এস.আজাদ

১ 

লম্বা গরমের ছুটির পর আজ স্কুল খুলেছে। গরমের ছুটি শেষ হলেও গরম শেষ হয়নি। এ বছর কালবৈশাখীর খুব একটা দেখা পাওয়া যায়নি। জ্যৈষ্ঠের নিদারুণ দহন যন্ত্রণায় যখন জীবনের মধু শুকিয়ে আমসি তখন মধুমাস নামের আর সার্থকতা কি? ফ্যানের তলাতেও বসা যায় না আগুন জ্বলে সারা অঙ্গ জুড়ে। ট্যাপের জলে হাত ধুতে গেলে ছ্যাকা লাগে। আষাঢ় মাস এসে গেছে, বর্ষা রানী আসবো আসবো করেও আসছে না। ল্যাজে খেলাচ্ছে। বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক রঞ্জন ঘোষ স্বভাব সিদ্ধ ব্যস্ততায় ডুবে আছেন মিড ডে মিলের হিসেবে। তার কাছে গোপন খবর আছে যে কোনদিন সেন্ট্রাল টীম ভিজিটে আসতে পারে। ফাস্ট পিরিয়ড শেষের ঘন্টা সবেমাত্র বেজেছে হন্তদন্ত হয়ে সলিল বাবু, যিনি ফিজিক্যাল এডুকেশনের শিক্ষিক হলেও শিক্ষিক ঘাটতির জামানায় সপ্তম শ্রেণীর ভূগোল টাও পড়ান, একেবারে প্রধান শিক্ষকের টেবিলের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন। 

— “স্যার খবরটা শুনেছেন?”

প্রধান শিক্ষক স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হিসাবের খাতা থেকে চোখ ও পেন না সরিয়ে চশমার উপরের ফাঁক দিয়ে সলিল বাবুর উদ্বিগ্ন মুখচ্ছবিটা দেখে চিন্তিত হলেন কিন্তু শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোনটা?”

—ওই যে সোফিয়ার ঘটনাটা।

— শুনেছি। স্যাড, ভেরি স্যাড।

— শুধু স্যাড! কিরকম হরিবল ঘটনা বলুন। তখন পই পই করে বললাম। মেয়েটার বিয়ে দিও না। বয়স কম, বাচ্চা মেয়ে।  এখন পড়াশোনা করুক। না শুনলে না কথা। বলতে বলতে কেমন বিষন্ন হয়ে গেলেন সলিলবাবু। প্রধান শিক্ষক ডুবে আছেন তার কাজে। আর কেউ কোন উত্তর করছে না দেখে খানিকটা আহত হলেন সলিল বাবু বললেন যাই দেখি, সেকেন্ড পিরিয়ডে আবার সিক্সের ক্লাস আছে। না গেলে ছেলেগুলো চেঁচামেচি করবে। নাইনের ঘর থেকে ম্যাডাম কমপ্লেন করতে আসবেন। সিক্সের ছেলেদের চেঁচামেচির জ্বালায় তিনি নাকি পড়াতে পারছেন না। কি যে ভারী পড়ায়! মনে করছে কিছুই বুঝিনা। আরে বাপু এই করতে করতেই চুলগুলো পেকে গেল। আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে অফিস থেকে বেরিয়ে ক্লাস রুমের পথ ধরলেন। 

আমাদের সলিল বাবু লোকটা বরাবর এরকমই খুব অল্পতেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। হাই প্রেসার হাই সুগার। তবুও রসনায় নিয়ন্ত্রণ নেই। আপন মনে কথা বলতে থাকেন। অনেক সময় এমন হয় কোন একটি বাচ্চাকে খুঁজছেন। যাকে খুঁজছেন সে পাশ কাটিয়ে চলে গেল তিনি বুঝতেই পারলেন না। যাই হোক, এই গল্পটা সলিল বাবুর নয়। আমরা বরং একটু পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি, — 

রজনী বাবু মানে রজনী সান্যাল, ইতিহাসের শিক্ষক, নামের সঙ্গে চেহারার অদ্ভুত মিল আছে  রাতের মত মিশ মিশে কালো কিন্তু চোখ দুটো দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল। বুদ্ধি ক্ষুরধার, সংবেদনশীল মন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মনের কাছাকাছি পৌঁছাতে চেষ্টা করেন। ছাত্ররা যেমন তাকে শ্রদ্ধা করে তেমনি আবার ভয়ও পায় তার ব্যক্তিত্বকে। সেই রজনী বাবু সাত-আট মাস আগে একদিন  নবম শ্রেণীর ক্লাসে শিল্প বিপ্লব পড়াচ্ছিলেন।  নবম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের শিল্প বিপ্লব বোঝানোটা একটু কঠিন হলেও সেই কাজটাই সহজ করে করার চেষ্টা করেন তিনি। ক্লাসে পিছনের দিকের দু-চার জন ছাড়া প্রায় সবাই অপার বিস্ময় নিয়ে শুনছে শিল্প বিপ্লবের গল্প। কিভাবে একদিন ওই সাগর পাড়ের ইংল্যান্ডে তুলো থেকে সুতো তৈরি হতো আর সেই সুতো দিয়ে তৈরি কাপড়ে পৃথিবীর ইতিহাসের গল্পটাকে বদলে দিল। বদলে দিল সমাজ সভ্যতা আর জীবনের মানে। একদল মালিক খুলে বসলো কারখানা। দলে দলে মজুররা কাজ করতে এলো। সামন্ত যুগের দাস প্রথার অবসান ঘটে  শুরু হলো মজুরি দাসত্বের নতুন ইতিহাস। এই গল্প বলতে বলতেই রজনী বাবুর চোখ গেল অন্তরার পাশের জায়গাটা খালি পড়ে আছে।  কদিন ধরেই তিনি লক্ষ্য করছেন। ক্লাসের উজ্জ্বল মেয়েগুলোর মধ্যে একজন সোফিয়া খাতুন গত চার পাঁচ দিন ধরে স্কুলে আসছে না।  তিনি পড়া থামিয়ে মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলেন, সোফিয়া কদিন স্কুলে আসছে না। শরীর খারাপ নাকি? চার পাঁচ জন মেয়ে একসঙ্গে বলে ওঠে, — না স্যার। ওর বিয়ে।

 রজনী বাবু হতচিত হয়ে পড়েন, এটা শোনবার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অবাক বিষয়ের চেয়ে থাকেন কচি কচি ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে। ক্ষণিকের বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে তিনি বলেন, — বিয়ে মানে! 

সুমিত্রা যার বাড়ি সফিয়াদের বাড়ির কাছেই, সে বলে হ্যাঁ স্যার  কালকেই তো প্যান্ডেলের বাঁশ ফেলেছে  ওদের বাড়ি থেকে ঢোলের আর গীদের  আওয়াজ শোনা যাচ্ছে রাস্তা থেকে।

—  তোমার বয়স কত?

 হঠাৎ এরকম প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে সুমিত্রা বলে, — পনেরো। 

— আমাদের দেশে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স আঠারো। তোমাদের কন্যাশ্রী ক্লাব আছে না। তোমরা ব্লকে কমপ্লেন করতে পারছ না।

সোফিয়াদের পাড়ার আরেকটি মেয়ে শেফালী বলে, — না স্যার ওর বাপ চাচারা লোক ভালো নয়। বিয়ে ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বিপদে পড়ি আর কি। ওর মা তো আমাদের সবাইকে বলেছে কাউকে কিছু না বলতে। আপনি জিজ্ঞেস করলেন তাই বলে ফেললাম। এখন জানি না কি বিপদ কপালে নাচছে।

—  সোফিয়া কি বলছে?  সে কি এই বিয়েতে রাজি?

— রাজি না হয়ে উপায় কি? বাবা-মায়ের কথার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কি আমাদের আছে? সে তো স্কুলে আসতে চায়।  পড়াশোনা করতে চায়। পরের বছর মাধ্যমিক। একদিন তো স্কুল থেকে ফেরার পথে কেঁদেই দিল। বলছিল মরে যাবো তাও আচ্ছা। কিন্তু বিয়ে করব না। 

—  ঠিক আছে আমি দেখছি।

শিল্প বিপ্লবের পাঠ ভুলে রজনী বাবু এখন সমাজ শোধনের কথা ভাবতে শুরু করেছেন। দেশ সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি  সর্বোপরি তার সামনে অবাক বিস্ময়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা শিশুগুলোর অনিশ্চিত আগামীর কথা ভাবতে ভাবতে মাঝে মাঝে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে যান। ছাত্র-ছাত্রীরা আড়ালে আবডালে বলে স্যার বোধ হয় তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমাতে পারে, বুঝলি। রজনীবাবুর উদ্বিগ্ন মুখ চোখ, কেঁপে ওঠা গলার স্বর ছাত্র-ছাত্রীদের মনেও প্রভাব ফেলে। ক্লাস শেষের ঘন্টা পরে। টিফিন শুরু হয় ছাত্রছাত্রীরা হইহই করে মাঠে নেমে পড়ে। যারা মিড ডে মিল খায় তারা থালা নিয়ে কলতলার দিকে দৌড়ায় হাত ধুতে। রজনী বাবু অন্যদিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে ধীর পদক্ষেপে অতীতের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটাতে ঘটাতে স্টাফ রুমের দিকে হাঁটলেও আজ কিন্তু তা করলেন না হন্তদন্ত হয়ে চললেন প্রধান শিক্ষকের চেম্বারের দিকে। কোনভাবেই তিনি শান্ত হতে পারছেন না। একটা চোদ্দ-পনেরো বছরের বাচ্চা মেয়েকে বিয়ের নামে পরিবার সমাজ সংসারের যাঁতাকলে পিষে শেষ হয়ে যাওয়া দেখতে তিনি রাজি নন।

তিনি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পান বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই দু-তিনটে অপরিণত অসুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়ে  জীবনকে জানা ও বোঝার আগেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া রুগ্ন পান্ডুর অসুস্থ মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি। এ ছবি কবির কল্পনা নয়। চোখের সামনে দেখা  চরম বাস্তব। বছর বারো আগে  তিনি গিয়েছিলেন কাটোয়া হাসপাতালে, ঠিক কি কারণে গিয়েছিলেন এখন আর মনে নেই।  সম্ভবত নিকট আত্মীয় কেউ ভর্তি ছিল দেখা করতে গেছিলেন।  হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেখেন ইমারজেন্সি গেটের সামনে  ট্রলি স্ট্রেচারের ওপর শোয়ানো আছে এক জীবন্ত কঙ্কাল সেই কঙ্কালের পেটের ভিতর কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে আর একটা কঙ্কাল। তারই নড়াচড়া পরীক্ষা করছেন ডাক্তার। পাশে দাঁড়িয়ে অপুষ্টিতে ভোগা উষ্ক-খুশকো চেহারা তামাটে চুল সাদা চোখের অর্ধনগ্ন দুটো বাচ্চা। ঠাকুমা দিদিমা গোছের  কারো গায়ে লেপ্টে আছে ভয়ে। ওই ফ্যাকাশে সাদা চোখ দিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখছে হাসপাতালের দুনিয়া। চেয়ে আছে তার মায়ের পেটের সঙ্গে ঝুলতে থাকা জীবন্ত মাংসপিণ্ডটার দিকে। একটা সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে বুলি ফুটেছে মুখে, আর একটা বছর তিননেকের হবে।  কথায় কথায় জানা গেল আর একটা আছে বাড়িতে এ বছর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে পুরনো আউটডোরের নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে অজোর ধারায় কেঁদেছিলেন রজনী বাবু। সেদিন শপথ নিয়েছিলেন পরিচিতদের মধ্যে অন্তত এই বার্তা পৌঁছে দেবেন আঠারো বছরের আগে কোনভাবেই মেয়ের বিয়ে না দেয়। কিন্তু ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতে এসে তিনি দেখেন আর্থ-সামাজিকভাবে দুর্বল মানুষের মধ্যে পারিপার্শ্বিকতার দোহাই দিয়ে অবাধে চলছে বাল্যবিবাহের মতো জঘন্য একটা অপরাধ। বারো-তেরো বছরের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীদের বিয়ে হয়ে যেতে দেখেছেন। একে শুধু অপরাধ বললে কম বলা হবে। একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকারি তরফে উদ্যোগ একেবারে নেই বলা যাবে না, কিন্তু ঝামেলা এড়ানোর জন্যই হোক আর ভোটের বাক্স অটুট রাখাতেই হোক, বাল্যবিবাহ বাধাহীন ভাবে ঘটে চলেছে জন সচেতনতার অভাবের দোহাই দিয়ে। কিন্তু আজ তিনি এ বিয়ে কোনমতেই হতে দেবেন না। মনে মনে এই পণ করে প্রধান শিক্ষকের চেম্বারে ঢুকে  ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিলেন। ওদিকে তিনি ক্লাস থেকে বেরোতেই কয়েকজন ছাত্রী দৌড়ে তার পাশ কাটিয়ে স্টাফ রুমে কন্যাশ্রী ম্যাডামের (বিদ্যালয়ের কন্যাশ্রী নোডাল টিচার) কাছে গিয়ে সোফিয়ার বিয়ের ব্যাপারটা বলে। তিনিও ঘটনাটি শুনে চমকে ওঠেন। স্টাফ রুমে বিষয়টা নিয়ে চর্চার পর কন্যাশ্রী ম্যাডাম সহ দু-তিনজন শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের চেম্বারে চলে আসে। তারা এসে দেখেন রজনীবাবু আগে থেকেই অফিস সরগরম করে রেখেছেন।

এতক্ষণ রজনী বাবুর প্রশ্নবানে জর্জরিত অসহায় প্রধান শিক্ষক কন্যাশ্রী ম্যাডামকে দেখে আশ্বস্ত হন, তাড়াতাড়ি করে ম্যাডামকে বলেন। দেখুন আমি এখানে নতুন এসেছি এই এলাকা এখনো ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি। আপনার তো ২৪-২৫ বছর হয়ে গেল আপনি একটু দেখুন ব্যাপারটা। রজনী বাবুকে কোনভাবেই বোঝাতে পারছি না যে বিয়ে আটকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু পরিস্থিতি বিচার করে ব্লকে এবং থানায় একটা খবর দিতে পারি। এবং সেটাও দেবো কিনা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে মিটিং করতে হবে। কারণ এটা একটা প্রতিষ্ঠান আমি একা একা চাইলে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। একটা বাচ্চা মেয়ের ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে কষ্ট যেমন আপনারা পাচ্ছেন তেমনি আমিও পাচ্ছি কিন্তু এখানে অযথা আবেগের কোন স্থান নেই। পরিবেশ পরিস্থিতি যুক্তি দিয়ে বিচার করে তারপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিদ্যালয়ের সব থেকে পুরনো শিক্ষিকা কন্যাশ্রী ম্যাডাম, জাহানারা বেগম যিনি এই বিদ্যালয়ের প্রাণ, বিদ্যালয় আর বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী অন্তঃ যার প্রাণ। তিনি প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে তার মুখের দিকে হা করে চেয়ে থাকেন। তিনি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। একি শুনছেন। এতো ভূতের মুখে রাম নাম। দু বছর হয়ে গেল এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি আসার আগে জাহানারা বেগম তিন বছর টিচার-ইন-চার্জ এর দায়িত্ব সামলেছেন। যা হয় আরকি ইগোর লড়াই। প্রধান শিক্ষক চান তার নির্দেশে স্কুল চলুক, যেহেতু তিনি প্রধান শিক্ষক তাই তার কথামতো সকলকে চলতে হবে। জাহানারা বেগম যেহেতু সবথেকে পুরনো শিক্ষিকা  এবং প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষ, তিনি চান  প্রধান শিক্ষক তার সঙ্গে পরামর্শ করুন। তার মতামত নিয়ে স্কুল পরিচালনা করুন। তিনি যত বড় প্রশাসকই হন না কেন সুষ্ঠুভাবে সমগ্র প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। হতে পারে তিনি প্রধান শিক্ষক তার হাতে সমস্ত ক্ষমতা। কিন্তু সহশিক্ষক ও শিক্ষা কর্মী ছাড়া তিনি অচল। আবার অন্যদিকে সহ শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের ভাবতে হবে যেহেতু প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের প্রধান তাই তাকে যথাযথ সম্মান দিয়েই স্কুল পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়া বা হস্তক্ষেপ করা। কিন্তু বর্তমান প্রধান শিক্ষক ও প্রাক্তন টিচার-ইন-চার্জ দুজনেই তাদের ইগোর কাছে নতি স্বীকার করেছেন তাই অন্য কারোর কাছে মাথা নোয়াবেন না। এখানে একটা টুইস্ট আছে জাহানারা বেগম হেডমাস্টারের বিষয়ে যত কঠোরই হন, ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থে তিনি কিন্তু ততটাই নরম। এটা প্রথম দিনই বুঝে গিয়েছিলেন হেডমাস্টার রঞ্জন ঘোষ। তিনি সরাসরি ম্যাডামকে কোন নির্দেশ দেন না। বরং ম্যাডাম ই সমস্যা খুঁজে নিয়ে  সমাধান করে বেড়ান। ছাত্র-ছাত্রীরা কোন সমস্যা নিয়ে এলে প্রধান শিক্ষক শীতের সকালের আলসে রৌদ্রের আমেজ উপভোগের মতন আলোর দিকে পিছন ফিরে অতিবাহিত করেন সময়। ছদ্ম ব্যস্ততায় মুখ গুঁজে থাকেন টেবিলের  খোলা ফাইলে। অভিযোগকারী ছাত্র বা ছাত্রী দু চার মিনিট অপেক্ষা করে নিজেই চলে যায় ম্যাডামের দরবারে। তাতে ম্যাডাম খুশি হন। তিনি তো আর জানেন না প্রধান শিক্ষকের উপেক্ষা ছাত্রটিকে তার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি যথাসাধ্য  আপ্রাণ চেষ্টা করেন সমস্যা সমাধানের। নিজে না পারলে অন্য শিক্ষকদের সাহায্য নেন। কোনোভাবেই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধান শিক্ষককে ক্রেডিট দেওয়া যাবে না। কিন্তু আজ  একটা  অমীমাংসিত সমস্যা নিয়ে ম্যাডামকে প্রধান শিক্ষকের চেম্বারে আসতে দেখে প্রধান শিক্ষক যতটা অবাক হয়েছেন  ঠিক ততটাই অবাক হয়েছেন জাহানারা বেগম ও তার সহযোগীরা হঠাৎ করে প্রধান শিক্ষককে নরম সুরে কথা বলতে দেখে।

গত দুবছর ধরে নানা ঘাত প্রতিঘাতে প্রধান শিক্ষক বুঝে গেছেন। এলাকায় জাহানারা বেগমের গ্রহণ যোগ্যতা তার থেকে বেশি। এবং প্রশাসনিক অফিসেও জাহানারা বেগমের সংযোগ অনেক দৃঢ়। তাই আর বছর চারেকর চাকরি জীবন তিনি কোন ঝামেলা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে কাটিয়ে দিতে চান। প্রধান শিক্ষকের এখন অবস্থা মানে মানে পেনশন নিয়ে বিদায় হতে পারলে বাঁচি। যাইহোক সংঘাতের সময় এখন নয় ছাত্রীর বিপদের এই দিনে যুদ্ধ তোলা থাক ভবিষ্যতের জন্য এই মন নিয়ে বর্তমান প্রধান শিক্ষক ও প্রাক্তন টিচার-ইন-চার্জ দুজনেই আলোচনায় বসেন সহ শিক্ষকদের নিয়ে। ঠিক হয় আগামীকাল বেলা এগারো টায়  সমস্ত শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পরিচলন সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে।

পরদিন ঠিক বেলা এগারো টায়  শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে নিয়ে পরিচালন সমিতির মিটিং শুরু হল। ক্লাসের সময়সীমা পনেরো মিনিট পিছিয়ে দিয়ে শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রথমে মতামত রাখবার সুযোগ দেওয়া হল। আগের দিন  সলিল বাবু ছিলেন না।  সেদিন মিটিং এর আগে সহকর্মীদের কাছে বিষয়টা শুনে তিনি বেশ উত্তেজিত। প্রথমেই  রজনী বাবু খুব অল্প কথায়  বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নিজের স্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন। চার পাঁচ জন শিক্ষক শিক্ষিকা  যারা কোন মন্তব্য করেননি, তারা ছাড়া প্রায় সকলেই এই বিয়েটা বন্ধের পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু পরিচালন সমিতির সদস্যদের মধ্যে দুই এক জন  সব আয়োজন হয়ে গেছে এখন আর বিয়ে বন্ধ করা যাবে না  গোছের মন্তব্য করায়,  সলিলবাবু  ক্রুদ্ধ হয়ে বেশ কটা কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন  তাদেরকে। সলিলবাবুর পাশে বসা ভূগোলের শিক্ষক কৃষ্ণ বাবু তাকে বারবার থামানোর চেষ্টা করেন। যিনি দিদিকে ক্ষমতায় আনবার জন্য মিটিং মিছিল করেছেন। এখন সুবিধা হচ্ছে না দেখে দাদার দলে নাম লিখিয়ে ময়দানে নেমেছেন। আজকের নীতিহীন রাজনীতি যুগে এটা কোন বিরাট বিষয় নয়। ঝান্ডা হাতে ময়দানে না নামলেও বামপন্থী আদর্শ বিশ্বাসী রজনী বাবুর সঙ্গে তার পড়ানোর বিষয়গত সাজ্জুস থাকলেও বাস্তবে তাদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। প্রথম পিরিয়ডে যাদের ক্লাস ছিল তারা এগারোটা পনেরো বাজতেই চক ডাস্টার আর্টেনডেন্টসের খাতা হাতে ক্লাসে চলে গেলেন। আরো কিছুক্ষণ মত বিনিময়ের পর ঠিক হলো সোফিয়ার বাবাকে ডেকে পাঠানো হোক। যেমন ভাবা তেমনি কাজ  স্পিকার অন করে  প্রধান শিক্ষক ফোন  করলেন সোফিয়ার বাবাকে। স্কুল থেকে ফোন পেয়ে তিনি যে ভয় পেয়েছেন সেটা বোঝা গেল। ফোনেই  বারবার অনুনয় বিনয় ও কাতর আবেদন জানাতে থাকলেন  প্রধান শিক্ষক যেন থানা বা ব্লকে খবর না দেন।  তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুলে আসছেন। আনুষ্ঠানিক মিটিং শেষ হলে কৃষ্ণ বাবু সলিল বাবুকে গলা নিচু করে বলেছিল  ওদের ব্যাপারে অত নাক গলানোর কি আছে। ওদের আলাদা আইন আছে, শরীয়তের আইন, ভারতে থাকবে খাবে আর পাকিস্তানের আইন মেনে চলবে। ঘাড় ধরে সবকটাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিলে বুঝবে ঠেলা। কৃষ্ণ বাবুর কথায় অন্যরকম ইঙ্গিত বুঝে তাকে ঠিক পাত্তা না দিয়ে উঠে বাথরুম চলে যান সলিলবাবু। সলিল বাবু উঠে যেতে পাত্তা না পেয়ে নিরাশ কৃষ্ণ বাবু মনে মনে বলে এই লোকগুলোর জন্যই দেশটার এই হাল। সব শালা ঘরের শত্রু বিভীষণ। 

মিনিট  কুড়ি পঁচিশ এর মধ্যে  সোফিয়া সোফিয়ার বাবা-মা মামা এবং দুই চাচাকে নিয়ে তিনটে মোটরসাইকেল হাঁ হাঁ করতে করতে ঢুকলো স্কুলের মাঠে। হেডমাস্টারের অফিসে ঢুকেই সোফিয়ার মা হাউ হাউ করে মরা কান্না জুড়ে দিল। কান্নার মাঝে মাঝেই যা বললো  তাতে বোঝা গেল ভালো ছেলে, টাকা পয়সা লাগছে না। তাদের চেনা জানার মধ্যেই। বাড়িতে পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা সোফিয়া দিতে পারবে কিন্তু প্রতিদিন ইস্কুলে আসা হয়তো সম্ভব হবে না। প্রধান শিক্ষক  সফিয়ার মাকে কান্না থামাতে বলে সোফিয়াকে কাছে ডাকলেন। প্রধান শিক্ষকের ঠিক পাশেই বসেছিলেন  কন্যাশ্রী ম্যাডাম  তিনি সুফিয়ার একটা হাত ধরে মোলায়েমভাবে জিজ্ঞাসা করলেন কিরে মা তুই কি চাস? আইনত  বিয়ের বয়স এখনো তোর হয়নি। জোর করে তোর বিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কারোর নেই। গত এক মাস ধরে মায়ের  ভেজা চোখ আর বাপের লাল চোখের সামনে অসহায় সোফিয়া কন্যাশ্রী মডেমের স্নেহের প্রশ্রয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সেও হাও হাও করে কাঁদতে শুরু করে। বলে আমি তো পড়তেই চাই। কিন্তু আমরা যে গরিব। পড়াশোনা শিখে চাকরি-বাকরি পাব তারও তো কোন ঠিক নেই। সেই শেষ পর্যন্ত বিয়েই  করতে হবে। কিন্তু তখন যদি ছেলে পক্ষ অনেক টাকা চায়। কোথায় পাবে আমার মা-বাবা? আর একটা ছোট বোন আছে। এখন টাকা পয়সা লাগছে না। মাধ্যমিক পরীক্ষাটাও দিতে দেবে বলেছে। স্কুল যাতায়াতের পথে বা পাড়াতে বেরোলেই চ্যাংড়া ছেলেগুলো যেভাবে তাকায় ভরসা পাই না জানেন। আপনারা তো বড়লোক  আপনারা ঠিক বুঝবেন না।

ক্লাস নাইনে পড়া সোফিয়ার কথা শুনে উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষা কর্মী, পরিচালন সমিতির সদস্য কারুর মুখেই কোন কথা সরে না। ভারতীয় গণতন্ত্রের ঢাকঢোল পেটানো বাকস্বাধীনতার অধিকার যেন চুরি করে নিল ছোট্ট মেয়েটি। কন্যাশ্রী ম্যাডাম চশমার নিচ দিয়ে রুমালে মুছে নেন  চাবুকের দাগ। প্রধান শিক্ষকের গলার স্বর ভিজে যায়  তিনিও কোন কথা বলার মত অবস্থায় নেই। সোফিয়ার বাপ বুঝতে পারেনা তার মেয়ে কি এমন বলে দিল যে সবাই নীলকুঠির মাঠে ছাদ হীন ভাঙ্গা দালানের প্রাচীরের মতো বোবা হয়ে গেল। তার মেয়ে তো ঠিক কথাই বলেছে। অস্বস্তিকর নীরবতা পালনের সময় তাদের নেই তাদের এখন অনেক কাজ। কাল মেয়ের গায়ে হলুদ, এখন অনেক কেনাকাটা বাকি আছে। আত্মীয়-স্বজন বেশি জোটাতে না পারলেও  ১০০ বরযাত্রীর তিন বেলা খাবারের যোগাড় তো তাকে করতে হবে। ছেলে পক্ষ না চাইলেও শুধু হাতে তো আর মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠানো যাবে না। তারও যোগার যন্ত্র আছে। দু তিন মিনিট এভাবে কাটার পর  সোফিয়ার মামা অধৈর্য হয়ে বলে, আপনারা কি বলছেন একটু তাড়াতাড়ি বললে ভাল হয়। আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে।

সোফিয়ার বাপ দুহাত বুকের কাছে জড়ো করে সবার সামনে মিনতি করে বলে আমরা খুব গরীব মানুষ  খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্ট করে মেয়ের বিয়ের জন্য যা জমিয়েছিলাম কেনাকাটা আর খাবার-দাবারের আয়োজন করতে খরচ করে ফেলেছি কিছু টাকা ধারও করেছি। এখন এই অবস্থায় যদি আপনারা বিয়েটা বন্ধ করে দেন তাহলে মেয়ে বউ নিয়ে গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া কোন পথ থাকবে না। তার উপর আমরা তো গরিব মানুষ আমাদের মান সম্মান টাকা দিয়ে কেনা নয়। এই অবস্থায় যদি মেয়ের বিয়ে বন্ধ করে দিতে হয় তাহলে মেয়ের চরিত্র নিয়ে পাড়ায় যা কুৎসা রটবে আমরা সইতে পারবো না। মেয়েটার আর কোনদিন বিয়ে দিতেও পারবোনা। এখন আপনাদের যদি দয়া হয় তো রাখুন না হলে আদেশ দেন সপরিবারে গায়ে আগুন দি। একথা শোনার পর  আর কোন মতামত দেওয়ার ক্ষমতা উপস্থিত কারোর মধ্যে ছিল না। তবুও বিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে প্রধান শিক্ষক বললেন, — আচ্ছা ছেলেপক্ষকে একবার বলে দেখতে পারেন না।  বিয়ে আপনি দেবেন। সেই ছেলের সঙ্গেই দেবেন দু’বছর পর  ততদিনে মেয়েটার মাধ্যমিক হয়ে যাবে আর ১৮ বছর বয়স হয়ে যাবে।

সোফিয়ার এক চাচা বলে, — না মাস্টার মশাই  এ তো আর আপনাদের মত শিক্ষিত ধনী ঘরের ব্যাপার নয়।  আমাদের মত  গাঁয়ের গরিব লোকের ঘরে ওই শহুরে কথা কেউ শুনবে না। তাতে মাঝে থাকতে যা হবে সে তো শুনলেন ভাইয়ের মুখে। মেয়েটার গায়ে লাগবে কলঙ্কের দাগ। যে দাগ জীবন দিয়েও মোছা যাবে না। আর আমাদের শরীয়তে তো এরকম কোন বিধি-নিষেধ নেই।

শরীয়তের কথা শুনে  প্রধান শিক্ষক আরো একটু দমে যান কারণ তিনি জানেন না সোফিয়াদের শরীয়তে কি লেখা আছে কি নেই। কোনদিন জানার প্রয়োজন বোধও করেননি। শুধু তিনি কেন শরীয়তের দোহাই দিয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্ধ করা মানুষগুলো কি জানে আসলেই কি লেখা আছে ধর্মের আইনে।

কেউ কিছু বলে না সবাই চুপচাপ তাই মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে চোখের জলে মুখ ধুয়ে মামার মোটরসাইকেলের পিছনে চেপে পিছনের দিকে তাকিয়ে মায়া ভরা চোখে বিচ্ছেদের রোদন নিয়ে বেরিয়ে যায় স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে। পিছনে পড়ে থাকে তার প্রিয় শিক্ষক শিক্ষিকারা, সহপাঠী বন্ধু, ভাই-বোন, দাদা-দিদি, অসমাপ্ত স্বপ্ন।

আজ স্কুলে এসে খবর পাওয়া গেল  দিন দশেক আগে  সোফিয়া গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খবরটা শুনে রজনী বাবু নীরবে চোখের জল মুছে ভাবলেন দেশে টা এখন সত্যিই নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘ইতরের দেশ’। ততক্ষণে প্রার্থনা সভা শেষ হয়ে গেছে। প্রধান শিক্ষক জাহানারা ম্যাডামকে ডেকে বললেন, — ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন। তারপর না হয়  টিফিনের পর শোক প্রস্তাব আর নীরবতা পালন করে ক্লাস সাসপেন্ড করে দেব। যতই হোক প্রাক্তন ছাত্রী তো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *