নীলাদ্রি পাল

কলকাতায় পার্সিদের অগ্নিমন্দির

ইংরেজ আমল থেকেই কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে চিৎপুর রোডের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাঙালিদের সাথেই গড়ে উঠেছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চাইনিজ ও পার্সিদের বসতি। এই জায়গার মধ্যে বেশ কসমোপলিটন একটা গন্ধ আছে। এখানে রয়েছে পার্সিদের একটা ধর্মশালা ও একটা অগ্নিমন্দির। 

এই অগ্নিমন্দিরের বিষয়ে বলার আগে কলকাতায় পার্সিদের আগমন ও পার্সিদের ধর্ম পরিচয় সংক্ষেপে বলে নেওয়া প্রয়োজন। পার্সিদের নাম হয়েছিল তাদের আদি বাসস্থান দক্ষিণ ইরানের পার্স বা ফার্স প্রদেশ থেকে। জন্মভূমিতে ধর্মাচরণের বিরোধিতা এবং আরবদের ক্রমাগত আক্রমণের কারণে তাদের মধ্যে একদল বেরিয়ে পড়ে নিজের দেশ ছেড়ে গুজরাটে এসে পৌঁছায় সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি। তৎকালীন গুজরাটের হিন্দুরা তাদের মেনে নেয়। পার্সিরা ভারতবর্ষে বসবাস শুরু করে। সময়ের সাথে পার্সিরা ভারতের মূল স্রোতে মিশে যেতে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন অংশে। 

কলকাতায় পার্সি হিসেবে প্রথম নাম পাওয়া যায় দাদাবয় বেরামজী বানাজীর। বাণিজ্যিক সূত্রে তিনি ১৯৬৭ সাল নাগাদ সপরিবারে সুরাট থেকে কলকাতায় আসেন এবং এই শহরেই থেকে যান। তারপর থেকে ধীরে ধীরে পার্সিরা কলকাতায় আসতে শুরু করেন। 

পার্সিদের ধর্মগুরু ছিলেন জরাথুস্ট। জরাথূস্টের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই পার্সিরা সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করতেন। এই ধর্মের নাম ছিল মজদায়সন। এই সময় ধর্মীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল একদল ক্ষমতালোভী পুরোহিতের হাতে। এই পুরোহিতদের উৎপাতের হাত থেকে পার্সিদের রক্ষা করতে আবির্ভাব হয় জরাথুস্টের। তিনি ঘোষণা করেন শক্তি ও জ্ঞানময় ঈশ্বরই হলেন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। প্রকৃতির অন্তর্গত সমস্ত বস্তুশক্তি তাঁর নিয়মেরই অধীন। সেই ঈশ্বরের প্রতীক হল পবিত্র অগ্নিশিখা। এই ধর্মের নাম হল অহুরমজদা। 

কলকাতায় প্রথম পার্সি অগ্নি মন্দির নির্মাণ করেন রুস্তমজী কাওয়াসজী বানাজী। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। ২৬ এজরা স্ট্রিটে তিনি এক বিঘা আঠারো কাঠা জমিতে সম্পূর্ণ নিজের খরচে এই মন্দির তৈরি করেন ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই মন্দির ব্যবহার করা হত। ১৯১২ সাল পর্যন্ত এই মন্দির ছিল কলকাতার একমাত্র অগ্নি মন্দির। ২০১৮ সালে রুস্তমজীর পরিবারের শেষ সদস্য মারা যাওয়ার পরে মন্দিরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এই মন্দিরের স্মৃতি বহন করছে সংলগ্ন পার্সি চার্চ স্ট্রিট। 

কলকাতায় দ্বিতীয় পার্সি মন্দির তৈরি করেন শেঠ এরভাদ ধুনজিবয় বেরামজী মেহেতা। ৬৫ নম্বর ক্যানিং ্স্ট্রিটে তাঁর নিজের বাড়িতে একটি ব্যক্তিগত অগ্নি মন্দির নির্মাণ করেন ১৮৯০ সালের ২৮ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুর পরে পরিবারের সদস্যরা বর্তমান ৯১ মেটকাফ স্ট্রিট পূর্বতন বন্দুক গলিতে ১৯১২ সালে বর্তমান অগ্নি মন্দিরটি (আগিয়ারি) নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের নাম আতশ আদারন। 

মন্দিরটি বেশ পুরনো হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে অনেকটা নতুনের মত দেখতে। এই মন্দিরটি পরিচালনা করেন পাঁচজন ট্রাস্টি। এদের মধ্যে তিনজন আঞ্জুমান ট্রাস্ট ফান্ডের সদস্য। 

মন্দিরের প্রধান ফটকের বাঁদিকে রয়েছে একটা হলঘর। সেখানে দেয়ালে খোদিত জরাথুস্টের প্রতিকৃতি ও পবিত্র আগুনের ছবি ও রয়েছে সূর্যের ছবি সংবলিত দিকচিহ্ন। এখানে রয়েছে বিভিন্ন সময়ের ট্রাস্টিদের নামের লিস্ট ও ছবি। রয়েছে ছোট একটা লাইব্রেরি। নজরকাড়া জিনিসের মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে বিশেষ অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনা একটি গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। 

এখানে অগ্নি মন্দির রয়েছে দোতলায়। সেখানে দিনরাত্রি জ্বলছে অনির্বাণ শিখা। আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাঠের টুকরো ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র পার্সিদেরই অগ্নি মন্দিরে প্রবেশাধিকার রয়েছে। রাতে সূর্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয় একটি জ্বলন্ত প্রদীপ। 

মানুষের জীবনে প্রকৃতির যে বিশাল অবদান, পার্সিরা তা উপলব্ধি করেছেন এবং নিজেদের ধর্ম চর্চায় সেটি ব্যবহার করেছেন। নির্জনে অগ্নি দেবতার উপাসনা করার নেপথ্যে রয়েছে ইরানে অত্যাচারের ভয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের নির্জনে জঙ্গলে লুকিয়ে স্বাধীন ধর্মচর্চা করার ইতিহাস। সেই কারণে পরবর্তীকালে তারা ভারতবর্ষে চলে এলেও নিজেদের মন থেকে এই অনিশ্চয়তার আশংকা দূর করতে পারেননি। সেই থেকেই জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় অগ্নি মন্দিরে প্রবেশ। 

পার্সি ধর্মাচরণে হিন্দুদের সাথে কিছু মিল পাওয়া যায় তাদের আচার অনুষ্ঠানের বিষয়ে। পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পার্সিদের মধ্যে সাদা রঙের প্রচুর ব্যবহার হয়। হিন্দুদের যেমন পৈতের অনুষ্ঠান হয় তেমনি পার্সিদের হয় ‘কুসতি’। বাহাত্তর গাছি ভেড়ার লোমের তৈরি পশম দিয়ে বানানো এই উপবিত বা পৈতে সাত বছর বয়সী ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সকলকে মন্দিরে এসে কোমরে জড়িয়ে ধারণ করতে হয়। 

পার্সি ধর্মে ষাঁড়ের ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সেই ষাঁড়ের রং হবে সম্পূর্ণ সাদা। শিং, খুড়, লোম সবই হতে হবে সাদা। এইরকম ষাঁড়ের একবিন্দু প্রস্রাব পান করে পবিত্র হওয়ার রীতি রয়েছে এই ধর্মে।   প্রতিভাস ম্যাগাজিন

জনশ্রুতি ও বাস্তবতার মিশেলে 

       ডায়মন্ড হারবারের চিংড়িখালি দূর্গ

পিকনিক স্পট ও সপ্তাহ শেষের ভ্রমণে বাঙালি বিশেষ করে কলকাতাবাসীর অন্যতম প্রিয় জায়গা হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবার। বর্ষার মরসুমে বাঙালিকে হাতছানি দেয় সেখানকার ইলিশ মাছ। 

ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলটি এক সময় ছিল সুন্দরবনের অন্তর্গত। আগে নাম ছিল হাজীপুর। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহ তাঁর গুরু পুত্র সাবর্ণ বংশীয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে হালিশহর থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত আটটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জায়গীর দেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বাক্ষর ও সনদ বলে এবং রায় ও চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেন। 

ইংরেজ আমলে সুন্দরবনে কিছু নতুন বন্দর নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়, যার মধ্যে ডায়মন্ড হারবার ছিল অন্যতম। ডায়মন্ড হারবারের পিকনিক স্পটের সামনে রয়েছে একটি ভাঙা দূর্গ। দূর্গটির কয়েকটা ভাঙা দেয়াল বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে। বাকি সব অংশ নদীর ভাঙনের ফলে বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন। দূর্গটির বিশাল আয়তনের প্রমাণ পাওয়া যায় নদীর তীরে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কেল্লার ইঁটের ছোট ছোট টুকরোর বিস্তার দেখলে। 

জনশ্রুতি অনুযায়ী লুঠের সামগ্রী রাখার জন্য সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা এই দূর্গটি তৈরি করে। ব্রিটিশরা পরবর্তীকালে সারিয়ে নিয়ে এটি ব্যবহার করে। নদীর পাড় ভাঙনের ফলে এই দূর্গটি পরিত্যক্ত হয়। কিছু মানুষ আবার এই দূর্গটি ফরাসিদের তৈরি বলে দাবি করেন। 

এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু ঘটনা প্রবাহের দিকে দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন। পর্তুগিজ জলদস্যুদের যে ধরনের জীবনযাপন পদ্ধতি ছিল, তাতে তারা লুঠের সামগ্রী রাখার জন্য অত বড় একটা কেল্লা বানিয়ে ফেলবে এবং তৎকালীন মুসলিম শাসক মুঘলরা বিষয়টা মেনে নেবে, এমনটা বিশ্বাস করা বড়োই কঠিন। আবার এদিকে ফরাসিদের বিষয়টাও একেবারেই অসম্ভব। 

এই অঞ্চলের এবং দূর্গের বিষয়ে লিখিত তথ্য পাওয়া যায় ১৮১৫ ও ১৯১৪ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটে। সেখানে বলা হয়েছে  ইংরেজদের পণ্যবাহী জাহাজগুলির বোঝাই ও খালাসের কাজ এখানে হত। এছাড়া গেঁওখালি ও আসামগামী স্টিমার গুলি এই বন্দর ছুঁয়ে যেত। 

বন্দর তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা হাজীপুরের নাম বদলে দেয়। সেই অঞ্চলের নাম হয় ডায়মন্ড হারবার। বন্দর হিসেবে এই অঞ্চলের ব্যবহার তখন যথেষ্টই হত। এর থেকে বোঝা যায় কলকাতা বন্দর চালু হওয়ার আগে ডায়মন্ড হারবার বন্দরের খ্যাতি যথেষ্টই ছিল। কলকাতা বন্দরে ঢোকার আগে জাহাজের অপেক্ষা করার জায়গা স্যান্ডহেড এই ডায়মন্ড হারবারেই অবস্থিত। 

১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ডায়মন্ড হারবারে ভারতের প্রথম টেলিগ্রাফ স্টেশন স্থাপিত হয়। ডায়মন্ড হারবার বন্দরকে কলকাতার সাথে যুক্ত করেছিল ইস্ট বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে এবং ত্রিশ মাইল দীর্ঘ একটি বাঁধানো রাস্তা। এখানে অনেক সরকারি অফিস গড়ে উঠেছিল। ছিল একটি ছোট কয়েদখানাও। 

এর আগে জনশ্রুতিতে ডায়মন্ড হারবারের চিংড়িখালি দূর্গের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। এবার আসা যাক বাস্তবের পথে। ডায়মন্ড হারবার বন্দরের প্রায় এক মাইল দক্ষিণে ১৮৬৮-৬৯ সালে ব্রিটিশরা নির্মাণ করে এই দূর্গ। বারাকপুর থেকে সম্ভবত পাঁচটি কামান এনে এখানে বসানো হয় দূর্গ সুরক্ষিত করার জন্য। এগুলির মধ্যে সম্ভবত দু’টি কামানের ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায় ২০১১ সাল নাগাদ। 

পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাত থেকে বন্দরকে রক্ষা করতে ও সাথে নুনের ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা এই দূর্গ নির্মাণ করে। সেই সময়ে নিমক রাজস্ব বিভাগের প্রধান কার্যালয় ছিল এই দূর্গে। এছাড়াও মক্কা থেকে যে সব তীর্থ যাত্রীরা ফিরতেন, তাদের জন্য পৃথকীকরণ শিবির বা কোয়ারেন্টিন ক্যাম্প ছিল এই দূর্গে। 

গত চার দশক ধরে নদীর পাড়ের ভাঙনের ফলে এই দূর্গ ক্রমশ লুপ্ত হয়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *