জয় ভদ্র
নতুন শতকের প্রথম দশকের প্রায় মাঝপর্বে একটা নতুন ফ্ল্যাট কিনেছি। বিয়ে করব করব। সে-সময়ে মাথায় কেন জানি না একটা খেয়াল চাপল ঘরের কাঠের আসবাবগুলো ভালো কাঠ নিয়ে এসে ভালো মিস্ত্রী দিয়ে বানাব। আমার এই রাম-খেয়ালের কারণ অবশ্যই আমার বাবা। দোকানের গিয়ে সরাসরি ফার্নিচার কিনে আনলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। এসব কথা বাবার কানে যেতেই প্রশ্ন করা শুরু হয়ে গেল— দোকানে তো যাবি, কাঠ চিনতে পারিস? যদিও কথাটার মধ্যে বিশেষ মিথ্যে কিছু ছিল না। তাছাড়া দোকানে গিয়ে কর সমেত একগাদা টাকা খরচ ক’রে ফার্নিচার কেনার চাইতে নিজের ঘরে বানিয়ে নেওয়ার যুক্তিটা খুব একটা মন্দ নয়। তাতে সবকিছুই মনের মতো হবে। অগত্যা আমারই বিশেষ পরিচিত কুচবিহার থেকে ভালো সেগুন কাঠের প্রসেসিং সিট আনিয়ে দিয়েছিল। কাঠের ঝামেলা তো মিটল, এবার মিস্ত্রী… এ-শহরের আমার এক অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধুকে বলেছিলাম ভালো একটা লোক জোগাড় ক’রে দিতে, আর তাইতে ও আমার কাছে আকাশকে পাঠিয়েছিল। ওর বাড়ি অনেক দূরে গ্রামে হলেও এ-শহরে ওরই এক পরিচিত জনের সঙ্গে মিলে একটা ইউনিট আছে। তাই এখানে আসামাত্রই আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল।
যাইহোক, শেষমেষ ও এসেছিল যথা সময়ে। যদিও আগেই ফোনে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সারা হয়ে গিয়েছিল। আসার দিন ও হাতে নিয়ে এসেছিল একটা ডিজাইনের বই। ও আমার কাছে আসার আগে ভেবেছিলাম— লেবার ক্লাস, হয়তো-বা একটু ‘অন্যরকম’ই হবে হয়তো। সাধারণত, যা হয় আর কি! কিন্তু ও যখন আমার সামনে প্রথমবার এসে দাঁড়াল দেখলাম তালগাছের মতো লম্বা-বলিষ্ঠ আর শান্ত একটা লোক। ভ্রূ দুটো জোড়া। চোখ দুটো টানা গভীর আর জলদ গম্ভীর। বয়স বলতে গেলে আমারই বয়সি অথবা আমার থেকে কিছুটা ছোটোও হতে পারে। নাম জিগেস করাতে বলল— ওর নাম ‘আকাশ’।
- আকাশ কী?
“আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র।”
নাম নিয়ে আমার মনে বিশেষ কৌতূহলের জন্ম নিলেও সেটাকে আমি আর প্রশ্রয় দিলাম না, চলে এলাম সরাসরি কাজের কথায়। যে-ডিজাইনের বইটা ও এনেছিল ওর কাছ থেকে সেটা চেয়ে ওটার পাতা উলটে তার মধ্যে থেকে একটা ডিজাইন পছন্দ করে ওকে কাজ শুরু করতে বললাম। কী নেবে না-নেবে তারও একটা রফা হয়ে গিয়েছিল। কিছু অ্যাডভান্স করে দিলাম। ও কাজ শুরু করে দিল… হাতের যন্ত্রটিকে দিয়ে কাঠের ওপর সুক্ষ-সুক্ষ কারুকাজ এমন অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলল যে মনে মনে তা তারিফ না করে পারলাম না। কিন্তু দিন-দুয়েক কাজ করার পর বুঝতে পারলাম— লোকটা বেশ গম্ভীর, আগ বাড়িয়ে কারোর সাথে খুব একটা বেশি কথা বলে না। ওর চোখ দুটোর দিক তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সেখানে এক গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। কিন্তু আমার পেশাগত কারণে নিছক কৌতূহলবশত খোঁচানোর স্বভাবটা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারিনি। বাংলা এক দৈনিক পত্রিকার জেলার পাতার দায়িত্বে তখন আমি। ওর কাজের অবসরের ফাঁকেই ওকে জিগেস করেছিলাম, কোথায় থাকা হয়?
বলল, “তালবেড়।”
- কোথায় সেটা?
উত্তরে সে জায়গাটার যে-অবস্থান জানাল তাতে বুঝলাম জায়গাটা এ-শহর থেকে বেশ দূর।
তারপর একে একে জিগেস করলাম— গ্রামের কথা, ওখানকার মানুষদের কথা, পঞ্চায়েত প্রধানের নাম, চাষবাস, শিক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। ও ধীরে ধীরে নম্র স্বরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। সে-সময়টা ছিল বিধানসভার নির্বাচনের সময়। রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় ভোট হয়ে গিয়েছিল। ওদের অঞ্চল ছাড়াও আরও অঞ্চলের ভোট তখনও বাকি ছিল। আধা-সামরিক বাহিনী ওদের ওই এলাকার গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়েছে ইতিমধ্যে।
- আপনাদের তো আর অসুবিধে রইল না, সবাই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে।
“কাগজে পড়ছেন, মিডিয়াতে দেখছেন, ওরকম মনে হয় দাদা।”
- কেন, মিডিয়া কি মিথ্যে কথা বলে?
“ঠিক সে-কথা বলছি না দাদা, তবে সাংবাদিকরা এখন শুধু পুলিশ আর রাজনৈতিক নেতাদের ধরে থাকে। সাধারণ মানুষের কাছে যায় কম তারা।”
- (যদিও জানি ও অবশ্য সত্যি কথাটাই বলছে, তবু সবকিছু না-জানার ভান করে বললাম) কীরকম?
“যেমন ধরুন, এই ভোটের কথাই বলি। খবরে দেখছেন বা শুনছেন গ্রামে মিলেটারি ঢুকে গেছে। সুতরাং সবাই ভোট দিয়ে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করবে— এটা আসলে আইওয়াস। আপনি কি মনে করেন প্রতিটা গ্রামের অলিতে-গলিতে পুলিশ বা মিলিটারি থাকে? সরকারের কি এত পুলিশ-মিলিটারি জোগান দেবার ক্ষমতা আছে?”
- এটা ঠিক যে আধা-সামরিক বাহিনী থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় অশান্তি হয়।
“যেখানে অশান্তি হয় না জানবেন সেখানেই গোলমাল বেশি। ভোটের পুলিশ-মিলিটারি আসার আগেই ঘরে ঘরে টাকা পৌঁছে যায়। অভাবি মানুষদের কোনো একটাকে বেছে নেওয়ার অবশন থাকে না। কিংবা ধরুন, ভোটের আগের দিন বা ভোরে গিয়ে ক্ষমতাসীন পার্টির কোনো লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসে— আপনাদের কষ্ট ক’রে যাবার কী দরকার…”
ওর সঙ্গে বাক্যালাপে বুঝলাম ও আমার বা আমাদের অন্যতম ভালো সোর্স হতে পারে। আমি ওকে আমার সাংবাদিক পরিচয় দিতে ও খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করেছিল— কোন কাগজে আছেন? ওকে আমার পত্রিকার নাম বলে দেওয়ার পর ও আমাকে অনুরোধ করল— আমাদের গ্রামটা খ্রিস্টানদের। একবার আসুন না, আমরা কিরকম আছি একবার দেখে যান…
আমার এখানে ওর কাজ শেষ হয়ে যাবার পর একদিন গিয়েছিলাম ওর গ্রামে। গ্রামে ঢোকার মুখে আপাতভাবে যেটা মনে হল পুরো গ্রামটাই প্রায় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত। সবাই মূলত গরিব কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী আকাশদেরই মতোন। হঠাৎ চোখে পড়ল টালির ছাউনি দেওয়া একখানা গির্জা। যদিও আমরা গ্রামে ওর ঘরে বসলাম না। ও নিয়ে গেল আমায় ওদের কবরখানার শেষপ্রান্তের সঙ্গে লাগোয়া বট গাছের নীচে। ওই গাছেরই নীচে গ্রামের দিকে মুখ ক’রে সিমেন্টের একটা বাঁধানো বেদি আছে, সেখানেই বসে আমরা পরস্পরে কথা বলছিলাম… বেশ নিরিবিলি জায়গা, এই বট গাছ বা কবরখানার পাশ দিয়ে মাতং নদী বয়ে যাচ্ছে। জানলাম ওর সঙ্গে যারাই দেখা করতে আসে এখানেই সবাইকে ও আমন্ত্রণ জানায়। ভীষণই নির্জন জায়গাটা। আমি যখন ওর সঙ্গে গিয়ে বসলাম পাশের নদীটাকে দেখেছিলাম শান্ত। তখন চৈত্র মাস। দমকা স্নিগ্ধ হাওয়া বারে বারে এসে আছড়ে পড়ছিল আমার আর ওর বুকে, নদীটার স্রোত বয়ে যাচ্ছিল আপন মনে। বেদিটার ওপর আমরা যেই বসতে যাচ্ছি হঠাৎই ও বলে উঠল, ‘গত সপ্তাহেই এক মার্ডার হয়ে গেল…’, আর এ-কথা বলেই সে চুপ মেরে গেল। মুখ ঘুরিয়ে থাকল নদীর দিকে, আর কেমন জানি মনে হল— নির্বাক নদীর কাছ থেকেই ও ওর সব জি’গেস, কৌতূহল আর অভিমানের উত্তর পেতে চায়।
তবুও আমায় বলতেই হল, ‘এর’ম তো আকছার হয়ে থাকে, এ আর নতুন কথা কী! কিন্তু কোথায় হল?” আমার জি’গেসের পরমুহূর্তেই সঙ্গে-সঙ্গেই ওর কাছ থেকে কোনো উত্তর পেলাম না, কারণ এবারেও ও চুপচাপ। কিন্তু বেশ বুঝতে পারলাম, যখনই আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম— সেই চোখে অনেক বেদনা, অনেক হতাশার কথা লেখা ছিল। তবুও আমি যে আমার প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় আছি ও বেশ বুঝতে পেরেছিল, হয়তো-বা ওই নির্বাক নদীই ওকে সে-কথা জানান দিচ্ছিল…
“আমাদেরই গ্রামে”, অবশেষে এই কথাটা ও আমায় বলল।
- কবে হয়েছে ঘটনাটা?
‘এই হপ্তাখানেক আগে।’
- ঠিক কী কারণে কারা মেরেছে বলে তোমার মনে হয়?
“কেন আপনি জানেন না! এক সপ্তাহ আগেই সব মিডিয়ায় দেখিয়েছিল। সব ডেইলিগুলোতেও ছাপা হয়েছিল।’
- এক সপ্তাহ আগে… তালবেড়… তালবেড়…
সাম্প্রতিক অতীতের ময়লা স্মৃতিগুলোর পাহাড় হাতরাতে হাতরাতে হঠাৎই খেয়াল হল— হ্যাঁ, এই তো সেদিন! তালবেড়ের এক যুবককে ধর্ষণের অপরাধে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
খবরটা আমার কাছে নেহাৎই মামুলি হলেও ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে শুরু করে সমস্ত ডেইলি নিউজে ছেপে বেরিয়েছে। আমাদের কাগজও ছেপেছে, বেশ স্পষ্ট মনে পড়ছে, আমার সঙ্গে জেলার পাতায় যিনি সহকর্মী আছেন তিনি এই রিপোর্টটা টাইপ করেছিলেন। ঘটনার বিস্তারিত মনে পড়াচ্ছে এখন।
কিন্তু যাই-ই হোক না-কেন, বিষয়টা খুবই সাধারণ মানের। আর এইর’ম একটা ঘৃণ্য কাজে রাগের মাথায় সংগঠিত মানুষ যদি কিছু করে থাকে তাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যায় কি? যদিও, এ-দেশের নাগরিক হওয়াতে আইন নিজের হাতে তুলে না-নেওয়ার সংখ্যাগুরুর মতকেই সমর্থন জানাচ্ছি।
‘আপনারা এই সংবাদ পেলেন কোত্থেকে?’
- আমার কাগজে জেলার পাতার দায়িত্বে আমিই আছি। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বড়ো ফিচার বা স্টোরি করার জন্য আমাকে বাইরেও যেতে হয়। আজ যেমন আমি তোমার এখানে এসেছি। কিন্তু দেখ ভাই, তোমায় সত্যি কথাটা বলি, আমাদের লোক বেশি নেই, বৈদ্যুতিন মিডিয়ার সঙ্গে প্রিন্ট মিডিয়ার আজ খুব কমপিটিশন, ডেইলি পেপারগুলো তাই ক্রমশ লোক ছাঁটাই করছে। তাই আমাদের জেলা করেসপন্ডেন্সরা থানা থেকেই রিপোর্ট সংগ্রহ করে। এটা শুধু আমাদের কাগজ কেন সব বড়ো হাউজগুলো তাই-ই করে এখন।
‘তাই সবগুলোতে সংবাদের বয়ানও তাই একই রকম।’ এই বলে সে তার ঠোটের কোণ দিয়ে এক বিদ্রূপাত্মক হাসি আমায় উপহার দিল।
যদিও এই উপহার গ্রহণ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি আমার একেবারেই ছিল না। তাছাড়া আমার মধ্যেকার মধ্যবিত্তসুলভ মানসিক ইগোর বিষয়টিও এর মধ্যে জড়িত ছিল।
- ধর্ষণের যে-কথা আপনারা ছাপেছেন সেটা আদৌ সত্যি নয়। সাত বছর ধরে মেয়েটার সাথে ভালোবাসা ছিল। কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি এমন কথা বলছি না। ছেলে-মেয়ে দু’জনকেই চিনি, মেয়েটা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। এই যে-নদীটাকে দেখছেন এখানে ওরা দু’জনেই আসত, গল্প করত। সেই স্কুলে পড়া থেকে ওদের ভাব-ভালোবাসা ছিল। সাত বছর মেলামেশার পর মেয়েটির মনে হল ছেলেটি তাকে ধর্ষণ করেছে? আসলে কী জানেন দাদা, আমাদের গরিব মানুষরা অনেকেই সামান্য কিছু টাকার লোভে বিকিয়ে যায়।
‘তা’লে এই ঘটনার পেছনে আসল মোটিভটা কী?” ওকে জিগেস করেছিলাম।
ও বলেছিল, ‘আমি এখানে বসে আছি, আপনি এই গ্রামের ঘরে ঘরে জিজ্ঞাসা করে আসুন, চাইলে আপনি আমায় সঙ্গে নিতে পারেন, এখানের মানুষের মুখ থেকেই শুনুন— ভেতরের ব্যাপারটা কী!’
আমি বললাম, “আকাশ, তুমি বললেই যথেষ্ট।”
“আসলে ধর্ষণের নাম করে যাকে পিটিয়ে মারা হল, ও দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার নানা ধরনের সমাজসেবা ও পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। চোলাই মদ, বালি ও জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। তাতে করে শাসকদলের অসুবিধা হচ্ছিল খুব। আর ধর্ষণ যদি করেই থাকে ও তাহলে পুলিশের কাছে সরাসরি নালিশ করল না কেন তারা? প্রায় একমাস হয়ে গেল পুলিশ এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারল না!
- তা তোমারা এতগুলো গ্রামের মানুষ আটকাতে পারলে না?
“খুনটাতো এখানে হয়নি, হয়েছে নদীর ওপাড়ে ওই দিককার এক গ্রামে।”
- আর মেয়েটা?
“মেয়েটা থাকে এখন ওই দিকটাতেই। বছর দুই আগে এই গ্রামের বাস উঠিয়ে ওই দিকটায় চলে যায়। শুধু আপনাদেরটাই নয়, সব কাগজ আর মিডিয়াগুলোতে যে-খবরটা হল বলতে গেলে সবটাই মিথ্যে।”
আমি আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রকে নির্মোহভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, “দেখ আনন্দ, বিষয়টা বোঝ। জেলার পাতায় আমরা মূলত নিউজটাকেই প্রাধান্য দিই। এখানে তদন্তের তেমন কোনো জায়গা নেই। তাছাড়া আমাদের এই এলাকায় কোনো ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট নেই। তাই খবরের সোর্স বলতে থানা, আর নয়তো লোকাল পলিটিক্যাল ফোর্স। তাছাড়া ভাইটাল যে-ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হয় সরকারি বিজ্ঞাপনের বিষয়টা। তাছাড়া দুই-একটা পত্রিকা বাদে, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্টরা তেমন কোনও পে পায় না, আমাদের শহুরে সাংবাদিকের চেয়ে তাদের ইকনমিক স্ট্রাগেলটা অনেক বেশি। ধরে নাও, মোটের ওপর টোটাল ব্যবস্থাটা এই রকমই। এর সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা-অধিকার, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ … গণতন্ত্র-ফণতন্ত্র এক করতে যেও না…
আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। আমার এইটুকু বলামাত্রই ও যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। নদীর দিকে মুখ ক’রে আবারও সে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে জিগেস করল, “তা’লে দিনের-পর-দিন এ’রম মিথ্যেই প্রকাশ পাবে?”
উত্তরে পালটা তাকে আমিই প্রশ্ন করলাম, “তুমি আমাদের সোর্স হবে? তবে বলতে পারব না সম্পাদক তোমায় কত-কী দেবে। হয়তো প্রথম দিকে কিছু না-ও দিতে পারে।“
- অর্থই কি দুনিয়ার সব দাদা? তবে বলছেন যখন, ব্যাপারটা মন্দ নয়।
বুঝতেই পারছি, আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র মুখে না-বললেও ও ওর নির্লোভ-নির্মোহের জায়গা থেকেই কথাটা বলেছিল। বুঝতেই পারছি, ওর পেশাগত জায়গা থেকে ও ওর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে যথেষ্টই সচেতন, আর, এই জায়গা থেকেই প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজের উত্তরণ ঘটাতে চায়। নদীর বুক থেকে প্রাণস্পর্শী দমকা হাওয়া ছুটে আসছে ওর আর আমার বুকে, আছড়ে পড়ছে, আর আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র বট গাছের নীচের বেদিটায় বসে নিজের দু’-পা দুলিয়ে চলেছে, অথবা আমি বেশ টের পাচ্ছি— আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র আমাকে ক্রমশই টেনে নিয়ে চলেছে ওর হৃদয়ের গভীর সমুদ্রের মধ্যে…
আমার নিজের শহর থেকে অনেক দূরে আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের গ্রাম, যদিও সেদিনই রওনা দিয়েছিলাম ফিরে আসার। ফিরে এসে আমার পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তালবেড় ধর্ষণকাণ্ডের নেপথ্যের ঘটনাবলীর ওপর একটা স্টোরি লিখব বলে, যদিও তিনি আমার প্রস্তাবে সায় দেননি। কারণটা তিনি স্পষ্টতই ব্যাখ্যা করলেন কেন সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার ব্যাপারটা সবার আগে মাথায় রাখতে হবে। তবে আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের অন্যতম জেলা করেসপন্ডেন্ট বা সোর্স হিসেবে তাকে আমাদের দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে, আর সে-কথাটা আমি তাকে জানিয়েও দিয়েছিলাম।
এরপর ওর ওখানে বিশেষ যাওয়ার প্রয়োজন বোধ হয়নি। ফোনে-ফোনে আমাদের যোগাযোগটা ভালোই ছিল। যে-রিপোর্টগুলো ও ওর গ্রাম বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ে লিখত সেগুলো পাঠাত, এবং তা সরাসরি শাসকশ্রেণির বিরূদ্ধে ছিল বলে আমাদের ভালোভাবে দেখেশুনে এডিট করে নিতে হতো— কিছু শব্দ বাদ দিয়ে, তার বদলে অন্য শব্দ বসিয়ে, কখনো-বা গোটা বাক্যটাকেই কেটে অন্যভাবে ঘুরিয়ে লিখতে হতো যাতে করে শাসকশ্রেণির বা সরকারপক্ষের গায়ে কোনো আঁচ না-লাগে, এছাড়াও সঠিক বাক্যগঠন, সংবাদপত্রের নিজস্ব ভাষা বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা কেটে বাদ দেওয়ার বিষয়গুলো তো ছিলই… আর এইভাবে ওর দেওয়া রিপোর্টগুলো ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ হিসেবেই যেত, ওর নামে নয়। কখনো-কখনো খুব জরুরি মনে হলে ওর রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আমাদের ওই জেলার প্রধান ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্টকে নির্দেশ দিতাম অমুক জায়গায় গিয়ে সরকারি পদস্থ অফিসারদের ইন্টারভিউ নিতে। আমাদের তরফ থেকে ম্যানেজ দেওয়ার ব্যাপার যেমন একটা ছিল, তেমনি আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র অযথা কোনও বিপদে পরুক এটাও আমরা চাইতাম না, কারণ ওর গ্রাম-সহ পার্শ্ববর্তী এলাকার পঞ্চায়েতগুলো আর ওইসব গ্রামের বিধানসভা এলাকা সবটাই বিগত ভোটে শাসকশ্রেণি পুনর্বার নির্বাচিত হয়েছে।
এইরকমই এক দিনগুলোর মধ্যে ও আমাকে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ জানাল সন্ধ্যায় ওর গ্রামে বিশেষ অনুষ্ঠানে। দিনটা ছিল সরস্বতী পুজো। ওর এই আমন্ত্রণটা ছিল ভীষণই আন্তরিক, আর আমার বন্ধুর বিশেষ পরিচিত বলে আমি সে-আমন্ত্রণ ব্যস্ত আছি বা প্রচুর কাজের চাপ— এইসবের দোহাই দিয়ে এড়িয়েও যেতে পারিনি। সুতরাং, দ্বিতীয়বারের জন্য গিয়েছিলাম তালবেড় গ্রামে। সেদিন গিয়ে অন্য এক আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রকে আবিষ্কার করেছিলাম। প্রথমবার যখন ওর গ্রামে গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম, এই গ্রামটা খ্রিস্টান-প্রধান হলেও বেশ কয়েক ঘর মুসলমানও আছেন, আর সামন্য কিছু হিন্দু। হিন্দুরা সেই অর্থে এখানে সংখ্যালঘু। যদিও এদের প্রত্যেকরই অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নীচের দিকে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোনও উচ্চ বিদ্যালয় নেই, নেই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে আমার দ্বিতীয়বার আসায় আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রকে নতুন ক’রে আবিষ্কার করেছিলাম এই কারণেই যে ভারি অবাক হয়েছিলাম ওদের এই সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটায় উপস্থিত থেকে। লক্ষ্য করলাম, এরা মূলত ভিন্ন ধর্মের হলেও এ-দেশের মূলস্রোতের চিরাচরিত বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে চলছে। সেই কারণে অনুষ্ঠানের দিনটা ওরা সরস্বতী পুজোর দিনই বেছেছিল। রঙিন কাপড়ের প্যান্ডেলের দেওয়ালে বাচ্চাদের আঁকা টাঙানো ছবিগুলো সাঁটানো ছিল। যদিও সরস্বতী ঠাকুর এখানে সরাসরি পুজিত হয়নি— তাকে সামনে রেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে এই অনুষ্ঠান হয়েছিল। আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র বলল, এটাই তো আসল পুজো। সরস্বতী তো কুসংস্কার-মুক্ত জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী। আমি ছাড়াও শহর থেকে এসেছিল একজন প্রথিতযশা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন সাহিত্যিককে এনেছিল। ছিল ওই গ্রামেরই নিজস্ব নাটক ও বিজ্ঞানমঞ্চের দল। ছিল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কয়েক জন ডাক্তারও। দেখলাম বেশ ভিড়, আশেপাশের গ্রাম থেকেও প্রচুর মানুষ এসেছিল। কোনও চটুল হিন্দি বা বাংলা গানের অনুষ্ঠান নেই, আর প্রতিটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রসংগীত চলছিল। নাটক যেটা দেখলাম সেখানে এক বিশেষ সামাজিক বার্তা স্পষ্ট। শুনলাম, সেই যে মিথ্যে ধর্ষণকাণ্ডের জেরে যে-ছেলেটাকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, তার কাজ অনেকটাই আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তবে এর কাজের ধারাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম, এর সঙ্গে আছে প্রচুর মানুষ…
ওখান থেকে ফিরে এসে তালবেড় নিয়ে একটা স্টোরি করেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম: ‘তালবেড় গ্রামের অন্য সরস্বতী পুজো।’ আড়াই-শো থেকে তিন-শো শব্দের এক ছোটো স্টোরি, তাতে আকাশের নাম ও ছবি দুই-ই ছাপা হয়েছিল।
বাটালি আর ছোটো হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র যে-অসাধারণ কারুশিল্প ফুটিয়ে তুলত সে-কারণে ওকে আবারও ডাকতে হয়েছিল আমার বাড়িতে। কারণ আমার ঘরের আরও কিছু আসবাবের কাজ বাকি ছিল। কথা প্রসঙ্গে জেনেছিলাম, ওই সান্ধ্য অনুষ্ঠানটি গ্রামে খুব সাড়া ফেলে দিয়েছিল, আর এর ফলে আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের নাম-ডাক আরও ছড়িয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে ওই আর্টিকেলটা প্রকাশিত হবার
পর।
এরপর বছর দেড়েক মহা উৎসাহের মধ্যে দিয়ে ওর দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যে আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র সামান্য দূরের এক গ্রামের এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। ওর বউ এখন পাঁচ মাসের সন্তানসম্ভবা। এমনি এক দিন ছিল সেদিন— গভীর চাঁদনি রাত, মাতং নদী দিয়ে হাওয়া বয়ে আসছিল ওদের ঘরের জানলার মধ্যে দিয়ে— হু হু করে, আর সে আর তার বউ গল্প করে চলছিল— আর প্রায় পাঁচ মাস পরেই তাদের সন্তান পৃথিবীতে আসবে— এই সুখস্বপ্নে তারা বুনে চলছিল তাদের স্বপ্নের নীড়… আর তখনই তারা শুনেছিল তাদের সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের নাম করে কে যেন ডাকছে— অতি পরিচিত স্বর, আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র দরজা খুলে দেয়, দেখে তার গ্রামসেবার তারই বহুদিনের সহকর্মী যে কিছু খবর দেয় তাকে, আর তাইতে আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র তার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের জ্যোৎস্নার রাত ছিল সেদিন। তারা এসে দাঁড়াল উন্মুক্ত আকাশের সেই জ্যোৎস্নার চাঁদোয়ার নীচে, তারপর তারা যাচ্ছিল কবর পার হয়ে মাতং নদীর দিকে, আর তখনই অন্ধকার চিরে কাতানের প্রথম কোপটা পড়ল তার ঘাড় বরাবর, তাতে বাঁ-হাতটা আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তারপর কোপ পড়ল কোমরের দিকে, যাতে করে ধড় থেকে তার পা-দুটো আলাদা হয়ে যায়— এইভাবে সেই চাঁদনি রাতে, নতুন গ্রাম গড়ার স্বপ্ন বুনতে বুনতে চলা আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র তিন টুকরো হয়ে গেল…
ওই জেলার প্রধান করেসপন্ডেন্ট যখন খবরটা দিল তখন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হল, আকস্মিক এই সংবাদটা আমার শরীরের পুরো এনার্জিটাকেই ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকল। কিন্তু পেশাগত কারণের জায়গা থেকেই আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের ওপর তৈরি হওয়া কোনোরকম মানসিক আবেগের বহিঃপ্রকাশের সুযোগ পাওয়া গেল না। ডেক্সে তখন সে-দিনের পাতা-তৈরির কাজে আমরা সবাই তখন ভীষণই ব্যস্ত। এরই ফাঁকে ওর মৃত্যুর রিপোর্টটা তৈরি করে ফেলেছিলাম। জেলার পাতার ডান দিকে একেবারের শেষ কলামটার মাঝবরাবর সাত-আট লাইনের একটা প্রতিবেদন গিয়েছিল।
তালবেড় গ্রামের মাতং নদীর ধারে নির্জন সেই কবরখানার বট গাছের তলাতেই আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রকে চিরনিদ্রার জন্য শুইয়ে দেওয়া হল। ওই বট গাছের নীচে আগে কোনোদিন কাউকে কবর দেওয়া হয়নি। গ্রামের সবাই তাকে মাটি দিয়েছে, আর তা দিতে দিতে চোখের জল ফেলেছে, আর তার হিন্দু বউ বটের কচি পাতা-সহ একটা ডাল ছিঁড়ে কবরে বিছানো মাটিতে পুঁতে দিতে দিতে উদ্ভ্রান্তের কাঁদতে কাঁদতে পেটের সন্তানের উদ্দেশ্যে বলছে— তুই পৃথিবীতে আয়, তখন বলব এই বট গাছই তোর বাবা, আমি এই গাছকেই বিয়ে করেছিলাম। যেন পাহাড়ের মতো ভারী এক মৃত্যু মাতং নদীর উপত্যকার এই গ্রামটাকে এক বিষণ্ণতার চাদরে ঢেকে দিয়েছিল— আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের কবরের ওপর বটের ডালটাকে রেখে পুরো কবরটাকে ইট-বালি আর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মাথার দিকে রাখা হয়েছিল যে-শ্বেতপাথরের ফলকটা তাতে লেখা ছিল— নাম : আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র; জন্ম: ১লা আগস্ট, ১৯৭৩, মৃত্যু : ১১ই মার্চ, ২০১১।
আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রকে কবর দেওয়ার দিনে আমার যাওয়ার পর থেকে তালবেড়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে শূন্যে গিয়ে ঠেকে। আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র আমার বহু স্মৃতির বোঝার নীচে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে। এইভাবে কেটে গেল বারোটা বছর। এই বছরগুলোতে ওই জেলার প্রধান করেসপন্ডন্ট তালবেড় নিয়ে কোনও রিপোর্ট করেনি। তবে তিন-তিনবার ওই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ে ছোটো রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তা-ও তা থানায় গিয়ে সংগ্রহ করা। আর এই রিপোর্টগুলো আসলেই আমার আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের কথা মনে পড়ত। ওর কথা মনে পড়ত মাঝেমধ্যেই রাতে আমার দেহটা ক্লান্তি আর আবসরে যখন বিশ্রাম নিত। তালবেড় গ্রামটাকে নিয়ে কী পাহাড়-সমান প্যাশন ছিল ওর! আমাকে বলত, ওর গ্রামের কৃষকদের এককাট্টা করে ভালোভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাসায়নিক সারের চাষ থেকে সরিয়ে আনার কথা, গ্রামে যে-স্বাস্থ্যকেন্দ্রটা তৈরি করেছিল সেটাকে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে আরও বড়ো করার কথা। বলত, সরকার না-করলে আমাদেরই করে নিতে হবে। এক প্রাইভেট কোম্পানি গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে জমি কিনতে এসেছিল— সামনে ছিল বালি আর জমি মাফিয়ারা। আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র এদের বিরুদ্ধে জোট গড়ে তুলেছিল। আবার ওরই নেতৃত্বে গ্রামের সবাই মিলে বিডিও-র কাছে ডেপুটেশন দিয়েছিল। তালবেড়ে একটা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল হবার জন্য। চেয়েছিল নাটকের দল আর বিজ্ঞানমঞ্চটাকে আরও শক্তিশালী করতে… এ হেন আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র কি কোনও উত্তরাধিকার তৈরি করে যেতে পারল না?— এসব ভাবি আর ততই আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের স্মৃতি ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে আমার বহু স্মৃতির বোঝার তলানিতে।
কিন্তু হঠাৎ করে তালবেড় একদিন আবার খবরের শিরোনামে উঠে আসল, এবং তা আসল আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের মৃত্যু প্রায় বারোটা বছর পর। যদিও এখনও পর্যন্ত এ-খবর কোনও বৈদ্যুদিন বা ওয়েব মিডিয়ার নজরে আসেনি, সরাসরি এসেছে আমাদের পত্রিকায়, করেছে ওই জেলারই প্রধান জেলা করেসপন্ডেন্ট যে এত বছরেও তালবেড় নিয়ে কোনও রিপোর্ট লেখেনি। যদিও এই রিপোর্টও তেমন কোনও তদন্তমূলক লেখা নয়। সেই অর্থে ভীষণই জোলো। তাহলেও প্রতিবেদনটি ছিল ভীষণই তাৎপর্যপূর্ণ। রিপোর্টটি বিস্তারিত লিখে সে আমার আর সম্পাদকের মোবাইলের হোয়াট্সঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছিল। হেড লাইন করেছিল: ‘তালবেড় গ্রামের ভুতুড়ে বটগাছ আর রহস্যময় খুন।’
আমি এই রিপোর্টের বিস্তারিতে যাওয়া বাহুল্য মনেই করছি। তবে এইটুকু বলতে বাধ্য হচ্ছি সময়ের খুব নিকট ব্যবধানে তিন-তিনটে রহস্যজনক মৃত্যুর পর স্থানীয় থানার ওসি নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেই এর কোনও যথাযথ কারণ উদ্ধার করতে পারেননি। ঘটনাস্থল ছিল তালবেড় গ্রামের কবরের সেই বটগাছ। তিনটে মৃত্যুর মধ্যে প্রথমটি ছিল ওই অঞ্চলের বালি মাফিয়াদের এক সর্দার, অপরজন ছিল আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্রের খুনের প্রধান আততায়ী, শেষজন ছিল সেই মেয়েটা দশ বছর আগে তার প্রমিককে মিথ্যে ধর্ষণের অভিযোগে পিটিয়ে মারার অন্যতম চক্রী। তিন জনের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর ধরন এক। বটের নতুন নরম ঝুরিতে ফাস লেগে মৃত্যু! এটা কি কোনও গুম-খুন? না আত্মহত্যা, অথবা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করানো?— তালবেড় থানার পুলিশ সে-রহস্যের কিনারা এখনও করে উঠতে পারেনি! এর বাইরে আমি এই রিপোর্ট সম্পর্কে আর-কিছুই আলোচনায় আনছি না, শুধু এইটুকুই বলতে চাইছি— আকাশ— আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র নতুন ভোরের মতন একজন মানুষ হতে চেয়েছিল! আর, এ-কথাও জানাতে চাইছি, সম্পাদক মহাশয় জানত তালবেড় নিয়ে আমার পুরোনো দুর্বলতার কথা— তাই আমি চাই বহু বছর পর তালবেড় যেতে, আর তাইতে এঁকে বিশেষ অনুরোধ করেছিলাম এই রিপোর্টটা যেন অন্তত তিন-চারদিনের জন্য চেপে রাখতে।
আজ ২০২৩-র ১১ মার্চ। এই দিন ওর মৃত্যুদিন। চৈত্র মাস। আমি হাঁটছি এখন নদীর পাড় দিয়ে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি তালবেড় গ্রামের সেই কবর আর ওই বটগাছ। কিন্তু ওর কবরের বুকে যে-বটের ডাল পুঁতে দেওয়া হয়েছিল সেটার এখন আর-কোনো অস্তিত্ব নেই। মূল বটের সাথে এক হয়ে সে এখন মহীরুহ হয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ দেখছি— ও কে!!! বহু পুরোনো বেদিটার ওপর বসে!!! হ্যাঁ, ওই-ই তো— আকাশ উইলিয়াম মহাপাত্র!!! পা দোলাচ্ছে আর মাতং নদীর দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে— বড়ো গভীর সে-তাকানো। নদীর বুক থেকে হু-হু করে ছুটে আসছে বাতাসেরা, আমার বুকের ওপর, বিপরীতে, ওর বুকের ওপর।