, কত অবহেলা, কত মাথা নীচু হয়ে থাকা, কত বলার কথাগুলো দমবন্ধ হয়ে দলা পাকিয়ে যাওয়া। ওরা কথা চালাচালি করে বটে, সে বড় দূরের, নিকটের আর হলো কই। পথই যে কত সময়ের বলি চড়ায়, ভেবে ভেবে আমি অস্থির হয়ে উঠি, সে কথা কি জানে আনজনে? মনে পড়ে তো জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে শীতল বাতাসের শিরশিরানিতে দু’পাড়ের ঘরবাড়ির প্রতি চোরাটান, ওদের চঞ্চলতা, উদোম গায়ে মাঠ-জঙ্গলের মধ্যে আনাগোনা মনের কোথায় জায়গা করে নিয়েছিল ভাবখানা ওরা আমারই লোক। পাড়ে এসে পা ছোঁয়াতেই মনে হয়েছিল এই অজানা ভূখণ্ডটি আমার কর্মভূমি হয়ে উঠবে তো। আমি নিজেকে পারব তো মানানসই করে তুলতে! সেদিনের সেই কল্পনারা আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি আগন্তুক হয়ে আসলেও এদের চেনাজানা হতেই হবে আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু, না হয় কোনো অনাগত দিনে।  

গুপ্ত কবির আগমনের কথা শুনে আমি খানিকটা উৎসাহিত হয়েছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এসে তাঁর আসন গ্ৰহন করেছেন। ওই সভায় আমাকে দেখে অনেক কবিতা প্রেমীরা ফুসুর ফাসুর শুরু করে দিয়েছেন, এমন রসিকতা জন্মে দেখি নি। কারও ধারণা ছিল বাংলা কবিতার রসকস এই ম্লেচ্ছ আর কী বুঝিবে। তাও আবার যেই সেই কবি নন, স্বয়ং ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক বলে কথা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেই গেলাম। আশ্চর্য তো হতেই হয়, প্রথম বাংলা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদনায় শক্ত হাতে হাল ধরেছেন, তাঁর রসবোধ ও পান্ডিত্য আমার স্বদেশীরাও ধারে কাছে নেই। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল। তিনি ব্রাক্ষসমাজের সদস্যদের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার কথাও উল্লেখ করেছেন তাঁর বক্তৃতায় বারে বারে। বাঙালি বাবুদের হাততালি তো আর থামতেই চায় না। তোষামোদি করার বদভ্যাসটা ভালোই রপ্ত করেছে। এঁরাই আবার এদের স্বজাতিদের ছায়া মাড়ায় না, ব্রাক্ষণত্বের বড়াই করে, ইংরেজদের তোষামোদি করে পঞ্চমুখে, জাল, জুয়াচুরি, উৎকোচ, প্রবঞ্চনা, মিথ্যার বেসাতি করে ধনী সাজতে লজ্জা করে না। ঝোলেও আছে, অম্বলেও আছে। প্রসিদ্ধ বাঈজীর জন্য অনায়াসে টাকা ছড়াতে বাঁধে না, হাত খুলে খরচা করে আর সেকথা বৈঠকে বৈঠকে ফলাও করে জাহিরও করে। এই নিয়ে আবার কেউ দোষের কিছু দেখেন না। আমি জানি না এটা কোনও মানসিক বিকার কিনা, সমাজটাই হয়তো রসাতলে বসেছে। এরা এসবের থোড়াই তোয়াক্কা করে – সকলে উচ্ছন্নে যাক, নিজেদের ঠাঁটবাট যেন ষোলো আনা বজায় থাকে। এমন উদাসীন ভদ্র শিক্ষিত সন্তান কেই বা কবে দেখেছে। কলকাতাকে নরক বানিয়ে রেখেছে।না হলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে লিখতে হয়  – “রেতে মশা দিনে মাছি,/ দুই নিয়ে কল্‌কেতায় আছি।” 

গাড়োয়ান বলল, ‘সাহেব-বাবা মোরা দিন আনি দিন খাই। আদার ব্যাপারি জাহাজের খোঁজে কাজ কী। বাবুদের সঙ্গে আমরা কেন মিলতে যাব? তেনারা কী আমাদের সমাজের মানুষ।’ ওর কথার সারবত্তা আছে। বাবু সমাজের ঘর গেরস্থালি দিয়ে গোটা সমাজকে বুঝতে গেলে ভুলের বোঝা বাড়বে বই কমবে না। অভাব অনটনের দিন রাতের জ্বালা একেক জনকে এক এক রকমের ছুঁয়ে যায়। সকলের নাড়ির খবর না জানলে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে বই কী। কে জানে বাবু লোকদের গা থেকে কেমন দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে, ওদের ছায়া মাড়ালেই সারা শরীর রি রি করে উঠবে। ভোস্‌ ভোস্ করে দিন দুপুরে ঘুমায়, ঘুড়ি ওড়ায়, বুলবুলির লড়াই দেখে,  ফুর্তির কি শেষ আছে। সেতার, এসরাজ বীণ বাজায়, হাপ আকড়াই, পাঁচালি শোনে। তাতেই কি দিনের আলোতে সকল কিছুর আশ মেটে। রাত যত বাড়ে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য করে, খড়দহের মেলা ও মাহেশের স্নানযাত্রায় কলিকাতা হতে বারাঙ্গনাদের নিয়ে দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ আহ্লাদের ফোয়ারা ছোটায়। পোশাক-আশাকে কেটো ধূতি আর ফতুয়া পরা মানুষগুলোর সঙ্গে মিলবে কেন। ভিন্ন দুনিয়ার ভিন্ন মানুষ – বাউরি চুল, দাঁতে মিশি, ফিনফিনে কালাপেড়ে ধূতি, অঙ্গে মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে চুনট করা উড়ানী ও পায়ে বগ্‌লস দেয়া চিনের বাড়ির জুতা আরও যে কত রকমারি সাজ। সময় যত যায়, ইংরেজদের সঙ্গে তালে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেদের ঘরানাকে এমনি করে জলাঞ্জলি দেয় বাবুলোকরা। এদেরকে দেশের মানুষ হিসেবে বেছে নিলে দেশীয়দের অপমান করা হয়। এক বাংলাতে কত পৃথিবী, গোটা ভারতবর্ষে জাপটে ধরলে না জানি কত অনৈক্যের সুর বাজতে থাকবে, তার কুল কিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘সাহেব এসব গল্প আমায় শুনিয়ে কী লাভ?’ লাভ লোকশান কি এত সহজে বিচার করা যায়। গাড়োয়ান বলে, ‘আপনি কোন ধরনের মানুষ, জেতা হারার বিচার করেন না!’ জিতব বলে তো তোমাদের দেশের মাটি মাড়ায়নি। ‘তবে এলেন কেন এই পোড়া দেশে মরতে?’ বাঁচব আর বাঁচাব বলেই তো এসেছি। এই দেশের বাবুলোকদের কীসে যে আনন্দ হয়, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। দাশরথি রায়ের নাম শুনেছ? তা তুমি শুনবে কেমন করে। ওখানে তো তোমাদের জায়গা হবে না। কবির দলের বাঁধনদার ছিল। পরে পাঁচালি গানের পথ ধরেছে। এত অশ্লীল উপমার ছড়াছড়ি কর্তব্য নয়। ‘ওসব রসের অংশীদার হবো, এমন মানুষ আমি নই। নুন আনতে যার পান্তা ফুরায়, তার কি এসবের দোকানদারি সাজে। আমরা হলাম গিয়ে মেঠো লোক, আদারে-বাদারে ঘুরে বেড়াই, শিবের গাজন, চড়ক, পালাগান শুনেই মনের আবদার মিঠাই। আপনারা হলেন গিয়ে জ্ঞানী গুণী মানুষ, আপনাদের মনের ভাব বুঝব, সেই সাধ্যি কী আমাদের আছে, সাহেব-বাবা।’ তুমি তো বেশ বেড়ে কথা বল। কে বলে তোমাদের বুদ্ধি নেই। তোমরাই পার শাসকের কাছ থেকে সব অধিকার আদায় করে নিতে, বাকিরা তো মোসাহেবি করেই আখের গোছায়। ওরা কী করে বুঝবে তোমাদের কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা, অভাব অভিযোগের কথা। আমি এক নতুন স্কুল খুলেছি, তোমার ছেলেকে পাঠিও, পড়ালেখা শিখবে। তুমি চাও তো তোমার ছেলে দশের একজন হোক, মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। ‘চাই সাহেব-বাবা চাই। আমরা সমাজের এক কোণে পড়ে থাকি। কে আমাদের কথা ভাবে বলুন। বাপ ঠাকুরদারা মাথা নুইয়ে থেকেছে, মাথাওয়ালাদের পায়ের নীচে থেকেছে, তাই আমরাও থাকি। আমাদের কী ভুত আর কী ভবিষ্যৎ।’

অদূরে শশ্মানে চিতা জ্বলছে। জীবনের সকল গন্ধ উবে যাচ্ছে নিমেষে। এখানে কেউ কারও আছে কোন হিসাব চায় না, শুধু শোকে বিহ্বল হয়ে মরার গন্ধ শোঁকে। গলগল করে ওঠা ধোঁয়ায় দমকা হাওয়ার ধাক্কা লেগে বুঝিয়ে দেয় – জীবনকে আগলে রাখ। অস্থি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে উন্মুক্ত আকাশে বিলিন হয়। আমি নিজেকে বার বার ছুঁয়ে দেখি আর উপলব্ধি করি নিজের ভেতরের মানুষটা এই মুহূর্তে কোন চেতনায় ঘর করছে। অনেক প্রশ্ন এসে ধাঁধার সৃষ্টি করে চলে যায় কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। কে আমি, কেন আমি, কীসের জন্য আমি? বাংলার মাটি  এখন আমার শরীর ছুঁয়ে আছে, আমার অস্তিত্বের সবটুকু নিয়ে আমার দৃষ্টি আমাকে প্রশ্ন করছে ‘পাখির ডানার শব্দ শুনতে পাচ্ছ? নদীর ডাকাডাকি তোমার কল্পনাতে মিশে যাচ্ছে না তো ? দেখতে পাচ্ছ কি এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ।’ চিতার আগুন আমার চারদিকে কি বৃত্তাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নাকি ঘুরবে বলে সকল আয়োজনে মেতে উঠেছে? নিজেকে বড় অসহায় লাগে। তবুও যেন সত্য মনে হলো কতগুলো মানুষের মুখ, ওরা হাঁ করে আছে, ওরা নির্বিকার, ওরা মুখ ঘুরিয়ে নেয়, নিঃশ্বাসের বাতাসকে উপেক্ষা করে পৌঁছে যাচ্ছে নিজস্ব গন্তব্যে। কোনো সাড়া নেই, সকল শব্দরা থেমে গেছে। আমি আরও একটু এগিয়ে গিয়ে কথা চালাচালির সঙ্গে মিশে যেতে চাই যেখানে বাঁচার চিহ্নগুলো রমরম করছে। কথার মারপ্যাঁচে গুলিয়ে দিচ্ছে সব হিসেব। মরণপণ করে জীবনের কাছে এই যে স্বীকারোক্তি এর মূল্য তো কম নয়। জগৎ সত্য বলেই না মৃত্যুর ছায়ারা ওদের গিলে নিতে গিয়েও ভয় পাচ্ছে। তাই কি জীবনকে অর্থময় করে তোলার মধ্যেই রয়েছে সকল পরিপূর্ণতা। ভাবলাম এরা তো প্রকৃত অর্থে আমার অনাত্মীয়, গড়নে চলন বলনে ভিন্ন মেরুর। তবুও কেন বলতে পারছি না, না না এটা সত্য নয়, আরও এমন কিছু আছে যা আমাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে ‘এরাই সব’।  

শিক্ষা না হলে মানুষ চোখ থেকেও অন্ধ। এমন দিনও ছিল কেউ কেউ কেবল ব্যাকরণ স্মৃতি ন্যায় শাস্ত্র পড়ত। বেদ, বেদান্ত, গীতা, পুরাণ, ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞ ছিল।  শ্রীরামপুরের মিশনারিরা দেশীয় ভাষাতে বাইবেল প্রভৃতি গ্ৰন্থ অনুবাদের জন্য বাংলা ভাষার অনুশীলন করাতেন। পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ রচনা করেন। কলিকাতা শহরের বাবুরা জোর কদমে সন্তানদের ইংরেজি শেখাতে শুরু করলেন। শোনা কথা নবীন বাবু নামে এক কর্মচারী ঘোড়ার দানায় টিফিন করার জবাবে বলেন, “ইয়েশ্‌ শার্‌ মাই হাউস মার্নিং এণ্ড ইবনিং টুয়েন্টি লীভস্‌ ফল, লিটিল লিটিল পে, হাউ ম্যানেজ?” এই তো ছিল শিক্ষার ধরণ।  ‘আত্মীয় -সভা’ শেষে হেয়ার সাহেব বললেন, “রামমোহন বাবু, ‘এই দেশীয়দের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করা গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত। এই বিষয়ে আপনার মত কী’? রামমোহন বাবু বললেন, ‘এই বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই।” আমি দুটি ভিন্ন চিত্রের মুখোমুখি হই যখন কচি কচি মুখগুলো হাঁড় ভাঙা খাটুনি খাটে মাঠে ময়দানে, দরদর করে ঘাম ঝরে গোটা শরীর নিংড়িয়ে, আর এক দল শৈশবের দিন কাটায় বই বগলে। কাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে কে বলতে পারে। কী জানি হয়তো কারও জীবন হবে জানার লিপ্সায় ভরপুর আবার কেউ কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চুল ছিঁড়ে এক গোপন আঁধারে হাতড়াতে থাকবে আর জানতে চাইবে ‘এই জীবন নিয়ে লোফালুফি খেললে হিসাব মিলাবে কেমন করে!’ আমি চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দুপক্ষকেই দেখি আর ভাবি এই গুরু দায়িত্বের ভার বহন করার ক্ষমতা আমার আছে কী?

এমন ঘরের আচার বিচার জীবনে দেখি নি। আমি নিজেও জানিনা কেমন করে এর অন্দরমহলে প্রবেশ করব। ঘরের বউ ঘোমটা টেনে কাঠের পিঁড়িতে এক গ্লাস জল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখটা ঢাকাই ছিল। বাড়ির কর্তার কথা চালাচালিতে শুনলাম পূজা দেবী এই বাড়িতে ঘরকন্না করছেন বছর দশেক হলো। নামটা যেমন মিষ্টি, কথার উচ্চারণও কম মধুর নয়। আন্তরিকতা টের পাচ্ছি ধাপে ধাপে। আমার জানার খুব ইচ্ছা ছিল বঙ্গ ললনারা কেমন ঢঙে গৃহকর্ম সামলায়। এই যে বিদ্যাসাগর মশাই মেয়েদের পড়ালেখা নিয়ে এত দিনরাত মাথা ঘামান, আসলে তার হেতুটা কী! উনি কী সত্যি সত্যি সঠিক জায়গায় ঘা মারছেন। না, এই বধূটি এর বিন্দু বিসর্গ জানেন না। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও ওর মনের কথা জানা সহজ হলো না। বুঝলাম ওর অন্তরের পৃথিবীটা এতই গোপনীয়, জানতে বুঝতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে বই কী।  গণ্ডিটা যে নারীদের সীমানাতেই বাঁধা পড়ে আছে, এর বাইরে যে আসতে মানা, ওরা নিজেরা এই সত্যি কথাটা আর কবে বুঝবে। বাড়ির কর্তা কত কথাই তো গড়গড় করে বলে গেলেন। আমিও প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জানতে চাইলাম কোথায় এত শক্তপোক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ওদের মনটাকে। একটি শিশু এসে মায়ের আঁচল ধরে কেমন নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে রইল। ওই শিশুটি আর ওর মায়ের না-বলা কথার মধ্যে আমি কোনো তফাৎই খুঁজে পেলাম না। পুরুষটি একটু আধটু বর্ণপরিচয়ের সুযোগ সুবিধা পেলেও তেমন কিছু মনোযোগ দেবার উৎসাহ দেখান নি। নিজের গিন্নীর দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ও একটু এইরকমই। তাতে তেমন কিছু অসুবিধা নেই, কাজ চলে যায়। মেয়েমানুষ এর চেয়ে বেশি পা ফেললেই হোঁচট খাবে যে।’ এরপর আর কি কোনো কথা বাড়ানো যায়। একটু পরেই অনেকটা দূর থেকেই যে শব্দগুলো ভেসে এলো – ‘উলু উলু ধ্বনি’। এমন ধ্বনিতে বুঁদ হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা খোলা থাকে না।  বউটি স্বামীকে ডেকে ছোট্ট একটা কাঁসার থালায় দু-চারটে গোল গোল সাদা রঙের কী দিয়ে হাতটা আমার দিকে তাক করে বলল, ‘সাহেব-বাবাকে দিন।’ হিন্দু ঘরের বৌ স্বামীকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করে। আমাকে অবাক হতে দেখে কর্তা বললেন ‘ নারকেলের নাড়ু, ভয়ের কিছু নেই, নিশ্চিন্তে খান।’ এত মমতা ভরা অদেখা দৃষ্টি আমি জীবনেও কল্পনা করি নি এমনিতে কিন্তু বুঝলাম এদেশের মেয়েদের মনের জমিটা বড় উর্বর, ঠিকঠাক চাষ করলে উৎকৃষ্ট ফসল ফলবেই। বন্ধ ঘরের দরজা জানালাগুলো খুলে দিতে হবে। বললাম, আমার গিন্নীর ঘরোয়া পাঠশালায় পাঠাতে আপনার আপত্তি আছে?  কথাটা শুনেই ক্ষণেক থমকে গেল ওনার স্বামী। আমার ভাবনাটা জোর পেল উঠোনে রোদে শুকাতে দেয়া কাঁথায় অপূর্ব সুন্দর কাজ দেখে। চোখ জুড়িয়ে গেল মুহূর্তে। কী শৈল্পিক নৈপুণ্যে প্রকৃতিকে  সাজিয়ে তুলেছে । বাংলার মায়েদের এত ঘুমন্ত প্রতিভা দেখে প্রশ্ন না করে পারলাম না। আপনি মা কেমন করে ফুটিয়ে তুলেছেন?  এমন উত্তর আসবে আশা করিনি। কথাটা মুখে যেন বসানোই ছিল – ‘এই আর এমন কী,  আমাদের ঘরে ঘরে মেয়েরা এর চেয়ে ভালো কাজ করে।’ আরও কত প্রতিভা না জানি এরা লালন করে! এত দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে মেয়েরা দিনরাত সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে নিজেকে এমন করে উজাড় করে দিতে পারে আর যাই হোক এদের উপেক্ষা করা যাবে না, এখানে আলো ফেলতেই হবে, যেভাবেই হোক। শুধু আমি নই, আমার স্ত্রীও সায় দিয়ে বলল, ‘এদেশের শাসক কী করবে জানি না, গোটা পৃথিবীর নারীদের গল্প আমাকে এদের শোনাতেই হবে।’ 

এই দেশের আলো বাতাসে হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিওর আত্মা ঘুরে বেড়ায়। ওই তো গঙ্গার পাড়ের মুক্ত বাতাসের ছোঁয়ায় তাঁর কবিতার পঙক্তিগুলো সকলে কেমন মুগ্ধ হয়ে আজও যেন শুনছে, দোলা দিয়ে চলেছে কত না গভীরে, আমার ভাবনাকেও চঞ্চল করে তুলে ধাক্কা মারছে সজোরে। আমি তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে চাই। কেন মনে  হচ্ছে এই তো সেদিন আমিও ছিলাম, একই শ্রেণীকক্ষে বসে পাঠ শুনেছি আর শব্দের মায়ায় জড়িয়ে গিয়ে শৈশবকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,যৌবনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে এমন এক পাড়ে এসে উপনীত হয়েছি যেদিকে তাকাই শুধুই প্রকৃতির ডাকাডাকি, সবুজের সমারোহ, এই পৃথিবীটাকে বুকে করে বাংলার মাটির গন্ধ শুঁকছি। ছাত্রশিক্ষকের এমন সমধুর সম্পর্কের ছবি কে কবে দেখেছে, এমন কথা কে আর কবে শুনেছে। আহাঃ একবার যদি তাঁর বাগ্মীতার ছোঁয়া পেতাম। রামতনু লাহিড়ী, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়রা কতই না ভাগ্যবান হিন্দু কলেজে এমন শিক্ষকের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। না হলে কে এমন করে গভর্ণর জেনারেল লর্ড আমহাষ্টকে পত্র লিখতে পারেন ‘…অঙ্কশাস্ত্র, রসায়নবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, শারীরবিদ্যাকে অন্য বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত যদি প্রকৃতই ব্রিটিশ আইনসভা এদেশীয়দের উদার ও আলোকিত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়…।’  লর্ড ওয়েলেস্‌লির উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাঙ্গালা গ্ৰন্থ রচনা করেছিলেন “বত্রিশ সিংহাসন” ও “রাজাবলী”, রাজীবলোচন প্রণীত “কৃষ্ণচন্দ্র চরিত”, চণ্ডীচরণ মুন্সীর “তোতার ইতিহাস”। এইসব গ্ৰন্থ কয়জন দেশীয়দের বইয়ের টেবিলেই বা জায়গা পেয়েছে। বাঙলা গ্ৰন্থে পারসী শব্দের ছড়াছড়ি, বোধগম্য নয়, এখনকার বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। এক মাষ্টার মশাই তো বলেই ফেললেন, ‘ আপনি যাই বলুন, তাই বলুন আমরা কিন্তু নিজেকে এখানে খুঁজে পাই না, ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো তো দূরের কথা। বিদেশের ভাব দিয়ে তো স্বদেশকে চেনা যায় না। আমাদের কত অভাব, কত অভিযোগ, এইসব পড়ে তো ওরা কি করে বুঝবে, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের শিকড়ই বা কোথায়?’ কথাটা আমার কানে লেগে গেল। সত্যিই তো সবার আগে তো নিজেকে জানতে হবে, না হয় এই শিক্ষার মূল্য কী! সব যে বদহজম হবে। ইংরেজদের কার্যসিদ্ধি হবে বটে, বাবুদের অতৃপ্ত মনের খোরাকও জোগান দেবে কিন্তু দেশীয়রা থেকে যাবে যেই তিমিরে সেই তিমিরেই। ডাক্তার ফ্রান্সিস্‌ বুকানান হামিল্টন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন ‘কেবল ব্যকরণ স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্র পড়ে তো আর মন সমুন্নত, জগত ও মানবকে বুঝিবার সহায়তা হয় না। …তাছাড়া এদেশের পণ্ডিতদের বেদ, বেদান্ত, গীতা, পুরাণ, ইতিহাসের জ্ঞানগম্যেরও অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।’ একথাটা তো ঠিক কতিপয় কলিকাতার মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ইংরেজি শিক্ষা দিয়ে গোটা সমাজকে চেনা যায় না, খোলনলচে পাল্টে ফেলার জরুরি, যত তাড়াতাড়ি এই সত্য ভারতবর্ষের মানুষ বুঝতে পারবে, ততই মঙ্গল। সময় মানুষকে কতটা শেখায়, অনুমান করা কঠিন কিন্তু মানুষ সময়ের থেকে রোজ অল্পবিস্তর অনেক মূল্যবান সম্পদ খুঁজে নিয়ে ভবিষ্যতকে মনের মতো গড়ে নিতে পারে, এটা ধ্রুব সত্যি। এমন আলোর উৎসের কথা মনে নিয়ে আমি এমন আলপথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম যেখানে পিছপা হওয়া যায় না, অথচ সামনের পথটা কম পিচ্ছিল নয়। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *